প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-৪৬+৪৭

0
556

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৬
,
কালো রঙের গাড়িটা বেশ বড়সড় একটা বাড়ির সামনে এসে থামলো। জোসেফ রৌদ্রকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলো। গাড়ি থেমে গেছে ভেবে জয় ও ডিকি থেকে বের হলো। হাঁটু মোড়া দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে। হাঁটু আর প্যান্ট ভালো মতো ঝেড়ে নিলো। সাদা ইউনিফর্ম টাই ধূলো লেগে গেছে। ভালো মতো ঝেড়েঝুড়ে সামনের দিকে তাকালো। কাঁধের স্কুল ব্যাগটা কাঁধ থেকে একটু ঢিলা করে আশেপাশে তাকালো।

“এই যা মেজো ভাইয়া কোন দিকে গেলো ওই লোকটার সাথে এখন কীভাবে বুঝবো?

চারপাশে বেশ ভালোমতো তাকালো জয়৷ এদিকটায় মানুষজন বেশ কম। সামনে বড় একটা বাড়ি হয়ত বাড়িটার ভিতরে গিয়েছে। তবে গেটের সামনে দুজন দারোয়ান দাঁড়ানো। জয় সেদিকে গিয়ে দারোয়ান এর সামনে দাঁড়িয়ে বেশ সোজা ভাবে বলল।

” আমার মেজো ভাইয়াকে দেখেছেন?

জয়ের কথায় দারোয়ান ওতোটা গুরুত্ব দিলো নাহ। ভাবলো ছোটো মানুষ হয়ত হারিয়ে গেছে। এই জন্য তিনি বেশ নরম গলায় বলল।

“নাহ আমরা তোমার মেজো ভাইয়াকে দেখেনি। তুমি এখানে কেনো বাবু যাও বাড়ি যাও।

” বাড়ি যাবো কেনো? আমি আমার মেজো ভাইয়া কে নিয়েই বাড়ি যাবো। আর আমি জানি মেজো ভাইয়া এই বাড়িতেই গিয়েছে আপনারা বলছেন নাহ।

“এতো বেশ অবাধ্য বাচ্চা। ভালো কথা বললাম তবুও শুনলো নাহ।

কথাটা অপর দারোয়ান বলে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল।

” এই যাওতো এতো বেশি কথা বলো কেনো। আর এখানে তোমার ভাই নেই যাও।

জয়ের বেশ রাগ হলো। তবে কিছু বলল নাহ। বাধ্য ছেলের মতো গেটের সামনে থেকে চলে গেলো। কিন্তু ওর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কোনো দুষ্ট বুদ্ধি।
,,,,,,,,,,,,

“এখন কি হবে। আমি এতো করে বললাম ইমরান ভাইয়া আপনি আমার দিকে ধ্যান নাহ দিয়ে ওই গাড়িটাকে ফলো করেন। শুনলেন নাহ আমার কথা এখন তো গাড়িটিকে হারিয়ে ফেললাম। কোন দিকে গেলো সেটাও জানি নাহ।

” আমরা গাড়িটা পরেও খুঁজতে পারবো৷ কিন্তু আপনি তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ম্যাম। এখন আমাদের হসপিটাল এ যাওয়া প্রয়োজন।

“এটা কি ধরনের কথা বলছেন ইমরান ভাইয়া। ওই গাড়িতে জয় রয়েছে। এতোক্ষণে ওর কিছু হয়ে গেলো কিনা সেটাও জানি নাহ। রৌদ্র ভাইয়ার ফোনটাও বন্ধ আসছে। সমুদ্র যাওয়ার আগে আমাকে ওদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমি কীভাবে ওদের কথা ভুলে নিজের কথা ভাবি। আমি ঠিক আছি আপনি প্লিজ কারো কাছে জিগাস করে দেখেন কেউ ওই গাড়িটা দেখেছে কি নাহ।

শশীর কথা শুনে হতাশ শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো ইমরান। ম্যামও ঠিক তার স্যারের মতোই জেদী। মেইন রোডে গাড়িটাকে নজরে রেখেছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়িটা ডান দিকে মোড় নিয়ে একটা গলির মধ্যে চলে গেলো। সামনে আরো অন্য গাড়ি ছিলো বিধায় ওদের গাড়িটা বেশ পিছনে পড়ে গিয়েছে। তবে যখন ওরা গলির মধ্যে গেলো। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পরে সামনে দুটো রাস্তা যা দুদিকে চলে গেছে। কালো গাড়িটা ঠিক কোন দিকে গেছে এটা ওদের অজানা। ইমরান গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকালো বড় বড় বিল্ডিং ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সামনে থেকে যদি আরো একটা গাড়ি আসে তাহলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। গলির মধ্যে দিয়ে এতোটাই জায়গা। ইমরান পুনরায় গাড়িতে এসে বসে শশীর দিকে তাকালো। শশী পেটের বেথ্যায় একদিকে কাঁত হয়ে হেলান দিয়ে আছে। ইমরান একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল।

” ম্যাম এই পাশের রাস্তাটা বন্ধ কাজ চলছে।

“তাহলে আমাদের এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া উচিত। আপনি গাড়ি স্টার্ট দেন ইমরান ভাইয়া।
,,,,,,,,,,,,

বাইরে থেকে বাড়ির মতো মনে হলেও আসলে এটা বাড়ি নয় কোনো গুদাম ঘর। ভিতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছোটো ছোটো কাঠের বাক্স সাজানো। আর তার সামনে বস্তা সাজানো। জোসেফ রৌদ্র কে নিয়ে ভিতরে আসতেই রৌদ্র অবাক হয়ে আশেপাশে দেখলো। কৌতূহল নিয়ে জোসেফ কে জিগাস করলো।

” এটা কোন জায়গা? তুই নাহ বললি তোর বাসায় যাবি তাহলে এটা?

রৌদ্রের কথায় জোসেফ বাঁকা হাসি দিয়ে রৌদ্রের কাঁধে নিজের হাত রেখে বলল।

“আর এতো তাড়া কিসের আগে ভিতরে চল তারপর আপনাআপনি সবটায় জেনে যাবি।

জোসেফ এর কথাটা রৌদ্রের তেমন পছন্দ হলো নাহ। কাঁধ থেকে জোসেফ এর হাত সরায়ে বলল।

” আজকে নয় অন্য কোনোদিন আসবো। এখন আমাকে যেতে হবে। জয় বাসায় গেছে কিনা তাও জানি নাহ। তুই আমার ফোনটা দে আমি বাড়িতে যাবো।

“আরে যাবে যাবে এতো তাড়া কীসের। প্রথমবার আসলে কোনো আ্যাপায়ন ছাড়াই যেতে দেবো। তা আবার হয় নাকি। জানো নাহ অতিথি সম্মানিয় ব্যাক্তি।

পিছন থেকে আসা মেয়েলি স্বরে জোসেফ রৌদ্র দুজনেই সেদিকে তাকালো। মালবিকাকে দেখে জোসেফ বাঁকা হাসি দিলেও রৌদ্র অবাক চোখে মালবিকার দিকে চেয়ে আছে। এই মহিলা কে ও চেনে। মায়ের কাছ থেকে জেনেছে চাচ্চুর সাথে এই মহিলার সম্পর্ক ছিলো। তবে সেটা অর্ধেক পুরো সত্যিটা সমুদ্রের থেকে শোনা৷ যেটা ওর মায়েরও অজানা। মালবিকা কে দেখে রৌদ্র রাগী চোখে তাকিয়ে বলল।

” আপনি এখানে? আর জোসেফ এই মহিলা এখানে কি করছে। একে আমার সামনে থেকে সরে যেতে বল নয়ত আমার হাতে কোনো খুন হয়ে যাবে।

কথায় বলে নরম মনের মানুষের রাগ ভয়ংকর হয়৷ তবে তারা সেটা প্রকাশ করে নাহ। সব সময় যারা চুপ থাকে রাগলে তারা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। রৌদ্র ও ঠিক সেই রকম। রৌদ্রের এমন কথাশুনে মালবিকা হেসে সামনে রাখা চেয়ারে বসল। অতঃপর বাঁকা হেসে বলল।

“এতো রাগ? কিন্তু আমার জানা মতে তো তুমি রাগ করতেই পারো নাহ। তবে তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। আসলে তুমি না ঠিক অভিক এর মতো হয়েছো। প্রচন্ড বোকা। সল্প কথায় যে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলো। সে কে তার পরিচয় কি এসবের কোনো খোঁজ না নিয়েই বন্ধুত্ব করে ফেলো। তবে তোমার বড় ভাই সম্পূর্ণ আলাদা এই জন্যই তো ওকে শেষ করতে আমার এতো পরিকল্পনা করতে হলো।

মালবিকার কথাশুনে রৌদ্র রেগে তেড়ে এসে মালবিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল।

” কি করেছেন আমার ভাইয়ার সাথে?

“তেমন কিছুই করেনি শুধু আস্তে করে আমার রাস্তা থেকে সরানোর ব্যাবস্হা করেছি। এতোক্ষণে হয়ত সরেও গেছে। ঠিক তোমার বাবা কাকা কে যেভাবে আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে ছিলাম তেমন ভাবে।

রাগে রৌদ্রের মুখ লাল হয়ে গেছে। পুরো শরীর কাঁপছে। তবে মালবিকার কথাশুনে রৌদ্র অবাক হলো। ওর বাবা আর চাচ্চুর মৃত্যুর পিছনে এর হাত ছিলো? কই ওতো জানে নাহ। তাই রৌদ্র বুঝতে না পেরে বলল।

” মানে?

“আচ্ছা তাহলে আমাদের রৌদ্র বাবু দেখি কিছুই জানে নাহ। সমুদ্র দেখি তোমাকে কিছুই জানাইনি। ওকে ব্যাপার নাহ। আমি তোমাকে সবটা জানাচ্ছি। কি বলোতো কারো শেষ ইচ্ছে টা পূরণ করা আরেকজনের কর্তব্য। তোমার বাবা ছিলো একজন সৎ আর্মি অফিসার ঠিক সমুদ্রের মতো। তো সৎ হবে ভালো কথা ঘুরে ফিরে আমাদের পিছনে লাগতে আসার কি দরকার ছিলো? এর জন্য তো পুলিশ ছিলোই। কিন্তু নাহ ওনার তো সব বিষয়ে নাক গলানোর স্বভাব। আমার বিজনেস এর দিকে ঝোঁক টা বেশি ছিলো। সাথে ছিলো টাকার প্রতি লোভ। টাকার জন্য সবকিছু করতে রাজী ছিলাম৷ চতুর বৃদ্ধির জন্য ভাইয়ের বেশ কাছের ছিলাম। আমার ভাই তখন সদ্য মন্ত্রী পদ পেয়েছে। কি বলোত সৎ পথে না বেশি টাকা ইনকাম করা যায় নাহ৷ এতো মানুষের দেশের সেবা করে লাভ কী? তাই জন্য আমরা অন্য ব্যাবসাও শুরু করলাম। কিন্তু সেটা তোমার বাবার পছন্দ হলো নাহ। মেয়েদের এভাবে পাচার হওয়া দেশে অবৈধ অস্ত্র আসা এসব কোন সৎ অফিসার এর পছন্দ হয় বলো? যাই হোক তোমার কাকু তখন সদ্য ট্রেনিং শেষে জয়েন করেছে। সমুদ্র ও বেশ বড় তুমিতো তখন নিতান্তই ছোট ছিলে। তোমার বাবার জন্য আমাদের বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। সেই জন্য আমি এক প্লানিং করলাম। কি বলোত? তোমার বোকা কাকু কে প্রেমের ফাঁদে ফেলার।

এই টুকু বলেই মালবিকা বাঁকা হাসি দিলো। রৌদ্র পারে নাহ সামনে থাকা মালবিকা কে নিজে হাতে খুন করতে। কোনো সন্তানই এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের বাবা কাকার এমন নির্মম মৃত্যুর বর্ণনা শুনতে পারে নাহ। মালবিকা আয়েস করে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল।

“তবে তোমার বাবাকে মারতে আমাদের বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি সে নিজেই কোনো এক মিশনে গিয়ে মারা গিয়েছে। তবে হ্যাঁ তোমার কাকা কে আমি নিজ দায়িত্বে মেরেছি।

কথাটা বলেই মালবিকা হাসি দিলো। রৌদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলো।

” তখন হয়ত জয় সম্ভবত তোমার মায়ের পেটে ছিলো। তুমিও বেশ বড়ই। সমুদ্র তো বুদ্ধিমান হয়ে গিছিলো। কি বলোত তোমার পরিবারের লোকেরা বেশ সহজ সরল এই জন্য তাদেরকে বোকা বানানো ভীষণ সহজ। এতো নিরীহ দের মারতে আমার ভীষণ খারাপ লেখেছিলো। কিন্তু কি আর করার বলো। নিজে বাঁচতে হলে তো পথের কাঁটাকে সরাতেই হতো। অভিক আমার প্রেমে মজে ছিলো। বোকা ছেলেটা বুঝতেও পারলো নাহ সে কতবড় চক্রান্তের শিকার হচ্ছে । তবে আমার পুরো খেলাটা ভেজতে দিলো ওই সমুদ্র। আমাকে অন্য লোকের সাথে হোটেলে দেখে ফেলে। যুবক বয়স তো সব কিছুতে কৌতুহল নিতান্তই বেশি। এইজন্য আমাকে রীতিমতো ফলো করা শুরু করলো। অভিক তো ব্যাস্ত তার এসবের জন্য সময় কোথায়। কিন্তু সমুদ্র সে আমার পিছু ছাড়লো নাহ। আমার অজান্তেই সবকিছু তদন্ত করলো। আর সবটা সুন্দর মতো অভিককে বলেও দিলো। কিন্তু অভিক সেতো প্রমে অন্ধ ছিলো। ভাইয়ের ছেলের কথা কেনো বিশ্বাস করবে৷ তার উপর ছোট মানুষ হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে ভেবে পাত্তা দিলো নাহ। আমিও সেটার সুযোগ নিলাম। কিন্তু সমুদ্র? ওতো নাছোড়বান্দা সবটা অভিককে বিশ্বাস করায়ে তারপর দম নিলো। এতোবড় ধোঁকা অভিক মেনে নিতে পারেনি। আমার কাছে এসে হাত ধরে বলে। মালা আমরা চলো কোথাও পালিয়ে যায় এসবে কিছুই লাগবে নাহ। দুজনে ঠিক কোথাও না কোথাও নিজেদের ব্যাবস্হা করে নিতে পারবো। হায়! গাধা একটা। এতো ভালোবাসা যে এদের কোথায় থাকে। ওফ!

কথাগুলো বলে অভিক এর উপর হাসলো মালবিকা।

“কিন্তু আমিতো রাজি ছিলাম নাহ৷ সরাসরি ওকে না করে দিই। তবে বেচারা প্রেমে বেথ্যা পেয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আমাকে হুমকি দিলো যদি না শুধরে যায় তাহলে আমাকে শাস্তি দিবে। ব্যাস এটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়ালো। ওই রাতেই পরিকল্পনা মতো ওকে বিষ দিয়ে শেষ করে দিলো আমার দলের লোকেরা। কি বলোত টাকার কাছে সবাই গোলাম। ওর সঙ্গীদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু খুব দুঃখ লাগলো বেচারা মরেও শান্তি পেলো নাহ। ওর ঘাড়ে দায় চাপলো ড্রাগস আর অবৈধ অস্ত্র পাচার এর। এটা অবশ্য চাপেনি আমিই চাপিয়েছি। ক্যাপ্টেন অভিক ইকবাল লোভে পড়ে নিজের সততা কে টাকার কাছে বিক্রি করে খারাপ কাজের সাথে যুক্ত ছিলো। নিজের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে রাতের অন্ধকারে বিষ পান করে নিজের জীবন ত্যাগ করেছে। সুন্দর নিউজ টা শুনলেও মনটা ভরে যায়। আজও সেই গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে বেচারা। মরে গিয়ে শান্তি পেলো নাহ।

মিছে মিছে দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করলো মালবিকা। রৌদ্র রেগে তেড়ে এসে আচমকা মালবিকার গলা টিপে ধরল। যেনো আজকেই এই মহিলাকে শেষ করে দিবে।

“আমার নিষ্পাপ পবিত্র চাচ্চুর চরিত্রের উপর এমন নোংরা দাগ লাগাতে তোর একবারও ভয় লাগলো নাহ? আরে সেতো তোকে ভালোবেসে ছিলো আর তুই তার সুযোগ নিলি। তোর মতো মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

রৌদ্রের উপর যেনো অসুরের শক্তি ভর করেছে। দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম মালবিকার। জোসেফসহ আরো কয়েকজন মিলে রৌদ্রকে টেনে সরিয়ে আনলো। ছাড়া পেতেই কাশতে লাগলো। গলা ডলে পাশ থেকে পানি খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল মালবিকা। রৌদ্র নিজেকে ছাড়ায়ে জোসেফ এর কলার ধরে রেগে বলল।

” আর তুই কি বলতো তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই। রাগ তো আমার নিজের উপর হচ্ছে। যে তোর মতো কাউকে আমি বিশ্বাস করেছি। বন্ধুত্বের যোগ্য তুই নোস।

কথাটা বলেই জোসেফ এর নাক বরাবর ঘুষি মারলো। জোসেফ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। নিজের নাকে হাত দিয়ে দেখলো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বাঁ হাতে সেটা মুছে। উঠে দাঁড়িয়ে রেগে রৌদ্রের দিকে তেড়ে যেতে গেলে পিছন থেকে মালবিকা থামিয়ে দিয়ে বলল।

“না! কোনো মারামারি নয়। তুই বরং তোর বন্ধু কে আমাদের নতুন আসা জিনিসগুলো টেস্ট করা। একটাও বাদ রাখবি নাহ। কি বলতো আমরা আমাদের বাড়িতে আসা মেহমানদের একটু অন্যভাবে ট্রিট করি।

কথাটা বলে মালবিকা বাঁকা হাসলো। জোসেফ এর মালবিকার ইশারা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে রৌদ্রকে টেনে ভিতরের একটা রুমে নিয়ে গেলো। রৌকে নিয়ে যেতেই ওখানে শশী আর ইমরান এসে উপস্থিত হলো। শশী সামনে মালবিকা কে দেখেই চমকে গেলো। গেটের সামনে কালো গাড়িটা দেখে ভিতরে এসেছে। তবে এখানে এসে মালবিকাকে দেখবে এটা আশা করেনি। মালবিকা শশী কে দেখে অবাক হওয়ার অভিনয় করে বলল।

” আরে এসো এসো আজকে তো দেখি আমার বাড়িতে চাঁদের হাট লেগে লেগো। মানে আশা না করতেই সবকিছু হাতের নাগাড়ে চলে আসছে। আর আসতে তো হবেই সময়টা যে এখন মালবিকার।

মালবিকার কথাশুনে শশী কোনো উত্তর দিলো নাহ৷ হাতটা পেটে রেখে বহু কষ্টে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল।

“জয় কোথায়?

কথাটা শুনতেই এবার মালবিকা সত্যিই অবাক হলো৷ কেননা প্লান মোতাবেক ওরা রৌদ্র কে এনেছে জয়কে আনেনি৷ তাহলে এরা জয়ের কথা কেনো জিগাস করছে? পরক্ষণেই মালবিকা কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে শশীর দিকে এগিয়ে গেলো। শশীর ফুলের উঠা পেটের উপর হাত রেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল।

” ক’মাস চলে এখন?

শশী কিছুটা পিছিয়ে এসে আতংকিত গলায় বলল।

“খবরদার আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করবেন নাহ। ভালোই ভালোই বলুন জয় কোথায়?

” আরে আমি জানি নাহ জয় কোথায়। কি বলোত জানলেও বলতাম নাহ।

কথাটা বলেই বাঁকা হাসলো মালবিকা। পরক্ষণেই দুঃখি মুখ করে শশীর দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলল।

“আহারে বাচ্চাটার জন্য বড়ই দুঃখ হচ্ছে। বেচারা বাবার মুখটাও দেখতে পাবে নাহ।

মালবিকার কথাশুনে শশী আতংকিত চোখে মালবিকার দিকে তাকালো। তবে শশী কিছু বলার আগেই ইমরান সামনে এগিয়ে এসে বলল।

” একদম ম্যাম কে ভুলভাল কিছু বলবেন নাহ। ভালোই ভালোই বলে দিন জয় কোথায়। আমরা পুলিশকে ইনফর্ম করে দিয়েছি৷ পুলিশ এসে সব কটাকে জেলে পুড়ে দিবে।

ইমরানের কথায় মালবিকার কিছু এলো গেলো নাহ৷ আরাম করে আবার চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল।

“হ্যাঁ আসুক পুলিশ আমিও অপেক্ষা করছি। তবে আমাকে একটা কথা বলো। পুলিশ আসলে তোমরা কি বলবে? আমি জয়কে কিডন্যাপ করেছি? কিন্তু প্রমাণ কোথায়? আর তোমরাও এখানে নিজে ইচ্ছে এসেছো কেউ জোর করে তোমাদেরকে আনেনি৷ আর মুক্তি পনের জন্য তোমাদের কল ও করেনি আমি৷ তাহলে এবার আমাকে বোঝাও পুলিশ আমাকে কেনো ধরবে?

মালবিকার কথায় এবার ইমরান দমে গেলো। তবুও সেটা প্রকাশ না করে পুনরায় কিছু বলতে যেতেই ঘাড়ে কিঞ্চিৎ বেথ্যা অনুভব হলো। সাথে সাথে সেখানে হাত দিতেই পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। শশী ভয়ে ইমরান এর কাছে গেলো তবে ও নিচে বসতে পারলো নাহ পেটে চাপ অনুভব হলো। মালবিকা মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ শব্দ করে বলল।

” মাঝখান থেকে এই বেচারাকে বলি হতে হলো। এসব নিরীহ মানুষ কে মারতে আমার একদম ভালো লাগে নাহ। যাওতো ওকে বাইরে কোথাও সযন্তে ফেলে আসো।

“কি করেছো ইমরান ভাইয়ার সাথে সত্যি বলো।

শশীর কথা শুনে মালবিকা শশীকে শাম্ত করার ভঙ্গীতে বলল।

” আরে কুল কুল ওকে প্রাণে মারেনি শুধু বেশি লাফানোর জন্য শাস্তি দিয়েছি।

দুজন লোক এসে ইমরান কে টেনে নিয়ে গেলো। শশী সেদিকে তাকিয়ে আবার কিছু বলতে যেতেই একজন লোক জয়কে টানতে টানতে ভিতরে এনে মালবিকাকে বলল।

“ম্যাম এই পিচ্চি টা বাইরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিলো এটাকে কি করবো?

কথাটা শুনতেই শশী পিছন ফিরে জয়কে দেখলো৷ মালবিকা জয়কে দেখে খুব খুশি হলো। ইশারায় লোকটিকে বলল জয়কে ছেড়ে দিতে৷ জয় ছাড়া পেতেই শশীকে জড়িয়ে ধরলো। শশীও জয়কে আগলে নিলো। মালবিকা কিছু বলল নাহ। তখন ওখানে জোসেফ আসলো। ও শশী আর জয়কে খেয়াল করেনি। মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল।

” কাজ শেষ।

মালবিকা বাঁকা হেসে ইশারায় পিছনে তাকিয়ে বলল।

“সবে তো শুরু।

জোসেফ ও পিছনের দিকে তাকালো। অতঃপর শশীকে এখানে দেখে বলল।

” আরেহ বাহ সমুদ্রের পুরো পরিবার যে এখানে। তাহলে আমাদের কষ্ট কম হয়ে গেলো। না চাইতেই সবকিছু হাতের মুটোয় হাজির৷

কথাটা বলে বিচ্ছিরি একটা হাসি দিলো। শশী ভয়ে জয়কে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ভিতরে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলো নাহ। শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো পুলিশের আসার। ওরা এখানে আসার আগে পুলিশকে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে তবে আসতে এতো দেরি কেনো হচ্ছে । জোসেফ শয়তানি হাসি দিয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল।

“ওহ ফুপি আমার মাথায় একটা দারুন আইডিয়া এসেছে৷

” বলে ফেল।

“বাইরে সমুদ্রের প্রাণের স্ত্রী আর ভিতরে মাতাল ভাই। এদের দুজনকে দিয়ে একটা ভিডিও বানালে কেমন হয়? কালকের রসালো হেড লাইন। মৃত অফিসার সমুদ্রের স্ত্রীর সাথে তারই ছোট ভাই এর অন্তরঙ্গ গোপন ভিডিও ফাঁস। আহা ভাবলেও শান্তি লাগছে।

কথাটা বলেই জোসেফ আর মালবিকা হেসে উঠল।

” আরে নাহ এটা তো এখন ওসমানের ওকে দিয়ে আমাদের কি কাজ।

শশী চমকে ওদের দিকে তাকালো। তারমানে রৌদ্র ভাইয়া ওদের কাছে৷ শশী কাঁপা গলায় বলল।

” রৌদ্র ভাইয়া কোথায়? কি করেছেন ওনার সাথে?

জোসেফ শশীর দিকে এগিয়ে এসে বলল।

“বাহ স্বামীর থেকে তার ভাইয়ের জন্য চিন্তা দেখি বেশি।

” এই আপনি আমার মেজো ভাইয়ার বন্ধু নাহ? আমার ভাইয়া কোথায়?

জয়ের কথাশুনে জোসেফ হাসলো তবে কিছু বলল নাহ। শশী কিছুই বুঝতে পারছে নাহ৷ এই লোককে সে চেনে তবে এই লোকটি যে ওই মহিলার আত্মীয় তা জানতো নাহ। মনে মনে ভয় পেলেও নিজেকে শক্ত রাখলো এখানে ভয় পেলে হবে নাহ৷ শক্ত হাতে এদের কে প্রতিহতো করা লাগবে। জোসেফ ইশারা করতেই ভিতর থেকে রৌদ্রকে আনলো। রৌদ্র পুরোপুরি মাতাল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পযন্ত পারছে নাহ৷ ঝাপ্সা চোখে সামনে তাকিয়ে আবছা আবছা শশী আর জয়কে দেখলো বোধহয়। তবে দেখেও কিছু করতে বা বলতে পারার মতো শক্তি ওর নেই৷ শশী রৌদ্র কে এভাবে দেখে আতংকে চিৎকার করে নাম ধরে ডাকলো। তবে রৌদ্রের কোনো সাড়া নেই। মালবিকা জোসেফ এর দিকে তাকিয়ে বলল।

” সাবাশ বেটা, এবার এটাকে সসম্মানে হাইওয়ে তে চলন্ত গাড়ির সামনে ছেড়ে দাও৷

কথাটা শুনতেই শশী চমকে উঠল। দৌড়ে রৌদ্রের কাছে যেতে গেলেও পারলো নাহ। পেটের মধ্যে বেথ্যা করে উঠল। পেট ধরে মাঝ পথেই দাঁড়িয়ে পড়ল। জয় গিয়ে জোসেফ এর হাতে কাঁমড় দিলে জোসেফ ধাক্কা দিয়ে জয়কে পাশে ফেলে দিলো। সবাই রৌদ্র কে নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। মালবিকা শশীর দিকে তাকিয়ে বলল।

” যাও গিয়ে পারলে নিজের দেবরকে বাঁচিয়ে নাও। কেউ তোমাকে বাঁধা দিবে নাহ। আমি কথা দিচ্ছি। আর আমি এখন বসে বসে আরাম করে তোমাদের পরিবার টাকে ধ্বংস হতে দেখবো। তোমার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করেছে।

শশী বুঝলো মালবিকাকে কিছু বলে লাভ নেই৷ এই মহিলার মায়া দয়া কম। শশী কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চলে গেলো। জয় ওদের পিছু পিছু আগেই চলে গেছে। হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তবুও বাইরে গিয়ে সিএনজি পেয়ে গেলো। ওতে জয়কে নিয়ে উঠে বসলো। সোজা মেইন রোডে গিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই দেখলো রৌদ্র মাঝ রাস্তায় টলছে। শশী যেতে গিয়েও পারছে নাহ৷ চলন্ত গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। তার উপর পেটে অসয্য যন্ত্রণা। জয় শশীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কাঁধের ব্যাগটা শশীর হাতে দিয়ে বলল।

“তুমি বসো আমি ভাইয়া কে আনছি।

শশী জয়ের হাত ধরে ফেললো কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে নিষেধ করলো যেনো না যায়৷ তপ্ত দুপুরে রাস্তায় মানুষ কম শুধু গাড়ি চলছে৷ আর যারা আছে তারা ফিরেও দেখছে নাহ। শহরে এমনি হয় কেউ যেছে এসে বিপদে পড়তে চাই নাহ। জয় শশীর কথা শুনলো নাহ৷ হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেলো। শশী বেথ্যা সয্য করতে না পেরে ফুটপাতে বসে পড়েছে৷ বারবার নিষেধ করছে তবে জয় শুনলে তো। রৌদ্র টলছে কোনো হুশ জ্ঞান নেই। জয় কোনো দিকে না দেখে দৌড়ে যেতে গেলেই ডান দিক থেকে মালবাহি ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা দিলো। ছিটকে ইটের ফুটপাতে পড়ে গেলো। সাদা ইউনিফর্ম লাল রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেলো। উপুড় হয়ে পড়েই গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলো। শশী জয়ের অবস্থা দেখে চিৎকার করে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলো। মাথা তুলে কোলের উপর নিতেই নেতিয়ে পড়ল। শশী চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে তবে কেউ শোনেনি। ওদিকে রৌদ্রকেও মালবিকার কথামতো অন্য একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিলো। রৌদ্র গাড়ির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলো। শশী রৌদ্রের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার করে কান্না করছে৷ পরপর দুটো এক্সিডেন্ট হওয়ায় গাড়িগুলো থেমে গেছে। গাড়ি থেকে মানুষ জন নেমে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে হাত দিতে ভয় পাচ্ছে। শশী পাগলের মতো কান্না করছে। মাঝ রাস্তায় এমন জটলা দেখে ট্রাফিক পুলিশ ও ওখানে আসলো। বাইক থামিয়ে নেমে এসে ঘটনা দেখে দ্রুত একটা গাড়ি দেখে ওদের তিনজনকে গাড়িতে তুলল।
,,,,,,,,,,,,,,
জঙ্গল থেকে পুড়ে যাওয়া বডিসহ আরো কয়েকটা ডেডবডি উদ্ধার করেছে। শুকনো পাতার নিচে পুড়ে যাওয়া একটা বডি অবহেলায় পড়ে আছে। শরীরের একাংশ পুড়ে গেছে। ক্ষতে মাছিগুলো ভন ভন করে উড়ছে। ওসমানকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে সেন্যারা পুনরায় জঙ্গলে এসেছে। তাদের সৈনিকদের বডি উদ্ধার করতে। একে একে বেস কয়টা বডি উদ্ধার করা হয়েছে। সমুদ্রের বডিটা একপাশে শুকনো পাতার নিচে পড়ে আছে। পুরো শরীরের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। মাছি ভন ভন করছে। সব শেষে সমুদ্রের কাছে আসলো। সকলের চোখে পানি টলমল করছে। সমুদ্রের সাথে তাড়া অনেক মিশনে সফল হয়েছে। তাদের স্যার তারা একজন দায়িত্ববান অফিসার কে হারিয়ে ফেলল। সকলে এক সারিতে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো সমুদ্রের বডিকে। অতঃপর হেডস্যারের আদেশে সমুদ্রের বডিকে তুলতে গেলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সমুদ্রের পুড়ে যাওয়া হাতটা ধরলো। এই সেই মানুষ যে সব সময় সকল পরিস্থিতিতে সাহস যুগিয়েছে। সম সময় দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এই লোকটি এমন একজন যাকে দেখলে সম্মানে মাথা এমনিই নুইয়ে যাই। আজ সেই মানুষ টা হারিয়ে গেলো সারা জীবনের মতো। কেউ আর কখনো বলবে নাহ সব সময় নিজের লক্ষের দিকে এগিয়ে যাবে। আশেপাশে যা কিছুই হয়ে যাক নাহ কেনো। সৈনিক টি টলমল চোখে সমুদ্রের পোড়া মুখের দিকে তাকালো অতঃপর দুজনে মিলে সমুদ্র কে তুলতে গেলে চমকে পুনরায় সমুদ্রের মুখের দিকে তাকালো।

#চলবে?

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৭
,
শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সমুদ্র। চারপাশে পাখির সুমধুর ডাক। প্রকৃতি কত সুন্দর। শুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। নিজেকে কেমন হালকা পাখির ন্যায় লাগছে। এতো শান্তি কখনো অনুভব হয়নি। সামনে থেকে সাদা আলোর বলক থেকে তীক্ষ্ণ আলোর রশ্মি আসছে। সমুদ্র মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেদিক পানে এগিয়ে গেলো। গোল বলের মতো জিনিসটা থেকে সাদা আলো ভেসে আসছে। সমুদ্র মহিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওইতো ওর বাবা আর কাকু দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে আছে। কত সুন্দর লাগছে কতটা পবিত্র আর স্নিগ্ধ। হাত বাড়িয়ে সমুদ্র কে নিজের দিকে ডাকলো। যেনো ছোট্ট সমুদ্র কে কাছে ডাকছে আদর করার জন্য। সমুদ্র ও ছোট বাচ্চার মতো বাবার দিকে এগিয়ে গেলো। যেনো ওখানেই সব সুখ লুকিয়ে আছে। যেনো ছোট্ট সমুদ্র এখনি বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাবার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরার জন্য সেদিকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ অনুভব হলো বাম হাতের একটা আঙুল কেউ শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। সমুদ্র বাবার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা থেমে গেলো। মাথা নিচু করে নিজের আঙুল ধরে রাখা মানুষ টার দিকে তাকালো। ছোট্ট একটা প্রাণ ওরই মতো শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র তাকাতেই মিষ্টি করে হাসলো। সমুদ্র অবাক হয়ে সেই হাসির দিকে চেয়ে আছে। কত নির্মল আর পবিত্র সেই হাসি। দেখলেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সমুদ্র অবাক চাহনিতে সেদিকে চেয়ে থাকলো। সামনে থেকে পুনরায় সমুদ্রের নাম ধরে কেউ ডাকলো। সমুদ্রের ধ্যান ভেঙে গেলো। সামনে থাকা বাবার দিকে চেয়ে সেদিকে হাত বাড়াতেই বাম হাতের আঙুল ধরে রাখা ছোট্ট প্রাণটা মিষ্টি কন্ঠে ডেকে উঠল।

“বাবা!

আহ, কি শান্তি এই ডাকটায়। কতটা মধুর এই ডাক। এতো সুখ কেনো এই ছোট্ট শব্দ টায়। সমুদ্র অবাক হয়ে প্রাণটার দিকে চাইলো। সেই ছোট্ট প্রাণটা মিষ্টি হেসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে পুনরায় ডাকলো।

” বাবা!

এবার বুঝি প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। হাঁটু মুড়ে বসল সম্মুখে থাকা ছোট্ট প্রাণটা তার ছোটো দুটো হাত দিয়ে সমুদ্রের পুরো মুখে হাত বুলালো। কী নরম সেই ছোট্ট হাত দু খানা। যেনো আঁকড়ে ধরলেই মিলিয়ে যাবে। অতঃপর কপালের মাঝ বরাবর আস্তে করে চুমু দিয়ে মিষ্টি হাসলো। সমুদ্র অবাক চাহনিতে চেয়ে সেই হাসির সাক্ষী হলো। সমুদ্র চোখটা বন্ধ করে নিলো। এই মুহুর্তটাতো অনুভব করতে হবে৷ কত শান্তি, ভিতরটা একদম শান্ত হয়ে গেছে। আস্তে করে চোখ খুলতেই সামনে সেই ছোট্ট প্রাণটা কে আর দেখতে পেলো নাহ। ভিতরটা অশান্ত হয়ে উঠল। ওর বাবা কাকাও নেই। সেই সাদা আলোটা মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ঝলমল করতে থাকা চারপাশটা কেমন কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেলো। আর সেই ছোট্ট প্রাণটা কালো অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলে উঠল বাবা! কিন্তু সমুদ্র? ও যেনো পাথর হয়ে গেছে হাত পাও নড়াতে পারছে নাহ৷ কি হলো হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে কাছে টানতে পারছে নাহ সেই প্রানটাকে। শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎই সেই কালো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসলো এক নারী। খোলা চুলের সাদা শাড়ি পড়হিত এক নারী। কী করুন তার মুখখানি৷ কতটা ব্যাথিত সে। সমুদ্রের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। নারীটি সামনে এসে সেই ছোট্ট প্রাণটির ছোট হাতটি ধরলো। সমুদ্রের মনে হচ্ছে এই নারীটিকে সে চেনে। খুব কাছ থেকে চেনে, তার সবটা ওর জানা। হ্যাঁ সে আমার অর্ধাঙ্গীনি। আমার জীবনের অর্ধেক অংশ। কিন্তু তার এমন কঠিন রুপ কেনো? সমুদ্র হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে। নারীটি সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। কঠিন কন্ঠে কয়টা বাক্য আওড়ালো বোধহয়। সমুদ্র মন দিয়ে তা শুনছে।

“আপনি কথা রাখলেন নাহ। কখনো ক্ষমা করবো নাহ আপনাকে।

ব্যাস কথাটা বলেই দুজনে কালো অন্ধকারের দিকে পা বাড়ালো। ছোট্ট প্রাণটা নারীটির সাথে কালো অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে পুনরায় মিস্টি করে হাসলো। সমুদ্র চিৎকার করে ডাকতে চাইলো কিন্তু কোনো আওয়াজই বের হলো নাহ। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে উঠল তাদের।

পুরো শরীলে ব্যান্ডেজ এ মোড়ানো নিথর দেহটা হসপিটালের বেডে পড়ে আছে। মুখের অক্সিজেন মাস্কটার কাজও বোধহয় শেষ। আর কোনো আশা নেই। ডাক্তার নিরাশ হয়ে যখনি মাস্ক টা খুলতে যাবে তখনি বেশ জোরে গুঙ্গিয়ে উঠল সমুদ্র।
,,,,,,,,,,,,,

সৈন্যরা যখন সমুদ্রের ডেডবডিটা তুলতে যাচ্ছিলো তখনি একজন চমকে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল।

” স্যার ওনার তো শ্বাস চলছে।

এ যেনো মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে। ব্যাস ওপাশ থেকে কেউ দরজাটা খুলে দিলেই ইহকালের জীবন এর সমাপ্তি। সৈনিক এর কথাশুনে মেজর তাপস চমকে সেদিকে তাকালো।

“কি বলছো কী?

” আমি সত্যি বলছি স্যার। সমুদ্র স্যার এর শ্বাস চলছে তবে খুবি ক্ষীণ।

“ওকে জলদি উঠাও। আর যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে বের করো। মিডিয়ার সামনে পড়া যাবে নাহ পড়লে ওখানে আরো বেশি দেরি হবে।

” তাহলে আমরা মিডিয়াকে কী জবাব দেবো স্যার?

সৈনিক এর কথাশুনে। মেজর নিজের মুখটা কঠিন করে বলল।

“এটাই যে সাহসী অফিসার সমুদ্র এই মিশনে শহীদ হয়েছে।
,,,,,,,,,,,,,

শশীকে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই শরীরে এতো দৌড় ঝাঁপ সয্য হয়নি। স্যালাইন চলছে তবে শশীর কোনো ঙ্গান নেই। গ্রাম থেকে সকলেই চলে এসেছে। ইমরান কে পুলিশ উদ্ধার করেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে অপারেশন থিয়েটার এর সামনে সমানে পায়চারী করছে। শাহানারার অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। তিন ছেলের এমন অবস্থার কথা শুনলে কোনো মা ই সুস্থ থাকতে পারেন নাহ। ওনাকে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলো। ডাক্তারকে দেখতেই সবাই সেদিকে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার সবাইকে আসতে দেখে ওনিও তাদের দিকে গেলো। জামশেদ দ্রুত ডাক্তারকে জিগাস করলো।

” জয় আর রৌদ্রের কী অবস্থা ডাক্তার?

“দেখুন কথাটা খারাপ লাগলেও আপনাদের শুনতে হবে। সত্য সব সময়ই শুনতে খারাপ লাগে। ছোটো ছেলেটা মানে জয়। ওর আঘাতটা বেশ গভীর। মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছে সেরে উঠতে সময় লাগবে। তবে আপাতত বিপদ মুক্ত সামনে কি হবে সেটা বলতে পারছি নাহ।

” আর রৌদ্র?

জামশেদ কথাটা বলতেই ডাক্তার বিষন্ন স্বরে বলল।

“আম সরি ওনাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম নাহ। আসলে ওনার শরীরে এতো পরিমাণ ড্রাস দেওয়া হয়েছিলো যে ওনার শরীর এটা নিতে পারেনি। আর তাছাড়া ওনি আগে কখনো এসব সেবন করেনি। এই জন্য প্রভাবটা বেশি পড়েছে। তার উপর এই এক্সিডেন্ট, আমাদের হাতে কিছুই ছিলো নাহ। ওনি হসপিটালে আসার আগেই মারা গিয়েছে। মানে স্পট ডেট।

এই একটা কথাটায় ওখানে থাকা প্রতিটা মানুষের কথা বন্ধ করে দিলো। সবাই নির্বাক হয়ে বসে পড়লো। শাহানারাকে কীভাবে সামলাবে ওরা। তার থেকেও বড় সমুদ্রের কথাটা কীভাবে জানাবে। দুই ছেলের এমন করুন পরিনতি কোনো মায়ের পক্ষেই সয্য করা সম্ভব নয়। কোনো মা বাবাই চাই নাহ তারা বেঁচে থাকতে তাদের চোখের সামনে তাদের সন্তানের মৃত্যু হোক। জামশেদ মাস্টার খুব কঠিন মনের মানুষ তবুও এখন কেমন ভেঙে পড়েছে। তবে তাকে শক্ত থাকতে হবে। সামলাতে হবে তার মেয়েকে। ইমরান নিচে মাথায় হাত রেখে বসে পড়েছে। সে থাকতেও কিছুই করতে পারলো নাহ। যে স্যার তার এতোবার জীবন বাঁচিয়েছে তার পরিবারের জন্য ও কিছুই করতে পারলো নাহ। এই অপারগতা ভিতরটায় যেনো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নার্স এসে জানালো শশীর ঙ্গান ফিরেছে। পারভিন দৌড়ে শশীর কাছে গেলো। দরজা খুলে কেবিনে যেতেই দেখলো শশী বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে শশী সেদিকে তাকালো। মাকে দেখে শুকনো হেসে ইশারায় কাছে ডাকলো। মেয়ের এমন শান্ত ভাবটাই পারভীন এর ভিতরে ভিতরে ভয় পেয়ে গেলো। শশীতো জানে সমুদ্রের কথা তারপরেও এমন কীভাবে আছে। পারভীন কাছে গিয়ে শশীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতেই শশী মুখ খুলে ক্লান্ত স্বরে বলল।

“চিন্তা করো না মা। ওনি এসে সবটা ঠিক করে দেবে। ওনি যে আমায় কথা দিয়েছে। কথা রাখতে ওনাকে যে ফিরতেই হবে। এটা আমার বিশ্বাস।

মেয়ের এমন ভাবনায় মুখে কাঁপড়ের আঁচল চেপে কেঁদে উঠল পারভীন তার ছোট্ট মেয়েটা আর কত সয্য করবে।
,,,,,,,,,,,,,,

জয় কে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে জয় বিপদ মুক্ত। কেবিনের দরজা ছোট হাতে ঢেলে ভিতরে প্রবেশ করলো জোনাকী। মাথায়, পায়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। জোনাকি আস্তে আস্তে জয়ের বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জয়ের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওখানে থাকা ছোট্ট টেবিলটাই হাতের মধ্যে থাকা লজেন্স গুলো রাখল। লজেন্স রেখে জয়ের মাথার কাছে গিয়ে বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

” নাও এই সবগুলো তোমার। আমি আর তোমার থেকে নেবো নাহ। তোমাকে কাঁমড়েও দেবো নাহ। তুমি যতখুশি খেতে পারো আর কুঁমড়ো পটাস নামে ডাকবো নাহ। শুধু তুমি ঠিক হয়ে যাও। তোমাকে এমন দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে নাহ। কেমন জানো অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে। তুমি এক টা বার ঠিক হয়ে যাও তারপর আর আমি আন্টির কাছে তোমার নামে বিচার দেবো নাহ। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাবো। আর আড়ি করবো নাহ।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে