প্রেয়সীর শব্দপ্রেম পর্ব-০২

0
660

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[২]
মেঘকে সামনে দেখে শরীরের শিরা-উপশিরা রাগে শিউরে উঠল। লোকটা আবারও তার সামনে, কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝেও মনকে প্রশান্ত করার জন্য হেঁটে বাসায় ফিরছিল ঝুমঝুমি। বাস ভাড়ার টাকাটা রাস্তায় অভুক্ত বাচ্চা ছেলেটাকে দিয়ে এসেছে। ভেবেছিল হেঁটে-হেঁটে বাসায় যাবে কিন্তু মেঘকে দেখে তীব্র ব্যাথাটা বাড়তে শুরু করল। মেঘ বাইক থেকে নেমে ঝুমঝুমির সামনে দাঁড়ালো। চোখেমুখে তীব্র রাগ নিয়ে বলল, নিষেধ করেছিলাম টিউশনি করতে। আমার নিষেধের দাম তোর কাছে নাই?

প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল ঝুমঝুমি, আপনার নিষেধাজ্ঞা মেনে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। রাস্তা ছাড়ুন।
-” জেদ ধরে আছিস? এখন আমি যদি তোকে তুলে নিয়ে খারাপ কিছু করে ফেলি তখন কী করবি?

রি’রি করে উঠল ঝুমঝুমি শরীর। কতটা নিচ হলে নিজেরই আপন ফুপাতো বোনের সাথে কেউ এধরনের কথা বলতে পারে। বাড়িতে থাকছে বলে সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে হবে? মেয়ে বলে মানুষ নয় সে? তীব্র থেকে তীব্র ব্যাথাটা মনে আরো চেপে বসলো। ঘৃণায় মুখ সরিয়ে পাশ কেটে যেতে চাইলেও পারলো না। মেঘ পথ আটকে দাঁড়িয়ে রইল।
-” আমায় যেতে দিন।
-” আগামীকাল থেকে টিউশনি সব ছেড়ে দিবি।
-” এক কথা একবার বললে আপনার কানে যায় না তাই না? আমাকে আমার মত চলতে দিন। আমাকে বিরক্ত করবেন না। প্রয়োজন হলে আমি আইনি সহায়তা নিবো।

ঝুমঝুমির কথাতে হো-হো শব্দে হেসে দিল মেঘ। আচমকা ওড়নাটা শক্ত করে ধরে মিশে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকে বিড়বিড় করল, পছন্দ করি বলে সবকিছু মেনে নিবো ভাবিস না। ওকে যা তোর যা ইচ্ছে করতে থাক আমিও দেখে নিবো কতদিন ডানা মেলে উঠতে পারিস।

ঝুমঝুমি সজোরে ধাক্কা দিলো মেঘকে। কিন্তু মেঘকে নড়াতে পারলো না, উপায়ন্তর না পেয়ে জুতো দিয়ে পায়ে চে’পে ধরে আবারও জোরে ধাক্কা দিলো। মেঘ সামান্য ব্যাথা পেয়ে রুষ্ট নজরে চেয়ে রইল ততক্ষণে ঝুমঝুমি জোরে-জোরে পা বাড়িয়ে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠল। মেঘের সাক্ষাৎকারে ভুলে গেল তার কাছে বাস ভাড়াটা পর্যন্ত নেই।

বসার জন্য জায়গা খোঁজে পাচ্ছে না ঝুমঝুমি। মানুষ ভর্তি হয়ে আছে। মাঝ বরাবর একটি সিট খালি কিন্তু সিটের পাশের সিটে বসে আছে একজন ছেলে। ক্যাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা ছেলেটির। ছেলেটির পাশে বসা ছাড়া উপায় নেই,সারাদিনের ক্লান্তিকর দেহটাকে বয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর, বিশ্রাম প্রয়োজন। ব্যাগটা সামনে রেখে গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়ল ঝুমি। চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়তিকে নিয়ে মনে-মনে পরিহাস করল। ভাগ্য বুঝি এতই খারাপ ওর। বাবার মৃত্যুর পর পর সুখ পাখিটা ছলাৎ করে উড়ে গেল বহুদূরে। আত্মীয়রা হয়ে উঠল ভয়ংকর। চাচা,ফুপিদের কথা মনে হতেই হৃদপিন্ড কেঁ’পে উঠল। ভয়ঙ্কর সেই কথা মনে হতেই চোখজোড়া সজাগ হলো।
-” নেও পানি খাও। ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে গেছ।

অপরিচিত পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো পাশ থেকে। ঝুমঝুমির দৃষ্টি সেদিকে যেতেই বিরক্তি প্রকাশ পেলো মুখশ্রী জুড়ে। তৃতীয় তলার চার ছেলের মধ্যে একজন। যে চুপচাপ ফোনে স্ক্রল করেছিল। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না।
-” আপনি এখানে? ফলো করছেন?

মাথায় ক্যাপ পরে কান থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে ভ্রু নাচালো আষাঢ় বলল, কি বললে?
-” ফলো করছেন আমাকে?
-” আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোমায় ফলো করব। এই মেয়ে তুমি ঝ’গড়া ছাড়া কিছু বুঝ না তাইনা।
-” আমি মোটেও ঝ’গড়া করি না।
-” চোর কখনো শিকার করে সে চুরি করেছে?

ঝুমঝুমি বুঝল ছেলেটা ইচ্ছে করে ওকে রাগাতে চাচ্ছে। কথা বলার ফন্দি। ছেলেটার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত রাখলো। মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে বাসায় গিয়ে টাফনিল নিবে।
-” তেজপাতা, এই তেজপাতা শুনো।

ভ্রু কুচকালো ঝুমঝুমি। ছেলেটা ওকে তেজপাতা বলে ডাকছে শুনে আবারও রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, লিমিট ক্রস করবেন না। আমার নাম তেজপাতা নয়।
-” আপনার নাম তো আমি জানি না তাই তেজপাতা বললাম। নাম জানলে অবশ্য না ডাকতেও পারি।
-” আমার নাম ঝুমঝুমি।
-” ঝুমঝুমি কারো নাম হয়? আচ্ছা আপনার চৌদ্দ গুষ্টির নামগুলো বলবেন প্লিজ। দেখি আনকমন নাম পেলে বাচ্চাকাচ্চার জন্য রেখে দিবো।

ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলল ঝুমঝুমি। আষাঢ়ের প্যাচাল ওর সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে জানালা দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে। যতসব অসহ্য ছেলেপিলে।

আকাশে একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে চাঁদও সাথে যাচ্ছে। আষাঢ় মনোযোগ দিয়ে একফালি চাঁদকে দেখে ঝুমঝুমির মুখের দিকে তাকালো। ক্লান্ত,ম্লান,নিস্তেজ অগোছালো মুখশ্রী জুড়ে মায়া বিরাজ করছে। শোঁ শোঁ বাতাসে সামনের চুলগুলো উড়ে চলেছে। ঘন চোখের পাঁপড়ি নেশামোয় ঘোর সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। ঝুমঝুমি চোখ মেলে তাকিয়ে আষাঢ়কে চেয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল। বলল, সমস্যা কী? চেয়ে আছেন কেন?

আষাঢ় ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি দেখতে স্বচ্চ পুকুরের ফোঁটে উঠা পদ্মফুলের মত সুন্দর কিন্তু তোমার কথাবার্তা তেজপাতা ধরনের, খুবই ঝাঁঝ। তেলে ছাড়ার সাথে-সাথে ছ্যাত করে উঠে।
-” আরেকবার কথা বলতে আসলে লোক ডাকবো।

আষাঢ়ের মনে লাগলো কথা। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও মনযোগ দিল আকাশের এক ফালি চাঁদের পানে।

বাস কন্ট্রাক্টর তাড়া দিচ্ছে বাস ভাড়ার জন্য। ঝুমঝুমির মনে পড়ল তার কাছে ভাড়া নেই। মুখটা ভয়ে,লজ্জায় চুপসে গেল। কন্ট্রাক্টর যদি এখন লজ্জায় ফেলে সবার সামনে। আমতা আমতা করে বলল, মামা পিছন থেকে নিয়ে আসুন আমি দিচ্ছি।

কন্ট্রাক্টর মামা পিছনে চলে গেল। ঝুমঝুমি পাশে বসা আষাঢ়ের পানে তাকিয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভীতু গলায় বলল, আপনার কাছে ত্রিশ টাকা হবে?

আষাঢ় শুনেও না শোনার ভান ধরে অন্যপাশে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ আগের অপমানটা এখনও ভুলেনি ও। ঝুমঝুমি উপায় না পেয়ে আষাঢ়ের হাতে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, বাসায় গিয়ে দিবো প্লিজ। আমার সম্মানটা বাঁচান।

ঝুমঝুমির আকুতি ভরা কণ্ঠ শুনে আষাঢ় টাকা বের করে কন্ট্রাক্টরের হাতে দিয়ে দিল কিন্তু ঝুমঝুমির সাথে কথা বলল না। সপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমঝুমি বলল,থ্যাংকস।

জড়তা কাজ করছে ঝুমঝুমির। মনের ভিতরে অপরাধবোধ বেড়েছে। মনে হচ্ছে ছেলেটাকে তখন ওভাবে না বললেই ভালো হতো। বাস যখন গন্তব্য স্থলে এসে দাঁড়ালো ঝুমঝুমি উঠে দাঁড়ালো। বাস তখনও ধীরে ধীরে যাচ্ছে। ঝুমঝুমি তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে গিয়ে সামনের সিটের এক লোকের পায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে আষাঢ়ের উপরে ছিটকে পড়ল। চোখ বন্ধ করে আষাঢ় বিড়বিড় করে বলল, মরে যাচ্ছি।

ঝুমঝুমি উঠে দাঁড়াতে চাইলে আষাঢ় খপ করে হাত ধরে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে, খবরদার উঠবে না। বাস থামুক তারপর নামবে। তোমার জন্য বারবার ব্যাথা পেতে পারব না। জানো কোথায় ব্যাথা লেগেছে?

ঝুমঝুমি লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো সে জানে আষাঢ় কোথায় ব্যাথা পেয়েছে। ছেলেটার লজ্জায় বলতে কিছু নেই। বড় গলায় আবার বলতে চাচ্ছে।
-” আই অ্যাম স্যরি।
-” স্যরি বললে হবে না। আগামীকাল আমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। বলা তো যায়না তোমার হাতের ঘড়ির চাপে আমার ভবিষ্যত্ প্রজন্ম বাড়ানোর মেশিন অকেজো হয়ে গেলে তখন দায়ভার তোমারই নিতে হবে।

আষাঢ়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল ঝুমঝুমি। বাস থেমে গেছে। তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে সোজা রাস্তায় হাঁটা দিলো। আষাঢ়ের ভয়ংকর কথাবার্তা বারবার রিপিট করছে কানে। পিছন থেকে আষাঢ় ডেকে যাচ্ছে। ঝুমঝুমির সেদিকে নজর নেই দ্রুত হেঁটে বাসায় পৌঁছেই কলিং বেল বাজাল। তৃষ্ণা ও নীরা দাঁড়িয়ে-ই ছিল ওর জন্য। শব্দ পেয়ে দরজা খুলতেই ঝুমঝুমি তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জোরে দম ছাড়ল।

তৃষ্ণা বলল, আজ এত দেরি হলো কেন তোর? ভয় পাচ্ছিলাম আমরা।

নীরা রেগে গিয়ে বলল, তোর ফোন কই? ফোন যাচ্ছে না কেন?

ফ্লোরে মাদুর বিছানো। ঝুমঝুমি সেখানে ধপাস করে বসে পড়ল। ইশারায় বুঝাল পানি আনতে। তৃষ্ণা পানি আনলো। নিমিষেই সবটুকু শেষ করে সব ঘটনা খুলে বলল। ফোনের কথা বলাতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। ফোন সুইচ অফ। কখন হয়েছে জানে না। তৃষ্ণা ও নীরা রেগে গিয়ে বলল, তোর কাছে টাকা নেই তাহলে ছেলেটাকে দিতে গেলি কেন?
-” বাচ্চাটা না খেয়ে ছিল তাই।

দুজন হতাশ হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। ঝুমঝুমির সম্পর্কে ওরা সব জানে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নীরা বলল, বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। তোর পিছনে তাকা ঝুমি।

ঝুমঝুমি পিছনের তাকিয়ে চোখ দুটো বড়বড় করে বলল, কী হয়েছিল এখানে?

##চলবে,

[ভুল বানানগুলো কমেন্ট বক্সে ধরিয়ে দিবেন। আজ রি-চেইক করিনি। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে