#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, নামাজ পড়তে হবে। মৃদুলের থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে এলাম। বেশিক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে না, হঠাৎ করে ভালোলাগা মানুষগুলোকে খুব বেশিক্ষণ সহ্য করতে ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ তাদের থেকে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে। ওজু করে নামাজ শেষ করলাম। এই অন্ধকার জীবনের আলো খুঁজে পেতে আল্লাহই আমাকে পথ দেখাতে পারে। নিরবের কথা মনে পড়ছে, প্রতিদিন এ সময়ে পড়তে বসতো। পড়তে বসলে ছেলেটা বাঁচাল হয়ে যায়, অতিরিক্ত কথা বলে। কার বাড়িতে কি হয়েছে, কোন বন্ধুকে স্যার কি বলেছে, সে একবার পেয়ারা চু’রি করতে গিয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছিল। এমন নানান গল্প, মাঝেমাঝে নিরবকে ভাঙা টেপরেকর্ডার মনে হতো। পড়তে আসলে বকবক শুরু করে। তবে ওর কথা শুনতে মন্দ লাগতো না। সরলতা ছিল কথার মাঝে, হেসে হেসে কথা বলার ধরনটা মানুষকে খুব সহজে আকৃষ্ট করতে পারে।
” কি রে? আমার কথা তোর মনেই নেই দেখছি। কতদিন পর দেখা হলো। সুখ দুঃখের কথা বলবি, তা না টোটো করে বেড়াচ্ছিস!”
” ওরে বাপু, সবে নামাজ শেষ করে বসেছি। সারা রাত গল্প করবো বলেছি তো। দিন দিন বড্ড অভিমানী হয়ে যাচ্ছো তুমি!”
” ওই আর কি! বুড়ো বয়সে একা থাকলে বুঝতে পারবি কেমন কষ্ট লাগে। ”
” এখানে মামা বাবার কাছে এসে থাকতে পারো না? কি আছে ওই গ্রামের বাড়িতে? ছেলে বউ নিয়ে সুখে সংসার করবে। তা না, এখনও হাত পুড়িয়ে রান্না করো। ”
” ওসব তুই বুঝবি না দিদিভাই। শহরে থাকতে ভালো লাগে না। ”
” শহরের ভিতর হলেও বাড়িটা একদম গ্রামের মতো। কত বড় দেখেছ তুমি?”
” হ্যাঁ রে দেখেছি। একাত্তরের সময় তোর দাদা বেশ সস্তায় কিনেছিল। সেকেলে জমিদার বাড়ির মতো অনেকটা।”
” আচ্ছা বুঝলাম। গ্রামে কিভাবে দিন কাটে তোমার? একা একা থাকো, কেউ কোথাও নেই। ভৌতিক পরিবেশ।”
” বারো বছর বয়সে ও বাড়িতে এসেছি। ওখানেই শান্তি লাগে। তা দাদাভাই তোকে আদর করে? খুব ভালোবাসে বুঝি? ”
” এসব কেমন কথা বলো? তুমি তো খুব নির্লজ্জ! ”
” ইসস রে আমার লজ্জাবতী! যখন উনার সাথে আমার প্রেমের কথা শুনতে চাইতে তখন এসব লজ্জা কোথায় ছিল?”
মন খারাপ হয়ে গেছে। দাদি সামান্য একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে, এতে এতো খারাপ লাগার কি আছে বুঝতে পারছি না। চাইলেও দাদিকে নিজের জীবনের এ অধ্যায় সম্পর্কে বলতে পারবো না, বুড়ো বয়সে উনাকে আর কষ্ট দিতে চাই না। নিরবের ব্যাপারে জানলে এখনই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া অশান্তি শুরু করবে। তাছাড়া শশুর আব্বু এ বাড়িতে, কোন প্রকার ঝামেলা না করাই ভালো। দাদি এক নাড়াতে কথা বলে যাচ্ছে, আমি চুপচাপ শুনছি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওদিকে মা ডাকছে, হয়তো সন্ধ্যাবেলার জন্য নাশতা বানাতে হবে।
” হ্যাঁ রে সাজু, তোর মা এতো ডাকাডাকি কেন করে?”
” নাশতা বানাতে হবে হয়তো, না জেনে কি করে বলবো বলো? তুমি যেখানে আমিও তো সেখানে। ”
” আসার পর থেকে দেখছি তোকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে, তুই এ বাড়িতে না থাকলে তখন কি করে? না খেয়ে থাকে নাকি?”
” রাগ করে না। আমি যাবো, আর আসবো। ”
দাদি গোমড়া মুখে বসে রইলো। কথায় কথায় গাল ফোলানোর স্বভাবটা আর গেল না। মা’য়ের কন্ঠ অনুসরণ করে রান্নাঘরে পৌঁছালাম। চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছে।
” কেমন আক্কেল তোর? সন্ধ্যাবেলা নাশতা তৈরি করবি না? ”
” এইতো এসেছি, বলো কি করবো। ”
” চায়ের পানি বসিয়েছি, চা হলে দুকাপ ঘরে দিয়ে যাস। তোর শশুর আর মৃদুলকেও দিস। শুধু চা দিস না যেন, ওখানে নুডলস, পাস্তা এসব রাখা আছে। ঝটপট কিছু একটা বানিয়ে দিস। ”
” আচ্ছা, রান্নাঘর এলোমেলো করিস না যেন। তুই তো আবার হাবা মেয়ে!”
‘হাবা মেয়ে’ শব্দটা মা’য়ের খুব পছন্দের। ক্লাস নাইনে আম আঁটির ভেঁপু’ গল্পটা পড়ার সময় এ শব্দের সাথে পরিচয়। সেখানে অবশ্য ‘হাবা ছেলে’ ছিল। মা পরিবর্তন করে ‘হাবা মেয়ে ‘ বানিয়ে নিয়েছে। চা বানানো শেষ। দু’কাপ চা নিয়ে মা’য়ের ঘরের দিকে গেলাম। বাবাও ঘরে আছে। দরজায় টোকা দেওয়ার আগ-মুহুর্তে কানে এলো,
” রেণু কথাটা বুঝতে পারলে তো? সানজিদাকে কাজে ব্যস্ত রাখবে। মা’য়ের সাথে বেশি কথা বলার সুযোগ দেবে না। নিরবের বয়স নিয়ে ঝামেলা করতে পারে। তাছাড়া নিরবের বাবাও এ বাড়িতে আছে। ”
” তোমার মেয়ের জন্য এতো ঝামেলা সহ্য করতে পারছি না। ”
” আর তো একটা দিন। তাছাড়া ওঁরা না এলে কি এতগুলো টাকা হাতে আসত? ”
” তা অবশ্য ঠিক বলেছ। মেয়েটাকে চা করতে বলে এসেছি, দেখি কতদূর হলো। ”
” সানজিদার শশুরের যত্ন-আত্তি হচ্ছে তো? মৃদুলকে আবার সানজিদার পাশে বেশি ঘুরঘুর করতে দিও না। ”
” মেয়ের জন্য চিন্তা উথলে পড়ছে দেখি। ওই চালচুলোহীন মেয়ের সাথে মৃদুলের কিছুই হবে না। ”
বাবা আর কিছু বললেন না, মা আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে মা’য়ের ঘরে প্রবেশ করলাম। চা দিয়ে চুপচাপ চলে এলাম। চালচুলোহীন মেয়ে বলতে আমাকে বুঝিয়েছে, নিজের মা কি করে আমাকে চালচুলোহীন বলতে পারে? দাদির কাছ থেকে সবকিছু জানতে হবে, যে করেই হোক! স্বাভাবিক ভাবে সব কাজ করতে লাগলাম। রাতে দাদির কাছে এই কথার জবাব চাইবো। দাদি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানবে। চুলায় গরম পানি বসিয়েছি, নুডলস রান্না করবো। শশুর আব্বু আর মৃদুলকে নাস্তা দিতে হবে। দাদিও এসব খেতে খুব পছন্দ করে।
” নুডলস রান্না করছেন? ”
” হ্যাঁ। মৃদুল সাহেব আপনি আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। বাড়িতে আমার শশুর আছে, উনি ব্যাপারটা ভালো ভাবে নাও নিতে পারেন। ”
” আপনি কি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন?”
” যেমন মনে করবেন। ”
” কষ্ট দেওয়া মেয়েদের স্বভাব। ”
” সব মেয়ে কষ্ট দেয় না। আমার বিয়ের পিছনে আপনার অনেক বড় অবদান ছিল। হবু বর সেজে অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন। যার কোনটাই সত্যি হয়নি। ”
মৃদুল কিছু না বলে গটগট করে চলে গেল। তাতে অবশ্য কিছু যায়-আসে না। নিজের মনকে প্রশ্রয় দিতে চাই না, এ মনে মায়া-মমতার স্থান নেই। জীবনে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনার জবাব চাই এখন। কেন আমার জীবন এতো আলাদা! কিসের এতো ভয় আমার!
নাস্তা গুছিয়ে শশুর আব্বুর কাছে গেলাম।
” আব্বু আসবো?”
” বউমা, হ্যাঁ এসো। তোমার সাথে জরুরি কথা ছিল। ”
” জ্বি বলুন। ”
” কাল সকালে কাজের জন্য আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে, তুমি দু’দিন এখানেই থাকো। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। ”
” জ্বি, আচ্ছা। কাল কখন যাবেন? ”
” সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বো। তুমি চিন্তা করো না। ”
শশুরের ব্যবহার স্বাভাবিক। ও বাড়ির কেউ তেমন খারাপ ব্যবহার করে না, রিতু বাদে। ঠিকমতো কাজ করলে শাশুড়ি মা প্রশংসাও করে। তবে এটা উনাদের বাহিরের রূপ। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। বিনাকারণে এমনভাবে ছেলের বিয়ে দেয়নি। রাতের খাওয়া শেষ হতে হতে ১১টা বেজে গেল। সন্ধ্যার পর হতে মৃদুলের সাথে কোন কথা হয়নি। সে কথা বলতে আসেনি, আমিও নিজে থেকে কথা বলতে যায়নি। খাবার টেবিলে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন কতশত রহস্য লুকিয়ে রেখেছি আমার মাঝে।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর শুরু হতে মিনিট বিশেক বাকি। দাদি আধশোয়া হয়ে বিছানায়, সারা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। বেশ রাত পর্যন্ত জেগে থাকবে।
” একটা সত্যি কথা বলবে?”
” কি কথা দিদি ভাই? ”
” না আগে বলো সত্যি বলবে, তবেই বলবো। ”
” আচ্ছা বলবো। এখন বল তো কি হয়েছে? ”
” যাদের মা বাবা বলে জানি এরা কি আমার বাবা-মা না?”
” দিদি ভাই, তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”
” তুমি সোজাভাবে উত্তর দিতে পারছো না, মানে এরা আমার বাবা-মা না। তাহলে কে আমার বাবা-মা? ”
দাদি শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পর কোমল গলায় বললো, ” তুমি যাকে বাবা বলে ডাকো সে-ই তোমার বাবা তবে ওই মহিলা তোমার আপন মা না, সৎ মা। ”
” ওহ্! তাহলে আমার মা কোথায়?”
” কাল সকালে তোমাকে তোমার মা’য়ের কাছে নিয়ে যাব। তখন সবকিছু জানতে পারবে। কখনো কিছু জানাতে চাইনি, তবে আজ হঠাৎ মনে হলো সবকিছু বলে দেওয়াই ভালো। তুমি বড় হয়েছ, সহ্য করতে পারবে। এখন শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে। ”
দাদির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মা’য়ের সৎ বা আপন হয় বলে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। বিগত দিনের অ”ত্যা”চা”র, অবহেলা সবকিছু কেমন যেন নতুন করে হৃদয়ে আ”ঘা”ত করছে। মা’য়ের ব্যবহারের কারন স্পষ্ট কিন্তু বাবা কেন আমায় সহ্য করতে পারে না? আমি তো তার নিজের মেয়ে, হবে কোন কারণ। আমার অজানা কিছ! দাদি শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে, বুঝতে পারছি উনি ঘুম না তবুও সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত শেষে কখন সকাল হবে? কখন মা’য়ের কাছে যাব? অস্থিরতা, উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। ফজরের আজান দিতেই দাদিকে ডেকে তুললাম।
” সকাল হয়েছে, ওঠ, আমাকে মা’য়ের কাছে নিয়ে চলো। ”
চলবে