প্রদীপের নিচে আমি পর্ব-০৩

0
656

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩

আমার নিজের মোবাইল নেই কিন্তু শশুর -শাশুড়ির মোবাইল নম্বর তো তাদের কাছে ছিল। হয়তো ঝামেলা বিদায় হয়েছে, তাই আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। খুব ইচ্ছে করছে ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে, মা-বাবাকেও খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। শাশুড়ি মা’কে বলে দেখবো? যদি যেতে দেয়।

রাত এগারোটা। আমি আর শাশুড়ি মা খেতে বসেছি। বাকিদের খাওয়া শেষ। এখন একবার বললে কেমন হয়!

” মা একটা কথা ছিল। ”

” কি কথা? কোন সমস্যা হচ্ছে? ”

” না মা, সমস্যা হচ্ছে না। আসলে মা বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কখনও আলাদা থাকিনি। যদি অনুমতি দিতেন তাহলে একটু ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসতাম। ”

” তোমার মা-বাবা তো একবার কল দিয়ে খোঁজ নিলেন না। সে যাইহোক, একা তো যেতে পারবে না। দেখি তোমার শশুরের সময় থাকলে বলবো ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। ”

খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো। সবসময় এ বাড়ির মানুষগুলোকে খারাপ মনে হয় না। মাঝেমধ্যে মনে হয় এরা খুব ভালো। ইচ্ছে হলো শাশুড়ি মা’কে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিতে কিন্তু পারলাম না। মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম। নিরবের এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না, ঘরে শুয়ে আছে। নিরবকে পড়ানো না থাকলে রাতে তেমন কোন কাজ থাকে না। বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম, আজ অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ঘুমানো যাবে।
বিছানায় আসার কয়েক মিনিট পর কারেন্ট চলে গেল, গরমে ঘুম আসছে না। শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। ওপাশে শশুর আব্বু আর শাশুড়ি মা কথা বলছে, অস্পষ্ট কানে আসছে। খেয়াল করে শুনলে সবটা বোঝা যায়, তবে আমার সেদিকে মনযোগ নেই। নিজের জীবন নিয়ে ভাবছি, জানি এ ভাবনা বৃথা তবুও ভাবতে ভালো লাগে। ভাবনার মাঝে হঠাৎ কানে এলো,

” আচ্ছা তুমি মেয়েটাকে দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনবে? আজ রাতে বলছিল বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। ”

আমার ব্যাপারে কথা হচ্ছে দেখে কান খাঁড়া করলাম। মনে মনে শাশুড়ি মা’কে ধন্যবাদ দিলাম। উনি এতো তাড়াতাড়ি শশুর আব্বুকে বলবে ভাবতে পারিনি।

” আহ্! তুমি কি শুরু করলে বলো তো? এমন ভাব করছ কেন খুব শখ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছ। ”

” দামী জিনিসকে যত্ন করতে হয়। আর তা যদি হয় সোনার হরিণ তাহলে তো কথাই নেই। ”

ওপাশে আর কি কি কথা হচ্ছে বোঝা গেল না। কারেন্ট চলে এসেছে, ফ্যানের শব্দে কথাগুলো মাত্রাতিরিক্ত অস্পষ্ট হয়ে কানে লাগছে। শশুর আব্বুর কথায় বিরক্তি স্পষ্ট। তবে শাশুড়ি মা’য়ের কথা বুঝতে পারলাম না, আমি দামী জিমিস, সোনার হরিণ! অদ্ভুত তো। সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। শুয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেছি। ফজরের আজান কানে আসতে উঠে পড়লাম। নামাজ পড়তে ইচ্ছে করছে, দুনিয়ায় সবকিছু যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন আল্লাহই সেখানে আলো এনে দেন। নামাজ শেষ করে কিছু সময় বসে রইলাম। চারদিক সূর্যের আলোয় ভরে গেছে, সকালের নাস্তা তৈরি করতে হবে। সবজি কাঁটার সময় শাশুড়ি মা এলেন।

” বউমা শোন। ”

” জ্বি বলেন। ”

” বিকেলে তোমার শশুরের সাথে গিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। চাইলে দু’দিন থাকতেও পারো। আমি উনাকে বলে দিয়েছি। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি খুব ভালো। ”

শাশুড়ি মা কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল। কতদিন পর নিজের চেনা পরিচয় ঘরে ফিরবো। মা বাবাকে দেখতে পাবো, বাবা-মা হয়তো আমাকে অন্য মা-বাবাদের মতো আদরে আহ্লাদে বড় করেনি। তবুও তাদের খুব ভালোবাসি। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বিকেল হবে। অপেক্ষার প্রহর কাটতে চায় না। খুব যত্নের সাথে সব কাজ শেষ করলাম। আগামী দুদিনের খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে যাব। শাশুড়ি মা রান্না করতে না পারলেও খাবার গরম করে নিতে পারবে। উনাকে জিজ্ঞেস করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সারা দুপুর খুব ব্যস্ত সময় পার করালাম, দু’রকমের মাছ ভাজা, আলু বেগুন দিয়ে শুঁটকি মাছের তরকারি, ছোলার ডাল, মুরগির মাংস আর দুই রকমের শাক ভাজি। আশা করি এতে হয়ে যাবে।

সব কাজ শেষ করতে করতে চারটে বেজে গেল। শশুর আব্বু দুপুরের খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে, একটু পরেই রওনা দেবো। যাওয়ার আগে নিরবের সাথে দেখা হবে না, স্কুল শেষ করে আসতে আসতে প্রায় ছয়টা বেজে যায়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব পরছি, শাশুড়ি মা কয়েক মিনিট আগে এসে রেডি হতে বললেন। আলাদা করে নেওয়ার মতো কিছু নেই, ও বাড়িতে আমার কাপড়-চোপড় আছে।
নিরবকে বলে যেতে পারলে ভালো হত, ওকে হয়তো আমি স্বামীর চোখে দেখি না। তবে এক মাসে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমরা তাদের প্রতি খুব দূর্বল হয়ে পড়ি, যাদের সাথে প্রাণ খুলে হাসতে পারি। নিরবের সাথে যতোটা হেসেছি গত এক বছরেও এতটা হাসতে পারিনি। এজন্যই হয়তো ওর প্রতি আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়েছে। হঠাৎ ইচ্ছে হলো নিরবের জন্য একটা চিঠি লিখে যেতে, কখনো কারো জন্য চিঠি লেখা হয়নি। আজ না হয় প্রথম চিঠি লিখলাম।

নিরব,

আশা করি ভালো থাকবে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করবে, নিজের খেয়াল রাখবে। সব থেকে বড় কথা মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। তোমার থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সম্ভব হলো না।

ইতি,
সানজিদা

চিঠিটা ভাজ করে নিরবের টেবিলের উপর রেখে দিলাম। একটু পরেই হয়তো বাড়ি ফিরবে, ইসস বিদায় নিতে পারলে খুব ভালো হত।

” বউ মা। ”

” জ্বি আম্মা।”

” তৈরি হওয়া শেষ হলো, তোমার শশুর আব্বু তো দাঁড়িয়ে আছে। ”

” হ্যাঁ, এই তো আসছি। ”

” আর শোন, ও বাড়িতে তোমার যেসব কাপড়-চোপড় আছে সেগুলো সাথে করে নিয়ে এসো। বেশ কয়েকদিন পার হয়ে যাবে। আজ-কাল সবকিছুর দাম বাড়ছে। ”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। শশুর আব্বু অপেক্ষা করছে, আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললো, চলো বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। সত্যিই নিরবের পরিবার বেশ ধনী, নিজেদের গাড়ি আছে। বাড়িটাও দোতলা, পরিবার নিয়ে থাকার উপযোগী। আশেপাশে বেশিরভাগ জায়গা নিরবের দাদার নামে ছিল, উনি বেশ কয়েকবছর আগে মা”রা গিয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে সকল সম্পত্তির মালিক তাঁর দুই ছেলে। নিরবের বড় চাচার সম্পর্কে কিছু জানি না, কখনো কাউকে প্রশ্ন করা হয়নি। শাশুড়ি মা গম্ভীর প্রকৃতির, নিরবের চাচি ঘর দিয়ে বের হয় না তেমন, বাড়িতে বাইরের কেউ আসে না।

বাড়ি পৌঁছুতে সন্ধ্যে নেমে এলো। গাড়িতে চড়ার অভ্যাস নেই, শরীরটা খারাপ লাগছে, বমি বমি পাচ্ছে। চির-পরিচিত বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম, ঘরে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে।

মা দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,

‘ কোন সমস্যা হয়েছে? আপনি এ সময় সানজিদাকে নিয়ে এলেন, ও কোন সমস্যা করেনি তো আবার। ”

” না ও কিছু করেনি। ”

” তাহলে?’

” আপনাদের দেখতে চাইছিল তাই নিয়ে এলাম। দু’দিন থেকে আবার ফিরে যাব। আশা করি সমস্যা হবে না। ”

মা মেকি হাসি দিল। দরজার সামনে দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে তরল গলায় বললেন, ” না সমস্যা হবে কেন। বলে আসলে প্রস্তুতি নিতে পারতাম, এই আর কি!”

” সমস্যা নেই, আলাদা করে কেন প্রস্তুতি নিতে হবে না। ”

মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমাদের বসতে বলে বাবাকে ডাকতে ডাকতে ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল। শশুর আব্বু সোফায় বসে পড়লেন, আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। ধূলোময়লা জমে ঘরটা থাকার অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে, আমি চলে যাওয়ার পরে বোধহয় কেউ এ ঘরে পা রাখেনি। বোরকা-হিজাব খুললাময় খাটের উপর রেখে তোয়ালে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও নেই! কি আর করার, একটা ওড়না হাতে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম, গোসল করতে পারলে খুব ফ্রেশ লাগতো কিন্তু ঠান্ডা লাগতে পারে।

হাত-মুখ মুছে ওড়নাটা দরজার উপর মেলে দিয়ে, বিছানা ঝাড়তে শুরু করলাম, ইসস কত্ত ধূলো পড়ছে! ঘর ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। আসতে তেমন কষ্ট হয়নি, তবুও খুব ক্লান্ত লাগছে। মা বাবা কেউ আমার খোঁজ করতে আসেনি, সবাই শশুর আব্বুকে নিয়ে ব্যস্ত। ওপাশে শশুর আব্বুর যত্ন-আত্তির ত্রুটি হচ্ছে বলে মনে হয়। গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু গেলাম না৷

আচ্ছা চিঠিটা নিরবের হাতে পড়েছে তো! কথাটা মনে হওয়ায় খুব বিব্রতবোধ করলাম। পরক্ষণেই মনে হলো এখানে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই।

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে মুখে লাগছে, পূর্ব দিকের জানালাটা খোলা ছিল। কিছু সময় রোদের উত্তাপ অনুভব করলাম, মন্দ লাগছে না। এই মুহুর্তে কোন কবির চোখে পড়লে সে নিশ্চয়ই বিষয়টা নিয়ে কবিতা লিখে ফেলতেন। আমি কোন কবি নই, আমার হাতে ছন্দ লেখা হয় না। তাই এসব ভাবা বৃথা। হয়তো আরো কিছু সময় এভাবে শুয়ে থাকতাম কিন্তু মা’য়ের ডাকে বিছানা ছাড়তে হলো। হাই তুলতে তুলতে দরজা খুললাম।

” নবাবজাদার মতো শুয়ে আছেন কেন মেডাম? এদিকে এসে একটু সাহায্য করুন। ”

” ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”

মা কিছু না বলে চলে গেলেন। হাত মুখ ধূয়ে শাড়ি পাল্টে নিলাম, ঘরে বেশ কিছু থ্রি-পিস আছে তবে শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলো। চুলগুলো নিচু করে খোঁপা করে নিলাম, কপাল পর্যন্ত কাপড় টেনে বাইরের দিকে রওনা হলাম। বেশিরভাগ কাজ রান্নাঘরের তবে উঠান থেকে কয়েকটা লেবু পাতা নিয়ে আসি। চায়ের ভিতর লেবু পাতা দিলে বেশ গন্ধ ছাড়ে, প্রতি চুমুকে আলাদা তৃপ্তি পাওয়া যায়।

তিন কাপ চা নিয়ে বসার ঘরে গেলাম, যদিও বসার ঘরে শশুর আব্বু আর বাবা বসে গল্প করার কথা, এ বাড়িতে বাইরের কেউ আসে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। শশুর আব্বু আর বাবার সাথে সুদর্শন এক যুবক বসে, হাসি মুখে দু’জনের সাথে গল্প করছে। শীতল হওয়া আমাকে স্পর্শ করছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে খোলা মাঠ, সবুজ ঘাসের চাদর বিছানো, চাঁপা ফুলের মিষ্টি নষ্ট নাকে লাগছে। খুব জোরে বৃষ্টি নামবে, কেউ ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসছে।

” ভিজে যাবেন, এই ছাতার নিচে আসুন। আমি আপনার অপেক্ষায় আছি, বহুকাল ধরে। ”

বাবার ডাকে কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়েছি। একি আমার হাত কাঁপছে কেন!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে