#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[২]
সূর্যের দাবদাহ তেজ। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্নায় ব্যাস্ত ঝুমঝুমি। বাম হাতে কপালের ঘাম মুছে ছোটাছুটি শুরু করেছে। ঝিনুকের আজ স্কুলে প্রথম দিন। খাবার রেডি করে আঁচল ছেড়ে মুখ মুছে বেড রুমে ঢুকে দেখল ঝিনুক এখনও ঘুমে। ছোট্ট টেডি জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে আছে। মেয়ের মাথায় নিরিবিলি হাত রেখে মৃদু শব্দে ডাকলো ঝুমঝুমি। ঝিনুক নড়েচড়ে আবারও ঘুম। আদর করে ডেকে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ে রেডি করে সে নিজেও বের হলো। যেতে-যেতে হালিমা খালাকে বলল, ঝিনুকের স্কুল ছুটি হলে নিয়ে এসো খালা। আমি ছুটি পাব না।
-” আইচ্ছা। তুমি টেনশন কইরো না আমি এক ঘণ্টা আগে গিয়া বইয়া থাকুম।
-” আমি ফোন দিবো খালা। অবহেলা করো না।
ব্যাস্ত পায়ে মেয়েকে নিয়ে ছুটল মোড়ের দিকটায়। ঝিনুক হাঁটছে কম লাফাচ্ছে বেশি। ঝুমঝুমি দুয়েকবার ধমকও দিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি। রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে মেয়েকে কোলে তুলে হাঁটতে লাগলো। চার বছরের মেয়েকে নিয়ে অনেক্ষণযাবত হাঁটা কষ্টসাধ্য। কোল থেকে নামিয়ে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে গলায় ঢাললো।
-” সাহায্য লাগবে? ছেড়ে দিবো স্কুলে?
হাত থেকে বোতল গড়িয়ে রাস্তায় পড়ল। বোরকার সামনের দিকটা ভিজা। আশ্চর্যান্বিত চোখজোড়া দুবার উঠানামা করে বলল, আষাঢ়! আপনি?
গাড়ি থেকে নামলো আষাঢ়। পরনে সাদা শার্ট, জিন্স। সাদা গাড়ির সাইডে ঠেসে দাঁড়িয়ে বুকে দুহাত ভাঁজ করে বাচ্চা মেয়েটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঝুমঝুমি গলা কেশে মেয়ের হাত ধরতেই ঝিনুক চিল্লিয়ে উঠল, মাম্মা আমরা গাড়ি করে যাব?
‘ মাম্মা ‘ শব্দটি রিপিট করল আষাঢ়ের কানে। হাতের ভাঁজ ছেড়ে ঝুমঝুমিকে প্রশ্ন করল, তোমার মেয়ে?
ঢোক গিললো ঝুমঝুমি। আমতা-আমতা করে বলল, হুম।
-” বাহ, স্বামী কোথায় তোমার? কি করে? আসেনি তোমার সাথে? দেখতে কেমন? আমার থেকেও হ্যান্ডসাম?
একদমে বলল আষাঢ়। প্রশ্নগুলো ধমকের সুরে বলল। ঝিনুক তখন ঝুমঝুমির হাত ছেড়ে আষাঢ়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আঙ্কেল তুমি মাম্মাকে বকছ কেন? জানো না বাচ্চাদের সামনে ঝগলা করতে নেই। আমার বাবা মা’লা গেছে অনেক আগে বুঝেছ।
-” তোমার বাবা নেই?
-” না তো। শুনো আমার বাবা নেই বলবে না তাহলে আমি ও মাম্মা খুব কষ্ট পাব।
ছোট বয়সেই মেয়েটার বোঝ বড়দের মত ঠিক যেন ছোট্ট ঝুমঝুমি। বলার আগেই সব বুঝে ফেলে।
-” তোমার মাম্মাকে বলো আমার গাড়িতে উঠতে আমি পৌঁছে দিই।
ঝিনুক প্রথম বড় গাড়িতে উঠবে বলে হাত তালি দিল। চোখে-মুখে আনন্দ উপছে পড়ছে ওর। ঝুমঝুমির হাত ধরে বায়না করে উঠল, চলো মাম্মা আমরা গাড়ি করে যাই।
-” না মা। আমাদের গাড়িতে উঠা মানা। গাড়ি বড়লোকদের। আমাদের নয়।
ঝিনুক কি বুঝল জানা নেই মুখটা ছোট করে আষাঢ়কে বলল, আঙ্কেল তুমি চলে যাও আমরা রিক্সায় যাব। জানো রিক্সায় চড়তে খুব মজা। গাড়িতে মজা নেই।
রিক্সা আসলো। ঝুমঝুমি ও ঝিনুক রিক্সায় উঠে বসল। আষাঢ় দেখল চোখের পলকে রিক্সা ছুটেছে গলির মোড় ধরে। সময় নষ্ট না করে নিজেও গাড়িতে উঠে বসল। ঠোঁটে ফুটলো তৃপ্তির হাসি। ঝুমঝুমির স্বামী মা’রা গিয়েছে শুনে খুশিতে নাচতে মন চাইলো। কি আশ্চর্য, কি আশ্চর্য মানুষ ম’র’লে দুঃখ পাওয়ার বদলে এত খুশি হয়? ছি খুবই খারাপ ব্যাপার-স্যাপার। খারাপ ব্যাপার হলেও আষাঢ়ের মনে প্রেমের ফুল ফুটেছে দ্বিতীয়বার। হ্যাঁ একই নারীর প্রতি দু-দুবার প্রেমে পড়েছে। একই নারীর মায়াজালে জড়িয়েছে দু-বার। প্রেম খুব সাংঘাতিক রোগ। প্রেম রোগের ওষুধ শুধু প্রেয়সীর প্রেম। মৃত প্রেমকে নতুন করে জাগানো। মিউজিক বাজাল আষাঢ়। মৃদু স্বরে গান চলছে,
শোন গো দখিন হাওয়া
প্রেম করেছি আমি,
লেগেছে চোখেতে নেশা
দিক ভুলেছি আমি।
শোন গো দখিনো হাওয়া
প্রেম করেছি আমি।।
মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে তিয়াসা
জাগিল মধু লগনেতে বাড়ালো পিয়াসা,
মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে তিয়াসা
জাগিল মধু লগনেতে বাড়ালো পিয়াসা,
উতলা করেছে মোরে, আমারি ভালবাসা
অনুরাগে প্রেম সলিলে ডুব দিয়েছি আমি
শোন গো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি।।
_________________________________
ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে সামনে বসা মেয়েটিকে হিরণ প্রশ্ন করল, অপেক্ষা করতে নিষেধ করেছি। তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় নীরা।
প্রথম প্রেমের প্রথম প্রেমিক হিরণ। ভালোবাসার ফুল ফুটিয়ে এখন কত সুন্দর করে ই না বলছে বিয়ে করবে না। কতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করেছে তবুও হিরণের মন গলেনি। আজও আশা নিয়ে এসেছিল হিরণ তাকে অ্যাকসেপ্ট করবে কিন্তু না হিরণ এক কথাতেই অনড়। ঝুমঝুমির জন্য আষাঢ়ের জীবন জাহান্নামে পরিণীত হওয়ার পর থেকেই নীরাকে এড়িয়ে চলে হিরণ। বন্ধুর বেদিশা জীবনযাপনের জন্য নীরাকেও দায়ী মনে হয় ওর। সেদিন যদি নীরা জানাতো ঝুমঝুমির বিয়ের কথা তাহলে বন্ধুরা মিলে কিছু একটা করে বিয়ে ভেঙ্গে ঝুমঝুমিকে তুলে নিয়ে আসতো।
ছলছল চোখজোড়া চকচক করছে অশ্রুতে। হিরণের দিকে নির্লজ্জের মত তাকিয়ে রইল।তন্মধ্যে হিরণ চোখ তুলে নীরাকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” যাচ্ছে না কেন?
-” বিয়ে করছেন না কেন?
-” আমার ইচ্ছা তাই।
-” আমারও ইচ্ছা আমি যাবো না।
-” বেশি হয়ে যাচ্ছে না নীরা। ভুলে যাচ্ছ কেন তুমি একজন মেয়ে। মেয়েদের ছেলেদের পিছনে ঘুরঘুর করা ঠিক নয়। একদম বেআইনি।
-” পুরুষ যদি শখের নারীর পিছনে না ছুটে তাহলে তো নারীকেই ছুটতে হয় শখের পুরষের পিছনে।
হিরণ দুপলক তাকিয়ে ছাড়া কথা খোঁজে পেল না। দুরুদুরু বুকে ঢেউ খেলছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ঝুমঝুমি ফিরে এসেছে!
ঝুমঝুমি নামটি ঢোলের মত বাজছে নীরার কানে। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীর ফিরে আসা শোনে খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও কাঁদল না। অভিমানে মুখ সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হিরণকে আবারও বলল, বাসা থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে। আমি কি তাহলে রাজি হয়ে যাব? ছাব্বিশ বছরের মেয়েকে তো আর ঘরে রাখা যায়না লোক থু-থু ছুঁড়ছে।
-” বিয়ে করে নাও।
দাঁড়াল না নীরা। চোখের পানি মুছতে-মুছতে বিদায় হলো। নীরা চলে যেতেই হিরণ টেবিলের উপরে মাথা রেখে দুহাত নিচে রেখে চোখ বুজে রইল। নীরাকে আপন করে নিতে চাইলে প্রিয় বন্ধুর চোখে যদি সেও বেঈমান হয় তখন? না বন্ধুত্ব ভুলতে পারবে না সে।
ফোন বাজলো হিরণের। এলোমেলো দৃষ্টি বুলিয়ে দেখল আষাঢ়ের ফোন। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ঝুমঝুমির স্বামী মা’রা গেছে!
মানুষ ম’র’লে এত খুশি হওয়া যায় হিরণ জানত না। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল, নাজিমের কথা শুনে কিছু করিস নি তো? খু’ন? গু’ম?
রাগী কণ্ঠে ধমকে দিল আষাঢ়, বাজে বকিস না। ঝুমঝুমির স্বামী অনেক আগেই মা’রা গেছে।
-” আলহামদুলিল্লাহ। তো বলল কে?
খুশি হলো হিরণ। পথের কাঁটা আপনাআপনি সরে যাবে ভাবেনি। হিরণের খুশির জোয়ারে ভাটা পড়ল আষাঢ়ের উত্তর শুনে, ঝুমঝুমির মেয়ে বলেছে।
মেয়ের কথা শুনে চুপ মারলো হিরণ। বিয়ে হয়েছে মানা যায় কিন্তু মেয়ে। নাহ মানা যায়না।
-” এতে খুশি হওয়ার কী আছে? যেভাবে লাফাচ্ছিস মানুষ বিশ্বজয় করেও এভাবে লাফায় না।
-” ঝুমঝুমিকে জয় করার চেয়ে বিশ্বজয় দ্বিতীয় আছে হিরণ? মিরাজ,নাজিমকে বলিস রাতে আসতে। প্ল্যান আছে।
-” হুম।
ফোন কাটলো। হিরণের ঠোঁটে ফুটলো খুশির জোয়ার। অবশেষে ওর ভালোবাসার প্রাপ্তি ঘটবে বলে দুবার হাত ঘুরিয়ে নাচলো। ফোন দিল নীরার নাম্বারে। রিসিভ হতেই হিরণ বলল,
-” পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়ালে পা কে’টে হাতে ধরাবো। বাসায় প্রস্তাব পাঠাচ্ছি।
-” পাঠানোর আগেই রিজেক্ট করলাম। আমাকে ইগনোর করার শাস্তি।
ফোন কাটলো নীরা। ফোনে রাগ প্রকাশ করলেও মনে-মনে সে খুব খুশি। একবার যেহেতু বলেছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে তাহলে তো হিরণ পাঠাবেই। ঝুমঝুমির ফিরে আসাতে ওর জীবনে নতুন খুশির আগমন ঘটেছে।
____________________
ধরণী জুড়ে কালো আঁধারের খেলা। আকাশে কৃষ্ণ-কালো মেঘে ভরপুর। বাতাস বইসে তীব্র বেগে। কিয়ৎক্ষণ পরপর গগন কাঁপিয়ে চিৎকার। রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে ঝুমঝুমি। রাতের তৃতীয় প্রহর।
“প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী। তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে চতুর্থ প্রহরে যোগী।”
মনে মনে আউরালো ঝুমঝুমি। বৃষ্টিময় রাতের বজ্রপাতে ঝিনুক ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। ঘুমের ঘোরে ওর ছোট্ট দুটো হাত মায়ের বুকে। ঝুমঝুমির চোখে ঘুম নেই।
ধরণীতে বৃষ্টির ছোঁয়া পড়তেই বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরা বন্ধ করেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বাহিরে ঝড়,ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চিন্তা ভাবনায় ব্যাস্ত ঝুমঝুমি। সিলেট ছেড়ে ঢাকা আসার কারণ এখনও সফল হয়নি। প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝেও ছুঁইছুঁই করে ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। কয়েকটি বছর নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখেও মনের শান্তি মিলেনি। পাঁচ বছরের হিসাব,জীবনের হিসাব করায় গুন্ডে নিবে বলে ই আবারও আসা।
ঘটঘট শব্দ কানে বাজতেই ঠোঁটে প্রসারিত হাসি ফুটলো ঝুমঝুমির। পিছু না ঘুরেই বলল, খালা আসো।
-” তোমার কী হইছে মা? আমারে ডাকলা কেন? তুমি তো বৃষ্টি ডরাও না?
-” ভয় পাইনা খালা। আমার জীবনে ভয়ের অস্তিত্বও নেই। ভয় মানুষের মনে রোগবালাই সৃষ্টি করে। ভয়কে জয় করার জন্য দরকার মনোবল। মনোবল ই হলো আসল মেডিসিন।
-” তুমি মেলা সাহসী মা।
হাসলো ঝুমি। আঙুল নাড়াচাড়া করে বলল,
-” খালা, তুমি ঝিনুকের সাথে থাকো আমার যেতে হবে?
ভয় পেল হালিমা। বাইরে চলছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। এসময় ঘরে থাকতেও ভয় হচ্ছে। কণ্ঠে তীব্র ভয় রেখেই বলল, পাগল হইছো? কই যাইবা? তোমার মন আমি বুঝি না হুটহাট রাত কইরা কই যাও তুমি।
-” হিসাব মিলাতে যাই খালা।
শান্ত কণ্ঠে বলল ঝুমঝুমি। কিন্তু হালিমার কানে বাজলো ধারালো ছু’রি’র বেখেয়ালি শব্দের মতন। মনে ভয় জাগ্রত হলো কিন্তু প্রশ্ন করল না। ঝুমঝুমির মতোই ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল।
##চলবে,,