বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছি। বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ের বিয়ে।
খাবার আইটেমের অভাব নেই। কমন আইটেম রোস্ট, পোলাও, গরু এসবের বাহিরেও বাড়তি স্পেশাল আয়োজন করা হয়েছে। তারমধ্যে চিংড়ি, ইলিশ ভাজি, রুই মাছ এবং হাসের মাংস উল্লেখযোগ্য। হাসের রান খেতে খেতে হঠাৎ দৃষ্টি পড়লো সামিয়ার মতন দেখতে একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটার শুধু সাইড ফেইস দেখা যাচ্ছে। হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে কার সাথে যেন হেসে হেসে কুটুর পুটুর গল্প করছে। মেয়েটা শাড়ি পরেছে, চুলে ফুলের তোরা গেঁথেছে। এমনেতে আমার অচেনা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকার স্বভাব একদম নেই বললেই চলে। আমার অন্তর লজ্জা একটু কম হলেও চক্ষুলজ্জাটা অত্যন্ত বেশি! কিন্তু আজ চক্ষু লজ্জা সরিয়ে মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। যেহেতু মেয়েটা দূর থেকে আমার গার্লফ্রেন্ড সামিয়ার মতন দেখাচ্ছে সুতরাং কে বেশি সুন্দর কাছ থেকে দেখার জন্য মনটা খচখচ করছিলো।
মেয়েটা এক পর্যায়ে ওয়েটারের কাছে কিছু একটা চাওয়ার জন্য আমার মুখোমুখি ঘুরে তাকালো। আমি সাথে সাথে বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে ঢকঢকিয়ে গ্লাসের পানি শেষ করে ফেললাম। মেয়েটা সামিয়ার মতো দেখতে নয়, স্বয়ং সামিয়াই সেখানে বসে আছে! ঠিক আমার বিপরীত টেবিলে সে বসে। আমার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড এই বিয়ের প্রোগ্রামে! ও মাই গড! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সকল পাপের শাস্তি বোধহয় আজকেই পেতে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই এটা তার আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের বিয়ে! দেখা হলে এখন উপায় কী? আমিতো এসেছি ফাও দাওয়াত খেতে! সম্পূর্ণ অচেনা কারো বিয়ের প্রোগ্রামে। খেতে এসে লোকমুখে শুধু শুনেছি একমাত্র মেয়ের বিয়ে। কার বিয়ে কিসের বিয়ে বিস্তারিত কিছুই জানি না। এই কাজটা আমি মাঝেমধ্যেই করে থাকি। ছোট বেলার বদভ্যাস আর কি। এখন সামিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেলে তাকে উত্তর দেব কী?!
সম্ভবত সামিয়া আমাকে এখনও দেখেনি। খাওয়া বাদ রেখে দ্রুত উঠে ওয়াশরুমে হাত ধুতে গেলাম। বুক ধুকধুক করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালানোর প্রয়োজন, একবার দেখে ফেললেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। হাত ধুয়ে যেইমাত্র ঘুরেছি অমনি দেখি সামিয়া এঁটো হাতে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে! চোখ বড়বড় করে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে নিচু স্বরে বলছে “তুমি এখানে!”
আমার ঠোঁট জোড়া মুহূর্তেই অবশ হয়ে এলো, এক বিন্দুও নাড়াতে পারছিলাম না। সামিয়ার হাত থেকে পানির বোতল কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো বোতল সাবাড় করে দিলাম। হাত পা জ্বালাপোড়া করছিলো। সামিয়া অবাক সুরে বলছে.. “কী হইছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কার বিয়েতে এসেছো?” আমি আমতা আমতা করে বললাম হাসের মাংসটা অনেক ঝাল ছিলো, তাই খুব পানি পিপাসা লেগেছে” “ও আচ্ছা”
সামিয়া আবার প্রশ্ন করছে “তুমি কোন পক্ষের? ছেলে নাকি মেয়ে?” কি উত্তর দিব খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যদি সামিয়ার সাথে মিলে যায় সরাসরি ধরা খেয়ে যাবো। যা আছে কপালে, যেহেতু আমি ছেলে তাই ঝটপট বলে ফেললাম ছেলে পক্ষের। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম তুমি? উত্তর শুনে মনে মনে বললাম যাক বাবা বাঁচলাম! সামিয়া মেয়ে পক্ষের। এখন পাত্রের পরিচয়টা বন্ধু, বড় ভাই, প্রতিবেশী উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে দিলেই ভেজাল শেষ।
সামিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করছে..
– এই.. তুমি বিয়ে খেতে এখানে আসছো কাল রাতে কিছু বললে না কেন আমাকে? আজ না আমাদের বিকালে দেখা করার কথা?
আমতা-আমতা করে উত্তর দিলাম..
– দূর সম্পর্কের এক বন্ধুর বিয়েতো তাই আর কি আসার নিয়ত ছিলো না, তুমি বললে আজ বিকেলে দেখা করবে, ভাবলাম একই এলাকায় যাচ্ছি বিয়েটাও তাহলে খেয়ে নেই
– ও আচ্ছা
– তুমিও তো কাল কিছু বললে না?
– আমিতো ভেবেছিলাম শাড়ি পড়ে তোমাকে আজ সারপ্রাইজ দেব, তাই আর কিছু বলিনি, এখন তো তোমাকে দেখে উল্টো নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম!
সামিয়া আমাকে আর বেশি প্রশ্ন না করে একটু পর পর ভেতরে তাকাচ্ছে আর কানের কাছে মিনমিন করে বলছে তারাতাড়ি এখান থেকে চলে যাও, কেউ দেখে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে।
আমিও আর দেরি করলাম না, নিশ্চয়ই সামিয়ার আত্মীয়স্বজন সব এখানে উপস্থিত। ভবিষ্যতে সামিয়ার সাথে বিয়ে হলে যদি আমাকে কেউ চিনে ফেলে! কী পরিচয় দেব তখন? দ্রুত কমিউনিটি সেন্টার থেকে কেটে পরলাম।
সেখান থেকে বেরিয়ে চেনা পরিচিত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে রইলাম। প্রতিবার এখানেই আমরা দেখা করে থাকি। সামিয়া টেক্সটে জানিয়েছে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে আসবে। এদিকে আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, ফেলা আসা হাসের রানটা একটু পর পর চোখের সামনে ভাসছে। গলদা চিংড়িটা প্লেটে তুলেও নিয়েছিলাম এক কামড় খেয়েও দেখা হলো না, আফসোস!
কিছু সময় পর সামিয়া রেস্টুরেন্টে হাজির। তাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। টেবিলে বসেই আমাকে আবার প্রশ্ন করা শুরু…
– ঐ পাত্র তোমার কেমন বন্ধু হয়?
– কেমন বন্ধু আবার, অনেক আগে প্রাইভেট পড়তাম একত্রে সেই থেকে পরিচয়
– কী বললা? অই বুইড়া ছেলে তোমার ক্লাসমেট!
মনে মনে বলি সর্বনাশ! কি বলে ফেললাম, আমিতো পাত্রের চেহারাও দেখি নাই!
– না মানে অনেকে থাকে না দেরিতে স্কুলে ভর্তি হয়, অনেকে গ্যাপ দেয়, এজন্য বয়স্ক লাগে অনেককে।
বত্রিশ দাঁত বের করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম।
সামিয়া কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না। সে চোখ ছোট ছোট করে আবার জিজ্ঞেস করতেছে..
– সত্যি করে বলো কার বিয়েতে গেছিলা? ঐ পাত্রী তোমার কিছু হয়?
– না না, আমি পাত্রীকে চিনিই না, কোনোদিন দেখিও নাই
– তাহলে বলো.. পাত্র কী করে? বাসা কোথায়? কয় ভাইবোন? বিস্তারিত বলো আমাকে..
– উফ! কি শুরু করলা এসব, এমনেতেই দুপুরে খেতে পারি নাই, না খেয়ে উঠে আসছি, পেটে অনেক ক্ষুধা, তার মধ্যে এখন এসব প্রশ্নের মানে কি? বাদ দেও তো
– এই চুপ, একদম কথা ঘুরাবানা, সত্যি করে বলো তুমি কোন পক্ষের??
নিচু গলায় উত্তর দিলাম
– কোনো পক্ষেরই না
– তার মানে!!
কোনো উত্তর না দিয়ে বসে বসে টিস্যু ছেঁড়া শুরু করে দিলাম। আমি কোনো কিছুতে ধরা খেলে হাতের কাছে যা পাই তাই ছেঁড়া শুরু করে দেই।
সামিয়া আমার অবস্থা দেখে যা বুঝার বুঝে ফেলে। আমাকে লজ্জা দিয়ে বলে..
– ছিঃ ছিঃ ছিঃ তুমি…! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না
– স্যরি ভুল হইছে আর জীবনেও এই কাজ করবো না। আমার খুব টেনশন হইতেছে তারা তো ভিডিও করে ফেলছে, এখন তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে কেউ যদি চিনে ফেলে? কেউ যদি বলে এই ছেলেকে অমুকের বিয়েতে দেখছে! কত শত প্রশ্ন শুরু হয়ে যাবে! কি জবাব দিব আমি তাদের?
সামিয়া মুচকি মুচকি হেসে বলে.. “আচ্ছা থাক আর লজ্জা পাইতে হবে না, যা হওয়ার হইছে, পরেরটা পরে দেখা যাবে, এখন কিছু ভারী খাবার অর্ডার দাও, আমি বিয়েতে আচমকা তোমার মুখ দেখে টেনশনে কিছুই আর খেতে পারিনি”
আমি ওয়ালেট বের করে দেখি একশো পঞ্চাশ টাকা চিপায় পড়ে আছে। এই টাকা দিয়ে ভারী খাবার খাওয়া অসম্ভব। মানিব্যাগ ফাঁকা করে সামিয়াকে দেখালাম। সে বিরক্তি নিয়ে সিট ছেড়ে উঠে পড়লো।
মেয়েটাকে কত করে বুঝালাম রাগ কইরো না, মনের ভুলে টাকা রেখে আসছি, এটিএম থেকে এক্ষুনি তুলে আনতেছি, সে আমার কোনো কথাতে কান দিচ্ছে না, তার মুখে একটাই কথা “চুপচাপ আমার সাথে চলো”
আমাকে নিয়ে ঝটপট একটা রিক্সায় উঠে পড়লো। এরপর রিক্সায় বসে কোথায় কোথায় যেন ফোন দিল। ফোনে কিসের নাম ঠিকানা নিয়ে হাতের মধ্যে লিখলো। এরপর রিক্সাটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বললো এখানে রিক্সায় বসে চুপচাপ ওয়েট করো পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতেছি।
পাঁচ মিনিট পর দেখি সামিয়া চিকচিকে কাগজে মোড়ানো একটি গিফট বক্স নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। হাতে লেখা ঠিকানা অনুযায়ী রিক্সাওয়ালাকে বললো ভাই.. আজমপুর ৭ নং সেক্টর উত্তরা পার্টি সেন্টারে নিয়ে যান আমাদের। আমি সামিয়ার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করি.. “অইখানে কেন? কার অনুষ্ঠান? কিসের অনুষ্ঠন?”
সামিয়া আমার প্রশ্ন থামিয়ে ধমক দিয়ে বলে, প্রশ্ন থামাও তো এখন। তোমার জন্য দুপুরে কিচ্ছু খাইতে পারি নাই, বান্ধুবীরা পেট ভরে খাইছে আর আমি টেনশনে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। ক্ষুধায় এখন পেটে ইঁদুর ছুটোছুটি করতেছে। চুপচাপ চলো এখন আমার সাথে। আমি বোয়াল মাছের মতো হা করে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি! তার মানে আজ দুপুরে তুমি কোন পক্ষের ছিলা?
সামিয়া মুচকি হেসে উত্তর দিলো.. “উভয় পক্ষের!”
সামিয়া দেখছি আমার থেকেও এক্সপার্ট। আমি তো হুটহাট গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসি, আর সে পাত্র পাত্রীর সব ডিটেইলস জেনে এরপর বান্ধুবীরা মিলে দাওয়াত খেতে যায়!
রিক্সায় যেতে যেতে সামিয়ার মুখে গল্প শুনি তাদের নাকি আগে থেকেই লোক দিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে খোঁজ নেওয়া থাকে, কবে কোথায় কার কার বিয়ে হচ্ছে চার্ট সব সময় প্রস্তুত করা থাকে। আমাকে হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে.. “এখানে পাত্র পাত্রীর নাম, ঠিকানা, অভিভাবকের নাম, বিস্তারিত লেখা আছে বসে বসে মুখস্থ করো। আর খবরদার কেউ জিজ্ঞেসা করলে এভাবে মিনমিন করে উত্তর দিবা না, ঠাসঠাস করে উত্তর দিয়ে দিবা। আর আমরা দুজন এই মুহুর্তে হাসব্যান্ড ওয়াইফ!” আমিও সামিয়ার কথার তালে তালে মাথা নাড়িয়ে গেলাম।
সামিয়ার সাথে কদম মিলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কানে কানে প্রশ্ন করলাম..
– গিফট বক্সের ভেতর কী নিছো?
– অনেক মূল্যবান জিনিস
– অযথা টাকা নষ্ট করার কি দরকার ছিলো
– কোথায় টাকা নষ্ট করলাম? মাত্র দশ টাকা লাগছে
– অহ, তার মানে খালি র্যাপিং করা বাক্স!
– খবরদার! খালি বাক্স বলবা না, অনেক মূল্যবান জিনিস আছে এর ভেতরে
– দশ টাকায় আর কী মূল্যবান জিনিস আছে এখানে?
– এই শুনো সবকিছু কি টাকা দিয়ে মাপা যায়? সব চেয়ে মূল্যবান গিফট হচ্ছে দোয়া! আমি বক্সের ভেতরে নব দম্পতির জন্য দোয়া লিখে দিয়েছি!
এরপর সামিয়া আমাকে সেই দোয়া বলে শুনালো, কাগজে সে লিখেছে… “হে সৃষ্টিকর্তা, এই দম্পতির সংসার আপনি সুখ সমৃদ্ধিতে ভরপুর করে দিয়েন, দুজনের সম্পর্ক মধুর মতো মিষ্টি করে দিয়েন, এই বন্ধনের মাঝে আসা সকল ধরনের বিপদ আপদ বালা মুসিবত দূর করে দিয়েন”
আমি সাথে সাথে সামিয়ার হাতটা ধরে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলাম, “আ..মি..ন!”
✍ Md Shahadat Hossain
( জাগ্রত প্রতিধ্বনি )
জোস লাগল!