#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২]
” ফ্লুজি আমার জান শুনতে পাচ্ছো?”
আরশাদের ভারী নিশ্বাসের পতন ঘটছে খুশবুর চোখে মুখে।মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।দু’চোখ ফুলে যাচ্ছে তাই অবস্থা।আরশাদ মায়াভরা দৃষ্টিতে দেখলো তার ফ্লুজিকে।এলোমেলো চুল জড়িয়ে দিলো কানের পেছনে।অদৃশ্য এক অধিকার নিয়ে কপালে চুমু খেল বারংবার।এই মেয়েটা তার ধৈর্যের সীমা ভেঙে দেয় তার প্রেমে ডুবে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আরশাদের।
আরশাদের কাছে এসব এখন আশ্চর্য বিষয়।একটা সময় ফ্লুজি তার পিছু ছাড়তো না।অনলাইনে সারাটা সময় মেয়েটা তাকে বিরক্ত করেছে একটা সময় এসে আরশাদ নিজেও মেয়েটার প্রেমে ডুবেছে অথচ এই প্রেম শেষে কি না অচেনা গল্পে রূপ নিলো!তার ফ্লুজি কি সত্যি তাকে চিনতে পারছে না?নাকি চিনতে চাইছে?
এসব টালবাহানায় খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না ফ্লুজি।এই আরশাদ ইহসান একবার যখন তোমার প্রেমে মজেছে তখন তোমার সব কৌশল এখানেই ব্যর্থ।আরশাদের চাওয়া পাওয়া ভীষণ অল্প স্বল্প কিন্তু সে যা চেয়েছে তা আদায় করে ছেড়েছে।তার গ্র্যানি মানে দাদিমা বলেন সে হয়েছে তার দাদার মত।মানুষটা ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পূর্ণ মানব, শিকার ধরতে তিনি যে বেশ পটু।
” আমার জান শুনতে পাচ্ছো?”
আরশাদ আদর নিয়ে ডাকলো খুশবুকে।মেয়েটার সাড়া শব্দ না পেয়ে ফোলা ফোলা দু’গালে চুমু খেল বেশ কয়েকবার।
উষ্ণতায় আরো গুটিয়ে গেল খুশবু তা দেখে হাসলো আরশাদ।কিন্তু খুশবুর অবচেতন মন যে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে অচেনা আতঙ্কে ঝট করে চোখ মেলে তাকায় সে।তার দেহখানি জড়িয়ে থাকা আরশাদকে দেখে ছিটকে দূরে সরে যায়।কিন্তু পারলো কই?আরশাদ তাকে শক্ত বন্ধনীতে চেপে আছে।
“ক্লাম ডাউন ফ্লুজি মাই ডল।”
খুশবু শুনলো না আরশাদের কথা সে, চোখ রাঙিয়ে তাকালো মুহূর্তে,
” ছাড়তে বললাম তো।”
” এই রাগি চাহনিতে অনেক দিন পর তোমায় দেখলাম ফ্লুজি।”
খুশবুর এবার কান্না পেল কি এক মহা ঝামেলায় পড়লো সে।আচ্ছা এই লোকটার মাথায় কি সমস্যা আছে?নাকি সেচ্ছায় এমন করছেন তিনি।মুখভরে গা লি এলো খুশবুর তবুও নিজেকে সংযত করে বলে,
” নির্লজ্জ লোক।”
” লিলাযা মানে?”
ভাঙা ভাঙা শব্দে উচ্চারণ করলো আরশাদ।সে বাংলা কথায় পটু নয়।যতটুকু যা শিখেছে সবটাই মায়ের মুখে শুনে।যার জীবনের গোড়াপত্তন ইতালিতে সে তো ইতালীয় ভাষায় দক্ষ হবে।
আরশাদের ভ্যাবাচেকা ভাবটার সুযোগ নিয়ে ছিটকে দূরে সরলো খুশবু।
” আপনি এখান এখানে কি করছেন?”
” ডাক্তার এসেছে ফ্লুজি।তোমার শরীর ভালো নেই উনি চেকাপ করবেন।”
আবার সেই ভাঙা ভাঙা বাংলা এবার ভীষণ বিরক্ত লাগলো খুশবুর।মায়ের মুখের বাংলা ভাষাটাকে উনি যাচ্ছে তাই করে ছেড়েছেন।
” আমি ঠিক আছি।কোন ডাক্তার ফাক্তারের প্রয়োজন নেই।”
” আমার থেকেও বেশি বুঝতে যেয়েও না তুমি।”
” আপনি সত্যি চান আমি ভালো থাকি?”
” ইয়েস।”
” আমাকে বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিন।সন্তান নিখোঁজে মা বাবা কত চিন্তায় থাকে আপনি জানেন?”
” সরি এই টপিক বাদ।”
আরশাদ উঠে গেলো ক্লোজেট থেকে জামা নিয়ে এগিয়ে দিল খুশবুর কাছে।
” ফ্রেশ হয়ে আসো জান।ডাক্তার অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছেন।”
খুশবু উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু মুহূর্তে ‘আহ’ শব্দে থমকে পড়লো সে।দুই পায়ে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে,গতরাতে আরশাদের আঘাতে ঘাড়ের ছিলে যাওয়া অংশে কেমন টান টান ব্যথা লাগছে।সবচেয়ে বেশি জ খ ম পেয়েছে পিঠে।তাকে যখন জোর জবরদস্তি করা হচ্ছিল তখন কোন কিছুর কোনার সাথে তার পিঠে বেশ আঘাত পেয়েছে।
খুশবুর চাপা আর্তনাদে আরশাদ দরজার কাছে গিয়ে ফিরে আসলো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তার ফ্লুজিকে।
” কি হয়েছে?আমায় বলো জান।”
” গতকাল থেকে কম অ ত্যা চার করছেন না, অ স ভ্য ব র্ব র লোক।আমার দু’পা শেষ।”
” আমায় বলো কি হয়েছে।”
খুশবু দু’চোখ ভেসেছে অশ্রুপাতে।ব্যথায় টনটন করছে সারা শরীর।মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে কেমন রক্তিম হয়েছে।আরশাদ আনজুমকে ডাকলো।মেয়েটা বসলো খুশবুর কাছে।আরশাদ ছুটলো ডাক্তার ডাকতে।মেয়েটার অবস্থা দেখে আনজুমের বেশ মায়া লাগলো,
” ম্যাডাম কি হয়েছে আপনার?আমাকে বলুন আমি সাহায্য করবো।”
” আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে।জানেন কতটা জায়গা ছিলে আছে। এই লোকটা এমন পাষাণ কেন?কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তার?জানেন এতটা কষ্ট আমি কখনো পাইনি এতটা আঘাত আমি কখনো পাইনি।
বড্ড যন্ত্রণা নিয়ে বললো খুশবু।ততক্ষণে আরশাদ চলে এসেছে সঙ্গে এসেছেন গম্ভীর মুখ করা একজন ডাক্তার।খুশবুর কাছে সকল সমস্যার কথা জানতে চান তিনি মেয়েটা নিজের সুস্থতা কামনায় ডাক্তারের কাছে সকল সমস্যার কথা জানায়।
ডাক্তার কিছু ওষুধ মলম লিখে দেন এবং জানান একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে।মনের সকল সাহস এক নিমিষে ফুস হয়ে গেল খুশবুর।সে চোখ বড় করে তাকালো ডাক্তারের পানে আরশাদ আশ্বস্ত করলো তাকে কিছুই হবে।কিন্তু কে শুনে কার কথা খুশবু নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে যেতে চাইলো আরশাদ তাকে চেপে বসালো বিছানায় এবং জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
বিয়ে উপলক্ষ্যে নেইল এক্সটেনশন করিয়েছিল খুশবু সেই বড়বড় নখ দিয়ে চেপে ধরলো আরশাদের হাত।নখ দেবে আরশাদের হাতে রক্তে দেখা মিলছে কিন্তু টু’শব্দ করলো না সে।তার ফ্লুজির দেওয়া সকল ব্যথা সে এক নিমিষে হজম করতে পারে শুধু পারে না ফ্লুজির দূরত্বের কষ্ট মেনে নিতে।
.
একটা রাত পেরিয়ে গেল অথচ খুশবুর কোন খোঁজ এনে দিতে পারলো না কেউ।পুলিশ তার কাজ করছে কিন্তু এখনো তারা কোন পজেটিভ খবর এনে দিতে পারলো না।
খুশবুর শোকে তার বাবা বাহারুল হক চেতনা হারিয়েছিলেন তারপর থেকে তিনি বিছানায় লেগে আছেন।
বর্তমানে এই পরিবারের কাছের মানুষগুলো নানান কথা ছড়াচ্ছেন কেউ বলছেন মেয়ে পালিয়ে, কেউ বা বলছে নষ্টা মেয়ে।এসব কথা আর কানে সয়না খুশবুর মা অনিমার।তিনি কাঁদতে কাঁদতে বারবার বেহুশ হচ্ছেন।
ছেলের বাড়ির লোকেরা প্রথমে পরিস্থিতিটাকে বিপদ ভাবলেও এখন তারা শাসিয়ে চলছেন।কম টাকা খরচ হয়নি এই বিয়ে জুড়ে,আত্মীয় স্বজন সহ শত মানুষের কাছে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।
এই ভাঙাচোরা পরিবারটার পাশে আছে খুশবুর হবু বর রোহান।ছেলেটা খুশবু বলতে অস্থির ছিল।নিজের পছন্দ করে বাবা-মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করছে সে।মোদ্দা কথা সবটাই পারিবারিক ভাবে কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।
রোহান এতক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে সবার থেকে আপডেট খবর নিচ্ছিলো।কাজ শেষে সে প্রবেশ করলো বাহারুল হকের কক্ষে।একদিনে এই মানুষটার সে কি বেহাল দশা।
” আঙ্কেল এখন কেমন ফিল করছেন?”
” ভালো।বাবা তুমি আমার মেয়েটার কোন খোঁজ পেয়েছো?”
” পুলিশ এখনো কোন খোঁজ দিতে পারলো না আঙ্কেল।”
” আমার মেয়ের কোথাও কোন রিলেশন নেই সে বরাবরি ভীতু প্রকৃতির।তার পৃথিবী জুড়ে আমি আর তার মা ছিলাম।এই মেয়ের তেমন কোন বন্ধুও নেই।”
” আমি সেসব জানি আঙ্কেল।সবার থেকে ভিন্নতা দেখে আমি খুশবুকে আমার জন্য পছন্দ করেছিলাম।জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়েছি।আঙ্কেল আপনার কোন আড়ালে থাকা শত্রু আছে?”
” শত্রু!বাবা আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ বন্ধু নামের কত শত্রুই তো আছে।আমি কীভাবে যে বুঝবো কে আমার জীবনের অভিশাপ নামালো।”
.
আরশাদ নিজের কক্ষে এসে চুপচাপ বসে আছে।তার ঠোঁটের কোনে দেখা মিলছে হাসির আভাস।খুশবুর দেওয়া আঁচড়ের স্থানে সে বেশ কয়েকবার চুমু খেয়েছে।
দূর থেকে যতটা না ভালোবেসেছিল তার ফ্লুজিকে, কাছে আসার পর ফ্লুজির প্রতি আলাদা টান জন্মেছে।এককথায় উন্মাদ হয়ে পড়েছে ফ্লুজির প্রেমে।আরশাদের ফোন এলো তার বাবা ফোন করেছে হাসি মুখে রিসিভ করলো আরশাদ।তার বাবার সাথে তার বাক্যালাপ ছিল ইতলীয় ভাষায়।
” বাবা কেমন আছো?”
” খুব ভালো।তুমি কেমন আছো?ফ্লুজি কেমন আছে?”
” সে ভালো নয় আমার কারনে অনেক চোট পেয়েছে।ডাক্তার দেখিয়েছি একটু আগে।আশা করি দ্রুত সেরে যাবে।মা কোথায়?”
” তোমার মা তোমার জন্য অস্থির হয়ে আছে বাবা।তুমি ফ্লুজিকে নিয়ে কবে ফিরে আসবে সেই অপেক্ষায় আছি আমরা।”
” ফ্লুজি আমাকে চিনতে পারছেনা নাকি চিনতে চাইছে না বাবা।আমি তাকে আমার কাছে কিছুতেই বশে রাখতে পারছি না।অথচ যতদিন যাচ্ছে আমি ততটাই তার প্রতি দূর্বল হচ্ছি।”
পুত্রের কথা শুনে কিঞ্চিৎ শব্দ করে হাসলেন পিতা।তিনি যতবার পুত্রের প্রেম কাহিনী শুনেন ততবার তিনি তার প্রেমকাহিনীতে ডুবে যান।
” এক বাঙালি হরিণাক্ষী মেয়ের প্রেমে পড়ে জাত কূল সবটাই আমি জলে ভাসিয়েছিলাম বাবা।আমি আশা রাখছি তোমার চেষ্টায় সফলতা আসবে।”
আরশাদ আরো কিছু কথা বলে ফোন রাখলো।তার বাদামি চোখের মনি কেমন ঝকমক করছে।চুলে দু’হাত বুলিয়ে পুনরায় গেল খুশবুর কক্ষে।মেয়েটা তখন বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছিল।
আরশাদের মন ভাঙলো,তীব্র ক্রোধে রিরি করছে তার শরীর।ঝটকায় খুশবুকে টেনে বসালো সে।দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” কাঁদছো কেন?”
খুশবু ভয় পেল তার ফোলা ফোলা চোখের আতঙ্ক নিয়ে বলে,
” আমাকে বাড়ি দিয়ে আসেন প্লিজ।”
” নো ফ্লুজি।”
” বাবার সাথে একবার কথা বলতে দিন একবার প্লিজ একবার।”
আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না বরং চেপে ধরলো ফ্লুজির থুতনি।চোখের জলে ভেসে গেছে ফ্লুজির দু’গাল।আরশাদ চুমু খেল তার ফ্লুজির চোখের পাতায় তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠলো খুশবু।মেয়েটা নিজেকে সরাতে চাইলো কিন্তু আরো সন্নিকর্ষে আসলো আরশাদ।থুতনি থেকে আরশাদের আঙুল বিচরণ করলো তার ফ্লুজির কোমল লাগে।মুগ্ধতায় ব্যাকুল হয়ে আরশাদ বলে,
” ইউ আর সো ড্যাম প্রিটি মাই গার্ল।”
” প্লিজ আরশাদ আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করতে দিন।”
আরশাদ থমকে গেল।চোয়াল শক্ত করে বড় বড় শ্বাস ছাড়লো।চোখের পর্দা ফেলে প্রশ্ন করে,
” কি বললে?”
খুশবু ভয় পেল মানুষটার অদ্ভুত আচরণ তাকে ভয়ে ডুবিয়ে মা রে।
” ব..বলেছি ব..বাবার সাথে…”
” না তা নয় এর আগে কি বলেছিলে?”
” প্লিজ আরশাদ।”
” আরেকবার বলো।”
” প্লিজ আরশাদ।”
আরশাদ চোখের পাতা খুলে তাকালো তার ফ্লুজির পানে।ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হেসে আচমকা কোলে তুললো খুশবুকে।
” এই যে আমাকে চিনতে না পারার নাটক করলে আসলেই আমাকে তুমি চেন না জান?”
” সত্যি চিনি না।”
” তাহলে জানলে কিভাবে আমার নাম আরশাদ।”
” আমাকে তো আনজুম মেয়েটা বলেছে।”
” চুপ।আর কোন বাহানা নয় জান।”
“নামান আমাকে নির্লজ্জ লোক।”
আরশাদ নামালো না বরং খুশবুকে জড়িয়ে বসালো সোফায়।মেয়েটাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে রাখলো ঠিক আদুরে বিড়ালছানার মত।
” ইউয়ু আর সো ফ্লাফি মাই গার্ল।”
চলবে_____