#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[৬]
শুক্রবারে বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলেও আজ নীরা উঠে পড়ল সকাল-সকাল। জম্পেশ ঘুম হয়েছে আজ। চিন্তার পাখিরা ডানা মেলে চলে গেছে বহুদূরে। বহুদিন পর সুখের আবেশ পেয়ে ঘুম হয়েছে দারুণ। দুহাত উপরে তুলে হামি হয়ে পিটপিট করে চোখ খুলল। এক্ষুনি ফ্রেশ হতে হবে। হাতে সময় খুবই কম। চট-জলদি ফোনটা হাতে তুলে তৃষ্ণাকে বলল তাড়াতাড়ি তৈরি হতে উদ্দেশ্য ঝুমঝুমির বাসা।
মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে ঝুমঝুমি। বেশিরভাগ সময় ই শাড়ি পরে থাকতে হয় ও’কে। শাড়ি পরে থাকার যথাযথ কারণ আছে। কারণটি হলো হঠাৎ ই একদিন সেলোয়ার কামিজ পড়া ঝুমঝুমিকে দেখে ফেলে ভাড়াটিয়া এক মহিলা। তখন ওনি ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজছেন। ঝুমঝুমি তখন ওই এলাকায় নতুন এসেছে। প্রথম দেখাই পছন্দ করে ফেলেন মহিলা ঝুমঝুমিকে। কথা নেই বার্তা নেই সুযোগ বুঝেই একদিন ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন ঝুমঝুমির বাসায়। হঠাৎ মেহমান আশায় ভরকে যায় ঝুমঝুমি। ভিতরে প্রবেশ করিয়ে নাস্তা সামনে রাখতেই মহিলাটি বলেন, তোমার মায়ের সাথে কথা আছে একটু ডেকে দেও তো মা।
ঝুমঝুমি আন্দাজ করতে পারে কিছুটা তবুও ক্ষীণ গলায় বলে,আমার মা নেই চাচী।
আশাহত হলেন মহিলা। অত্যান্ত কষ্টে ঝুমঝুমির মাথায় ভরসার হাত রেখে বললেন, তুমি একা থাকো মা?
নড়েচড়ে উত্তর দিলো ঝুমঝুমি, না চাচী। আমার সাথে আমার মেয়ে ও আমার একজন খালা থাকে।
ভরসার হাত গুটিয়ে নেয় মহিলা। অবাক হয়ে জানতে চায়,তুমি বিবাহিত? স্বামী কি করে?
-” কার অ্যা’ক’সি’ডে’ন্টে মা’রা গেছে আমার স্বামী। মেয়েকে নিয়েই থাকি।
মুখটা চুপসে যায় মহিলার। যতই পছন্দ হোক তাই বলে ছেলের জন্য বিধবা মেয়ে ঘরে তুলবেন না ভেবে উঠে দাঁড়াতেই বাগড়া দেয় মহিলাটির ছেলে। ঝুমঝুমিকে মনে ধরেছে তার। মায়ের বিপক্ষে গিয়ে বেলেহাজের মতোই বলে ফেলে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
ঝুমঝুমি বাঁকা হেসে মহিলাটিকে বলে, চাচী আপনার ছেলেকে নিয়ে যান। ওনার মাথায় সমস্যা আছে।
মহিলাটি ফোঁস করে দম ছেড়ে জোর করে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন বিরক্ত করে ছেলেটি, বাধ্য হয়েই বাসা পরিবর্তন করে ঝুমঝুমি। সেলোয়ার কামিজের পরিবর্তে শাড়ি বেছে নেয় নিজেকে বিবাহিত জানানোর কৌশল হিসেবে।
-” মাম্মা তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে।
শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে ঝিনুক বলে উঠে। ঝুমঝুমি মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলে, তোমার আন্টিরা চলে আসবে। ওদের বিরক্ত করবে না কেমন?
বাধ্য মেয়ের মতোই মুখের হাবভাব ধারণ করে বলে, আমি তো ভদ্র মেয়ে দুষ্টুমি করি? একটুও না। তুমি কেনো আমায় দুষ্টু বললে। আমি লেগে (রেগে) গেছি। আমার লাগ(রাগ) হচ্ছে।
ঝিনুক গাল ফুলালো। আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকাতেই অসাড় হয়ে আসলো মন। ঝিনুক তখন হাতের আঙ্গুল কা’ম’ড়ে ধরেছে। একজনের কথা মনে পড়ল। লোকে বলে, রক্ত কথা বলে। রক্তের থেকে যতই দূরে থাকা যায়না কেন আত্মিক উদ্দীপনা বলে দেয় রক্ত ঠিকই তার উদিস নিজে থেকেই আয়ত্ব করে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘামের দেখা মিলল। আঁচল দিয়ে মুছলো ঘাম। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল, আমি বলেছি না এভাবে মুখ ফুলাবে না। আঙুল সরাও মুখ থেকে। ব্যাড হ্যাবিট জানো না।
-” কেন মাম্মাম? পঁচা লাগে আমায়?
মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল ঝুমঝুমি। মেঘেরা ঘিরে ধরল ছোট্ট ঝিনুককে। কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলল, ইচ্ছে করে না এমনি-এমনি হয়ে যায়।
-” আচ্ছা। তুমি সোফায় গিয়ে বসো। আন্টিরা চলে আসবে।
ঝিনুক দেরি করল না। দৌড়ে গিয়ে ড্রইংরুমে বসলো। ঝুমঝুমির কপালে ভাঁজ পড়ল। সে চায়না মেয়েটা ওই মানুষটার মত হোক। নিজের মতো গড়ে তুলছে মেয়েটাকে কিন্তু হঠাৎ করেই ঝুমঝুমির মনে হচ্ছে মেয়ের মাঝে সে আরেকজনকে দেখছে। ভিতরটা তেতো হলো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। অনুভুতি ভোঁতা হতে শুরু করল।
ড্রইংরুমে মানুষে গিজগিজ। পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল ঝুমঝুমি। রান্নাবান্না হালিমা খালার হাতে ছেড়ে ছুটে আসলো ড্রইংরুমে। মিরাজ,নাজিম,হিরণ ও আষাঢ়কে দেখে আশ্চর্য হলো। এদের তো আসার কথা নয় তাহলে। আষাঢ় দেখল ঝুমঝুমি নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী পারের মেরুন রঙের শাড়ি। আঁচল কোমরে গুঁজে রাখা, হাত পেঁচিয়ে খোঁপা করা,কয়েকটি ছোট ছোট চুল কপাল ছুঁয়ে গালে ছড়িয়ে রাখা। কানে ছোট পাথরের দুল, গলা শূন্য,হাত শূন্য, ঠোঁট হালকা গোলাপি। আষাঢ় বুঝল ঝুমঝুমির ঠোঁটে লিপস্টিক নেই ওইটা আসল। আষাঢ়ের স্বাদ জাগলো সে যদি শাড়ি হতো তাহলে এই ললনার অঙ্গে লেপ্টে থাকতে পারতো, নিতে পারতো মাধকীয় সুঘ্রাণ। ইচ্ছে জাগলো কানের দুল হতে। তুচ্ছ দুলগুলো প্রেয়সীর কাছে যেতে পারে কিন্তু সে? টের পেলো সে লজ্জা পাচ্ছে। মেয়েদের মতন লজ্জা। গুটিয়ে রাখলো উত্তেজনা। যদি ঝুমঝুমি ধরে ফেলে এই ভয়ে। চমৎকার সুন্দরীরা বোকাসোকা হয় কিন্তু ওর সামনে থাকা মেয়েটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ বোকা কিনা সন্দেহ। ঝুমঝুমির চোখের দৃষ্টি বলছে সে এখনও অবাক হওয়ার দেশ ছাড়তে পারেনি। আষাঢ়ের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটলো। হিরণের কাছ থেকে জেনেছিল আজ তৃষ্ণা-নীরা আসবে ঝুমঝুমির বাসায়। সুযোগ হাতছাড়া করল না আগেভাগে রেডি হয়ে রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নীরা-তৃষ্ণাকে নিয়ে চলে এসেছে। তৃষ্ণা-নীরা বারণ করতে গিয়েও করল না ওরা চায় আষাঢ় ঝুমঝুমির একটা সম্পর্ক হোক।
-” আপনারা এখানে? বলেন নি তো আগে? তোরাও তো বলিস নি!
তৃষ্ণা-নীরাকে কঠিন কণ্ঠে বলল। ওরদিকে পাত্তা দিলো না কেউ। তবে নাজিম বলল, তাড়িয়ে দিচ্ছ ঝুমঝুমি? তোমার হাতের রান্নার জন্য আজকে চীট ডে পালন করছি।
ভ্রু কুঁচকে আসলো মিরাজের খেঁক করে বলল, তোর তো প্রতিদিনই চীট ডে।
ঠোঁট ওল্টালো নাজিম। গানের সুরে সুরে বলতে লাগলো,
আমাকে আমার মত থাকতে দাও,
আমি খাবারকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।
যেটা পারিনা সেটা না পারাই থাক,
ডায়েট করা কষ্ট ভীষন।
খিদের জ্বালায় জীবন ছারখার,
তবুও খেয়েছি মোটে দুবার।
আমি যে খেতে চাই আরও বারবার।
রান্নার হাত ভীষন ভালো ঝুমঝুমির,
বেরিয়েছে সুমধুর ঘ্রাণ অস্থির,
তাই চাই খেয়েদেয়ে জীবন পারাপার।
অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো সকলে। হাসতে-হাসতে বলল আষাঢ়,
-” কি রান্না করেছ তেজপাতা?
চঞ্চল হয়ে উঠল ঝুমঝুমি। ভাগ্যিস দুপুরের জন্য বেশি করে রেধেছিল তানাহলে আজ মানসম্মান ধুলোয় মিশতো।
-” দম বিরিয়ানি।
নাজিমের ঠোঁটে হাসির রেখা চওড়া হলো। হিরণ মজার চলে বলল, দম বিরিয়ানির দম আছে নাকি ফুরিয়ে গেছে?
-” ফুরোবে কেন? পেটে গিয়েও মুখ ফুলিয়ে দম নিবে বিরিয়ানি। বেশি কথা বললে আপনার দম বন্ধ করে দিবো। বাজে লোক।
নীরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, আমায় শা’সা’চ্ছ মেয়ে? ভুলে যেও না হবু বর আমি তোমার।
-” হাতেপায়ে ধরে রাজি করিয়েছেন আমায় ভুলে যাবেন না।
ফোঁস করে দম ছাড়ল হিরণ সত্যিই সে নীরার হাতেপায়ে ধরেছিল। মেয়র হান্নানকে বলেছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত বিয়ের জন্য রাজি না হচ্ছে মেয়েপক্ষ ততক্ষণ পর্যন্ত মেয়ের বাসায় অনশন করবে বাপ-ছেলে। প্রয়োজনে মিছিল বের করবে তবুও নীরাকে সে বিয়ে করবে। ছেলের এহেন কথা শুনে মেয়র হান্নান শিউরে উঠে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় নীরার পরিবার রাজি হয়।
খাবারের ঘ্রাণে ম-ম করছে পুরো রুম। নাজিম আগেভাগে ফ্লোরে বসে আছে। ফ্লোরে মাদুর বিছানো। ঝুমঝুমির বাসায় চেয়ার কম থাকায় সবাই মিলে ঠিক করে ফ্লোরে বসে খাবে। একে-একে খাবার সাজিয়ে সবাই বসে পড়ল ফ্লোরে। হালিমা খালা খুশিতে আগেই বসেছে। এই প্রথম বাসায় এতজন মানুষ একত্রে বসে খাবে ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ। নিজেদের প্লেটে নিজেরাই খাবার বেড়ে খাচ্ছে একেকজন। ঝিনুক বসে আছে আষাঢ়ের পাশে। নিজ হাতে ঝিনুককে খাইয়ে দিচ্ছে আষাঢ়। আড়চোখে ঝুমঝুমি সে দৃশ্য দেখে খুশিতে গদগদ। খাওয়া-দাওয়া শেষ সবাই গিয়ে বসলো সোফায় ফ্লোরে মিলিয়ে। হালিমা খালা ও ঝুমঝুমি থালা বাসন পরিষ্কার করে যোগ দিল আড্ডায়। তখনই মিরাজ বলে উঠল, এই চল সবাই মিলে ট্রুথ-ডেয়ার খেলি।
-” দিনের বেলায়?
নাজিমের প্রশ্ন। হিরণ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, কেন তোর কি রাতে থাকার ইচ্ছে আছে?
-” ঝুমঝুমি থাকতে বললে আমার আপত্তি নেই।
-” রাতে থাকার প্রয়োজন নেই আমরা দুপুরের আগেই বিদায় নিবো।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল আষাঢ়। সে চায়না ঝুমঝুমি অস্বস্তিতে পড়ুক। তাছাড়া বাহিরের লোকজন কানাঘুষা করতে পারে। ঝুমঝুমিকে কথা শুনাতে পারে। মেয়েটা জীবনে সুখের কালি কম দুঃখের কালি বেশি। চায় না মানুষের কথা শুনুন তার প্রিয় মানুষটি।
_______________________
রাত নয়টা, ঝিনুককে শুয়ে দিয়ে স্টাডি রুমে প্রবেশ করে ঝুমঝুমি। পরবর্তী শি’কা’রে’র জন্য প্ল্যান সাজাবে আজ। তবে এই শি’কা’র’কে সহজেই কাবু করতে পারবে বলে আশা করে সে। ছোট করে দম নিলো ঝুমঝুমি। তৃতীয় শি’কা’র’কে জানে মা’র’বে না কিন্তু এমন অবস্থা করবে যেন মৃ’ত্যু’র আগপর্যন্ত নিজের মৃ’ত্যু কামনা করে লোকটি। তিলে-তিলে মা’র’বে এই লোকটাকে। হঠাৎ ঝুমঝুমির মনে হলো ওর র’ক্ত টগবগ করছে, শরীর কাঁপছে আচ্ছা রক্তের সম্পর্কের কাউকে খু’ন করলে বুঝি এমন হয়? হ্যাঁ হয়। প্রথম শি’কা’র’কে যেদিন খু’ন করেছিল সেদিন তার শরীর এভাবে কেঁপেছিল ভয় সৃষ্টি হয়েছিল মনে। বিবেক বলেছিল, মা’রি’স না নিজের আপন মানুষকে কিন্তু সেদিন বিবেকের কথা শুনেনি ঝুমঝুমি। এই মানুষটাই তার হৃদয়ে প্র’তি’শো’ধে’র বি’ষ ঢেলে ছিল। ঝুমঝুমি তো ভালো ছিল। অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যত্,বর্তমান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না, অতীত ঠিকই ওর পিছু নিয়েছিল। শহর ছেড়ে পালিয়ে ভালোই কাটছিল ওর দিন একজনকে নিয়ে তাহলে সেই ভালো থাকার পথে মানুষটি কেন এসেছিল কাঁটা হয়ে? নতুন করে তৈরি করা স্বপ্নকে মিশিয়ে দিয়েছিল মাটির সাথে। নাহ খু’ন করে ভুল করেনি ঝুমঝুমি। আপন মানুষগুলো যদি পশুর মত আচরণ তখন তাদের ছাড় দিতে নেই। তাদের মে’রে পৃথিবী থেকে নর্দমার কীট পরিষ্কার করতে হয়।
আচমকা কানে বাজলো মাউথ অর্গানের সুর। হৃদয়ে কম্পন শুরু হলো। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, মেঘ ভাই।
##চলবে,,
(রি-চেইক করা হয়নি আজ।)