#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১৮
–” পারা পারির কাজ বাদ দিয়ে বলুন কবে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাবো?”
–” এত তাড়া কিসের?”
–” বিয়ে করে সংসারী বর হবো! বউ আমার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিবে, টাই টা নিজের হাতে লাগিয়ে দিবে!
মাঝে মাঝে চুপিসারে সবার আড়ালে তাকে কাছে ডেকে কানেকানে কিছু মধুর আলাপন করবো! ইশশ, এমন একটা মুহূর্ত যে কি শান্তিদায়ক তা কি আপনি জানেন? এমন একটা সুন্দর আর শুভ কাজ কি করে দেরী করি বলুন তো?”
–” হা,হা, সংসারী বর? সংসারী মেয়ে শুনেছি। এই প্রথম সংসারী বর শুনেছি তাও আপনার কাছ থেকে। তবে একটা কথা বলতেই হয় এই যে এত রোমান্টিকে ভরপুর কথা বলছেন। এত এত রোমান্টিকতার সময় পাবেন না ডাক্তার সাহেব! বিয়ের পর নিম পাতা হয়ে যায় সব!”
–” উহুম, আমি হবো মৌমাছি আর আপনি হবেন সুমিষ্ট ফুলের মধু! আমি ক্ষনে ক্ষনে সেই মধু আহরন করবো।
ইশশ,কি একটা মুহূর্ত হবে বলুন তো? টিনেজারদের প্রেম আমরা বিয়ের পর করবো। ”
বিভা ফাইয়াজের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে এই লোকটা তাকে মনে হয় পুরো চমকের উপরেই রাখবে। এত রোমান্টিক কথাবার্তাও যেন তার মুখে সব সময় লেগে থাকে।
— হুহ,ফাকাবুলি!”
ফাইয়াজ আর কিছু বলবে তার আগেই উর্মির আবির্ভাব ঘটল।
–“বিভা, ভাইয়া আপনারা এখানে দাড়িঁয়ে আছেন? আর ঐদিকে রিসোর্টে রশীদ আঙ্কেল খুজেঁ বেড়াচ্ছে। আপনারা সেই সকাল সকাল বেড়িয়ে পরেছেন কিছু খেয়েছেন কিনা তা প্রশ্ন করছে। সুমিকে বললাম ও বলল বিভা বেড় হয়েছে। আর কিছুক্ষণ পর আপনি ও নাকি বেড় হয়ে এসেছেন। খুজেঁ খুজেঁ আমি হয়রান!”
বিভা উর্মির হাত ধরে বলল চল যাই, আপনি ও আসুন।
ফাইয়াজ ও বিভার দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে। কি করার আর পিছন পিছন তাকেও যেতে হলো।
রিসোর্টে আসার পর বিভা, উর্মি, সুমি গিয়ে দেখল রশীদ সাহেব তাদের জন্য এলাহী কান্ড করেছেন। রশীদ সাহেব তাদের দেখে বললেন –
–“ঘুরতে গিয়েছিলে বুঝি? ”
–” জী আঙ্কেল, ”
–” এই জন্যই সকালে তোমাকে খুজেঁ পাচ্ছিলাম না। বাকিরা তো ঘুমিয়েছিল ওদেরকে বলতেই ওরা কিছু বলতে পারেনি। এখন ব্রেকফাস্ট করতে বসো পরো।
তুমি হলে আমার পরম স্নেহের অধিকারী তোমাকে কি আর কাছ ছাড়া করতে পারি? তোমাদের সবার দায়িত্ব এখন আমার উপর এসেছো যখন ভালোভাবে থাকার পরিবেশ তো করতে হবে।
তুমি মনে হয় কক্সবাজার খুব ছোট থাকতে এসেছিলে? ”
–” জী, আম্মু আব্বুর সঙ্গে এসেছিলাম ক্লাস টু তে যখন ছিলাম।এরপর আর আসা হয়নি।”
–” ও, আমি তখন ঢাকায় ছিলাম,তোমার বাবাকে ফোন করে বলেছিলাম আমাদের বাড়িতে থাকতে। সে থাকেনি কি আর করার এখন তুমি আর তোমার বন্ধুরা এসেছো এতেই যথেষ্ট।”
রশীদ আঙ্কেল তার রিসোর্টের লোকদের ডেকে বলে দিলেন ভালোভাবে পরিবেশন করতে। বন্ধুর মেয়ে বলে কথা বিভার বাবা তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। সেই বন্ধুর মেয়ে ও তার বন্ধুরা এসেছে আর তিনি তাদের ফেলে দিবেন এমন নয়।
হঠাৎ করে উর্মির চাচাতো ভাই সাব্বির বলে উঠল –
–” হ্যা রে উর্মি আস্ত একটা সৈকত থাকতে সৈকতে আসা লাগে নাকি?”
সৈকত খাচ্ছিল ভাইয়ের কথা শুনে বুঝতে পারল তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। উর্মি মুচকি মুচকি হেসে বলল –
–” তো কোথায় নিয়ে যাবো?”
–” কোথায় নিয়ে যাবি মানে সৈকতের মত বিশাল দেহী একজন মানুষ থাকতে তুই আবার সমুদ্র, সৈকত ঘুরতে এসেছিস কেন ভাই পাহাড় কি নজরে পরেনি?”
সাব্বিরের কথা শুনে সুমি বলে উঠল –
—” পাহাড় কেন যাবে ভাইয়া? পাহাড় ও তো আমাদের সামনেই আছে।”
–” কোথায়?
–” এই যে তুমি! বিশাল আকৃতির উচু লম্বা মোটা আস্ত একটা কালা পাহাড়! আমার ভাই লম্বা বলে সব সময় তুমি সৈকত ভাইকে পচাঁনো শুরু করে দেও।”
–” তুই চুপ কর পচাঁ নর্দমার পানি!”
–” আমি পচাঁ নর্দমার পানি আর তুমি কালা পাহাড়! এই ভাবী তুমি ভাইকে কিছু বলবে?”
তাদের ভাইবোনদের কথা শুনে হাসতে লাগল সবাই। উর্মি বোন সুমি আর তার ছোট ভাই সৈকত। সাব্বির ও তার স্ত্রী, বোন এসেছে তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বেড়াতে। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা চাচাতো ভাইবোন কম! কখনও তারাঁ ওই সম্পর্কটাকে আলাদা হিসেবে তৈরী করেনি উল্টো নিজের ভাইবোন হিসেবে দেখেছে। সাব্বির উর্মিদের পরিবারের সব দায়িত্ব না হোক অন্তত মাসের বাজারটা অন্তত করে দেয়। বিভা যখন উর্মি সঙ্গে পড়াশুনা করতো তখনই শুনেছিল উর্মির বাবা নেই, মা অসুস্থ তখনই উর্মির মুখে বিভা দেখেছিল একরাশ অসহায়ত্ত্ব। উর্মির কথা বলা চালচলন তার কাছে মনে হতো কেমন হয়েগিয়েছিল মেয়েটা। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পেরেছে সে পরিস্থিতি এমন একটা জিনিস যা মানুষকে একদম বদলে দেয়। উর্মি পাশে সেদিন এসে দাড়িয়েছিল সাব্বির আর তাঁর পরিবার। এখনকার এই সমাজে অনেক পরিবার আছে প্রভাবশালী হয়ে শুধু নিজের সুখটাকেই দেখে যায়।
কিন্তু তার ব্যাতিক্রম সাব্বির,সে নিজে হাতে পুরো সংসারটাকে আগলে রেখেছিল। সাব্বির উর্মিদের ভাইবোন সবার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছে।
ব্রেকফাস্ট করতে বসে অনেকবার চোখে চোখ পরেছে ফাইয়াজ আর বিভার। অস্বস্তি হচ্ছে বিভার, ফাইয়াজের চোখ থেকে লজ্জায় চোখ সরিয়ে ব্রেকফাস্ট করে উঠে পরল সে।
কক্সবাজার এসেছে আর হিমছড়ি ইকোপার্কে আসবেনা তা হয় নাকি? তাই আজ এসেছে সবাই। আজ পুরো প্রকৃতিকে দেখবে আর আপন করে নিবে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে। হিমছড়ি ইকোপার্কে অবস্থিত ঝর্ণার ধারায় আগেও ভেসেছিল বিভা এবার একটু অন্যরকম। আগেরবার ছোট্ট দুহাতের সঙ্গী ছিল তার বাবা আর মা এবার সে পূর্ণযুবতী তার সঙ্গে আছে তার প্রাণের বান্ধবী আর ঘুটিকয়েক বন্ধুবান্ধব। সঙ্গে একজন স্পেশাল মানুষ
যে কিনা একাই পারে পুরো দলটাকে হাসিয়ে তুলতে।
ফাইয়াজ ঝর্ণার নিচে এসে দাড়িয়ে পরল। ঝিরিঝিরি ঝর্ণার ধারা বহিছে পাহাড়ের উপর থেকে। সেই জলের ধারায় নিজেকে একদম মুক্ত করে দিল। প্রথমে ফাইয়াজ নামলে ও পরে অন্যরা ও ভিজতে লাগল।
মেয়েরা সবাই একটু কমই ভিজেছে কারন এখানে টুরিস্টের সংখ্যাটা খুব বেশি। কক্সবাজার বাংলাদেশের ব্যস্ততম একটি টুরিস্ট প্ল্যাস বা জায়গা যেখানে সারাবছর টুরিস্ট থাকেই আর তার গননা করে নির্ধারণ করাও কঠিন। ঝর্ণার পানিতে কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করেই দৌড়ে চলে এলো বিভা এত ঠান্ডা কেন পানি? শীত প্রায় যায় বলে সে নির্দ্বিধায় পানিতে ভিজেছে কিন্তু এখন যে এমন ঠান্ডার প্রকোপে পরবে তা ভাবেনি সে। বিভা নিজের গায়ে জড়ানো ওড়নাটা ভালোভাবে পুরো শরীরে টেনে জড়িয়ে নিল। ফাইয়াজ পানিতে ভিজতে ভিজতে দেখল বিভা একপাশে দাড়িঁয়ে গায়ে ওড়না দিয়ে প্যাচিঁয়ে দাড়িয়ে আছে। সে সামনে গিয়ে দাড়িঁয়ে বলল —
—” শীত করছে?”
–“হুম কিছুটা,”
–” আপনার ঠান্ডার সমস্যা আছে?”
–” হ্যা আছে,”
–” তারপর ও আপনি এই ঠান্ডা পানিতে ভিজেছেন? ঠান্ডা বাধিঁয়ে ফেললে কি হবে বুঝতে পারছেন কিছু?”
–‘ আমি কি জানতাম নাকি এমন কিছু হবে?”
–” সামনে হাটুন আমি আসছি,”
–” কেন?”
–” ভিজে কাপড়ে দাড়িঁয়ে থাকবেন নাকি? এতটা কেয়ারলেস কি করে যে হতে পারে মানুষ, চলুন।”
সাব্বিরকে বলে ফাইয়াজ বিভাকে নিয়ে রিসোর্টে এসেছে। বিভা একটু নয় অনেকটাই ভিজেছে। বিভা নিজের রুমে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করতে চলেগেল। ফাইয়াজ রিসোর্টের কুক হাউজে গিয়ে নিজ হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। দুকাপ চা বানিয়ে ট্রেতে করে নিজেই এনে টি-টেবিলের উপর রাখল। বিভা তখন ওয়াশরুম থেকে সবেমাত্র। ফাইয়াজকে নিজের রুমে দেখে কিছুটা অবাক হলো বিভা । ভিজেঁ যাওয়া চুলগুলোকে টাওয়ালে প্যাচিঁয়ে বলল–
–” আপনি এখানে, কিছু বলবেন?”
–” না তেমন কিছু নয়, এক কাপ চা শুধু আপনার জন্য!
সেদিন আপনি তো নিজ হাতে চা বানিয়ে আমাকে দেননি তাই আজ নিজেই আপনার জন্য বানিয়ে নিয়ে এলাম।”
চলবে।