#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[৪]
ঝিনুককে হাঁটুর ভাঁজে বসালো আষাঢ়। এক হাত ঝিনুকের কোমর বরাবর হালকা করে ধরে রাখল যেন পরে না যায়। অন্য হাত ঝুমঝুমির হাতে লাগোয়া রিক্সার হুডে জড়ানো।
-” আঙ্কেল তুমি খুব ভালো।
-” তাই! আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে মামুনি?
-” ভীষন।
রাস্তায় হাওয়া মিঠাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। ঝিনুক দেখতে পেয়ে চিল্লিয়ে উঠল, মাম্মা আমি মিঠি খাব প্লিজ আমায় মিঠি এনে দাও।
-” সামনে থেকে কিনবো মা। লক্ষী মেয়ের মতো আঙ্কেলের কোলে বসে থাকো। তোমার আঙ্কেলের রিক্সায় চড়ার অভ্যাস নেই, হেরফের হলে পরে যাবে।
ঝিনুক অভিমানে মুখ ফুলালো। আষাঢ় ড্যাবড্যাব করে ঝুমঝুমিকে দেখল। বাচ্চা একটি মেয়ের সামনে ওর সম্মানে হারিকেন ধরিয়ে দিলো? রিক্সায় অভ্যস্ত নয় বলে আজ অপমানটা মুখ বুঁজে সয়ে গেল।
-” মামা রিক্সা থামান তো।
আরেকটি হাওয়া মিঠাইয়ের লোককে দেখা গেল। রিক্সা থামতেই আষাঢ় ঝিনুককে কোলে নিয়ে সেদিকে গিয়ে তিনটে হাওয়া মিঠাই কিনলো। দুটো ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে একটি ঝুমঝুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও।
-” আমি খাইনা এসব।
-” খাবা কেমনে। মিষ্টি খেলে তো মুখ থেকে মিষ্টি কথা বের হয়ে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। তোমার তো আবার মিষ্টি কথাতে এলার্জি। শাশুড়ি মা জন্মের পর কিপটামি করেছে বুঝেছ? মধু না কিনে ঘরের কোনার গাছ থেকে নিম পাতা বেটে রস খাইয়েছে। বেচারা আষাঢ় তোর কপালে মিষ্টি বউ নাই রে।
-” মিষ্টি দেখে মেয়ে বিয়ে করছেন না কেন? আমার পিছনে ঘুরঘুর করছেন বেয়াড়া লোক।
-” যতই গালমন্দ করো আমার গায়ে লাগবে না। জানো তো, নিমপাতার রস খুব উপকারী। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়। তারচেয়ে ভালো নিমপাতাতে সই।
ঝুমঝুমির মাথা খারাপ করে দিচ্ছে আষাঢ়। যত বাজে বকবকানি আছে সব একেরপর এক বলে যাচ্ছে। উপর থেকে রাগ দেখালেও মনে মনে হেসে ফেটে যাচ্ছে ঝুমঝুমি। এখনো আগের মতই রয়ে গেছে তবে বেয়াড়া স্বভাব বেড়েছে।
রিক্সা থামলো। ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকলো তিনজন। গেইটের কাছাকাছি আসতেই লাল কাপড় বেঁধে দিল ঝুমঝুমির চোখে। জারপরান অবাক হলো ঝুমঝুমি। কথা বলার আগেই আষাঢ় বলল, সারপ্রাইজ আছে তেজপাতা।
ভিতরে ঢুকলো তিনজন। মনে হলো কিছু জিনিষ উপর থেকে গায়ে পড়ছে হ্যাঁ গোলাপ ফুলের পাপড়ি। আষাঢ় পট্টি সরাতেই চোখের সামনে পরিচিত দুটো মুখ ভেসে আসলো। হ্যাঁ ঝুমঝুমির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীরা ও তৃষ্ণা। নীরার চোখে টগবগ করছে অশ্রুকণা কিন্তু তৃষ্ণা মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিমানে কথা বের হচ্ছে না কন্ঠস্বর থেকে। ঝুমঝুমি ই প্রথম এগিয়ে গেল দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
-” সরি রে, আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দে।
-” আপনার ভুল নয় ঝুমঝুমি। ভুল আমাদের আপনি আমাদের আপন ভাবতে পারেননি। আমরা আপনার ভালো বন্ধু হতে পারিনি।
তৃষ্ণার জবাবে শব্দ করে কাঁদল ঝুমঝুমি। নীরা বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে যাচ্ছে। দুহাতে চেপে ধরে বলল, তুই খুব খারাপ। আমাদের একটুও ভালোবাসিস না। পঁচা খুব খুব পঁচা।
-” তোদের আমি খুব ভালোবাসি।
নীরা, ঝুমঝুমির গালে চুমু খেল। দুহাত দিয়ে মুখ মুছে তৃষ্ণার উদ্দেশ্য বলল, ক্ষমা করে দে ঝুমিকে।
-” আমি ক্ষমা করার কে? তোরা কাঁদতে থাক আমি যাচ্ছি।
ঝুমঝুমি শক্ত করে ধরল তৃষ্ণার হাত। ধমক দিয়ে বলল, বড্ড একরোখা হয়েছিস। এক পা সামনে এগুলে মাইর দিবো।
-” নীরা ওকে বলে দে মাইর আমিও দিতে পারি। বোঝদার মেয়ে হয়ে অবুঝের মত কাজ করা ওর ঠিক হয়নি। কতশত ফোন দিয়েছি কিন্তু ধরেনি। আমাদের তো চিন্তা হয়না। আমরা কে ওর?
-” তোরা আমার অনেক কিছু।
কান্নার মাঝেই ঝিনুক এসে তৃষ্ণার হাত ধরে বলল, আন্টি তোমরা কেমন আছো?
তৃষ্ণা-নীরা দৃষ্টি নিচু করল দেখল ছোট্ট একটা পুতুল হাতে হাওয়া মিঠাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে লেগে আছে হাওয়া মিঠাই। ঝুমঝুমির দিকে তাকাতেই ঝুমঝুমি বলল, আমার মেয়ে ঝিনুক।
নীরা-তৃষ্ণা আষাঢ়কে দেখল। আষাঢ় ইশারায় রিল্যাক্স থাকতে বলল। ভাবখানা এই যেন কিছুই হয়নি। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি বুলিয়ে ঝিনুকের গালে চুমু খেল দুজন। ভাব বিনিময় হলো সময় ধরে। দীর্ঘদিনের লালিত অভিমান পাথর চাপা পড়ল।
_____________________
মিরাজ,নাজিম,হিরণ ও আষাঢ় উল্টো দিগটায় বসেছে। ঝুমঝুমি, নীরা, তৃষ্ণা ও ঝিনুক ওদের সামনাসামনি। আগামীকাল বিয়ের তারিখ ফিক্সট হবে নীরা-হিরণের। এইজন্যই হিরণ ট্রিট দিবে বন্ধুমহলকে। টেবিলে রাখা হয়েছে সবারই পছন্দের খাবার,পানীয়। পেটুক নাজিম গপাগপ গিলেই যাচ্ছে কাবাব। ঝিনুক সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। ওর জন্য আনা চাউমিন এক হাতে রেখে খেয়ে যাচ্ছে নাজিম। ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করল।
-” আমার চিয়ামিউ ওই আঙ্কেল খেয়ে ফেলেছে।
ঝুমঝুমি মেয়েকে মৃদু ধমক দিলো। অপ্রস্তুত হয়ে নাজিমকে বলল, সরি ভাইয়া। বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি।
একগাল হাসলো নাজিম। ঝিনুকের দিকে অর্ধেক খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
আম্মাজান,আম্মাজান
আপনি আমায় ক্ষমা দান।
ভুল করেছি আমি
করব না আর ছ্যাচরামি।
ঝিনুক কবিতা শুনে হেসে দিল। হাত তালি দিয়ে বলল, আঙ্কেল তুমি মোটু পাতলুর ওই কবিতা বলা জনের মতো হিহিহিহি।
মুখটা আপেলের রূপ নিলো নাজিমের। ভুঁড়িতে হাত গলিয়ে পাংসুতে মুখ বানালো।
-” নাহ এবার দেখছি সত্যি সত্যিই ভুঁড়ি কমাতে হবে। কন্ট্রোল কন্ট্রোল নাজিম খাবার থেকে সরে আয়।
-” বাব্বাহ ঝিনুক তুমি তো দেখছি দারুণ ম্যাজিক জানো। আমরা কত করে বলি খাওয়া কন্ট্রোল করতে কিন্তু শুনে না তুমি বলাতেই রাজি হয়ে গেল।
মিরাজ ঝিনুকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে মিরাজকে দেখে চোখ সরালো। এই লোকটাকে ওর কেন যেন সহ্য হয়না। মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। তৃষ্ণাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিরাজ বলল, এই আমার রূপ কি বেড়েছে? আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছি? শাকচুন্নি মেয়েরা নজর দিচ্ছে কি করা যায় বল তো হিরণ?
-” যেই না চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা। নজর দিতে মেয়েদের ঠ্যাকা পড়েছে।
-” পড়ল কথা হাটের মাঝে যার কথা তার কানে বাজে।
মুক্ষম সুযোগ হাত ছাড়া করল না মিরাজ। তৃষ্ণা নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই মনে মনে বকতে শুরু করল। ঝুমঝুমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখল সব। মিস করছিল দিনগুলো আজ অতীতে ফিরে আসতে ফিরে হৃদয় জুড়িয়ে গেল।
_________________________
সূর্যের রঙ কমলা রূপ ধারণ করল। প্রশান্ত বিকেল,মৃদুমন্দ বাতাস, একদল বাচ্চারা ছুটাছুটি করছে। বাচ্চাদের সাথে ঝিনুকও যোগ দিয়েছে। জায়গাটি শিশু পার্ক। ঝিনুক এই প্রথম মুক্ত পাখির মত উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘর কুনোয় থাকা মেয়েটি প্রথম খেলার স্বাধ পেয়ে খুশিতে গদগদ। আষাঢ়ের গালে হাত রেখে আবদার করেছে সে আবারও ঘুরতে চায়,খেলতে চায়। আষাঢ় মুচকি হাসির সাথে কপালে চুমু দিয়ে বলেছে প্রতি শুক্রবার বিকালে ঘুরতে নিয়ে যাবে। এইটুকুতেই খুশি ঝিনুক।
ঝুমঝুমি মুগ্ধ নয়নে দেখে সে দৃশ্য। না চাইতেও আবারও প্রেমে পরে আষাঢ়ের কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পায়। মনেতে লুকানো অনেক ঘটনা বলতে গিয়েও দ্বিধাবোধ করে। নিজের ভবিষ্যতের ঠিক ঠিকানা নেই। দু-দুটো খু’নে’র জন্য পুলিশ খুঁজছে হন্যে হয়ে। মেয়েটার একটা ভবিষ্যত্ করে যেতে পারলে চিন্তা নেই। মনের ভিতরে সুপ্ত অনুভুতি জাগান দিয়েছে। ওর কিছু হয়ে গেলে নীরা,তৃষ্ণা, আষাঢ় বাচ্চা মেয়েটির পাশে থাকবে। তাছাড়া জীবনের লক্ষ্য এখনও বাকি। খু’নে’র নেশাতে নেমেছে যেহেতু সহজেই তো মুক্তি নেই। সামনে যে আরো শক্ত দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়াল ভাঙতে না পারা অব্দি শান্তি নেই। নাহ এখনই কিছু বলবে না আষাঢ়কে। তাহলে আষাঢ় কখনোই তাকে ম’র’ণ খেলায় নামতে দিবে না উল্টো আইনি লড়াইয়ে শাস্তি দিবে ওদের কিন্তু ঝুমঝুমি চায়না আইনি সহায়তা ও চায় নিজের হাতে শেষ করতে হিংস্র-জা’নো’য়া’র’দে’র।
ঝুমঝুমিকে ভাবতে দেখে আষাঢ় ডেকে উঠল। উত্তেজনায় বেদিশা হয়ে ঝুমঝুমি ভয় পেয়েও গুটিয়ে রাখলো উত্তেজনা।
-” সমস্যা কি তোমার ডেকে যাচ্ছি শুনছো না?
-” শুনছি তো।
-” বিয়ে করো না আমায়। দেবদাস হয়ে ঘুরতে ভালো লাগে বলো। ড্যাড পিছন পড়েছে এবার।
-” বিয়ের জন্য অগ্রিম শুভেচ্ছা।
-” মজা নিচ্ছো?
-” মজা নিবো কেন? আজকাল শুভেচ্ছা জানানো বুঝি অন্যায়?
-” হ্যাঁ অন্যায়। ঘোর অন্যায়।
ঝুমঝুমির হাত বুকের সাথে মিশিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, পাগল প্রেমিকের সঙ্গে পাগলামি করো না।
-” হাত ছাড়ুন লোকে দেখছে।
-” দেখুক। বলো বিয়ের প্রপোজাল কবে পাঠাবো?
-” বেশি হয়ে যাচ্ছে না।
-” একদমই না বরং কম কম হচ্ছে। দুবছর অসুস্থ ছিলাম আর অসুস্থ বানিয়েও না।
অপরাধে মুখখানি ছোট হলো ঝুমঝুমির। নীরার কাছ থেকে শুনেছে সব কিন্তু কি ই বা করার আছে। তবে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বড় দেওয়াল টপকানোর পর নিজের অনুভূতি শেয়ার করবে সে। খু’নে’র কথাও বলবে। খু’নি মেয়েকে জীবনে আনতে চাইবে কি আষাঢ়? খু’নে’র নেশায় যদি নিজের জীবন দেওয়া হয় তখন মেয়েটার কী হবে? আষাঢ় মেনে নিবে তখন?
-” এই কী ভাবছো তুমি?
-” আমার মেয়েকে আজীবন আগলে রাখবেন প্লিজ।
আষাঢ়ের কপালে ভাঁজ পড়ল ঠোঁটে হাসি ফুটে ঝুমঝুমির হাতে চুমু খেয়ে বলল, শুধু মেয়ে নয় মেয়ের মাকেও আজীবন আগলে রাখবে,অনেক ভালোবাসবো। কথা দিলাম।
##চলবে,,
রি-চিইক করা হয়নি আজ।