প্রেয়সীর শব্দপ্রেম পর্ব-০৫

0
547

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[৫]
রান্নায় ব্যাস্ত ঝুমঝুমি। হালিমা খালা সবজি কেটে-কুটে ঝিনুককে ডাকতে গিয়েছে। ঝিনুকের জন্য স্পেশাল চিজ-অমলেট বানানোর প্রস্তুতি নিলো ঝুমঝুমি। বাচ্চা মেয়েটির খাবারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চিজ-অমলেট। মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি বরাবর নজর ঝিনুকের ঝাল খাবার মোটেও সহ্য করতে পারে না। মেয়েকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে অতিশয় মনে পড়ল প্রিয় একজন মানুষের কথা। অজান্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।

কলিং বেল বাজার শব্দে চকিতে হুস ফিরে ঝুমঝুমির। চুলোর আঁচ কমিয়ে সন্দিহানী মন নিয়ে ড্রইংরুম পেরিয়ে মূল দরজার কাছাকাছি দাঁড়ায়। সাতসকালে কে বাজাবে কলিং বেল বুঝে উঠতে না পেরে দরজা খুলতেই দেখতে পায় তরতাজা লাল টুকটুকে গোলাপের তোড়া । নজর কাড়া লাল গোলাপের মাঝে শীর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা গোলাপ। সাদা মানে শুভ্রতা। ভ্রু কুঁচকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে ব্যাক্তিটির অস্তিত্ব বুঝতে না পেরে পুরো চোখ বুলায় গোলাপের তোড়ায়। দেখতে পায় নীল কাগজ মুড়ানো প্রেমপত্র। অজান্তেই হেসে উঠে ঝুমঝুমি। কাজটা কার বুঝতে পেরে চেপে ধরে নিচের ঠোঁট। হৃদয়ের ধুকপুক বাড়তে থাকে, অনুভুতি রূপ নেয় আঁধার আকাশে জেগে উঠা থালার মত পূর্ণ চাঁদে। নিঃশ্বাসের মাত্রা বেড়ে ঢেউ খেলে অন্তরিন্দ্রিয়। ভোঁতা অনুভুতি সজাগ হতে শুরু করে। কম্পন অনুভব করে অঙ্গ জুড়ে। একি সর্বনাশা প্রেমের জলোচ্ছ্বাস ঝুমঝুমির। উত্তাল সমুদ্রের ঝাঁপ দেওয়া তরীবিহীন এক নারীর নোঙর হয়ে আসা আষাঢ়কে নিয়ে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। ঝুমঝুমি পত্র মেলিয়ে দেখে,

“আমার হৃদ দেশের রাণী জানো আজকাল আমার নিজেকে পাগল মনে হয় ইচ্ছে হয় অগ্রাসি হতে,খানিক বাউণ্ডুলে, পাগল প্রেমিক,খানিকটা হ্যাংলাও। ইচ্ছে করে তোমার জন্য তৈরি হৃদয়ের গভীর ভালোবাসাটা পৃথিবীকে জানিয়ে একান্ত আপন করে নিই নিষ্ঠুর প্রেয়সীকে। সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে নির্লজ্জের মতন তোমায় নিয়ে ভাবে এ-মন। তোমার দু’চোখের মোহনীয় আকর্ষণীয় দৃষ্টির পানে চেয়ে থাকি, পান করি অমরত্বের সুধা। ভেসে যেতে চাই তোমার মাঝে। নিস্তব্ধ রাতে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে জেগে থেকেছি কতশত রাত। চোখের নিচের কালো পড়া দাগ সাক্ষী তোমার বিরহে ঘুম না হওয়া পাগলাটে প্রেমিক আমি। ঘুমহীন রাত্রীরা সেই থেকে সেই সুন্দর আবিষ্কারের নেশায় আকণ্ঠ ডুবে থাকে মেতে থাকে তোমাতে। তোমার চিরসংকুচিত স্বভাবের কাছে আমার কথারা কেবল ফানুসেই হারায় মিলিয়ে যায়। তুমি নিষ্ঠুর প্রেয়সী, পাষণ্ড প্রেমিকা। আমার প্রেমের বর্ষণ সমুদ্রে পরিণীত হয়েছে কিন্তু তুমি নিষ্ঠুর বুঝেও বুঝতে চাও না। তবুও তোমার প্রতি আমার ঘৃনা আসেনা, আসে শুধু ভালোবাসা,ভালোবাসা আর ভালোবাসা। এমন অদ্ভুত ভালোলাগার মুহূর্ত জীবনে খুব অল্পই আসে। মুক্তোর দানার মত ঝলমল করে উঠে। লাল গোলাপের মাঝে একমাত্র শুভ্র গোলাপটি হলে তুমি। লালের মাঝে শুভ্রতার প্রতিচ্ছবি। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি তেজপাতা। বুক পিঞ্জরে শুধু একজন পাষাণী প্রেমিকার বসবাস।”

পত্রখানা পরে হাসলো ঝুমঝুমি। আষাঢ়ের পাগলামিতে না হেসে উপায় নেই। আবারও চোখ বুলিয়ে দেখল আশপাশ। আষাঢ় দূর থেকে দেখল সেই মধু মেশানো ঝলমলে হাসি। ঝুমঝুমিকে তাকাতে দেখে আবারও লুকালো গাছের আড়ালে। বেড়েছে হৃদয়ের গতিবিধি।

হঠাৎ ই মনে পড়ল রান্নায় কথা। দরজা বন্ধ করে দৌড়ে কিচেন রুমে এসেই দেখল হালিমা খালা রান্না করছে। ঝুমঝুমিকে এদিক পানে আসতে দেখে প্রশ্ন করল, তোমার কি হইছে আগে কও? রান্ধা ফালাইয়া কই গেছিলা? হাতে ফুলের তোড়া কেন?

লজ্জায় পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্য পায়ে ঘর্ষণ করল ঝুমঝুমি। মুখে কিশোরী ছোঁয়া অনুভূত হলো। প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে হয়েও আচরণে স্পষ্ট বয়ঃসন্ধিকালে প্রেমে পড়া মেয়ের আবাস। হালিমা গলা ঝাড়ল। ঝুমঝুমির লাজুক মুখটি দেখে তৃপ্তির হাসি দিল। মেয়েটার নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবতে দেখে মাথায় হাত রেখে বলল, দোয়া করি সবসময় সুখী থাকো। হাসিখুশি সুন্দর একটা জীবন তোমার হোক।

ঝুমঝুমি তাড়া দিল। বলল, খালা তাড়াতাড়ি রান্না কর দেরি হয়ে যাচ্ছে।

____________________

হালিমা খাইয়ে দিচ্ছে ঝিনুককে। আজ বায়না ঝিনুকের নানুর হাতে খাবে। মাঝে-মধ্যে মেয়েটার এমন বায়নায় হাসে হালিমা। বাচ্চা মেয়েটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে কলিজা ঠান্ডা করে। মনে পড়ে অপ্রিয় মানুষটার কথা। হৃদয় পুড়ে ,অনুভুতি পুড়ে, শূন্যতার মাঝে পূর্ণতা আওয়াজ তুলে।

কলিং বেল বাজলো আবারও। ঝুমঝুমি আষাঢ় ভেবে দ্রুত দরজা খুলতেই দেখল নিউজ পেপার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝ বয়সী লোক। নম্র হয়ে নিউজ পেপার হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে ঝুমঝুমি। দু’পৃষ্টা উল্টাতেই কাঙ্ক্ষিত খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় ঠোঁটে ফুটে ফিচেল হাসি। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে নিজের একান্ত স্টাডি রুমে। এরুমে আসা নিষেধ ঝিনুক ও হালিমা খালার। সবসময় তালাবদ্ধ থাকা রুমটি একাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে ঝুমঝুমি। দরকার ছাড়া তালা খুলে না। রুমটিতে ঢুকেই প্রথমে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে লাইট জ্বালাতেই ভেসে উঠল কিছু মানুষের ছবি। দুটো ছবি লাল কালি দিয়ে ক্রস চিহ্ন আঁকা। টেবিলের উপরে পরে রয়েছে বিস্তার কাগজ সেটা কেটেকুটে একটুখানিতে ঠেকেছে। ঝুমঝুমির কন্ঠস্বর হতে অদ্ভুদ এক শব্দ বের হলো। শব্দের রহস্য অজানা। গুপ্ত লকার অতি সাবধানে খুলে বের করে আনলো পুরনো ডায়েরি। ডাইরির উপরে লিখা, স্বর্ণপদক। এই ডায়েরীটা ঝুমঝুমি ওর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। পুরনো ডায়েরির বেষর্ধেক পৃষ্ঠায় রয়েছে অনেক গল্প। বাবার সাথে থাকা মুহুর্ত। বাবার মৃ’ত্যু’র পর তো বেমালুম ভুলে বসেছিল ডায়েরির কথা কিন্তু ঝর্ণার উদ্বেগে একই ডায়েরিতে লিখেছিল বিষাদের ঘটনা। ডায়েরির এক পাতায় ছিল সুখের কালি,উল্টো পাতায় ছিল বিষাক্ত কালি। ঝুমঝুমি খুব গোপনে ডায়েরির মধ্যিখান হতে একটি খবরের কাগজের টুকরো বের করে। এক বছর আগের কাগজ সেটি। কাগজের উপর শুকিয়ে আছে রাস্তায় অযত্নে বেড়ে উঠা সাদা ফুল। ঝুমঝুমি না জানে না ফুলের নাম তবুও রাস্তায় পেয়ে যত্নে রাখে খবরের কাগজের উপর। হাতে থাকা নতুন খবরের কাগজ দেখে চোখ চিকচিক করে উঠে খুশিতে। কাগজে সাদামাটা ভাঙা গাড়ির ছবিতে শব্দবিহীন হাসে। লিখাগুলো আবারও বিড়বিড় করে কণ্ঠে দৃশ্যমান করে,

” গাড়িতে পাওয়া গেছে এক যুবকের নি’র্ম’ম বিচ্ছিন্ন লা’শ। নব্বই টু’ক’রো করা লা’শে’র খোঁজ নিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায় লোকটির নাম শামীম। কে খু’ন করেছে কেন করেছে এখনও জানা যায়নি। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তবে লা’শ দেখে এইটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে খু’নি’কে চিনত মৃ’ত শামীম। পুরনো তিব্র আ’ক্রো’শ বা শ’ত্রু’রা ছিল বলে জানালো তদন্ত কমিটি। মৃ’ত শামীমের অ’ন্ডো’কো’ষ পাঁচ টু’ক’রো করা ছিল। গাড়ির কাঁচ ভেঙে বৃষ্টির পানিতে মুছন ঘটেছে খু’নী’র হাতের ছাপ। খুব শীগ্রই খু’নি’কে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।”

ঝুমঝুমি শব্দ করে হাসলো এবার। কাঁ’চি দিয়ে ওইটুকু ছবি কে’টে ডায়েরির ভিতরে রাখলো। উপরে রাখল আষাঢ়ের দেওয়া সাদা গোলাপের চারটে পাঁপড়ি। গোপনে ডায়েরীটা রেখে ফুরফুরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে স্টাডি রুমের দরজা তালাবন্ধ করে বেড রুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার পর্যবেক্ষণ করল। চোখ দুটো চকচক করছে খুশিতে। ঠোঁট কামড়ে বলল, পরের শি’কা’র এখন নয়। সময় নিয়ে নামবো মাঠে। তাড়াহুড়োয় ভুল করা যাবে না,কিছুতেই যাবে না। ভুল হলেই আমার মেয়েটার জীবন অন্ধকার। আমার মেয়েকে আমি অন্ধকারে দেখতে চাই না।

_________________

নাজিম ছাদের রেলিং ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়ানোর ভঙ্গিমায় দৌড়াচ্ছে। থলথল পেটটা উপর নিচ হতে-হতে ক্লান্ত চেহারায় বন্ধুদের পানে তাকালো। আড়াই মিনিট হলো মাত্র কিন্তু নাজিমের মনে হচ্ছে আড়াই বছর পার করেছে। হতাশ দুঃখীপনায় মুখের ভঙ্গি কাঁদো-কাঁদো। নাজিমের নাজেহাল মুখটা দেখে মিটিমিটি হাসছে মিরাজ কিন্তু বন্ধুর দুঃখে হাসিখানা চেপে হিরণকে খোঁচা দিয়ে বলল, সামলাবি কেমনে?

ভাবুক হিরণ একরাশ হতাশ নিয়ে বলল, বা**ল। আগে থেকেই বলেছি সচেতন হ সচেতন হ। কিন্তু শুনে নাই। রাক্ষসের মত খেয়ে রাক্ষসের আকার ধারণ করেছে। দুই মিনিট কেন একমাসেও কমবে না। ভালো ডায়েটিশিয়ানের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

নাজিম দুঃখী দুঃখী নিরাশ কণ্ঠে বলল, ওজন কমানোর সত্যিই কোনো ওষুধ নাই বা**ল। পৃথিবী তাহলে কোন দুঃখে বিজ্ঞানী,ডক্টর পুষে আমি বুঝিনা। সামান্য একটা ওষুধ আবিষ্কার করতে পারে না তারা নাকি আবার দেশের নাম করবে। আমার ব***ল করবে। আমি এমপি মন্ত্রী হলে ব্যাটাদের বেতন কেটে রাখতাম।

মিরাজ তিক্ত হয়ে নাজিমকে ধমক দিল। বলল, তুমি সাস্থ্য সচেতন হবে না, সারাদিন খেয়ে যাবে। তেত্রিশ বছরের খাওয়া একদিনে হজম হবে? আসছে দেশের নামকরা পালোয়ান।
-” জানিস এই পৃথিবী আমায় ডিজার্ভ করে না। আমার উচিৎ এবং অবশ্যই উচিৎ পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চন্দ্রের দেশে চলে যাওয়া। ওখানে কেউ আমায় খেতে বারণ করবে না।

একদমে কথাগুলো বলে পাশ থেকে চিপসের প্যাকেটে হাত দিয়ে গপাগপ চিপস মুখে পড়ল। আষাঢ়,মিরাজ ও হিরণ দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে একে অপরের দৃষ্টি বিনিময় করে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো।

##চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে