বালিকা বধূ ৩য় পর্ব
#লেখাঃ_শারমিন_আক্তার_(#সাথী____)
———তনয়ার ঘুমোন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল বেলা যখন তনয়ার ঘুম ভাঙলে দেখে আয়াত ওর পাশে আধ শোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে।
তনয়া ভাবছে কি নিঃষ্পাপ মুখ! চোখে সারা রাজ্যের মায়া ভরা। কিন্তু তোমার মনটা কি তোমার মুখের মত এত সুন্দর। সেদিন যদি তুমি অমন না করতে তাহলে হয়তো আজ আমাদের সম্পর্কটা এমন হতো না। বিশ্বাস করো আয়াত সেদিন সকালে তোমার কাছ থেকে আসার পর বারবার ভাবতে ছিলাম কেন তোমায় তখন বলিনি যে,
হ্যা আয়াত আমি তোমার সাথে সারা জীবন থাকতে চাই। তোমার সাথে স্বপ্ন সাজাতে চাই। আমাদের কিশোরের স্বপ্ন গুলোকে একটু একটু করে বড় করে গড়তে চাই স্বপ্নের আশিয়ানা।
পাগলের মত সেদিন থেকে শুক্রবারের অপেক্ষা করতে ছিলাম। কিন্তু শুক্রবারটা ঠিকই আসলো কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কাল হয়ে। মাতাল হয়ে তোমার কাছে যাবার প্রসুস্তি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি শুক্রবারটাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় দিনে রূপান্তরীত করলে।
আয়াতের ডাকে ঘোর কাটলো তনয়ার। রাগি চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো—-
তনয়াঃ তুমি এ রুমে কেন আসছো? ঘুমের মাঝে আমার সাথে নোংড়ামি করতে? লজ্জা করে না তোমার বারবার অপমান করার পরও আমার কাছে আসতে? কেন মুক্তি দিচ্ছো না তুমি আমায়। বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। র্নিলজ্জ, বেহায়া , ইতোর, নোংড়া লোক কোথাকার!
তনয়ার কথা শুনে আয়াত প্রচন্ড কষ্ট পেলো। সাথে প্রচুর রাগও উঠলো। তাই তনয়াকে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো
আয়াতঃ হ্যা আমি র্নিলজ্জ বেহায়া, কিন্তু কেন জানো?তোমার জন্য! আর কি বললে ঘুমের মাঝে নোংড়ামি করতে আসছি? ভুলে যেও না আমি তোমার স্বামী আর তোমার উপর জোড় খাটানোর অধিকার আমার আছে! আর শোন তোমার এই অহংকার ভাঙতে আমার বেশি সময় লাগবে না! আর আমি নোংড়া লোক ভুলে যেও না আমাদের বিয়ের দশ বছর বেশি সময় হয়ে গেছে। অনেক আগেই তুমি আমি প্রাপ্ত বয়ষ্ক হয়েছি। দশ বছরে প্রথমবার গত কাল রাতে তোমাকে জাস্ট একটা কিস করেছি। তাও তোমার জেদের কারনে। আমি যদি নোংড়া লোক হতাম তাহলে এতদিনে তোমার নিজের বলে কিছু থাকতো না। কিন্তু আমি তোমার উপর জোড় খাটাতে চাই না। আমি তোমার মনের ঘৃনার প্রলেপটা সরিয়ে ভালোবাসা ফুল ফোটাতে চাই। কিন্তু আফসুস তুমি তো নিজেই ঘৃনার সাগরে ডুবে যেতে চাও। যা ইচ্ছা করো তুমি। কিন্তু মনে রেখো তনয়া যখন তোমার ভুলটা ভাঙবে হয়তো তখন অনেক বেশি দেরী হয়ে যাবে। আর তোমার করার মত কিছু থাকবে না।
তনয়াঃ ভুল কিসের ভুল? যদিও ভুল হয়ও তবে তার দায় আমি নিজে নিবো। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি শুধু ডির্ভোস পেপারে সাইন করে দাও।
আয়াতঃ হুমমম । সাইন! দেখা যাক! এখনো তিন মাস আছে তনয়া। মনে রেখো।
তনয়া নিজেকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আয়াত তনয়ার যাবার পানে কতক্ষন তাকিয়ে রইল।
তনয়া ফ্রেস হয়ে গিয়ে আয়াতের মায়ের সাথে নাস্তা বানাতে লাগলো। এ বাড়িতে তনয়া সবার সাথে মিশে থাকে। সবাইকে ভালোবাসে শুধু আয়াতকে ছাড়া। ওদের ভিতরের কথা আয়াতের বাবা মা তেমন না জানলেও আয়াতের বোন অনু মোটামুটি জানে। অনু সবসময় চেষ্টা করে আয়াত আর অনুর সম্পর্ক যাতে সুন্দর হয়। কিন্তু যতবারই চেষ্টা করেছে ততবারই তনয়ার জেদের কাছে ব্যার্থ হয়েছে। কিছুদিন পর অনুর বিয়ে। সবাই মোটামুটি বিয়ের তোরজোড় শুরু করে দিয়েছে। অনু সবসময় চায় ওর বিয়ের আগে যাতে আয়াত আর তনয়ার সম্পর্কটা ঠিক করতে পারে। কারন নিজের ভাইয়ের এমন কষ্ট কোন বোনই দেখতে পারবে না।
আয়াত তনয়ার জন্য কোন জিনিস কিনলে সেটা অনুর মাধ্যমে দেয়। কারন জানে আয়াত দিয়েছে জানলে তনয়া তা কখনো নিবে না।
পরের দিন বিকালে তনয়া ওর মায়ের কাছে গেলো। তনয়ার বাবা নাই। তনয়ার বড় ভাই আছে। সে আর তনয়ার মা আর ভাইয়ের বউ একসাথে থাকে। তনয়া তনয়ার মায়ের উপর ভিষন রাগের কারনে তার সাথে তেমন কথা বলে না। তনয়াকে দেখে তনয়ার মা বললো
মাঃ কেমন আছিস মনা?
তনয়াঃ তুমি যেমন দেখতে চেয়েছিলে তার থেকে ভালো।
তনয়ার ভাবিঃ তনয়া তুমি মায়ের সাথে সবসময় এভাবে ব্যবহার করো কেন?
তনয়াঃ ভাবি এই মহিলার কারনে আজ আমার এই অবস্থা। আমি ওনাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।
তনয়ার ভাবিঃ জাস্ট সেটাপ তনয়া। দিন দিন তুমি খুব বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছো। ভুলে যাচ্ছো ওনি আমাদের মা!
তনয়াঃ না ভাবি ভুলিনি ওনি আমার মা। যে কি না আমার সাথে ধোকা করেছে। ওনি যদি সেদিন আমার সাথে ঐ কাজটা না করতো তাহলে আজ আমাকে আয়াতের সাথে থাকতে হতো না। ওর সাথে ডিভোর্স এর জন্য ঘুরে বেড়াতে হতো না। যতটা দোষী আয়াত ততটাই ওনি দোষী।
তনয়ার কথা শুনে তনয়ার মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। মেয়ের সুখের জন্য সেদিন তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই থেকে তনয়া তার সাথে এমন ব্যবহার করছেন যেনো তিনি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছেন। তিনি বললেন—–
মাঃ তনয়া আজ তুই আমাকে যতটা কথা শোনাচ্ছিস একদিন এর জন্য ঠিক ততটাই আফসুস করবি। সব থেকে বেশি কিসের জন্য আফসুস করবি জানিস? তুই আয়াতের সাথে ঠিক যে যে ব্যবহার গুলো করেছিস তার কথা ভেবে তুই এত অনুতাপ করবি যে সারাজীবন কেঁদেও কুল পাবি না।
তনয়াঃ সেটা দেখা যাবে। আমি তোমার ফালতু কথা শুনতে আসিনি। ভাবি ভাইয়া কোথায়? তার সাথে কিছু কথা ছিলো।
তনয়ার ভাবিঃ বাইরে গেছে। কিছুক্ষন পর চলে আসবে। তুমি একটু বসো।
তনয়া গিয়ে ছাদে বসলো। খুব কান্না করতে ইচ্ছা করছে। নিজের মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করতে কোন মেয়েরই বা ভালো লাগে। কিন্তু মা যা করেছে সেটাও তো খুব অন্যায়। তাই না? তনয়া ভাবছে—–
তনয়াঃ মা কিভাবে আয়াতকে এত ভরশা করতে পারে? যে অন্যায় আয়াত করেছে তাতে ও ক্ষমা পাবারও যোগ্য না। কিন্তু মা কত সহজে সেটা ভুলে ওকে মাফ করে দিলো। আর আমাকে মিথ্যা বলে ম্যারেজ রেজিট্রি পেপারে সাইন করিয়ে নিলো। হ্যা আমার আর আয়াতের ছেলেবেলার বিয়ের কোন মূল্য ছিলো না আইনে দৃষ্টিতে। কিন্তু আট মাস আগে মা আমাকে অন্য পেপারে সাইন করাতে গিয়ে ম্যারেজ সার্টিফিকেটে সাইন করিয়ে আমাদের বিয়েটাকে আইনের দৃষ্টিতে লিগাল করে দিলো। নয়তো এখন ডিভোর্সের জন্য আমাকে আয়াতের সাথে থাকতে হতো না। বুঝি না সবাই আয়াতের কি দেখে ওকে এত বিশ্বাস করে? এত ভালোবাসে? নিশ্চই ছেলেটা সবাইকে হিপনোটাইস করেছে। যেমনটা আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় আয়াত খারাপ নয়। কিন্তু যেটা আমি নিজ চোখে দেখেছি তা আমি কি করে ভুলি? সেটাকে কি করে ইগনোর করি? নাহ আমি ওর মায়ায় নিজেকে জরাবো না। কখনো না।
তনয়া ভাবিঃ সেটা কি পারবি তনয়া?
ভাবির কথায় চমকে উঠে তনয়া।
তনয়াঃ বুঝলাম না ভাবি!
তনয়ার ভাবিঃ যখনই কারো মায়া থেকে বের হয়ে আসতে চাইবি তখনই তার মায়ায় বেশি করে জড়িয়ে যাবি।
তনয়াঃ কখনো না।
তনয়া ভাবিঃ আচ্ছা! চোখ বন্ধ কর! বুকে হাত দে আর আয়াতের কথা ভাব ঠিক কি দেখতে পারছিস?
তনয়াঃ ভাবি লাইফ ইজ নট মুভি
তনয়ার ভাবিঃ যেটা বললাম সেটা কর না!
তনয়া চোখ বন্ধ করলো! বুকে হাত রেখে আয়াতের কথা ভাবতে শুরু করলো। চোখের সামনে ভেশে উঠছে আয়াতের সাথে কাটানো হাজারো সুখময় স্মৃতি। ছোট বেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটা সময় আয়াতের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো ভাশছে। তনয়া চোখ বন্ধ করে ভাবছে কৈই কোথাও তো আয়াতের কোন খারাপ রূপ দেখতে পারছি না। সব ক্ষেত্রে সব সাজানো গুছানো স্বপ্নে আর আয়াতের ভালোবাসায় ঘেরা। তনয়া নিজে নিজে মিট মিট হাসছে। ফিরে যেতে চাইছে সেই শৈশবে। যেখানে আছে ওর আর আয়াতের জীবনের সব চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। হঠাৎ কিছু কালো আঁধারের ঝাপটায় ধ্যান ভাঙে তনয়ার। চমকে উঠে তনয়া। চোখ থেকে ঝড়তে থাকে অশ্রু কণা। তনয়া কিছু না বলে ছাদ থেকে নেমে গেলো।
তনয়ার ভাবিঃ তুই উপরে উপরে যতই আয়াতকে ঘৃনা করিস না কেন তনয়া। মনে মনে তোর থেকে বেশি ভালো আয়াতকে কেউ বাসে না। সমস্যা হচ্ছে তোদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির একটা দেয়াল তৈরী হয়েছে। সেটা ভেঙে গেলে তোদের মত সুখী দম্পত্তি আর কেউ হবে না।
তনয়া ওর ভাইয়ের সাথে সব কাজ শেষ করে। বাসায় গেলো। বাসা পুরো খালি। কেউ নেই। মনে হয় সবাই অনুর বিয়ের শপিং এ গেছে। রাস্তায় ঘটা কিছু ঘটনায় তনয়ার ভিষন কান্না পাচ্ছে। ভেবেছিলো ঘরে এসে অনুকে জড়িয়ে খুব কান্না করে মনটা হালকা করবে। কিন্তু বাসায় কাজের খালা বাদে কেউ নেই। নিজের রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে তনয়া। আয়াত তখন ওয়াশরুমে ছিলো। বের হয়ে দেখে তনয়া নিচে বসে কান্না করছে।
আয়াত তারাতারি তনয়ার কাছে গিয়ে জিগেস করলো
আয়াতঃ কি হয়েছে তনয়া?
তনয়া কান্নায় এতটা বিভোর ছিলো যে সামনে আয়াত সেটা না ভেবেই আয়াতকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই প্রথমবার তনয়া নিজ থেকে আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো। আয়াত তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বার বার জিগেস করছে
আয়াতঃ কি হয়েছে তনয়া? বলো? প্লিজ!
চলবে———
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।