বর্ষণের সেই রাতে ❤
পর্ব: ৩১
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আদ্রিয়ান সারা রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো অনিমা নেই। ও তো দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়েছিলো তাহলে? মেয়েটা গেলো কোথায়? বেশ ভয় পেয়ে গেলো ও। ওয়াসরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো দরজা খোলা আছে। তারমানে ওয়াসরুমেও যায়নি? তাহলে গেলো কোথায় আদ্রিয়ানের এবার কলিজা কেঁপে উঠতে শুরু করলো, সাথে ঘাম ও বেড়োতে শুরু করলো। হাত দিয়ে নাকের ঘাম মুছে একটা শ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেডে তাকিয়ে দেখলো বেডে চাদরটা নেই, সেটা দেখে ভ্রু কুচকে গেলো আদ্রিয়ানের। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ও তাড়াহুড়ো করে ব্যালকনিতে চলে গেলো। আর সেখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে ও হাসবে না কাঁদবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। অনিমা বিছানার চাদরটা রেলিং এর সাথে বেধে, মুখ ফুলিয়ে একবার নিচের দিকে দেখছে আরেকবার চাদরটার দিকে। অনিমা পালাতে চাইছে তাতে ওর রাগ হচ্ছে ঠিকি কিন্তু পালানোর পদ্ধতিটা দেখে হাসিও পাচ্ছে। আদ্রিয়ান হাসিটা চেপে রাগটাকেই প্রাধান্য দিয়ে মুখটা সিরিয়াস করে বলল,
— ” ঐ চাদরে কিছুই হবেনা।”
অনিমা চমকে পেছনে তাকালো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অনিমা আদ্রিয়ানকে দেখে ভয় পাওয়ার বদলে কেদেঁ দিলো। অনিমাকে কাঁদতে দেখে আদ্রিয়ান অবাক হয়ে ওর কাছে এসে ওর বাহুতে হাত রেখে বলল,
— ” কী হয়েছে কাঁদছো কেনো। আমি কিছু বলবোনা ডোন্ট ক্রাই।”
অনিমা কিছু না বলে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আদ্রিয়ান অবাক হয়ে গেছে অনিমার এমন ব্যবহারে। ও কিছু বলবে তার আগেই অনিমা বললো
— ” এমন কেনো আপনি? সকালে উঠে আপনাকে দেখতে না পেয়ে আমার কী অবস্হা হয়েছিলো জানেন আপনি? ফোনটাও ফেলে দিয়েছেন? আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো জানেন আপনি?”
অনিমার কথা শুনে আদ্রিয়ান অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো। হঠাৎ এরকম কথা কেনো বলছে? তবে ওকে নিয়ে অনিমা চিন্তা করছে এটা ভেবেই এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ওর মধ্যে। ও অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ” আমিতো রোজই বেরোই এতো টেনশন করার কী আছে?”
অনিমা আরো শক্ত করে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” আপনি বুঝতে পারছেন না আমি ভেবেছিলাম রিক আপন…”
এটুকু বলে থেমে গেলো অনিমা। আদ্রিয়ান অনিমাকে সরিয়ে নিজের সামনে দাড় করিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কী ভেবেছিলে রিক আমাকে কী?”
অনিমা নিজেকে সামলে ধাক্কা দিয়ে আদ্রিয়ানকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
— ” কিছুনা। যেতে দিন আমাকে।”
আদ্রিয়ান অনিমার কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
— ” আমি আগেও বলেছি আর এখোনো বলছি আমার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা ভূলে যাও।”
অনিমা নড়াচড়া করতে করতে বলল,
— ” আপনি আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারেন না।”
আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে নিয়ে রুমে যেতে যেতে বলল,
— ” আমি কী কী করতে পারি সেটা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই।”
তারপর অনিমাকে বেডে নামিয়ে ওর দিকে বেশ অনেকটা ঝুকে বলল,
— ” আর সেটা যদি তুমি সম্পর্কিত হয়। তাহলে আমি সব করতে পারি। সব মানে সব। ”
অনিমা ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানের প্রতিটা শব্দ ওর হৃদয়ে গিয়ে লাগে। এরকম একটা মানুষকে নিজের করে পাওয়া ওর কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ওর আব্বুর মৃত্যুর সেই দিনটা ও আজও ভুলতে পারেনা যদি ওর আব্বুর মতো আদ্রিয়ানকেও যদি ওরা। ওসব ভাবলেও ওর আত্মা কেঁপে ওঠে। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
— ” আপনি কথাটাই বুঝতেই চাইছেন না। আপনি জানেননা যে..”
আদ্রিয়ান অনিমার কথা শেষ করতে না দিয়ে ওর চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বলল,
— ” যেটুকু বোঝার বুঝে নিয়েছি। আর আমি শুধু এটুকুই জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর তুমি আমার কাছেই থাকবে আর আর কিছু জানার দরকার নেই আমার।”
অনিমা শুধু তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। ও কী বলবে? আদ্রিয়ানের কথাগুলোই যে ওকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, যেখানে থেকে আর ফিরতেই ইচ্ছে করেনা ওর। আদ্রিয়ান অনিমাকে ছেড়ে ওর সামনে বসে হেসে দিয়ে বলল,
— ” বাই দা ওয়ে তুমি বিছানার চাদর ব্যালকনিতে বেধে পালাতে চাইছিলে? সিরিয়াসলি?”
বলে শব্দ করে হাসতে লাগল আদ্রিয়ান। অনিমা মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” হ্যা তো এতো হাসার কী আছে?”
আদ্রিয়ান কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলল,
— ” সেভেন্ত ফ্লোর থেকে কেউ রেলিং এ চাদর বেধে নামবে। ওয়াও আমেজিং। একশন ফিল্মকেও হার মানাবে দেখছি। নিচে বা চারপাশে তাকিয়েও দেখোনি? ”
বলেই আবার হাসতে লাগল। অনিমা মাথা নিচু করে বলল,
— ” আসলে তাড়াহুড়ো করে করছিলাম তাই খেয়াল করিনি।”
আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেলে হাসি মুখেই বলল,
— ” হুমম। তারপর ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলে যে এখান থেকে নিচে পরলে নিচে নয় ডিরেক্ট ওপরে যাবে তাইতো?”
অনিমা বোকার মতো হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ান হেসে অনিমার চুল নেড়ে দিয়ে বলল,
— ” পাগলী।”
আদ্রিয়ান ভালোভাবে অনিমার চুলে হাত লাগিয়ে বলল
— ” চুল ভেজা? সাওয়ার নিয়েছো?”
অনিমা মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে বলল,
— ” যা পরা ছিলে সেটাই পরেছো তাইনা? আমার মাথাতেই ছিলোনা তোমার পোশাকের কথা। নো প্রবলেম আজকেই আনিয়ে নেবো।”
অনিমা কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান টি টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” যা ভেবেছিলাম তাই, কিচ্ছু খাওনি এখোনো?”
অনিমা চুপ করে বসে আছে কিছু বলছেনা আদ্রিয়ান খাবারের প্লেটটা নিয়ে অনিমার মুখের সামনে ধরতেই অনিমা সরিয়ে দিয়ে বলল,
— ” আমি থাকতে চাইনা এখানে প্লিজ যেতে দিন আমাকে।”
আদ্রিয়ানের এবার রাগ উঠে গেলো। ও শব্দ করে প্লেটটা ট্রে তে রেখে অনিমার কাছে গিয়ে ওকে একটানে নিজের কাছে এনে বলল,
— ” একটা এক্সট্রা কথা বলবেনা এখন চুপচাপ খেয়ে নাও। একটা শব্দ করলে আমার চেয়ে খারাপ এই মুহূর্তে আর কেউ হবেনা।”
অনিমা কিছু না বলে ছলছলে চোখ নিয়েই মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ানের বেশ খারাপ লাগল, ওর অতীত জানার পর সামান্যতম কষ্টও দিতে চায়না ও ওকে। কিন্তু কিছু করার নেই ওর এই মুহূর্তে ওকে রুড হতেই হবে। আদ্রিয়ান অনিমাকে খাইয়ে দিয়ে। উঠে কোথাও একটা গেলো অনিমা ভাবছে যে রিক যদি আদ্রিয়ানের কোনো ক্ষতি করে দেয় তাহলে? না ও এখানে থাকতে পারেনা, রিক তাহলে আদ্রিয়ানকে মেরে ফেলবে। আদ্রিয়ান নেই এখন এই সুযোগেই ওকে পালাতে হবে। এসব ভেবে রুম থেকে বেড়িয়ে মেইন ডোরের কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে বেড়িয়ে লিফ্টের বাটন প্রেস করতে যাবে তার আগেই কেউ ওর হাত ধরে ফেলল। ও পেছনে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান চোখ মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, আদ্রিয়ান এবার সত্যিই ভীষণ রেগে গেছে। অনিমা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
— ” আদ্রিয়ান আমি…”
অনিমা আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ওকে ভীষণ জোরে একটা ধমক দিলো। অনিমা হালকা কেঁপেও উঠলো ওর ধমকে। আর কোনো কথা বলার সাহসও পেলো না তাই মাথা নিচু করে ফোঁপাতে লাগল। আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে খাটের ওপর একপ্রকার ছুড়ে মারলো। তারপর সেই দড়িগুলো নিয়ে আবারও ওর হাত পা বেধে দিলো। অাদ্রিয়ানের ওই ধমকের পর আর টু শব্দ করার সাহস পেলোনা অনিমা শুধু অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান রাগী গলায় বলল,
— ” তুমি এটাই ডিজার্ব করো। যতোক্ষণ পর্যন্ত না তুমি এটা বুঝতে চাইছো যে তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে ততোক্ষণ তুমি এভাবেই থাকবে।”
_____________________
রিক সমস্ত জায়গায় খোজ নিয়ে নিয়েছে কিন্তু কোথাও খুজে পাচ্ছেনা অনিমাকে। ঐ আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের কোথায় এমন লুকিয়ে রেখেছে যে ও, রিক চৌধুরী খুজে পাচ্ছেনা। এসব ভেবেই রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে রিকের। একটার পর একটা গ্লাস ফাকা করছে ও। রিকের একজন লোক এসে বলল,
— ” ভাই এডি কে বেরোতে দেখা গেছে।”
রিক গ্লাসে চুমুক দিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— ” কোথায় আছে ওরা দুজন?”
লোকটা মাথা নিচু করে বলল,
— ” ফলো করতে চাইছিলাম কিন্তু লোকটা একটু বেশিই চালাক, এমনভাবে ড্রাইভ করলো যে কোথা থেকে কোথায় চলে গেলো কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
রিক গ্লাসটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো আর রাগে গজগজ করে বলল,
— ” এতোগুলো গাধা মিলে ঐ একটা ছেলের বুদ্ধির সাথে পেরে উঠলি না?”
লোকটা কিছু না বলে মাথা নিচু করে আছে, রিক রাগী গলায় বলল,
— ” এখন চেহারা না দেখিয়ে যা এখান থেকে।”
লোকটা চলে যেতেই রিক রাগে গজগজ করতে লাগল। মাথায় রক্ত উঠে আছে ওর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও চিন্তা করলো যে না এভাবে না ওকে এবার নিজেকেই কিছু করতে হবে। ও এবার নিজে কথা বলবে ঐ আদ্রিয়ান আবরার এর সাথে। মাথার সামনে বন্দুক ধরলে সব সুরসুর করে বলে দেবে।
_____________________
আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে উঠে বসে অনিমা। বিকেলে খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো অনিমা কিন্তু এখন উঠে চারপাশে তাকিয়ে অনিমা নিজেকে এক সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় আবিস্কার করলো। উঠে দাড়িয়ে দেখলো রুমটা লক করা। পাশের দেয়ালটা যেটা দিয়ে ব্যালকনিতে যায় সেটা কাচের, রুমটাও অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো। অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রুমে আদ্রিয়ানের ছবি দেখে বুঝতে পারলো এটা আদ্রিয়ানেরই বাড়ি কিন্তু ও ভাবছে যে আবার কোথায় এসে পরলো?
_____________________
একটা কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে আদ্রিয়ান আর রিক। আদিব আর আশিস আদ্রিয়ানের পেছনে দাড়িয়ে আছে আর রিকের পেছনে রিকের লোকেরা। সকলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিরবতা ভেঙ্গে আদ্রিয়ান বলল,
— ” মিস্টার রঞ্জিত চৌধুরীর একমাত্র ছেলে রিক চৌধুরী হঠাৎ একজন রকস্টার কে কেনো ডাকল?”
রিক টেবিলে হাত রেখে শক্ত গলায় বলল,
— ” অনিমা কোথায়?”
আদ্রিয়ান এই প্রশ্নটাই আশা করছিলো রিকের কাছে। তবুও খানিকটা আলসেমী ঝেরে বলল,
— ” অনিমা কোথায়? হুমমম গভীর প্রশ্ন। কোথায় বলুনতো?”
রিক রেগে গিয়ে টেবিলে বাড়ি মেরে বলল,
— ” মজা করছেন আমার সাথে?”
আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,
— ” আরে আরে রাগ করছেন কেনো? অনিমা কোথায় আছে সেটা দিয়ে আপনার কী কাজ?”
রিক আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলোনা। পেছন থেকে গানটা বের করে আদ্রিয়ানের দিকে গান তাক করে বলল,
— ” এবার নিশ্চই বলবে মিস্টার জুহায়ের?”
আদ্রিয়ান একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
— ” আরে আরে আপনিতো সোজা গানে চলে এলেন? এটা দিয়ে কী হবে বলুন। হ্যাঁ অনিমা আমার কাছেই আছে।”
রিক হেসে দিয়ে বলল,
— ” গান দেখেই ভয় পেয়ে গেলে? বাহ।”
আদ্রিয়ান সোজা হয়ে বসে হালকা গলা ঝেড়ে বলল,
— ” দেখুন এসব গান টান দিয়ে আমাকে মেরে ফেললে পরে অনিমার খোজ পাবেন কীকরে? তারচেয়ে বরং খুজুন। আপনার তো খুব পাওয়ার।”
— ” তো তুমি বলবেনা ও কোথায় আছে?”
আদ্রিয়ান মেকি হেসে বলল,
— ” বললাম তো আমার কাছেই আছে খুজে নিন। কিন্তু গানটা নামিয়ে।”
রিক বাঁকা হেসে বলল,
— ” এই সাহস নিয়ে আমার সাথে লাগতে এসছো। তবে যাই হোক অনিমাকে তো আমি খুজে নেবোই।
আদ্রিয়ান গানটা হাত দিয়ে নামিয়ে দিয়ে হেসে বলল,
— ” বেস্ট অফ লাক।”
রিক রেগে উঠে চলে গেলো। আশিস আর আদিব আদ্রিয়ানের পাশে বসল। আশিস আদ্রিয়ানকে খোচা মেরে বলল,
— ” ভাই? বন্দুক দেখে ভয় পেয়ে গেছো?”
আদ্রিয়ান আশিসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনজন একসাথে শব্দ করে হেসে দিলো যেনো ওদের সামনে সবচেয়ে বড় জোক বলা হয়েছে। কিছুতেই হাসি থামাতে পারছেনা।
.
#চলবে…