বিভাবতীর জীবন পর্ব-১২

0
1697

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
পর্বঃ১২

লজ্জায় তো আমারই পরতে হবে। তার চেয়ে বরং কোন বিকেলবেলায় আবার দেখা হবে! বায়!”
ফাইয়াজ কথাগুলো আপন মনে বলতে বলতে চলেগেল। আর বিভা বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলছে লোকটা এই রেগে রেগে কত গুলো কথা বলল। আবার এখন এমন কথা বলেগেল। এমন লোকের পাল্লায় পরলে কপাল খারাপ হয়ে যাবে তার। বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পরল বিভা।

–“কিরে সকাল সকাল কোথায় গেলি? কিছুই তো বললি না!”

–” এইতো পার্ক থেকে হেটে এলাম মা।”

–” ও, এইদিকে আয় তো, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে কিছু।”

–” হুম আসছি,
বিভা রুমে চলেগেল। ফ্রেশ হয়ে একবার নিজেকে আয়নায় দেখেনিল আর ভাবতে লাগল -‘ এই তো বেশ ভালোই তো আছি আমি। কই আমার মুখে তো আগের মত ক্লান্তির ছাপ দেখা যায় না। আবার আগের মত সবকিছু ফিরে পেলাম আমি। রঙ্গরুপ, শরীরের মলিন হওয়া সৌন্দর্য। আগের মতই বিলাসবহুল জীবন সবকিছুই পেলাম। কিন্তু, ভালোবাসার মানুষটাকে আর পেলাম না।
আর না পেলাম নিজের হারানো সংসারটাকে, ঠিক যেমন সে হঠাৎ করে না জানিয়ে আমার মনের জায়গা দখল করেছিল। ঠিক,যেমন ভাবে আমায় নিয়ে তার সংসার গড়ার খেলা খেলেছিল, তেমন ভাবেই না জানিয়ে তাড়িয়ে দিল। তাড়িয়ে না দিলেও তো আর কখনো তার খোঁজ ও নিল না। এতটা বছর পেরিয়ে গেল অথচ মানুষটা তাকে একবার ও জিজ্ঞেস করল না কেমন আছো? আমি তো তার কাছে কখনোই ফিরে যাবো না। কখনো না!
বেশ ভালো আছি আমি সেই নরক থেকে এসে, ঐ মানুষটার প্রতি কোন ভালোবাসা আমার মনে নেই।নেই কোন সহানুভূতি! অনেক আগেই তো সব শেষ!

বলা হয়ে থাকে স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা নারীদের অনেক সাহস বেড়ে যায়। মিথ‍্যে নয় একদম সত‍্যি কথা, যে কথাটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিভা। প্রতিনিয়ত সে যুদ্ধ করে গেছে সবার সঙ্গে। কম তো করেনি।

বিভা চোখের জলটাকে মুছে দাড়িয়ে পরল। নিচে নেমেই দেখল মা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পত্রিকা দেখছেন।
বিভা এগিয়ে গেলে তিনি বসতে বললেন। চোখের চশমাটা রেখে বললেন —

–” যা বলার জন‍্য ডেকেছিলাম, গতকাল যে ছেলেটা এসেছে ওর সাথে নাকি তুই একবছর কাজ করেছিস।
মানে যেকদিন সঙ্গে ছিলি তোর কেমন মনে হলো ছেলেটাকে দেখে? কেমন হতে পারে? ছেলেটার কথাবার্তা! চালচলন, কিভাবে সে মানুষের সঙ্গে চলতে পছন্দ করে তা ও তো দেখতে হবে আমাকে।”

–” মা, কথাটা তুমি বলোনি, একজন মানুষের সঙ্গে চললে তার চালচলন কথাবার্তা সবকিছুই বুঝতে পারা যায়। আচ্ছা তুমি তো বাবার সঙ্গে আজ প্রায় ত্রিশ বছর আছো।
অনেক সাধনার পর নাকি আমার জন্ম। এতটা বছর যে আছো তুমি বাবার সম্পর্কে কি জানো? কি জেনেছো?
বাবার কি পছন্দ অপছন্দ সব কিছুই জেনেছো। কিন্তু বাবা সব সময় কি চায় তা জেনেছো? বাবার মনে কি আছে?
বাবার ভিতরে কতটা মানসিক চাপ আছে তা জানতে চেয়েছো? অনেক দিন তো থাকছো তোমরা দুজন।”

–” তোর বাবার সম্পর্কে আর কি জানবো। মানুষটাতো কখনোই আমাকে কোন কথা মুখফুটে বলেনি। আর না কখনো সে আমার চাহিদার কোনক্রুটি রেখেছে।
আর সে কি চায় না চায় আমি বুঝবো কি করে বলা ছাড়া সব হয় নাকি?”

–” তুমি ত্রিশ বছর সংসার করে আজ পর্যন্ত বাবার মনের অবস্থাটা ধরতে পারলে না! আর আমি গুটিকয়েক দিনে একজন মানুষের আচরণ কেমন তা ধরতে পারবো?
আর তাছাড়া মা যে মানুষটাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি । যার সঙ্গে ঘর করেছি তাকেই তো আমি চিন্তে পারিনি। তিনটা বছর তার সঙ্গে ছিলাম, দেখা মানুষটাই তো অচেনা হয়েগেল। আর ওনাকে তো আমি তেমন কখনো পায়নি। হয়তো কোন অনুষ্ঠান, কোন কাজ ছাড়া আমি সেখানে যেতাম না।”

–” তা ও ঠিক, তবে আমার মনে হয় ছেলেটা খারাপ হবে না। এখানে এসেছে সেদিন ওর ফুফিকে নিয়ে। জানিস আমি নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকার আগেই শুনছিলাম ছেলেটা বলছিল -‘বউকে সে এভাবে নিবে না স্ট‍্যাম্প করে নিবে। মায়ের দেখাশুনা করার জন‍্য বিয়ে করছি, অতএব, দেখাশুনাই করবে এর বেশি করলে টুটি চেপে দিব তোমার!আমি তো ভেবেছিলাম কি সাংঘাতিক ছেলে!
বিয়ের আগেই কি কথা ছেলের!”
বিভা ফিক করে হেসে দিল মায়ের কথা শুনে।হেসে বলে উঠল- “উনি এরকমই, কথা বলেন না তবে বললে একদম হাসানোর মত আর নাহয় ধুম ধরিয়ে দেওয়ার মত কথা বলেন।”

” কিন্তু পরে ওর ফুফু ও হাসতে বলতে লাগল -‘বিয়ের আগে এমন ফাজলামো করেনিস। বিয়ের পরে টুটি ছুতেঁ গেলে বউ তোকে ফোনা তুলে না ছোবল মারে। আমি সামনে নাশতার টেবিল নিয়ে যেতেই ওর ফুফু হেসে হেসে বলছিল কথাটা। বুঝতে পারলাম ছেলেটা নিছক বেশ রসিক তবে ভাব এমন যেন একদম গম্ভীর! এমন রসিক আর রাগী রাগী ভাবের কথা বলা মানুষ কিন্তু খুব ভালো হয়। মনে হয় ছেলেটা খুব ভালো হবে। আমার মন বলছে দেখিস, মিলিয়ে নিস! খুব একটা খারাপ হবে না।”

–” তুমি বলছো যখন তখন তো খুব ভালোই হবে।”

–” আমি বললেই ভালো হবে, তুই বললে ভালো হবে না?”

–” আমি দুধ ভেবে চুন খাওয়া মানুষ। বলা যায় না আবার কোন ভুল করে বসি!”
দীর্ঘশ্বাসটাকে দীর্ঘায়িত না করে উঠেগেল বিভা। একটু পরেই তৈরী হয়ে অফিসে যেতে হবে।
______________________________

ফাইয়াজ বাসায় এসে চাবিটা টেবিলের উপর রাখতেই ফাহিমা বেগম এসে বললেন –

–“এত সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিস বললি নাতো।
তুই তো না বলে যাওয়ার মত নস!”

–” ঘুরতে গিয়েছিলাম, কি বলোতো সব সময় একই জায়গায় ঘুরাফেরা করা উচিৎ নয়। তুমি জানোনা হাওয়া বদল করতে হয়। মন খুব ফুরফুরে থাকে।”

—” ফুরফুরের জায়গায় মন এমন মলিন হয়ে আছে কেন?”

–” ফুরফুরে থাকবে কেমন করে জ‍্যাম পরলে কি ভালো লাগে?”

–“কোথায় গিয়েছিস তুই? এত জ‍্যাম পরেছে?”

–” উফফ মা এত প্রশ্ন করো কেন? ফুফু এসেছে ওনাকে একটু আদর সমাদর করো। ইশশ জার্নি করে সেই রাজশাহী থেকে এসেছে। রেস্ট করতেই পারল না, আবার আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরল। এখন ফিহাকে পাঠাও দেখে আসতে ফুফুকে।”
ফাইয়াজ মাকে পাঠিয়ে দিল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সব প্রশ্নই করে যাবে শেষ হবে না। ফাইয়াজ মাকে বিদায় করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে পরল। বিভার কালরাতের করা কলটির দিকে চেয়ে রইল কছুক্ষণ। তারপর সেখানে দুবার কল করে রেখেদিল। হয়তো বিভা বিরক্ত হতে পারে বেশি কল করলে। মেয়েটির জন‍্য তার খুব খারাপ লাগছে বারবার তার বলা একটি কথা যেন তার মাথায় গেথে গেছে। বিভা উঠে আসার আগে বলেছিল –

–“ঘর পোড়া গরু সিদূঁরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমার হয়েছে সেই দশা! বাংলার এইসব প্রাবাদ বাক‍্য এখন আমার মাঝেই সোভা পায়। এই যে আজ যত মানুষ আমার জীবনে আসছে বা ভবিষ্যতে আসবে কিন্তু,আমি হয়তো তাদের আপন করে নিতে পারব না। আপন করে নেওয়ার মত পরিস্থিতে অন্তত আমি নেই!”

সত‍্যিই তো মেয়েটার কথাগুলো মন্দ নয়। এমন কিছু ঘটলে যেকোন মানুষই দ্বিতীয়বার এই সমস‍্যায় পরতে চাইবে না।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে