#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ১
ছয়মাসের ভরা পেট নিয়ে মুখে কাপড় প্যাচিয়ে গাড়িতে বসে আছি। ভাবতে ঘৃণা লাগছে, যাকে ভালোবেসে নিজের বাড়ী ত্যাগ করলাম, মা-বাবাকে ত্যাগ করলাম।
আজ সে আমাকে রাখবে না। আমার পেটের সন্তানকে সে নষ্ট করার জন্য তার মা আর বোনকে বলে দিয়েছে অনেক আগেই । প্রেমের বিয়েতে নাকি স্বামী স্ত্রীর অনেক মনের মিল থাকে। এ কথা আমাদের লোকসমাজে খুব প্রচলিত। কিন্ত এর বাস্তবটা কি আসলেই সব সময় সত্যিই হয়? সবুজের সঙ্গে বিয়ের আজ তিন বছর! তিন বছরে সবুজের সঙ্গে প্রথম একবছর খুব সুখেই কেটেছে।
আমাদের ছোট্ট টুনাটুনির সংসারে খুব ভালোই কেটেছিল। সবুজ টিউশন করিয়ে যা মাইনে পেত তা দিয়েই ভালো চলতো আমাদের। কিন্তু সবুজের সংসারের মানি আমার শশুর বাড়িতে দিতে গেলে টান পরে যেত। সবুজের সঙ্গে টানা একবছর ঢাকায় একবছর থাকার পর এই সমস্যায় পরে যাই আমরা। সবুজ বাড়ির বড় ছেলে একমাত্র উপার্জন কারি পুরুষ মানুষ। তাকেই সংসারে হাল ধরতে হবে, সবুজ আমাকে এই চিন্তা করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। সবুজের হঠাৎ বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াটা আমার কাছে খুব ঝটকা লাগার মত ছিল। আমি শহুরে বেড়ে উঠা মেয়ে। কখনো গ্রামের খড়ি, কাঠের, মাটির উনুন ধরানো চুলোয় রান্না করিনি। কখনো জল থৈ থৈ পুকুরে গোসল করিনি। কখনো কড়া রোদে বাড়ির উঠোনে খড় কিংবা পাকা ধান শুকোতে দেইনি।
সেই মেয়ে আমি গ্রামে কি করে থাকবো?
সকল চিন্তাভাবনাকে ঝেড়ে ফেললাম স্বামীর দিকে তাকিয়ে। সবুজ না বড্ড আদুরে, যখন তার কাছে আমি আমার চিন্তার কথা বলতাম সে সহজে হেসে দিয়ে বলতো
–” এত চিন্তা করো না, মা আর মিনা আছে না? ওরা তোমাকে দেখে রাখবে। আমার বোন মিনাই পারে রাজ্যের যত কাজ একাই সামলাতে বুঝলে! তুমি নতুন বউ তারা কি তোমাকে খাটিয়ে মারবে বেশি? তারা বুঝে সব।
আমার মা কে একটু মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা কর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি সবুজের মনভুলানো কথায় তৃপ্তিতে তার বুকে মুখ গুজে থাকতাম। বয়সটা আমার বাড়লেও আবেগ আমার ছিল চঞ্চলা কিশোরীর মত। প্রাণপ্রিয় স্বামীর মধুর কথায় আর রাতের শিহরণ মাখা ভালোবাসায় ডুবে যেতাম তখন।
ভুলেই যেতাম যে ভালোবাসায় আমি ডুবছি, সেই ভালোবাসাই চিরদিনের মত আমাকে অতল গভীরে টেনে নিয়ে যায়?
না তখন আমি এসব ভাবতাম না। সবুজের কথামত সবুজের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে এসে পরলাম। ঢাকায় জন্ম হওয়া আর বেড়ে উঠা মেয়ে থেকে গ্রামে এসে পল্লীবধুর রুপ ধারণ করলাম। শাশুড়ি মায়ের থেকে একে একে শিখতে লাগলাম ঘর দোর আর গ্রামের জীবন যাত্রার কাজ। উনি আমাকে কাজ শিখাতেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক দিয়ে একদম মেনে নেনি। সবুজের সামনে তিনি হয়ে উঠতেন আদর্শ শাশুড়ি, সবুজ বেড়োলেই তার রুপখানা যেন ঝলমল করে বড্ড কুৎসিত আর বেমানান লাগতো।
আমার খুব অবাক লাগতো এই ভেবে এক মানুষ কত রুপে রুপান্বিত হয়? ননদিনী আমার সঙ্গে খুব একটা মিশতে চাইতো না। কথা ও ঠিক করে বলতো না, একদিন আমি তাকে সামনে নিয়ে বসে বললাম –
–” মিনা, তুমি কি কোন কারনে আমার উপর অসন্তুষ্ট? না দেখো আমি আরও হলেও মানুষ। তুমি যেভাবে চলতে পারো বা পছন্দ কর আমি হয়তো তেমন ভাবে চলিনাই তাই আমাকে তুমি পছন্দ করো না।”
–” ভাবী আমি তোমার সঙ্গে রেগে আছি এটা তুমি কি বলছো? ”
–” সেটাই তো বলছি, রেগে বা কোন ভাবে অসুন্তষ্ট থাকলে মানুষ একজন মানুষকে এরিয়ে চলে। কিন্তু তুমি কেন আমার সঙ্গে কথা বলো না?”
–” দেখো ভাবী, এইসব কথা বলে কোন লাভ নেই তুমি বড়লোকের ঘরের দুলালী! আমরা ছোট ঘরের, আমার ভাই দেখতে সুন্দর হেরে আমরা কোন ভালো ঘরে বিয়ে দিলে আজকে রাজরানী হয়ে আমার মা থাকতে পারতো।
কিন্তু তোমাকে আমার ভাই বিয়ে করে কি করল? একদম পালিয়ে নিয়ে আসলো বাবার বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে আসে নাই। তুমি ও এমন বেকুবের বেকুব মানুষ বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলে গহনা নিয়ে আসে টাকা পয়সা কিছু নিয়ে আসে। তুমি কিছুই নিয়ে আসোনি।
অবশ্য এতে বেকুব পরিচয় দেওয়া যায় না বুদ্ধিমত্তারই পরিচয়, ভেবেছিলে ছেলে ছাত্র হিসেবে ভালো টিউশন করিয়ে ভালো মাইনে পায়। এই ছেলের হাত ধরেছি তাহলে আমি আমার বাবার সম্পত্তি কেন নিব? কেন হাত দিব তাই না? এই ছিল তোমার বুদ্ধি!”
–” মিনা এগুলো তুমি বলতে পারলে? আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসি, সে ও আমাকে ভালোবাসে মিনা!”
–” এমন ভালোবাসা, বাসি কত দেখেছি,ভালোবাসা বিয়ের আগেই থাকে বিয়ের পর সব শেষ!”
মিনার কথায় আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি। মিনা আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল? আমি কি সবুজের সাথে বিয়ে করে আসলেই ভুল করলাম?
মিনার সেদিনের সেই কথার পর মিনা যেন আরও পিছনে পরে রয়েছে আমার। সবুজ বাড়িতে এলে আমি তাকে কিছুই বলতাম না। আমি শুধু চাইতাম সবুজ অন্তত বাড়িতে এসে এগুলো দেখে কষ্ট না পেয়ে বসে।
কেউ না জানুক আমি তো জানি আমার স্বামী কত কষ্ট পায় তার মা আর বোনদের চিন্তা করে। মা বোনের কষ্ট দেখলে তার খুব কষ্ট হতো। যেখানে আর দশটা ছেলে প্রেমিকাকে নিয়ে পার্ক, অথবা কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে রোমান্টিক কথায় মজে যেত। সেখানে সবুজ আর আমার মধ্যে আমাদের গভীর প্রেমালাপে ও সবুজ তার বোন আর মায়ের কথা বলতো। আমি সেগুলোকে নিয়ে বিরক্ত হতাম না। সে ঘরের বড় সন্তান তার সংসারের প্রতি মায়া থাকবে বোনের প্রতি টান থাকবে। আমি সেখানে কেন বাধা দিব?
প্রতিটা মুহূর্তে আমার জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। কথায় কথায় খোটা আজ মিনা তো কাল শাশুড়ি মায়ের।
সবুজ ও আজকাল বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গে কথা বলেনা। রাতের সোহাগ টুকু সে নিজের মত কাটিয়ে আমার কাছ থেকে সরে যায়। সকাল হওয়ার পর আবার আগের মতই চলতো। আমি চাতক পাখির মত তার দিকে চেয়ে থাকতাম কখন সে আমার দিকে ফিরে বলবে-
–” বিভাবতি কাছে এসো! তোমার হাতের নরম স্পর্শে আমার পিঠটা একটু মালিশ করে দেও। খুব ধরেছে পিঠটা আমার টনটন করছে। ” কখনো বা রাতে বলবে –
–” বিভাবতি এক কাপ চা নিয়ে আসোতো। ঘুমটা বড্ড বেড়েছে।”
আমার সবুজ আর আমাকে এই কথাগুলো না আর বলে না জানেন! আমি বুঝতে পারলাম আমার সংসার আর আগের মত নেই স্বামী নিয়েই তো সংসার সেই স্বামীই তো আমার হলো না। সবুজের এই ব্যাবহার আর এই অশান্তির মাঝেই আমি এক দারুন সুখবর পেলাম। আমি মা হবো!
এই বুঝি সুখপাখি আমার কাছে ধরা দিবে। কিন্তু হায়! এ যে মরিচিকা! সুখ তো নয় গো!
একদিন সবুজ ফোন করে বলল-
–“কার সাথে *** ছিলি? এই বাচ্চা কার? রহিমের? ঐ হারামীরে আমি পরে দেখমু। আগে তোরে বলি এই বাচ্চা ভালোয় নষ্ট করবি নাহলে আমি তোর বাচ্চা সহকারে কবরে উঠামু।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শাশুড়ি মায়ের ঘরের সামনে এলাম আমি। এসেই দেখি শাশুড়ি মা আমার ননদের সাথে বলছেন –
–” তোর ভাই বলছে আজকে রাতের মধ্যে দুধের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে খাওয়াইয়া দিতে। হাত পা গুলো দড়ি দিয়ে বেধে, গলায় একটা প্যাচ দিলেই শেষ,নদীর পাড়ে ফেলে দিতে বলছে। ”
–” আম্মা আস্তে কথা বল, দেওয়ালের ও কান আছে।”
বিভা যেন অবাক হয়েগেছে, সবুজ তার সঙ্গে কথা বলে না। আজ প্রায় তিনমাস হয় সবুজ তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। যোগাযোগ রাখে ও না, কিন্তু তাই বলে সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে ও সে খুন করতে বলল।
বিভা সারাদিন মায়ের কাছে ফোন করেছে। মা একবার ও ফোন ধরেনি, উল্টে একবার ফোন করে ইচ্ছে মত কত গুলো কথা শুনিয়ে দিলেন –
–” কেন ফোন দিয়েছিস?”
–” মা, আমাকে ক্ষমা করো,মা!”
–” ক্ষমা তো দূরে থাক, তুই যেন এই ইহজীবনে কখনো সুখের দেখা না পাস এই অভিশাপ আমি তোকে দিচ্ছি।
তোর সন্তান যেন তোর এই পাপের ভাগীদার হয়। কষ্টে কষ্টে মরবি, যেদিন দেখবি নিজের সন্তান তোর অবাধ্য হয়ে তোর বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করে। আমি দোয়া করি তোর মত কলঙ্গিনী মেয়ে যেন কোন সংসারে জন্ম না হয়। আমার সন্তান হয়ে তুই আমাকে এত বড় ধোকা দিলি।
এতগুলো মানুষের সামনে তুই আমার নাক কাটলি!
তোর মরা মুখ ও যেন আমার সামনে না পরে।”
–” মা,”
__________
মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন!
জন্মদেওয়া মা ও আজ মুখ ফিরিয়ে নিল বিভার কাছ থেকে। সত্যিই বিভা কলঙ্কিনী! নাহলে মায়ের কথা না শুনে আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছুই করতে পারতো না।
” যারে এত ভালোবাসো, যারে কর দেহ দান!”
দিন শেষে সে কি চায় তোমারে ইহকাল?
“যারে এত দেও সুখ, যারে কর তৃপ্ত!
দিন শেষে সে ঠিকই তোমাতে হয়েছে অসন্তুষ্ট!
কে রইলো স্বামী? কে হইলো কার?
দিন শেষে তুমি শুধুই তোমার!
“এই জগৎ জুড়ে নামেই সম্পর্কের জাল!”
-[তামান্না]