#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১১
ঘড়ির কা’টা তিনটার কিছুটা ওপারে। মধ্যরাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুনগুন শব্দ শুনতে পাচ্ছে সৌহার্দ্য। কিন্তু পৃথিবীর কোনো আওয়াজ এই মুহুর্তে সৌহার্দ্যের কর্ণকুহরে ধ্বনিত হচ্ছে না। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সে। এই আকাশের দিকে তাকালেই তার কষ্ট হয়। বিষাক্ত বেদনায় ছেয়ে যায় মন। তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুটো জিনিস হারিয়ে গেছে অনেক দূরে। হয়তো আকাশ যেখানে মিলিয়ে গিয়েছে, তার থেকেও অনেকটা দূরে! সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখের জলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।
-“যা হারিয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না। কিন্তু যার জন্য হারিয়ে গিয়েছে, তার জীবনটা নরক করে দেবে এই সৌহার্দ্য রায়হান। ”
বিষাদ ও বিরক্তি নিয়ে মনে মনে কথাটা আওড়ালো সৌহার্দ্য। সি’গা’রে’ট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে লাইটার জ্বা*লাতেই তরীর কথা মাথায় এলো তার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ঘরের ভেতরের দিকে। ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ফেলে সি’গা’রে’টটা ফেলে দিলো সৌহার্দ্য।
তরীর কপালের ওপর হাত দিয়ে জ্বর চেক করে আরেকবার বিরক্ত হলো সৌহার্দ্য। জ্বরের মাত্রা কমার পরিবর্তে আরো এক ধাপ বেড়েছে। প্রেশার ফল করায় তরীকে স্যালাইন দিয়েছে সৌহার্দ্য। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার পর কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিল! সৌহার্দ্যের এখনো মনে পড়ে সেই মুহুর্তটা। তরীর চাহনি মাঝে মাঝে অনেক কথা বলে। আচ্ছা, যারা কথা বলতে পারে না, তাদের সবার ক্ষেত্রেই কি এমন হয়? নাকি তরীর ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, তরী অরুণীকে দেখে এমন প্রতিক্রিয়া কেন দেখালো? হয়তো অরুণীকে দেখে এমনটা করেনি ও। শরীর খারাপ লাগছিল, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। সেটা ভেবে না-হয় মনকে মানিয়ে নিলো সৌহার্দ্য! কিন্তু দাদী যে তরীকে দেখে বলেছিল, ওর চেহারার আদল তার অনেক চেনা! সেটা কি শুধুই দাদীর একটা সামান্য ধারণা ছিল? নাকি অন্য কিছু? অনেক কিছু জানা বাকি, এটা সৌহার্দ্য বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।
-“তোমার-আমার বিয়েটা মোটেও কাকতালীয় নয়, তরী। সবটা সেভাবেই হয়েছে এবং সেরকম ভাবেই ঘটেছে, যেভাবে আমি চেয়েছি। তবে এটা আমি কনফেস করতে পারি যে, আমি তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছি। কিন্তু তোমাকে তোমার পরিবার নাম নরক থেকে বাঁচিয়েও এনেছি। মুখে যত যা-ই বলি না কেন? তোমায় আমার প্রয়োজন। অনেক প্রয়োজন! তাই তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। তোমায় আমি ছাড়ছি না। হয়তো স্ত্রীর সম্পূর্ণ মর্যাদা তোমায় কোনো একসময় দিবো, কিন্তু ভালোবাসতে পারবো না কোনোদিন। আমি একজনকে-ই ভালোবাসি আর সেই একজনটা তুমি নও!”
তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে কথাগুলো বললো সৌহার্দ্য। তরী কিছু শুনলো কি শুনলো, সেটা তার জানা নেই। তরীর ঘনঘন নিঃশ্বাস জানান দিচ্ছে, সে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
১৯.
-“কেসটা দিন দিন প্রচুর কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে, বুঝলে রিয়াদ।”
নিজের কেবিনে বসে কপালে আঙুল ঘষতে ঘষতে কথাটা বললো প্রহর।
-“মিস্টার রায়হানের এক্সিডেনটটা যেভাবে হয়েছে, তাতে বুঝা-ই যায় যে, ওনাকে মেরে ফেলাটা-ই উদ্দেশ্য ছিল ওদের। ভাগ্য ভালো হওয়ায় বেঁচে গিয়েছেন উনি। কিন্তু ওনাদের সবার জীবন-ই তাহলে বি*পদ*সংকুল আই গেইস!”
রিয়াদ নিজেও চিন্তিত কেসটা নিয়ে। তবে প্রহর কেসটা নিয়ে অনেক বেশি ঘাটাঘাটি করছে। এটা রিয়াদের কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। ভাবনাটা হঠাৎ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল রিয়াদের,
-“স্যার, আপনি এই কেসে এতো প্রায়োরিটি কেন দিচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না।”
প্রহর রিয়াদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রিয়াদ হকচকিয়ে গেল যঝন অনুধাবন করতে পারলো যে, সে কী বলেছে। আমতা আমতা করে বললো,
-“আব্ সরি, স্যার! একচুয়েলি, বলতে চাইছিলাম যে, আ…..”
-“এখানে জড়িত প্রতিটা মানুষ আমার জীবনের সবচেয়ে দূর্বল পয়েন্ট, রিয়াদ। মানুষ নিজের দূর্বলতা কখনো প্রকাশ করে না। করাটা উচিতও নয়। কিন্তু আমি নিজের এই দূর্বলতা লুকিয়ে কোনো বেনিফিট পাবে না, কারণ যাদের কাছ থেকে লুকানো উচিত তারা অনেক আগে থেকেই জানে সৌহার্দ্য আমার হৃৎস্পন্দন।”
প্রহর রিয়াদের সাথে এতো কিছু শেয়ার করায় রিয়াদ যেন একটু সাহস পেল। তাই সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
-“তাহলে মাধুর্য ম্যামকে নিয়ে আপনি এতো সেনসিটিভ কেন?”
প্রহরের আনমনা ও গাম্ভীর্য মিশ্রিত মুখে হঠাৎ হাসি খেলে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে আবার আনমনে সে বললো,
-“কারণ সে মধু। প্রহরের মধু! নাহ্, এটা মিলছে না।উম… মধুর প্রহর! হ্যাঁ, এটা সুন্দর।”
বলতে না বলতেই সৌহার্দ্যের ফোনে টেক্সটের নোটিফিকেশন এলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ওয়ালপেপারে মধুর ছবি দেখে রিয়াল মনে মনে হাসলো। বিরবির করে বললো,
-“আসলেই মধুর প্রহর!”
রিয়াদ চলে গেল। প্রহর সেদিকে নজর না দিয়ে ফোনে মধুর মেসেজটা দেখলো,
-“আজকে বিকেলে দেখা করবি। কথা আছে। স্ট্রিট পার্ক, সময়-৫ টা!”
প্রহর ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটা কি এরকম সরাসরি কথা বলা ছাড়া আর কিছুই পারে না? নাম মধু হলে কী হবে? নামের সাথে বৈশিষ্ট্যের কোনো মিলই নেই।
প্রহর বের হয়ে গেল নিজের বাইক নিয়ে। গাড়িটা নিলো না। যেতেই ঘন্টাখানেক লাগবে। বাইকে দ্রুত যাওয়া যাবে, গাড়িতে গেলে যেটা সম্ভব নয়।
প্রহর পৌঁছালো সাড়ে পাঁচটায়। মধু পার্কের বেঞ্চে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। হাতে দুটো হাওয়াই-মিঠাই। প্রহর গিয়ে মধুর পাশে বসলো। মধু কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একমনে বাদাম খাচ্ছে যেন তার আশেপাশে পরিচিত কোনো মানুষ-ই নেই। পৃরহর মধুর হাত থেকে একটা হাওয়াই মিঠাই নিতে গেলে মধু নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। বাদাম চিবোতে চিবোতে প্রহরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মধু। বললো,
-“এটা নিচ্ছিস কেন? তোর জন্য কিনেছি নাকি?”
প্রহর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো,
-“দুটো কিনেছো যে!”
-“তো! দুটো কিনলেই তোকে একটা দিতে হবে? কেন বে? আমি দুটোই আমার নিজের জন্য কিনেছি। দুটোই আমি খাবো। টাকা এতো বেশি হয় নাই আমার যে তোকে খাওয়াবো!”
চোখ রাঙিয়ে কথাগুলো বললো মধু। প্রহর বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
-“এই তুমি ভদ্রতা কবে থেকে শিখবে বলো তো? আমি তোমার থেকে বয়সে বড়, তারওপর আমার পরিচয় শুনে আমাকে তোমার সম্মান করা উচিত, ভয় পাওয়া উচিত!”
মধু কিটকিটিয়ে হাসলো। বললো,
-“ভদ্রতা? আমার থেকে এতো বেশি কিছু আশা করিস না, বস! এসব লোক দেখানো ভদ্রতা-সম্মান আমার মধ্যে জন্মের পর থেকে জিরো লেভেলে না, বরং মাইনাস ফি’গা’রে আছে, বুঝলি?”
প্রহর ব্যর্থতা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নাহ্! এই মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তবুও মনের একটা ইচ্ছে প্রকাশ করতে খুব করে চাইলো প্রহর। মধুর এদিক ওদিক তাকানো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার একটা কথা রাখবে?”
মধু নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-“জানি না।”
-“মানে?”
-“মানে হচ্ছে কী কথা রাখতে হবে, বল। মনে চাইলে রাখবো, না মনে চাইলে রাখবো না। তুই তো জানিস, আমি নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু করি না।”
-“একটু আগের মতো সেজে আসবে একদিন? মেয়েলি সাজ!”
মধু নিজের পোশাকের দিকে তাকালো একবার। একটা টিশার্টের ওপর নরমাল শার্ট আর একটা ঢিলেঢালা জিন্স পরেছে সে। চুলগুলো কাঁধের একটু উপরের দিকে একদম ছোট করে কেটে ছেড়ে রেখেছে। মধু নিজের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
-“সম্ভব না।”
-“একবার-ই তো! আমার এই একটা অনুরোধ রাখবে না।”
মধু উঠে দাঁড়ালো। স্কুটারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“মধু অনেক স্বার্থপর একটা মেয়ে। সে নিজের মনের কথা ছাড়া কারো কথা শুনে না, কারো অনুরোধও না। এটা মাথায় ভালোমতো সেট করে নে। চললাম, বস!”
প্রহর কষ্ট পেল কথাটা শুনে। তবুও সেটা প্রকাশ না করে বললো,
-“কী বলার জন্য ডেকেছিলে, সেটা তো বলে যাও!”
-“দেরী করে এসেছিস। ততক্ষণে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আমার।”
বলেই ঝড়ের বেগে স্কুটার নিয়ে চলে গেল মধু। প্রহর ওর যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। যতক্ষণ মধুকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ। এবং তার পরেও!
বাতাসের বেগে স্কুটার ছুটছে। চুলগুলো হাওয়ার তালে চোখেমুখে এসে পড়ছে মধুর। আজ বহুবছর পর মধু কাঁদছে। চোখের পানি নিজের গতিতে ঝরে পড়ছে। তার মধ্যে আজ কোনো চেষ্টা নেই। না ঠোঁ*ট কামড়ে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, আর না চোখের পানিগুলো নিজের হাতে মুছে ফেলার চেষ্টা!
২০.
সপ্তাহ ঘুরেছে। তরী এখন অনেকটাই সুস্থ! বিছানায় বসে নোটস গুলোতে চোখ বুলাচ্ছে সে। সৌহার্দ্য ঘরে প্রবেশ করলো। তরী তাকে দেখেই শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে বসে চুলগুলো হাত খোপা করে নিলো। সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর গালে-কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করলো। প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো,
-“যাক, ঠিকঠাক আছে।”
তরী অবাক হলো না। এ আর নতুন কী? অসুস্থতার এ কয়দিন সৌহার্দ্যের এমন যত্ন দেখে তরী অবাক হতে হতে এখন আর অবাক হতে ভালোই লাগে না ওর। স্বাভাবিক ভাবেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলো তরী। কিন্তু সৌহার্দ্য ওর দুই বাহুতে হাত দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“দাদীর কথা এতো কাবে তুলতে হবে না। দাদী আজ তোমাকে আমার জন্য লেমনেড বানাতে ব….”
তরীর ভীত চোখের দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য থেকে গেল। অপলক তাকিয়ে রইলো তরীর চোখ জোড়ায়। সৌহার্দ্যের কপালে ভাজ পড়লো। ধীরে ধীরে সেই ভাজ গভীর হচ্ছে। সৌহার্দ্যের চাহনি দেখে তরী সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো। সৌহার্দ্য তরীর দুই গালে হাত রাখলো। ওর মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“আমার দিকে তাকাও। ঠিক সেইভাবেই তাকাবে, যেভাবে কিছুক্ষণ আগে তাকিয়েছিলে।”
-চলবে….
#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১২
তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য তরীর চোখের দিকে জহুরি নজরে তাকিয়ে আছে। তরীর চোখে যেন সে খোঁজার চেষ্টায় আছে! হয়তো চেনা কিছু, নয়তো অচেনা। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সৌহার্দ্য বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। তরীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো বিমর্ষ ভঙ্গিতে।
-“কীসব হচ্ছে আমার সাথে, নিজেও বুঝতে পারছি না! যে পৃথিবীর মাটি থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে, তাকে বারবার খুঁজি আমি। জানো তো, তরী? মানুষের মন কখনো কোনো যুক্তি মানতে চায় না। হাহ!”
সৌহার্দ্য নিজের হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে কথাগুলো বললো। তরী অবুঝের মতো সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ওর দিকে আর তাকালো না। মানসিক ক্লান্তিগুলো আবার সারা শরীরে জেঁকে বসেছে। কি অসহ্যকর অনুভূতি!
সৌহার্দ্য ওয়াশরুমে ঢুকতেই তরী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটু বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। দু পা বাড়াতেই পাশে টেবিলের ওপর থাকা সৌহার্দ্যের ফোন ও ওয়ালেটের ওপর নজর পড়লো ওর। সৌহার্দ্যের ফ্রেশ হয়ে আসতে বেশ ভালোই সময় লাগবে। তাই তরী সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে সৌহার্দ্যের ফোনটা হাতে নিলো। ফোন অন করে দেখলো, স্ক্রিনে পাসওয়ার্ড-লকড্ অপশন এনেবল করা। তরী হতাশ হলো। ওয়ালেটটা একবার চেক দেওয়ার জন্য হাতে নিলো, যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়! কিন্তু ওয়ালেট খুলতেই একসাইডে একটা ছবি দেখে তরী বিস্ময়ের শেষ ধাপে পৌঁছে গেল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে। মানে কী এসবের? সৌহার্দ্য তো অরুণীকে ভালোবাসে! তাহলে ওয়ালেটের ভাজে এই ছবিটা কেন রেখেছে? কী চলছে সৌহার্দ্যের মনে?
২১.
সৌহার্দ্যের দাদী সবেমাত্র নামাজ শেষে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কুঁজো হয়ে যাওয়া দেহটাকে নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বিছানায় বসলেন আয়েশি ভঙ্গিতে। তসবীটা হাতে নিবেন এমনসময় দরজার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল দাদীর। সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে। এতোক্ষণ যেন ওনার নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল!
-“কী হইসে রে, নাতি? ঐখানে অমন কইরা দাঁড়াইয়া আছোস ক্যান? কিছু বলবি?”
সৌহার্দ্য কেশে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“তোমার সাথে কথা ছিল!”
-“বলে ফ্যাল! কী বলবি?”
সৌহার্দ্য ভেতরে প্রবেশ করলো। হাতের তালুতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
-“তুমি এখন ফ্রি-ই আছো, তাই না?”
দাদী বিরক্ত হলো। হাতের ইশারায় নিজের পাশের খালি জায়গাটা দেখিয়ে বললেন,
-“এখানে বয়! আর এতো ঘুরাইয়া কথা না বলে একটু ঝেড়ে কাশো তো দেখি!”
সৌহার্দ্য দাদীর কথা শুনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। মনে মনে আশা করলো, দাদী যেন তাকে সবটা বলে! মানসিক অশান্তি থেকে পরিত্রাণের প্রথম উপায় হলো ইতোমধ্যে যেসব ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, সেসব ক্লিয়ার করা। আর সেটা করার জন্য সৌহার্দ্যকে সবটা জানতে হবে। দাদী সবটা জানে কিনা, সে ব্যাপারে সৌহার্দ্য নিশ্চিত নয়। কিন্তু দাদী যে অনেক কিছু জানে, এটা নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সে বেশ গুরু*তর ভঙ্গিতে বললো,
-“দাদী, আমি তরীর ব্যাপারে তোমার কাছ থেকে সবটা জানতে চাই। সবটা মানে তুমি যা যা জানো!”
দাদী মুখের কৌতূহল নিমেষেই মিলিয়ে গেল। তিনি মুখ মলিন করে ফেললেন। বললেন,
-“তোরা যা জানোস, আমিও তো তা-ই জানি! সুজাতা আমারে যতটুকু বলছে, ততটুকুই তো জানি। এর বাইরে…….”
-“দাদী, প্লিজ! আমার সামনে এসব বলে কোনো লাভ নেই, তুমি জানো। তোমাকে আমি এর আগে সবটা বলেছি না? অরুণীর সাথে আমার সম্পর্ক, ভালোবাসার অভিনয় এসব সবটা তুমি জানতে আর কেউ না জানলেও! তুমি-ই আমাকে বলেছিলে অরুণী আর মিস্টার আরমান কি কি করেছিল! আমি যে সবটা জানি, এটা বাবা-মাও জানে না। ওনাদের না জানিয়ে তুমি আমাকে সবকিছু বলেছিলে না? বলো?”
সৌহার্দ্যের কন্ঠস্বর দৃঢ় ঠেকছে৷ দাদী মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“আরে, ঐ ব্যাপার আর এই ব্যাপার তো পুরাই আলাদা! ঐসব তো আমি জানতাম, তাই তোরে জানাইছি! এইখানে তরীরে নিয়া তো জানার মতো কিছু নাই! ও তো সাধারণ একটা মেয়ে।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ করে বললো,
-“তুমি সত্যিটা বলবে না, তাই না? তুমি নিজেও জানো, আমার সাথে মিথ্যে বলে কোনো লাভ নেই। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।”
দাদী অবাক হয়ে বললেন,
-“এতোটা নিশ্চিত কেমনে তুই? ”
-“চোখ দেখেছি। তরীর চোখ! খুব কাছ থেকে দেখেছি। আর দেখে এটাই বুঝেছি যে, এমন কোনো সত্যি আছে যা আমি আজও জানি না।”
সৌহার্দ্যের ওপর থেকে নজর সরিয়ে দাদী বললেন,
-“সব তোর মনের ভুল। ওসব কিছু না!”
সৌহার্দ্য দাদীর ওপর পূর্ণদৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
-“আচ্ছা? সবটা আমার মনের ভুল? তাহলে তুমি যেদিন প্রথম তরীকে দেখলে, সেদিন কেন বলেছিলে যে, তরীর মুখের আদল তোমার অনেক চেনা?
-“ওটা আমার মনের ভুল ছিল?”
সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“হাহ্! আচ্ছা? তাহলে আমাকে এটা বলো যে, ও কথা বলতে পারে না জেনেও কেন ওকে মেনে নিলে? এখন এটা বলো না যে, ও অসম্ভব সুন্দরী বলে তুমি ওকে মেনে নিয়েছো। ওসব বলে কোনো লাভ নেই। তোমাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। রূপ দিয়ে আর যা-ই হোক, তোমার মন জয় করা সম্ভব নয়।”
দাদী নীরব রইলেন। অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে সৌহার্দ্যের মনের সন্দেহ দূর করার চেয়ে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ালো। সে বুঝে গেছে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দাদী ওকে কিছুই বলবেন না।
২২.
আজ তরীর ভর্তি পরীক্ষা। এবারই তার প্রথম ও শেষ সুযোগ। যদিও সে অনিশ্চিত এটা ভেবে যে, তার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা!
পরীক্ষা দিতে সৌহার্দ্য-ই নিয়ে এসেছে তরীকে। মিস্টার রায়হান এখনো হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেননি। তাই সৌহার্দ্যের-ই আসতে হলো। পরীক্ষা শেষে তরী বিমর্ষ ভঙ্গিতে গেইট দিয়ে বের হলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো তরীর মলিন মুখের দিকে। বললো,
-“এক্স্যাম ভালো হয়নি!”
তরী মাথা নাড়ালো। বোঝালো ভালো হয়নি। একেবারে যে ভালো হয়নি এমনও না! কিন্তু তরীর মনে হচ্ছে, খুব খারাপ-ই হয়েছে। সৌহার্দ্য তরী মাথায় হাত রেখে বললো,
-“টেনশান করো না। যা হবে, ভালোই হবে। চলো, কিছু খেয়ে নেবে।”
আর কেউ কিছু জানুক, আর না-ই বা জানুক, সৌহার্দ্য তো বেশ ভালো করে জানে যে কথা বলতে না পারলে ডাক্তার হওয়া যায় না। তরীর পক্ষে কোনোদিন ডাক্তার হওয়া সম্ভব না। তার মা না-হয় ততোটা না ভেবে তরীর কথা মেনে নিয়েছে। সুজাতার ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু মিস্টার রায়হান? তিনি কীভাবে তরীর ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্তে সায় জানালেন? এটা তো কখনোই সম্ভব না। তিনি তো সবটা জানেন ও বুঝেন! ভেবে পায় না সৌহার্দ্য।
তরী খাওয়া শেষে হোয়াটসঅ্যাপে একটা টেক্সট পাঠালো মধুকে। একই কেন্দ্র পড়েছে তাদের দুজনের। তাই মধুর সাথে একবার দেখা করা যায়।
-“কোথায় তুমি, মধু? দেখা করবে না আমার সাথে?”
মধু সাথে সাথেই সিন করলো। রিপ্লাই দিয়ে বললো,
-“আর দেখা করা! আমি পরীক্ষা দেই নি।”
তরী অবাক হয়ে লিখলো,
-“কেন?”
-“আরে ইচ্ছে করেনি শুধু শুধু প্যারা নিতে। চান্স হবে না কিছু না, সেটা আমি ভালো করেই জানি। অহেতুক পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ?”
তরী বিরক্ত হলো। এই মেয়েটা এমন কেন? নিজের মন মতো কাজ করে শুধু। নিজের ভালো মন্দটাও বুঝে না। তরী রাগ দেখিয়ে লিখলো,
-“আমার তোমার সাথে কোনো কথা নেই।”
-“আরে ইয়ার! রাগ করছিস কেন? তোর পরীক্ষা কেন হলো বল!”
তরী কোনো রিপ্লাই না দিয়ে অফলাইন হয়ে গেল। তরীর নাকমুখ কুঁচকানো চেহারার দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য অবাক হলো। তরী এতো বিরক্ত হয়ে আছে কেন? এই প্রথম সৌহার্দ্য ওকে বিরক্তিমাখা মুখে দেখলো। নয়তো সবসময়ই বোকার মতো চাহনিতে, নয়তো অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। তরীর মুখে বিরক্তিটা বেশ মানায় তো! পরমুহূর্তেই নিজের অদ্ভুত ভাবনায় সৌহার্দ্য নিজেই অবাক হলো।
চোখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি থেমে গেল সৌহার্দ্যের। প্রহর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে হয়তো কাউকে খুঁজছে! এখানে কেন এসেছে প্রহর, সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পরিস্থিতিতে তারা এখন নেই। পরিস্থিতি কোথা থেকে মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলে, বোঝাটা আসলেই কঠিন। নয়তো আজ এতো ইতস্ততবোধ তার মধ্যে এসে পড়বে ভেবেছে সে কখনো? সৌহার্দ্য প্রহরের দিকে তাকিয়ে-ই রইলো।
তরী মুখ তুলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তরীর। এটা সেদিনকার ঐ ছেলেটা না? এখানে কী করছে ইনি? তরীকে ফলো করছে না তো?
-“এই ছেলেটাকে দেখেছো এর আগে তুমি? একদিন আমাদের বাসায় এসেছিল।”
সৌহার্দ্যের কথা শুনে তরী মাথা নাড়িয়ে জানালো, সে দেখেছে। সৌহার্দ্য কথা বাড়ালো না। তরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। প্রহরের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
গাড়িতে পাশাপাশি বসলো দুজন। সৌহার্দ্য ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি দ্রুত গতিতে-ই এগোচ্ছে। লুকিং গ্লাসে সৌহার্দ্য তরীর দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে। তার মন এটাই বলে যে, তরীকে যতোটা সাধারণ মনে হয়, সে বাস্তবে ততোটা নয়৷ অন্যদিকে তরী আড়চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, সৌহার্দ্যের ওপরের রূপ আর ভেতরের রূপ দুটোই আলাদা। মানুষটা একটা রহস্য, যাকে ভেদ করাটা দুঃসাধ্য হলেও অসাধ্য নয়।
-চলবে…..