প্রেয়সীর শব্দপ্রেম পর্ব-৭+৮

0
564

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৭]

ডিপার্টমেন্ট ট্যুরের জন্য একটি বাস নির্ধারণ করা হলো। স্টুডেন্ট হাতেগুনা কয়েকজন। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও বান্ধবীদের মন রাখার জন্য যেতে হচ্ছে ঝুমঝুমির। জানালার ধারে চোখ বুজে বসেছে ঝুমঝুমি। বাস ছাড়তে এখনও মিনিট বিশেক দেরি। ঠং শব্দে ম্যাসেজ আসলো মুঠোফোনে। মেঘ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে,
-” আমাকে না জানিয়ে ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে। যা ঘুরতে যা। খাঁচার পাখিকে স্বাধীনতা দিলাম। ডানা মেলে উড়ে বেড়া, উড়াউড়ি শেষে তো আমার খাঁচাতেই আসতে হবে। সারাজীবনের জন্য ডানা কে’টে দিবো। মনে রাখিস আমাকে অগ্রাহ্য করার জন্য তোকে অনেক বড় মাশুল দিতে হবে। কল্পনাও চিন্তা করতে পারবি না কী হতে চলেছে। আমার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলেছিস। সহজে তোর পিছু ছাড়ছি না। একদিনের জন্য হলেও তোকে আমার করব। সেদিন চাঁদের কলঙ্কে পর্যবসিত হবে নতুন কালো দাগ। মেঘ কথা দিয়ে কথা রাখে। মনে রাখিস।

নিষ্কাম নির্বিকার নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে রইল কিয়ৎপল। সলজ্জহাস্যে দিল ঝুমঝুমি মনেমনে শুধাল, যার একবার চরিত্র কালি ছিটে তাকে বারবার হু’ম’কি দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। সাদা জামায় একবার দাগ পড়লে কখনও উঠা যায় না ফলে জামার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। আমারও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে মেঘ ভাই। হু’ম’কি-ধা’ম’কি’তে আমি ভয় পাইনা। আমার ভয় শুধু মা-বোনকে নিয়ে।

বাসের মধ্য উচ্চশব্দে গান বাজানো হয়েছে। গানের তালে চিন্তার সুর কাটল ঝুমঝুমির। নীরা-তৃষ্ণাকে দেখতে পেল গানের তালে-তাল মিলিয়ে হাত নাচাচ্ছে। দুজনের সিটে গাদাগাদি করে তিনজন বসেছে। নীরা মধ্যখানে বসে হাতের সাথে মাথাও নাচাচ্ছে। বিরক্তি হলো ঝুমঝুমি বলল, নাচ থামাবি?
-” আজকে একটু আনন্দ করতে দে জান। ট্যুর জীবনে বারবার আসেনা। জানিস আমার জীবনে ট্যুর কিংবা প্রেম সহজে আসেনা। যখন আসে তখন হয়তো আমি বিজি থাকি তাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।

ঝুমঝুমি হেসে দিল। বিষণ্ণভাব সরিয়ে দিয়ে ঠাট্টা করে বলল, তৃতীয় তলার সেই ভাড়াটিয়ার কী খবর ? মানতে হবে ছেলেটার হিম্মত আছে নাহলে বাবাকে ফোন জানায় সে প্রেম করতে এসেছে?

লজ্জায় হিমশিম খেয়ে নীরা। শুরু থেকেই হিরণের প্রতি ওর অন্য রকম ফিলিংস কাজ করতো সেদিনের পর থেকে তো হিরণের বেপরোয়া কথায় মন দেওয়া প্রায়। নীরাকে লজ্জা পেতে দেখে তৃষ্ণা ওড়নাখানা নীরার মাথায় ছাপিয়ে ধা’ক্কা মে’রে বলল, “দূল্হে কা সেহরা
সুহানা লগতা হৈং
দুল্হন কা তো দিল
দীবানা লগতা হৈং”।

নীরা লজ্জায় মুখ লুকালো ঝুমঝুমির কাঁধে। হিরণের কাছ থেকে অনুভুতি লুকাতে পারলেও বান্ধবীদের কাছ থেকে পারলো না। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাসার আসার পূর্বে হিরণের ভরাট কণ্ঠে পিছনে তাকিয়ে থমকে গিয়েছিল কয়েকমুহূর্ত। ওদের ওড়না নেওয়ার সময় যখন জোর করে বাসায় ঢুকে সেদিনও ক্রাশ খেয়ে বসে হিরণের কথা শুনে। তারপর ওদের বাসায়,ছাদে দেখা, বাজারে দেখা সবকিছুতে হিরণের বেপরোয়া দুষ্টু হাসিতে মনের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল প্রেম-প্রেম ফিল। প্রচুর পরিমাণে ড্রামা সিরিজ দেখার ফল বলে আখ্যায়িত করেছিল ঝুমঝুমি । কিন্তু তাতে কি অনুভুতি তো মিথ্যা নয়। বান্ধবীর এহেন কথাবার্তা শুনে ঝুমঝুমি বলেছিল আগেই বলে দিসনা দেখ ছেলেটা টাইমপাস করছে নাকি সত্যিই বলছে। মেনে নেয় নীরা ঝুমঝুমির কথা। সহজে অনুভূতি প্রকাশ করবে না। সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশিত করবে।

আচারের প্যাকেটে ঠোঁট ডুবিয়ে দৃষ্টি রাখল চলন্ত বাসের বেগে চলতে থাকা রাস্তায়। মেঘের ম্যাসেজের কথা বেমালুম ভুলে বসল ঝুমঝুমি। আবহাওয়া ভালো, আকাশ পরিষ্কার কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। ধানের জমিগুলো কাঁটা হচ্ছে। ভুট্টা ক্ষেতের পাশ দিয়ে দুটো বাচ্চাকে দৌড়াতে দেখল ঝুমঝুমি। বাচ্চা ছেলেটির মাথায় বড় চওড়া বল যা গামছা দিয়ে বেঁধে দেওয়া, মেয়েটির হাতে ছোট্ট কলসি ও মগ বুঝাই যাচ্ছে ভাত নিয়ে যাচ্ছে দুজন। বাস থামলো সেখানে। গ্রামের দিকে ছোট্ট রেস্তোরায় দুপুরের লাঞ্চ সারতে হবে। একে-একে সবাই নামছে ঝুমঝুমিও নামলো। মনটা নিমিষেই ফুরফুরে লাগল। মনের তীব্র ব্যাথাটা হাওয়া মিঠাইয়ের মত উবে গেল। তৃষ্ণা-নীরা পিছনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ওয়াও কত সুন্দর। আমাকে যদি বলা হয় এখানে সারাজীবন থাকার জন্য আমি এক পায়ে রাজি। জায়গাটা রোমাঞ্চকর।

কাঠ,বাঁশ দিয়ে বানানো রেস্তোরাঁ। কাপলদের জন্য হার্ট লাভের বিশাল বসার জায়গা। রেস্তোরাঁর নিচে পুকুর। খাবার ফেলার সাথে-সাথে মাছদের আগমন। মাছের আকৃতিতে বানানো ডলফিন। ডলফিনের মুখ থেকে ঝরছে পানি। ছোট-ছোট একুরিয়ামের রঙিন মাছগুলো সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঙিন পর্দা, নানান রঙ মিলিয়ে তৈরি রেস্তোরাঁ। বিশ্রামের জন্য রয়েছে রুম। নীরা ঘুরে ঘুরে হাঁটছে। ওরা যাবার পর-পরেই ওয়েলকাম ড্রিংস হাতে তুলে দিল। রেস্তোরাঁ থেকে সোজা পুকুরে যাবার জন্য কাঠের সিঁড়ি। ওরা তিনজন সেখানে গেল, নীরা প্লাজু উচুঁ করে পা ডুবালো সেখানে। মাঝখান থেকে গান ধরল সিলেটি ভাষায়, আমার প্রেমর সাগর গো
আহ্লাদের টুখরা গো
আমি মন দিমু দিল দিমু
তুমি খতা রাখলে গো ।

তৃষ্ণা হেসে দিল। ঝুমঝুমিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মেয়েটা প্রেমে পাগল হয়ে গেছেরে ঝুমি। দেখ কিসব দেওয়া-নেওয়ার কথা বলছে। মনে হচ্ছে খুব শীগ্রই আমরা খালামণি হয়ে যাব।

পানি ছিটিয়ে গরম চোখে তাকাল নীরা। ঝুমঝুমি হেসে গড়াগড়ি। ঝুমঝুমিকে মন খুলে হাসতে দেখে দুজনে মুগ্ধ হলো। কত বছর পর মেয়েটা এভাবে হাসছে কে জানে? অবশেষে ঘুরতে আসাটা স্বার্থক। গম্ভীর মেয়েটার মনকে শিশুসুলভ বানাতে পেরে দুজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

দেশী মুরগীর ঝোল, কলা ভর্তা, সবজি ও চিকন চালের ঝরঝরে ভাত। তৃপ্তি সহকারে খাবার খেল সবাই। খাবার খেয়ে বিশ মিনিট রেস্তোরাঁয় ঘুরাঘুরি করে আবারও বাসে উঠল সকলে। বাস চলল আপন-গতিতে তার নিজ গন্তব্যে।

বিকাল হয়ে আসলো। সকলের আড়ালে চলন্ত বাসে ইশারায় আসরের নামাজ আদায় করল ঝুমঝুমি। সবকিছু আমল হয়তো করতে পারে না-ও কিন্তু নামাজ ছাড় দেয়না। মেয়েদের ব্যাক্তিগত সমস্যা বাদে সজ্ঞানে নামাজ বিলম্বিত করে না।

সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামলো। পুরনো জমিদার আমলের বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ঝুমঝুমি অবাক হলো ভীষন। ডিপার্টমেন্ট ট্যুর হয় একদিনের জন্য। দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করা হয় কিন্তু ওদের ট্যুর ভিন্ন রকম ঠেকছে ওর। ডিপার্টমেন্ট ট্যুর নিয়ে আগ্রহ না থাকায় কোথায় যাবে জানতো না-ও। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল, আজব তো? এখানে আনলো কেন?

তৃষ্ণা ও নীরা দুজনেই হতবাক। তারাও জানে না বিস্তারিত। ঘুরাঘুরি ইচ্ছে থাকা সত্বেও টাকার চিন্তা ছিল প্রথমে। ওদের আর্থিক অবস্থা ভালো। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট ট্যুরের ফী ছিল পাঁচ হাজার টাকা প্রতিজনে। যা ওদের সীমার বাইরে। ঝুমঝুমি অসুস্থ্য বিধায় একদিন ও ক্লাস করতে যেতে পারেনি সেদিনই ডিপার্টমেন্টের প্রধান হাবিবুর রহমান স্যার ওদের ডেকে পাঠান। বলেন, ঝুমঝুমিকে নিয়ে ট্যুরে যেতে। নীরা-তৃষ্ণা জানায় ওদের কাছে এতগুলো টাকা হবে না তখন ডিপার্টমেন্টের প্রধান মুচকি হেসে বলেন, তোমরা তিনজন দুহাজার টাকা দিলে হবে তবে শর্ত হলো একথা কাউকে বলবে না। এমনকি ঝুমঝুমিকে পর্যন্ত না।ডিপার্টমেন্টের স্যার’রা বলেন, ঝুমঝুমি মেয়েটা পড়াশোনায় বড্ড ভালো কিন্তু ক্লাসে সবসময় চুপচাপ, ক্লান্তিকর, বিষাদময় মুখশ্রী নিয়ে থাকে, হাসে না। মেয়েটার আর্থিক সমস্যা আমরা জানি তাই তোমাদের তিনজনের জন্য এইটুকু ছাড়। মেয়েটাকে ঘুরতে নিয়ে যাও দেখবে প্রকৃতির হাওয়ায় নিরাশ মুখটি সতেজ হবে।

স্যারের কথা শুনে দুজন সেদিন স্যারে’র প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ঝুমঝুমির ব্যাক্তিগত সমস্যা ওরা দুজন জানে, বাইরের মানুষ শুধু আর্থিক সমস্যার কথা যাবে। মনেমনে সেদিন যতনা খুশি হয়েছিল কিন্তু আজ ঠিক ততই ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রতিজনে পাঁচ হাজার টাকা একটি পরিকল্পনা যেন বেশি মানুষ না হয়। যারা ঘুরাঘুরির শখ, টাকার অভাব নেই তারা ব্যাথিত এ ট্যুরে কেউ আসবে না। নীরা তো ভয় পেয়ে কান্না করে দিলো। তৃষ্ণাকে বলল, আমাদের কী পা’চা’র করে দিয়েছে? লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। কেন যে রাজি হলাম সেদিন।

তৃষ্ণা যে ভয় পাচ্ছে না তা নয়। সেও ভয় পাচ্ছে পাশ ফিরে ঝুমঝুমিকে দেখে দিঢ় সাহস যুগিয়ে বলল, তোর ভয় করছে ঝুমি?

মাথা ঝাঁকাল ঝুমঝুমি। বলল, না, ভয় হচ্ছে না তবে সন্দেহ হচ্ছে। আমি একশো পার্সেন্ট শিউর আমরা ট্যুরে আসিনি। এখানে আসার প্ল্যান ভিন্ন। তাছাড়া আমাদের এখানে এনেই বা কী লাভ? পা’চা’র করবে না কারণ আমাদের সাথে আসা ছেলেমেয়েরা ধনী পরিবারের। পা’চা’র কিংবা খারাপ কাজে ব্যাবহার করলে কলেজের সম্মান থাকবে না। ব্যাপারটা অন্যকিছু। কিন্তু কী?

-” বাব্বাহ ভাবীর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় কত সহজে বুঝে গেল আমাদের পরিকল্পনা। ভাবী আপনার বান্ধবীকে একটু বুদ্ধি ধার দিন বেচারি ভীষন বোকা।

যেদিক থেকে শব্দ আসলো ওরা তিনজন সেদিকে তাকালো। তিনজন স্তব্ধতারূপে চেয়ে থেকে বলল, তিন তলার ভাড়াটিয়া চার ছেলে!

##চলবে,,

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৮]

যেদিক থেকে শব্দ আসলো ওরা তিনজন সেদিকে তাকালো। তিনজন স্তব্ধতারূপে চেয়ে থেকে বলল, তিন তলার ভাড়াটিয়া চার ছেলে!

আষাঢ় শব্দ করে হাসলো। বিমোহিত দৃষ্টিতে ঝুমঝুমিকে দেখে যাচ্ছে ও। ঝুমঝুমির সেদিকে অভিব্যাক্তি প্রকাশ পেল না। বরং সন্দেহ ভ্রু কুঁচকালো।
-” আপনারা এখানে?

~কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল , তোমারে চাই :

মিরাজের কণ্ঠে কবিতা শুনে বাকি সবাই ভ্যাবাচেকা খেল। নিজাম কবিতা বলে সর্বক্ষণ। ওর কাছ থেকে এরূপ প্রশ্নে কবিতা বলা আশ্চর্যজনক কিছু নয় কিন্তু মিরাজের কাছ থেকে এরূপ আশা করা বোকামি।
কপালে ভাঁজ পড়ল তৃষ্ণার। মিরাজকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কাটকাট কণ্ঠে বলল, আপনার বন্ধু আবোলতাবোল কবিতা বললেও নিজে বানিয়ে বলে কিন্তু আপনি তো দেখছি জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিজের নামে মেরে দিচ্ছেন। ধুরন্ধর কপিবাজ।

মিরাজ মুখ খুলতে যাবে আষাঢ় থামিয়ে দিল। ঝুমঝুমি তখনো ঠাওর করতে পারছে না এখানে নিয়ে আসার কারণ। ঝুমঝুমির সন্দিহান মুখশ্রী দেখে নির্বিকার ভাবে বলে উঠল আষাঢ়, আমি তোমায় পছন্দ করি ঝুমঝুমি। ভালোবাসা বললে ভুল হবে না।

তিক্ততায় বিষিয়ে উঠল ঝুমঝুমির মুখশ্রী। কণ্ঠে তেজ বজায় রেখে বলল, আমরা এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাব।

দুহাত বুকে ভাঁজ করে ফিচেল হাসলো আষাঢ়। বলল, অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে এনেছি তোমাদের, সহজে যেতে দিবো ভাবলে কি করে? যাও অনেকক্ষণ জার্নি করেছ বিশ্রাম করো গিয়ে। বাম পাশের রুমটি তোমাদের। পালাতে হলে বুদ্ধি দরকার, ক্লান্ত শরীরে মাথায় বুদ্ধি আসবে না।

আষাঢ়ের কথা মনে ধরল ঝুমঝুমির। অসাড় শরীরে শত্রুদের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। সুস্থ থাকতে হবে। পায়ের গতি বাড়িয়ে বান্ধবীদের উদ্দেশ্য বলল, রুমে চল। বিশ্রাম নিয়ে ভাববো কী করা যায়।

নীরা চলে যাবার সময় আলগোছে হিরণ হাতে ছুঁয়ে দিল। শিহরিত হলো পুরো শরীর। নীরা কঠিন দৃষ্টি ফেলতে গিয়েও পারলো না। হিরণের চোখে-চোখ রাখার অবস্থায় ও নেই। মনে মনে বলল, ভালোই হয়েছে এখানে এসে। নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারব। মনেমনে এটাও ঠিক করল কয়েকদিন থেকে যাবে এখানে। তৃষ্ণা-ঝুমঝুমিকে যেভাবেই হোক বুঝাবে।

______________

গোলাকার আকৃতির চাঁদ। ঝকঝকে-ফকফকা আকাশ, অজস্র নক্ষত্রের ভিড়। নারিকেল গাছের ফাঁক দিয়ে আলোকবিন্দু ছিটকে পড়ছে রুমে। লম্বা চুল ছেড়ে দিয়ে টুলের উপর জানালা বরাবর মুখ করে বসলো ঝুমঝুমি। গায়ে চাঁদের আলো উপচে পড়ছে। তৃষ্ণা মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে দেখছে অপরূপা সুন্দরী ঝুমঝুমিকে। সৌন্দর্য দ্বিগুণ ভাবে বেড়েছে চাঁদের আলোতে। নীরা, ঝুমঝুমির পাশে বসলো। প্রজ্বলিত নিরাভরণ কণ্ঠে বলল, চাঁদ কন্যা। আমি নিজেই বেহুস হয়ে যাচ্ছি তোকে দেখে।

ম্লান কণ্ঠে বলল , চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে। চাঁদের কন্যার গায়েও কলঙ্ক। ব্যাপারটা দারুণ না?

মুহূর্তেই দুজনের মুখের হাসি মিলে গেল। চাঁদখানা মুখে ফুটলো তৃপ্তির ছোঁয়া।
-” এখন কি করবি ঝুমি? আমরা তো বন্দী এখন।

তৃষ্ণার কথা শুনে ফিচেল হাসলো ঝুমঝুমি। এতক্ষণ ধরে অনেক কিছু ভেবে চলেছে ও। আষাঢ়ের প্রেমের প্রস্তাব ওর মনে আঘাত করতে পারেনি। বসন্তের বাইশ বছরে কম প্রপোজাল তো পায়নি তাই এসবে কৌতুহল ওর নেই। আপনলোকদের যেখানে পাত্তা দিচ্ছে না সেখানে আষাঢ় তো দূর ছাই। প্রেম ভালোবাসা ওর হৃদয়ে ঢুকতে পারে না, বিষাদময় লাগে এসব তাই হয়তো কারো প্রতি আকর্ষণ খোঁজে পায়না। তবে এখন যেতে চাইলে যাওয়া সম্ভব নয় এখান থেকে। ভার্সিটির প্রধান যেখানে জড়িত । মাঠে নেমেই ওদের এখানে আনা হয়েছে খুব ভালো বুঝতে পেরেছে ঝুমঝুমি। ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখে নীরার পানে দুষ্টুমির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, নীরু বেবি এবার তোমার পরীক্ষা। প্রেমিক শুদ্ধ না অশুদ্ধ বুঝার সময় হয়েছে। লেগে পর প্রেমিক নামের হিরণের প্রতি তবে মনে রেখো অতিরিক্ত কিছু করা যাবে না। প্রেমিক যতই সাদু হোক বিশ্বাস সহজে আনা যাবে না। ছেলে মেয়ে একসাথে থাকা মানে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অঘটন করা। আই হোপ তুই বুঝতে পারছিস।

নীরা ঠোঁট কামড়ে বাঁকা সুরে বলল, আমার চরিত্র নিয়ে তোর অবিশ্বাস আছে?
-” একদমই না। কিন্তু তুই ভীষন আবেগী। সব আবেগ দিয়ে ঠিক করিস। মানুষ আবেগের বশে অনেক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। আবেগ শব্দটি যতনা ভালো তারচেয়ে দ্বিগুণ অসহ্য।

তৃষ্ণা মনোযোগ শ্রোতার হয়ে শুনলো। ঝুমঝুমির কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো না। নিজের চোখে অনেককে দেখেছে প্রেমে জড়িয়ে আবেগের বশে প্রেমিকের কাছে নিজের সম্মানকে বিলিয়ে দিতে। নীরা সহজ সরল মেয়ে। ওকে যে কেউ দু চারটে মন ভুলানো কথা বললেই গলে যাবে। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
-” দুদিন এখানে থাকতে হবে?
-” আসছি যেহেতু থেকে যাই। আমিও দেখতে চাই ওরা কতদূর যেতে পারে।
-” এখন কী করব?

তৃষ্ণার প্রশ্নে ঝুমঝুমি ভাবতে বসল। ভেবে চিন্তে ঠোঁটের কোণায় ফুটল মিষ্টি হাসি। চুলগুলো খোঁপা করে আনমনে বলল, চল বাহিরে। জমিদার বাড়ি কিন্তু ভুতুড়ে টাইপ হয়। ভৌতিক শিহরিত ভাব গায়ে মাখি।

নীরা ভয়ে আড়ষ্ট হলো। ভূত অবাস্তব কাহিনী কিন্তু তবুও মনের ভিতরে রয়েছে ভয়ের সাগর। ক্রন্দন মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, রাত করে যেতে হবে?
-” রাতেই যেতে হবে।

বেরিয়ে পড়লো তিনজন। তবে ঝুমঝুমির মনে চলছে অন্যকিছু। মনের ভিতরে সৃষ্টি সন্দেহটা বান্ধবীদের সাথে শেয়ার করল না ইচ্ছে করে। সেও জানতে চায় ওর সন্দেহ কতখানি ঠিক না বেঠিক।

_________

থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে চারজন শুয়ে বসে আছে রুমের মধ্যে। মিরাজের দুহাত মাথার পিছনে রেখে হাঁটুর উপরে হাঁটু রেখে হিরণেকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই শিওর হিরণ?
-” একশো ভাগ শিওর।
-” আবারও ভেবে দেখতে পারিস। মেয়েটা ভীষন ভালো আমরা চাইনা মেয়েটার কোনো ক্ষতি হোক।

কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল আষাঢ়ের। হিরণ জানের বন্ধু হলেও বন্ধুর মতিগতি সম্পর্কে ওরা সবাই সবকিছু জানে। প্লেবয় হিরণের সত্যিই প্রেমে পড়া নিয়ে চিন্তিত বাকি তিনজন। গলা ঝেড়ে বলল আষাঢ়, মিরাজের কথায় আমিও একমত হিরণ। যাই করিস ভেবে চিন্তে। কিছুদিন সময় নেওয়া দরকার।

শোয়া থেকে বসল হিরণ। চোখেমুখে রাগের আভাস। মুখের ভাষা সাবলীল রেখেই বলল, আমার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র। আমি যাদের সাথে প্রেম করেছি সবকটাই টাকা দেখে আমার সাথে ডেট করছে। এমনকি টাকার জন্য বেড পার্টনার হতেও চেয়েছিল। তাই ছেড়ে দিছি। নীরাকে নিয়ে আমি সত্যিই সিরিয়াস। আব্বার সাথে এনিয়ে কথা হইছে। বলছে ইলেকশন শেষ হওয়ার পর বিয়ার প্রস্তাব পাঠাবে।

অনেকক্ষণ ধরে মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল নাজিম। বন্ধুদের ঝামেলায় কবিতারা মাথায় আসছে না। অনেকক্ষণ ধরে তিন বন্ধুর প্যাচাল সহ্য করে বলল, ভাই কইনে আনছস আমারে? হাগতে মুততে যাইতে পারি না। জঙ্গলে এসব করা যায়? সাপ টাপ থাকলে তখন কী হইবো? জমিদাররা খবিশ ছিল নাকি? হাগা মুতার জায়গা বাইরে বানাইছে ক্যান। চাপের ঠ্যালায় কবিতা আসেনা মাথায়।

হিরণ টিপ্পনী কেটে বলল, ভালোয় হলো বল। তোর ছাগল মার্কা কবিতা থেকে দুদিন মুক্তি পাব।

গায়ে মাখলো না নাজিম। বলল

“আসুক হাগা মুতা কিংবা পাদ,
তোদের সামনেই ছড়াবো আমি দুর্গন্ধের ঝাঁক।।”

নাক ছিটকে সরে পরল তিনজন। নাজিম বিজয়ের হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। এখন আর থাকা যাচ্ছে না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই ছুটল জমিদার বাড়ির শৌচাগারে।

ফোনে নেটওয়ার্ক না থাকায় রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল আষাঢ়। জরুরী ফোন দেওয়ার প্রয়োজন। ওদিকে কী হচ্ছে জানতে হবে এদিক সেদিক হলেই এতদিনের রেপুটেশন শেষ হয়ে যাবে। বাবার সামনে মাথা তুলে তাকানোর সাহস থাকবেনা। ঠান্ডা মাথায় ওর সাগরেদ রিয়াদের সাথে কথা শেষ করতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলালো। চোখের সামনে ঝুমঝুমিকে দেখে পলকহীন ভাবে চেয়ে রইল। সাদা কুর্তি, মাথায় সাদা পাতলা ওড়না। বেগতিক পরে যাওয়ার ফলে খোঁপা করা চুলগুলো রাশিরাশি করে খুলে গেল। আষাঢ়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝুমঝুমি আড়ষ্ট হয়ে অস্বস্তিবোধ করল। আষাঢ়ের খেয়াল হলো সে জড়িয়ে ধরেছে ঝুমঝুমিকে। বাঁধন ছেড়ে দিয়ে লজ্জিত হয়ে বলল আষাঢ়, সরি আমি দেখিনি। ব্যাথা পাওনি তো?

ঝুমঝুমি এতদিন ধরে ভাবত সকল পুরুষ এক। নিজেদের বড় করে তোলার জন্য অন্যদের মাটিতে ফেলতে দুবার ভাবে না। শুধুমাত্র ওর বাবাকে আলাদা ভাবত কিন্তু আজ আষাঢ়ের কাছ থেকে এরূপ ব্যাবহার দেখে এতদিনের চিন্তাভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো।
বলল, না ব্যাথা পাইনি। আপনার সাথে আমার পার্সোনাল কথা আছে।

মাথা চুলকিয়ে আষাঢ় বলল, আসো আমার সাথে।

##চলবে,

আজ বানান রিচেইক করিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে