#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২
চা বানাতে বানাতে মনে হলো মা বাবার সাথে কথা বলা দরকার। কোথাও খুব বড় ঝামেলা আছে। ছোট থেকে এক প্রকার বন্দী বানিয়ে বড় করেছে, মা তো লেখাপড়াও করতে দিতে চাইতেন না। শুধুমাত্র দাদির জন্য পারেনি। দাদি গ্রামে থাকে, বছরে দু’চারবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। আমার কোন ভাই-বোন নেই, বাড়িতে শুধু মা বাবার আর আমি।
দাদি আসলে আমার দিনগুলো খুব সুন্দর কাটতো, মা বাবা কোন খারাপ ব্যবহার করতেন না। দাদি প্রতিবার যাওয়ার আগে বাবাকে ডেকে বলতেন, “পাপ করেছিস তুই। খুব বড় পাপ। মেয়েটাকে মানুষ করে অন্তত কিছু পাপ কমানোর চেষ্টা কর। ”
এই কথার মানে আমি জানি না, দাদিকে প্রশ্ন করলে বলতো তোর বাবা ছেলেমেয়ে না হওয়ার জন্য আ”ত্ম”হ”ত্যা করতে চেয়েছিল। পুরনো কথা বাদ দে। তবে আমি বাদ দিতে পারতাম না। বেশ কয়েকদিন কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করতাম। একবার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কথাগুলো শুনে মা আমায় প্রচন্ড মা”র”লো। আমি নাকি বে”য়া”দ”প বড়দের কথার মাঝে কথা বলি। এরপর থেকে আর কখনো জিজ্ঞেস করিনি। বাইরের দুনিয়ার সাথে খুব বেশি পরিচয় নেই আমার, মা বাবা যতটুকু দেখতে দিয়েছে ঠিক ততোটা দেখতে পেরেছি।
চোখের পানি মুছে শশুর মশাইকে চা দিয়ে এলাম। এখন আবার রান্না করতে হবে। রান্না করা কোন কঠিন বিষয় নয়, বাড়িতে থাকতে সব কাজ আমাকেই করতে হতো। সেই সুবাদে সব রান্না কম বেশি পারি। সব কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হলে এলো। মাগরিবের নামাজ শেষ করে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। নিজের জীবন নিয়ে বড্ড ক্লান্ত আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু ছেড়ে কোথাও চলে যেতে পারতাম, কিন্তু কোথায় যাবো? বইয়ের জ্ঞান দিয়ে তো সবকিছু সম্ভব হয় না। কিছু করার জন্য মনোবল থাকা প্রয়োজন, যা আমার একদমই নেই।
” বউমা, নিরবকে একটু পড়া দেখিয়ে দেও তো। শুনেছি তুমি অর্নাস পাশ করেছ, বেশ ভালো হলো, আজকাল টিউশন মাস্টারের অনেক বেতন। ”
শাশুড়ি মা’য়ের কথায় বিছানা ছেড়ে নিরবের ঘরে গেলাম। নিরব ক্লাস নাইনে পড়ে, সাইন্সের স্টুডেন্ট। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল সাইন্স নিয়ে পড়ার, মাধ্যমিকে সাইন্স ছিল কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে এসে আর সাইন্স নিতে দিল না। সাইন্স নিলে নাকি টিউশন পড়তে হবে, আমার ডানা গজাবে। এই নিয়ে দাদির সাথে মা’য়ের খুব ঝামেলা হয়েছে। দাদি প্রচন্ড রেগে গেছিলেন, শেষ পর্যন্ত মা বললেন আমি গনিত ভালো পারি না, তাই সাইন্স নিয়ে পড়ে কি করবো। ফেল করার থেকে পাশ করা ঢের ভালো। কিন্তু দাদি নাছোড়বান্দা, রাগারাগি করে গ্রামে ফিরে গেলেন।
অনেক রাত পর্যন্ত নিরবকে পড়ালাম, ছেলেটার মেধা আছে। একবার বেশি বোঝাতে হলো না। শাশুড়ি মা বেজায় খুশি। খাওয়া-দাওয়া শেষ বিছানায় গিয়ে দেখলাম একটা বাজে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে গেল। খুব বেশি খারাপ সময় কাটছে এমনটা নয়। সারাদিন বাড়ির সব কাজ সেরে সন্ধ্যা থেকে নিরবকে পড়ানো। এটাই রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, শাশুড়ি মা কাজের হুকুম করলেও কখনো গায়ে হাত তোলে না, বাজে কথাও বলে না। শুধু এটা করো, ওই কাজ শেষ হয়নি কেন। এটুকু কথায় হাত থেকে বাঁচার জন্য গুছিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। নিরবের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। পড়ার বিষয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দু’জনে খিলখিল করে হেসে উঠি। হাসির শব্দে শাশুড়ি মা ভড়কে যায়, দৌঁড়ে আসে তারপর কিছু না বলেই ফিরে চলে যায়৷ মাঝেমধ্যে রান্নার সময় নিরব এটা ওটা বানিয়ে দেওয়ার আবদার করে। এই তো গতকাল দুপুরের রান্না করছি, হঠাৎ নিরব গিয়ে বললো, ” কি কি রান্না করবেন?”
” মাছ, ডাল আর সবজি। তুমি এখন কোথা থেকে এলে? স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে নাকি?”
” হুম, স্কুলে আর ক্লাস হবে না, কিসব অনুষ্ঠান। তাই চলে এসেছি। ”
” ওহ আচ্ছা। ”
” একটু কষ্ট করে পাস্তা রান্না করে দিবেন? খুব ক্ষুধা লেগেছে। ”
” এখন পাস্তা? ”
” হ্যাঁ, খেতে ইচ্ছে করছে। দেন না প্লিজ। ”
” আচ্ছা দিচ্ছি। ”
নিরব খুশি মনে নিজের ঘরে চলে গেছিল। ভাবতে অবাক লাগে এই ছেলেটা আমার স্বামী। ওদের পরিবার পেটে ভাতে কাজের লোক পাওয়ার জন্য আমার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছে কিন্তু ও কি করে বিয়েতে রাজি হলো। তাছাড়া আমার মা বাবা কি মনে করে এতো কম বয়সী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে?
রোজ এসব নিয়ে চিন্তা করি, কিন্তু উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। শাশুড়ি মা’কে প্রশ্ন করে ছিলাম কেন উনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিলেন। উনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ” আমি অসুস্থ, ডাক্তার কাজ করতে নিষেধ করেছে তাই ছেলের বিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া বেশি বয়সী মেয়ে বিয়ে করা সুন্নাত। নিরব একটু ছোট তবে সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিবে। ”
জবাবে কিছুই বলিনি। কি-ই বা বলতাম! নিজের মা বাবা যেখানে কিছু ভাবেনি। উনারা তো নিজের স্বার্থে বিয়ে দিয়েছে।
সকালের খাওয়া শেষে পুকুর পাড়ে থালাবাসন নিয়ে বসেছি। এগুলো ধূয়ে গোয়ালঘরে যেতে হবে। খোঁয়াড়ে খড় দিতে হবে, দ্রুত হাত চালানোর চেষ্টা করছি। এমন সময় নিরবের চাচাতো বোন এলো।
” বাহ্! মেয়ে তো দিনে দিনে একদম লক্ষী বউমা হয়ে উঠছে। আজকাল নিরবকেও ভালোই হাত করছ। পড়াতে বসে গায়ে ঢলেঢলে পড়ো। ”
” কেমন ধরনের কথা বলছ তুমি? ”
‘ কেমন কথা বলবো? যা সত্যি তাই বলছি। কি ভেবেছ এই রূপ দেখিয়ে নিরবকে হাত করবে? সন্ধ্যার পর তোমাদের হাসাহাসির শব্দে ঘরে থাকা দায় হয়ে যায়। ”
মেয়েটা একটু বাড়িয়ে বলছে, নিরবকে পড়াতে বসলে হাসাহাসি করি এটা ঠিক। তবে গায়ে ঢলে পড়িনি, তাছাড়া সবাই তো জানে আমি নিরবের বউ, গায়ে ঢলে পড়লে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
” নিরবের বউ তাঁর গায়ে ঢলে পড়লে তোমার কি সমস্যা? ”
” দুইদিনের অতিথি আসছে বউয়ের অধিকার দেখাতে। তোমার কপালে দুঃ”খ আছে। মিলিয়ে নিও। ”
মেয়েটা মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। এ বাড়িতে আসার পর থেকে দেখছি মেয়েটা আমায় সহ্যই করতে পারে না। হয়তো ভাবি ননদের শ”ত্রু”তার সম্পর্কে বিশ্বাস করে। তবে ওর একটা কথায় কেমন অদ্ভুত লাগলো। দুইদিনের অতিথি বলতে কি বোঝালো? তবে কি শাশুড়ি মা বা ওঁরা তা”লা”কের কথা ভাবছে। তা”লা”ক হলেও আমার কপালে কিসের দুঃ”খ আছে?
সবকিছু এলোমেলো লাগছে, মনে হচ্ছে বিয়ের ব্যাপারটা যত সহজ দেখাচ্ছে ততটাও সহজ নয়।
সন্ধ্যায় নিরবকে পড়াতে বসেছি, ও লিখছে। শাশুড়ি মা নিরবের চাচির ঘরে গিয়েছে। ওদের ঘর থেকে চাচির ঘরের দূরত্ব খুব বেশি নয়, মিনিট খানেক লাগে হেঁটে যেতে। তারপর আশেপাশে কোন বাড়ি নেই, সব জায়গা নাকি শশুরদের। এ বাড়িতে আসার পর বাড়ির সীমানার বাইয়ে যাওয়া হয়নি, তবে অনেক জায়গা নিয়ে ওদের বাড়িটা। লেখা শেষ করে নিরব বললো,
” মা রিতুদের ঘরে গেল না?”
” হুম। ”
” আপনার সাথে কি রিতুর ঝগড়া হয়েছে? তখন বললো আপনি নাকি ওঁকে কিসব বলেছেন।”
” ঠিক ঝগড়া হয়নি। কেন বল তো?”
‘ আপনাকে একটা কথা বলবো। কাউকে বলবেন না তো? প্রমিজ করেন। ”
” আচ্ছা কাউকে বলবো না। ”
” সত্যি বলবেন না তো?”
” সত্যিই কাউকে বলবো না। ”
” রিতু আমাকে পছন্দ করে, আমিও ওকে খুব পছন্দ করি। ছ’মাস আগে থেকে আমরা প্রেম করছি। ”
” কিহ্??”
” আস্তে আস্তে। মা শুনে ফেলবে। কি হয়েছে জানেন, একদিন রাতে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে, তারপর থেকে। আপনাকে বিশ্বাস করে বললাম, মা’কে বলে দিবেন না প্লিজ। ”
” আচ্ছা বলবো না। এখন পড়া শেষ করো। এই সৃজনশীলটা লিখে দেও তো। ”
নিরব খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করলো। এইটুকু ছেলে নাকি প্রেম করে, ভাবলেই কেমন হাসি পাচ্ছে। এখন বুঝলাম রিতু কেন আমাকে সহ্য করতে পারে না। ছেলে-মেয়েরা আজকাল ইঁচড়েপাকা হয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে দেখ, অনার্স পাশ করে আজও প্রেম করতে পারলাম না। বিয়েও হয়েছে এক পুঁচকে ছেলের সাথে, সে-ও নাকি আবার প্রেম করে। ভাবা যায়! অবশ্য জীবন কেটেছে বন্দিনীদের মতো। কখনো মোবাইল ছুঁয়ে দেখার সাহস পাইনি, কোন বন্ধু বানানোর সুযোগ হয়নি। বাইরে কোথাও গেলে বাবা সাথে নিয়ে গেছে, চোখে চোখে রেখেছে। মাঝেমধ্যে মনে হতো বাবার কাজই হলো আমাকে পাহারা দেওয়া। বাবা কোন চাকরি-বাকরি করতেন না, দাদার অনেক সম্পত্তি ছিল, বেশিরভাগ অংশ দাদির নামে লিখে দিয়েছে। দুইটা বাড়ি ছিল বাবার নামে, একটাতে আমরা থাকতাম অন্যটা ভাড়া দেওয়া। ভাড়ার টাকায় দিব্যি সংসার চলে যায়। আচ্ছা বন্দিনীর জীবনে কি প্রেম আসে না? তাদের কি কখনো মুক্তি মেলে না?
” কিসব ভাবছেন?”
” হ্যাঁ, লেখা শেষ?”
” লেখা তো শেষ হয়েছে বেশ আগে, কিন্তু আপনি তো খেয়ালই করছেন না। কিসব ভাবছেন কে জানে! প্রেমিকের কথা ভাবছেন নাকি? আচ্ছা আপনার প্রেমিক ছিল?”
” এসব কি ধরনের কথা? পড়ার মন দেও, ইংরেজি বই বের করো। ‘
” সরি, না বলতে চাইলে শুনবো না। ”
” আমি না বললে তুমি কি করে শুনবে? ”
নিরব আমি দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম। হাসলে মন ভালো হয়ে যায়, কেমন একটা হালকা লাগে। সবাই মন খুলে হাসতে পারে না, যারা মন খুলে হাসতে পারে তাঁরা বড্ড সুখী মানুষ।
রাতে ঘুমানোর সময় মনে হলো একবার মা-বাবার কাছে যাওয়া উচিত। এই এক মাসে একদিন কল দিয়ে আমার খোঁজ নেয়নি, দেখতে আসা তো অনেক দূরের কথা। যদিও আমার নিজের মোবাইল নেই কিন্তু শশুর -শাশুড়ির মোবাইল নম্বর তো তাদের কাছে ছিল। হয়তো ঝামেলা বিদায় হয়েছে, তাই আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
চলবে