প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৪৭

0
608

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪৭

সময় মতো নিহাল গাড়িতে করে দর্শিনীকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয়। দৃশ‍্যটা দূর থেকে একজন লক্ষ‍্য করেছে। দর্শিনীকে সবসময় আবিদই পৌঁছে দিতো। আবার যাওয়ার সময় হলে নিয়ে যেতো। সেখানে আজ দর্শিনীকে অন‍্যকারো সঙ্গে দেখে সাফিনের সাহস হলো। সে ভাবলো আজকে হয়তো দর্শিনীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে। সাফিন দেখল নিহাল আদিবাকে কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছে। সে দর্শিনীর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসে। কিন্তু দর্শিনী বান্ধবীদের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের ক্লাসে চলে যায়। সাফিনের সুযোগ হয়নি দর্শিনীর সঙ্গে কথা বলার।

নিহাল আদিবাকে কোচিং এ পৌঁছে দিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে! তখনি আদিবার ব‍্যাচমেট একটা ছেলে নিহাল, আদিবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘হাই আদিবা, তোমার ভাইয়া নাকি?’

আদিবা কী বলবে বুঝতে পারেনা। ভাবলো নিহালের পারমিশন ছাড়া তাকে বয়ফ্রেন্ড বলাটা ঠিক হবে না। সে নিহালের দিকে তাকিয়ে ছেলেটাকে বলে,

‘হ‍্যাঁ অনিক, উনি আমার কাজিন হয়, ডা. নিহাল রায়হান!’

এদিকে বয়ফ্রেন্ডকে কাজিন বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় নিহাল চোখ ছোট করে আদিবার দিকে তাকায়। আদিবা কিছু একটা ইশারা করে। বিষয়টি এমন যে, আদিবা সবটা সামলে নিবে! নিহাল যেন কিছু মনে না করে। এবার অনিক নামের ছেলেটা নিহালের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ওহহ, হ‍্যালো ভাইয়া! আমি অনিক মাহমুদ, আদিবার কোচিং এর ব‍্যাচমেট! আপনার বোন আদিবা দারুণ মেধাবী ভাইয়া। বিউটিফুল উইথ অ‍্যা ব্রিলিয়ান্ট ব্রেইন!’

বলেই হাসলো অনিক। নিহালের এবার ছেলেটার প্রতি রাগ হলো। সে বেশ বুঝতে পারছে অনিক তাকে আদিবার ভাই হিসাবে প্রশংসা করে পটাতে চাইছে! সেই সঙ্গে আদিবাকে ইমপ্রেস করতে চাইছে। শুধু তাই নয়, আদিবাকে প্রতিটা কথায় নিহালের বোন বলে সম্বোধন করছে। কিন্তু আদিবা তো কোনভাবেই নিহালের বোন নয়। সে নিহালের গার্লফ্রেন্ড! তা সত্ত্বেও যদি বয়ফ্রেন্ডকে বারবার এমন কথা বলা হয়, তাহলে রাগ করাটা কী স্বাভাবিক নয়? নিহাল চোয়াল শক্ত করে আদিবার দিকে তাকায়! আদিবা পড়েছে মহা ঝামেলায়। নিহাল ছেলেটাকে কিছু না বলে চলে যেতে থাকে। আদিবা স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিহাল রাগ করেছে। সে নিহালের পিছু পিছু যেতে থাকে। নিহাল গাড়ির কাছে আসে। সে নিজেকে শান্ত করতে বিরবির বলে,

‘বি ইজি নিহাল।’

ঠিক সেই মুহূর্তে আদিবা এসে বলে,

‘সরি, আসলে অনিক আমার ব‍্যাচমেট! তেমন ফ্রেন্ড নয় শুধু কোচিং এর পরীক্ষায় একবার একসঙ্গে বসেছিলাম। সেই থেকে সে আমাকে পছন্দ করে! তাকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলেও সে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আমি তাকে কৌশলে এড়িয়ে যাই!’

সবটা বলে আদিবা করুণ ফেস করে নিহালের দিকে তাকায়। নিহাল তখন রাগের মাথায় বলতে থাকে,

‘ছেলেটা বারবার তোমাকে আমার বোন বানাতে চেষ্টা করছিল। তুমি এটা কী করলে আদিবা? আমি তোমার কাজিন হই? তুমি তাকে কি সুন্দর করে বললে, আমি নাকি তোমার কাজিন! কীভাবে পারলে?’

‘তো কী করতাম আমি? আমাদের রিলেশনশীপ পাবলিক করা? যেখানে আমাদের ব‍্যাপারে কেউ জানেনা! সেখানে অনিককে বলে কী হবে? আপনার জানানোর হলে সর্বপ্রথম নিজের ফ‍্যামেলীকে জানান। তখন সবাই জানতে পারবে আমি আপনার কে।’

‘সে তোমাকে পছন্দ করে। ছেলেটা তোমাকে এভাবেই ডিস্টার্ব করতে থাকবে, স্টুপিড!’

‘এমন অনেকজন আমাকে পছন্দ করে! তাই বলে কী তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া সাজে? এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই আমার। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ওকে নিষেধ করবো! আপনি রাগ করবেন না প্লীজ।’

নিহাল একবার আদিবার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে চড়ে চলে যায়। আদিবা সবটা দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তার কী খুশি হওয়া উচিত? যেই লোকটাকে নিয়ে সে সবসময় ইনসিকিয়র ফিল করেছে। এখন সেই লোকটা তাকে নিয়ে ইনসিকিয়র ফিল করছে। ভাগ‍্য বড়ই অদ্ভুত, তার নিশ্চয়ই খুশি হওয়া উচিত হবে!

.

দর্শিনী ক্লাস করে ক‍্যাম্পাসে আসে। তার সঙ্গে ‘ল’ ডিপার্টমেন্টের একজন বান্ধুবী আছে। নাম রাইমা! কয়েকমাসের মধ‍্যেই মেয়েটা দর্শিনীর অনেকটা ক্লোজ হয়ে গেছে। দর্শিনী আর রাইমা ক‍্যাম্পাসে দিয়া, নাদিম, আহানাফ, হৃদিতাকে দেখতে পায়। দর্শিনী এদের সঙ্গে রাইমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেই সুবাদে তাদের বন্ধু মহলে রাইমা কয়েকমাস আগেই যুক্ত হয়েছিল। নিজ নিজ ডিপার্টমেন্টের ক্লাস শেষে, রাইমা সবাইকে ক‍্যান্টিনে কফি খাওয়ার কথা বলে। সবাই রাজি হয় ঠিকই তবে হৃদিতা বলে,

‘ক‍্যান্টিনে নয়! আশেপাশের রেস্টুরেন্টে গেলে ভালো হবে।’

তারা সবাই হৃদিতার কথায় রাজি হয়ে যায়। ভার্সিটির পাশে সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটা রেস্টুরেন্টে সবাই বসে খাওয়ার অর্ডার দিচ্ছে। দর্শিনী তখন আবিদকে টেক্সট করে জানিয়ে দেয়; সে বান্ধুবীদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে। আবিদ জানতে চায় তারা কোন রেস্টুরেন্টে আছে। দর্শিনী নামটা টেক্সট করে বলে দেয়। সবাই বেশ আনন্দ করছিল। কিন্তু তখনি সাফিন নামের ছেলেটি তাদের ফলো করে রেস্টুরেন্টে চলে আসে। ছেলেটির সঙ্গে দুজন মেয়ে, দুজন ছেলে ছিল। তারা দর্শিনীদের পাশের টেবিলে বসে বিশৃঙ্খলা, বিভিন্ন নয়েজ সৃষ্টি করছিল। সাফিন শুধু দর্শিনীকে দেখছিল! তার বন্ধুরা তখন মেয়েদের নামে কটূক্তি করছিল। দর্শিনীর মেয়ে বন্ধবীরা ভুক্তভোগী ছিল! বিশেষ করে দর্শিনীর উদ্দেশ্যে তারা নানান কথা বলছিল। দর্শিনী সবটাই বুঝতে পারছিল। নাদিম আহানাফ রেগে কিছু বলবে; তখনি দর্শিনী তাদেরকে থামিয়ে দেয়। মূলত সাফিন এতো সাহস পাচ্ছে আজকে দর্শিনীর হাসবেন্ড আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী নেই ভেবেই! নাহলে কখনো এমন বাড়াবাড়ি করেনি সাফিন। দর্শিনী ছেলেটাকে একটু ভদ্র ভেবেছিল। অথচ তার জঘন্যতম দ্বিতীয় রূপ দেখে রীতিমতো বিস্মিত হচ্ছে দর্শিনী। আবিদ সবকিছু জানলে ছেলেটাকে চরম শিক্ষা দিয়ে দিতো। দর্শিনী ভাবলো আবিদকে না জানিয়ে আসলেই ভুল হয়েছে তার।

আবিদ ইতিমধ্যে ভার্সিটিতে পৌঁছে গেছে। ভার্সিটির পাশে রেস্টুরেন্টটা দেখে আবিদ ড্রাইভারকে বলে দেয় আদিবার কোচিং শেষ হলে তাকে নিয়ে বাড়িতে যেতে। আজকে সে দর্শিনীকে নিয়ে রিক্সায় চড়ে বাসায় যাবে। ড্রাইভার তখন মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে চলে যায়। আবিদ তখন রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে যায়। দর্শিনী এখনো জানেনা আবিদ রেস্টুরেন্টে চলে আসছে। সে নাদিম, আহানাফকে সাফিনের গ‍্যাঙ্গের কোন কথা গায়ে মাখতে নিষেধ করে। তাদের পারিবারিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। দর্শিনী সেটা বেশ বুঝতে পারছে! তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের সম্মান নষ্ট করতে চায়না দর্শিনী।

সাফিন ছেলেটাও পরিবার থেকে শিক্ষা পায়নি স্পষ্ট! নাহলে একজন বিবাহিত মেয়েকে কেউ পছন্দ করতে পারে? শুধু পছন্দ নয় রীতিমতো বিরক্ত করছে এখন! দর্শিনী এসব সুস্থ মস্তিষ্কে কল্পনাও করতে পারছে না। সাফিনের গ‍্যাঙ্গের সদস‍্যরা দর্শিনী সহ অন‍্যান‍্য মেয়েদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। অনেক ক্ষণ ধরে তাদের বাজে কথা দর্শিনীর কানে আসছে। সে বাধ‍্য হয়েই নিশ্চুপ ছিল! কিন্তু সাফিনের পাশে বসা মেয়েটির শেষের কথা দর্শিনীর কানে গরম শীষা ঢেলে দেওয়ার মতো যন্ত্রণা অনুভব হলো। মেয়েটির কথা কিছুটা এমন ছিল যে,

‘দোস্ত, সুন্দর আছে তো! কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে বিবাহিত মাল! বিবাহিত মেয়েকে যখন পছন্দ করেছিস সামলাতে পারবি তো? যদি পারিস দেখিয়ে দিস তুই তার স্বামীর চেয়ে কতোটা সক্ষম! তখন দেখা যাবে স্বামীকে ছেড়ে ঠিকই তোর কাছে ছুটে আসবে ****।’

দর্শিনীকে এতো বাজে কথা শুনতে হবে কখনো কল্পনা করেনি সে। এখানে শুধু দর্শিনীকে একা বাজে কথা বলা হয়নি! আবিদকে টেনে বাজে কথা বলা হয়েছে। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কেঁপে ওঠে দর্শিনীর শরীর! সে চেয়েছিল অশিক্ষিত মেয়েটাকে ইগনোর করতে। নিজেকে কন্ট‍্রোল করতে পারেনা দর্শিনী। কান্না পাচ্ছে তার! শাড়ি পরিহিত অবস্থায় সহসা উঠে গিয়ে মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে সর্বশক্তি দিয়ে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয় দর্শিনী। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সকলে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। দর্শিনীর ফেন্ডরা সবাই তখন দর্শিনীর পিছনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি থাপ্পড় খেয়ে সাফিনের দিকে তাকায়। সাফিন তখন দিকবেদিক ভুলে গিয়ে দর্শিনীর তেজস্বী রূপ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি কিছু বলবে, তখনি দর্শিনী স্বশব্দে আরো একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলে,

‘তোর মতো নর্দমার কী’ট ভেবেছিস, সবাইকে? নাকি তোর মতো দুঃশ্চরিত্রের? আমি আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা! লাভা মানে বুঝিস তো? আগ্নেয়গিরির লাভা অনেক সময় নিশ্চল থাকে। এর মানে এটা নয়, লাভা তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। লাভার ভেতরে উত্তাপ, তেজস্ক্রিয়তা বিদ‍্যামান থাকে সর্বদা। আমাকে নম্র ভেবে ভুল করেছিস সবাই। তোদের মতো কী’টদের জন‍্য আমি সবসময় নম্র থাকব ভুল ধারণা তোদের। হ‍্যাঁ আমি বিবাহিত মেয়ে। আর আমাকে সামলানোর জন‍্য আমার স্বামীই যথেষ্ট। অন‍্যকারো ক্ষমতা নেই উত্তপ্ত আগুনে হাত দেওয়ার। কেবলমাত্র আমার স্বামী ছাড়া! তাইতো আমি জ্বলন্ত লাভার মতো। এমন উত্তপ্ত তেজস্বিনীকে শান্ত করতে সক্ষম ব‍্যক্তির সক্ষমতা সম্পর্কে তোর মতো নোংরা কী’টের ধারণা হাঁটুর নিচে থেকে গেছে। এবার আমার তোদের সক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকে গেলো।’

দর্শিনীর কথায় সাফিন এবং তার বাকি দুজন বন্ধু দপ করে জ্বলে উঠে। নাদিম আহানাফ দর্শিনীর ঢাল হয়ে পিছন থেকে সাবধান করে দেয় ওদেরকে। রাগ হয় তাদের দর্শিনীর প্রতি! নিজের স্বামীকে নিয়ে দশিনীর এমন গর্ব করাটা ভালো লাগেনি সাফিনের। সে আবিদকে নিয়ে কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু দর্শিনী সাফিনকে স্বজোরে থাপ্পড় বসিয়েছে। সাফিন থাপ্পড় খেয়ে একদম চুপ হয়ে যায়। সাফিনকে মারার জন‍্য দর্শিনীর কাছে থাপ্পড় খাওয়া মেয়েটা ক্ষিপ্ত হয়ে দর্শিনীর সামনে দাঁড়ায়। সাফিন তখন তার উদ্দেশ্যে বলে,

‘ইরা থাম! প্রিয়দর্শিনীকে কিছু বলবি না তুই।’

দর্শিনী ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। এমনিতেই জা’নোয়ার মেয়েটা তাকে বাজে কথা বলেছে। এতো সহজে তার রাগ কমবে না। সে ইরার চুল খামচে ধরে হাত স্বজোরে মুচড়ে দেয়। ব‍্যথায় ইরা কেঁদে ফেলে। দিয়া, রাইমা, হৃদিতা, দর্শিনীকে ছাড়াতে যায়নি। মেয়েটা দর্শিনীর হাতের মার খেয়ে দেখুক! হয়তো আজন্মের মতো শিক্ষা হয়ে যাবে। ইরার সঙ্গে আরেকটি মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটা মৃদু রাগ দেখিয়ে এগিয়ে আসে। ঠিক তখনি রাইমা তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। যাকিছু ঘটেছে আবিদ সবটা দেখেছে, ভালো করে শুনেছে। সাফিন নামের ছেলেটা দর্শিনীকে অনেকদিন ধরে পছন্দ করে এটাও আজকে জানতে পারলো। ছেলেটি নিশ্চয়ই দর্শিনীকে ফলো করেছে! মুগ্ধতা মিশিয়ে দর্শিনীর দিকে তাকিয়েছে। এসব ভেবে আবিদের প্রচণ্ড রাগ হয়! তার গমরঙা ত্বকে নীল রগ ফুটে উঠেছে। দর্শিনীর উপর তার মৃদুমন্দ রাগ হচ্ছে। আবার দর্শিনীর তেজস্বী রূপ, কথাবার্তা দেখে অনেক ভালো লেগেছে। কতোদিন পরে স্বচক্ষে দর্শিনীর দৃঢ়চেতা প্রতিবাদী রূপটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আবিদের। দর্শিনী একজন ভবিষ্যৎ লয়ার বা জজ। সে সবসময় চায় প্রিয়দর্শিনী সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ হোক। কেউ যেন কখনো তাকে অন‍্যায় ভাবে দমাতে না পারে!

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে ইরা নামের মেয়েটি! তাদের কাজের লোক, ইমান আবদুল্লাহ আর সুফিয়ার মেয়ে ইরা। এই মেয়েকেই তার বাবা শাহরিয়ার চৌধুরী নিজ উদ্যোগে টাকা খরচ করে ভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। মেয়েটা মোটামুটি মেধাবী ছিল! তাই যখন ভার্সিটিতে চান্স পেলো ইমান আবদুল্লাহর সার্মথ‍্য ছিলনা মেয়েকে পড়ানোর। তিনি যেহেতু অনেক আগে থেকে চৌধুরী পরিবারের বিশ্বস্ত কাজের লোক। তাই উনার মেয়ে ইরার পড়াশোনার খরচ চৌধুরী পরিবার থেকে দেওয়া হয়। সেখানে মেয়েটা বাজে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশে কী তৈরি হচ্ছে! আবিদের ইমান চাচা আর সুফিয়ার বেগমের কথা ভেবে খারাপ লাগছে। তারা কী জানে, তাদের মেয়ে বখে যাওয়া জঘন্য জীবন লিড করছে। ছিঃ পোশাকের অবস্থা যথেষ্ট শোচনীয়! আবিদ তার দিকে দ্বিতীয়বার তাকালো না। মেয়েটা শর্ট ক্রপটপ, জিন্সের প‍্যান্ট পড়ে আছে। পেটের অনেকটা দৃশ‍্যমান। মেয়েটাকে একবার দেখে কেউ কাজের লোকের মেয়ে বলবে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট ধনী ফ‍্যামেলী থেকে এসেছে। মেয়েটি নিশ্চয়ই সবার কাছে পরিচয় গোপন করে অশ্লীল কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে। সে হয়তো জানেনা দর্শিনী আবিদের স্ত্রী! না জেনেই দর্শিনীকে হাজারটা উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। আবিদ সাফিন সহ দুজনকে নোটিশ করে তাদের ছবি সহ গার্ডদের ছোট্ট একটা টেক্সট করে দেয়। এদেরকে আজ সে নিজের সক্ষমতা দেখাবে। অনেক ভালো করেই দেখাবে। নিহাতই সে মেয়েদের মা’রধর করেনা! নাহলে ইরাকে শিক্ষা দিয়ে দিতো। তবে আবিদ ঠিক করল ইরাকে শিক্ষা দেওয়ার জন‍্য ইমান আবদুল্লাহর হাতে ছেড়ে দিবে।

রেস্টুরেন্টের মধ‍্যে বেশ তর্কাতর্কি শুরু হয়েছে। দর্শিনী ইরার চুলটা এখনো ছাড়েনি। আবিদ এবার এগিয়ে আসে। সাফিনের গ‍্যাঙ্গের একটা ছেলে দর্শিনীর হাত থেকে ইরাকে ছাড়াতে তার দিকে হাত বাড়ায়। আবিদ তৎক্ষণাৎ ছেলেটির হাত মুচড়ে ধরে। মূহুর্তেই মটমট শব্দ হয়। ছেলেটা গলা ফাঁটা চিৎকার করে উঠে। ছেলেটার আঙ্গুল গুলো বুঝি ভাঙ্গলো! সবাই তখন দর্শিনীর পাশে সুট-বুট পরিহিত লম্বাটে সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকিয়ে দেখে। সাফিন সহ বাকি দুজন ভয়ে মৃদু ঢোক গিলে ফেলে। আবিদ ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দর্শিনীর দিকে ফিরে। দর্শিনী তখনও ইরার চুল ধরে আছে। ইরা তখন ব‍্যথায় কাঁদছে। আবিদ রুমাল দিয়ে দর্শিনীর শুভ্র কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামটুকু মুছে দেয়। তারপর চুলটা ঠিক করে কানের পিছনে গুঁজে দেয়। রাইমা, আবিদকে এতোদিন দেখেনি শুধু আবিদের সম্পর্কে দর্শিনীর কাছে শুনেছে। আজকে আবিদকে দেখে রাইমা হা হয়ে আছে! আবিদ তখন দর্শিনীর কমল হাত ধরে বলে,

‘দর্শিনী, ছেড়ে দেও! আমি দেখছি বিষয়টা।’

‘আবিদ, মেয়েটা প্রচণ্ড বাজে! আপনাকে নিয়ে প্রচুর বাজে কথা বলেছে। আমি ওকে ছাড়বো না। মে’রে ফেলবো ওকে!’

‘দর্শিনী, ইরা ইমান আবদুল্লাহ চাচার মেয়ে!’

সহসা দর্শিনীর হাত থেমে যায়। সে কী ঠিক শুনলো? ইরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো সে। মনে মনে ভাবলো ইমান চাচার মতো ভালো মানুষের এমন জঘন‍্য মেয়ে কীভাবে সম্ভব? ইরা আবিদের গলা পেয়ে ভয়ে নীল হয়ে গেলো। আবিদকে সে চিনে! মানুষটা প্রচণ্ড রাগী! এই লোকটার বাড়িতেই তার বাবা-মা কাজ করে। তাছাড়া আগে থেকে আবিদকে দেখেছে ইরা। আবিদের মতো ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষকে প্রচণ্ড ভয় পায় সে। কিন্তু ইরা জানতো না দর্শিনী আবিদের স্ত্রী। আজকে ইরা দর্শিনীকে যত খারাপ কথা বলেছে। সবটা আবিদ শুনেছে। ইরা ভয় পায় তার সিক্রেট সবার কাছে ফাঁস হয়ে যাবে ভেবে। তাছাড়া তার বাবা-মাকে এসবের জন‍্য যদি চাকরী চ‍্যূত হতে হয় তাহলে কী হবে? তাকে জীবন্ত কবর দিবে তার বাবা-মা। আজকে যাকিছু ঘটল সবটা জানতে পারলে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সে পারিপাশ্বিক অবস্থা চিন্তা করে কেঁদে ফেলল। আবিদ দর্শিনী দুজনেই তখন ইরার দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।

আবিদ সাফিন এবং তার বন্ধুদের নিজের পরিচয় বলে বকঝকা করতে থাকে। তারা সবাই ভয়ে ঢোক গিলছে। আবিদ তাদেরকে ভিসির সঙ্গে কথা বলে ছাত্রত্ব বাতিল করে দিবে বলে হুমকি দেয়। সবাই ভয় পেয়ে আবিদের পায়ের উপর হুরমুর করে পরে। আবিদ তাদের থেকে অনেক চেষ্টা করে পা ছাড়িয়ে নেয়। পরবর্তীতে সবাইকে ওয়ার্নিং দিয়ে দর্শিনীর হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে। দর্শিনীর পাশে ঢাল হয়ে থাকার জন‍্য, যাওয়ার আগে দর্শিনীর বন্ধুদের ধন্যবাদ দেয় আবিদ। তাছাড়া তাদের খাবারের বিলটা আবিদ দিয়ে দেয়। আবিদ রেস্টুরেন্টের ম‍্যানেজারকে সবটা বলে সিচুয়েশন নিজের দখলে করে নেয়। সে রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজটা সংগ্রহ করে নেয়। পরবর্তীতে আবিদ দর্শিনী চলে যায়। দর্শিনীর বন্ধুরা তখন আবিদ দর্শিনীদের পরে যেতে থাকে।

সাফিন বন্ধুরা কী মারাত্মক ভুল করেছে ভেবে একে অপরকে দোষ দিতে থাকে। অবশেষে তাদের মধ‍্যেই বড়সড় ঝগড়া বেঁধে যায়। সবাই রেগে গিয়ে ইরাকে সব দোষ দিতে থাকে। ইরা তখনও কাঁদছিল। সাফিন সবাইকে থামাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু কাউকে থামাতে পারেনা। সবার মনে ছাত্রত্ব বাতিলের ভয়টা ছিল। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্টের ম‍্যানেজার এসে জরিমানা নিয়ে তাদেরকে বের করে দেয়। সবাই ঝামেলা করে আলাদা আলাদা পথে চলে যায়। ইরা ভয়ে সাফিনের সাহায্য চায়। সাফিন তাকে মানা করে নিজের মতো চলে যায়। ইরা তখন সবদিক থেকে বিপদে পরে যায়। সে রাস্তাতেই কাঁদতে থাকে।

আবিদের সেট করা গার্ডস আবিদের কথা মতো সাফিন সহ দুজনকে অচেতন করে সিক্রেট প্লেসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মেয়ে দুটোকে আবিদ ভিসি, গার্ডিয়ান দিয়ে শিক্ষা দেবে তাই আপাতত ছেড়ে দেয়। আজকের ঘটনায় দর্শিনীর মন প্রচণ্ড খারাপ ছিল। আবিদ কিছু খাবার প‍্যাক করে আলাদা গাড়ি ডেকে নেয়। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি আসলে দর্শিনী উঠে বসে। আবিদ ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিয়ে অন‍্য গাড়িতে করে বাড়িতে চলে যেতে বলে। দর্শিনীর মন ভালো করার জন‍্য আবিদ ঠিক করে লংড্রাইভে যাবে। সেই অনুযায়ী অনুসা বেগমকে জানিয়ে দেয়। তারপর দুজনে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। দর্শিনীকে খুশি করার জন‍্য অনেক রকম চেষ্টা করে আবিদ। কোন কিছুতেই লাভ হয়নি। পরবর্তীতে আবিদ তাকে বলে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে ইরার বাজে কথাবার্তা শুনে সে কীভাবে রাগ কন্ট্রোল করেছে। তাছাড়া দর্শিনীর সাফিনের ব‍্যাপারে কথা লুকানোর জন‍্য আবিদের ইচ্ছে করছিল দর্শিনীকে শিক্ষা দিতে। সবকিছু আবিদ দর্শিনীকে বলতে থাকে। দর্শিনী না শোনার ভান করে থাকে। আসলে সে সবটা শুনেছে। দর্শিনী শুনে অবাক হয় আবিদ তাকে দূর থেকে বাহবা দিচ্ছিল। আবিদ দর্শিনীকে বলে,

‘তোমার তেজস্বী রূপ, উত্তপ্ত আগুনের ন‍্যায় দৃঢ়চেতনায় বারবার খু’ন হয়েছি, তেজস্বিনী। ঠিক এভাবেই তোমার নিজস্বতায় ভিন্ন অনুভূতি, ভালোবাসায় প্রতিনিয়ত আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি। সত্যিই তোমাকে ছোঁয়ার সাধ‍্য আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী ছাড়া কারো নেই সুদর্শিনী।’

দর্শিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে সবটা শুনল। আবিদের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে মন খারাপ আংশিক কমে গেছে। কিন্তু হঠাৎ-ই আবিদ মৃদুমন্দ রেগে যায়। দর্শিনীর উপর রাগ করে বলে উঠে,

‘ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করতো। তোমাকে ফলো করতো। না জানি কতোবার মুগ্ধ হয়ে তোমাকে দেখেছে। আমাকে আগে বলোনি কেনো? আমার ব‍্যক্তিগত নারীকে মুগ্ধ হয়ে দেখার অধিকার তার ছিলনা, দর্শিনী! আমাদের মাঝে কথা হয়েছিল একে-অপরকে সবকথা শেয়ার করবো। তাহলে তুমি বলোনি কেনো?’

দর্শিনী আবিদের তেজী কন্ঠে ভয় পায়। ছেলেটা তাকে সরাসরি ডিস্টার্ব করেনি তাই সে বলতে চায়নি! কিন্তু আবিদ কী তার কথা শুনবে? আবিদকে সেদিন সবটা বলে দেওয়া উচিত ছিল। দর্শিনীর এখন আফসোস হচ্ছে!

#চলবে

[ সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে