প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৫১+৫২

0
1503

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫১

অরুণী চোখ তুলে তাকালো। সৌহার্দ্যের প্রখর চোখের দিকে নজর পড়তেই মুখ জুড়ে শুকনো হাসি খেলে গেল ওর। পরক্ষনেই হাতের তালুতে ভর দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। শুভ্র ফিকে রঙের শাড়ির প্রান্তদেশ মেঝেতে গড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। সৌহার্দ্যের মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে দাড়ালো অরুণী। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে লৌহদন্ড ধরে উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। সৌহার্দ্য বিব্রত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অরুণীর এমন নজর ওর একদম অপছন্দ। অরুণী হাসলো। বললো,

-আমার নজরে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই, সৌহার্দ্য! আমার চোখ জুড়ে তোমার জন্য অঢেল প্রেম আছে, এটা সত্যি। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার কোনো সাধ বা তৃষ্ণা নেই।

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। অরুণীর কাছে এমন কোনো কথা যেন একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল! অরুণীর নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবার। মেয়েটা হয়তো নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সৌহার্দ্য বলার মতো কিছু পেল না। ক্ষণিকের নীরবতা শেষে অরুণী আবার বললো,

-অবাক হয়েছো? আমি কিন্তু সত্যি বলছি! দেরিতে হলেও তিক্ত বাস্তবতা বুঝতে পেরেছি আমি। যখন তোমাকে হারানোর বেদনায় আমার ভেতরে তীব্র দহন শুরু হয়েছিল, ঠিক তখনই আমার বাবা সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যা ইচ্ছে, তাই করেছি। কিন্তু দিনশেষে আমি প্রতারিত, আমার প্রাপ্তির খাতা শুন্য! আমার অপরাধের বোঝা বড্ড বেশি ভারী হয়ে গেছে। আমার হাত আমি বহুবার র*ক্তা*ক্ত করেছি। এই হাতের মালিক তোমায় ডিজার্ভ করে না, সৌহার্দ্য। দেরীতে হলেও আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমায় পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তোমার আর আমার সম্পর্ক বদলেছে। তুমি অরিত্রীর বর! তোমার দিকে সেরকম চোখে তাকানোও আমার জন্য পাপ। আমি আমার পাপের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। আমার মন আজ অকপটে মেনে নিতে বাধ্য যে, সৌহার্দ্যের প্রাণজুড়ে শুধুমাত্র চাঁদের অস্তিত্ব-ই সুন্দর!

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাক! দেরী করে হলেও অরুণী তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে। সে ম্লান হেসে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোমার জীবন আজ এই বদ্ধ কারাগারে কাটানোর কথা নয়, অরুণী! ডক্টর তুমি। হসপিটালে রোগীর কাঁধে ভরসার হাত রেখে তাদের সেবা করাটা তোমায় মানায়। কিন্তু তুমি সেটা বাদ দিয়ে আমার জীবন এলোমেলো করে দেওয়ায় মগ্ন ছিলে। আজ তোমার জন্য তরী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, আমার বাচ্চা দু’টো এতো বছর মা ছাড়া থেকেছে, বড় হয়েছে। মা থাকা সত্বেও ওরা আজ মাতৃহীন। এসব কিছুর জন্য তোমায় আমি চাইলেও ক্ষমা করতে পারবো না, অরুণী।

অরুণী শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

-ক্ষমার যোগ্য কোনো কাজ করিনি, তাই তোমার ক্ষমা আমি প্রত্যাশাও করি না। তুমি আমায় বাকি জীবনটা এই দম বন্ধকর জায়গায় কাটিয়ে দিতে দিলেও পারতে!

-তোমার অপরাধের তুলনায় তোমার শাস্তি আসলেই অনেক তুচ্ছ আর এটা আমার কারণেই হয়েছে। কারণ তরীর ইচ্ছেটা তুমি পূরণ করেছো। ও সবসময়ই চেয়েছে, ওর মায়ের খু*নী যথাযথ শাস্তি পাক। সেই শাস্তিটা ও নিজের হাতে দিতে চেয়েও পারেনি। তুমি ওর ইচ্ছে পূরণ করেছো। আরমান আহমেদকে যেই মৃত্যুটা তুমি দিয়েছো, এর চেয়ে বড় শাস্তি আর দেওয়া সম্ভব না। ওনার লা*শে*র দিকে কেউ তাকাতে পারেনি। তোমার করা সব অপরাধের পেছনে কলকাঠি তো উনিই নেড়েছেন! তাই তোমার প্রতি একটু সহানুভূতি থেকে সবটা করা। দু-এক মাসের মধ্যেই তোমাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। বাকি জীবনটা সুন্দর ভাবে কাটিও! ভালো কিছু করতে না পারলেও অন্তত অন্যায় কিছু করো না।

সৌহার্দ্য আর কালক্ষেপ করলো না। পা ঘুরিয়ে চলে গেল অরুণীর দৃষ্টি সীমার বাইরে। অরুণী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে হাসলো। আনমনে বললো,

-তোমার বর অরিত্রীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু কিছু কিছু দূরত্বও অনেক প্রয়োজন! তুমি এটা একদিন বুঝবে, সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো দুপুরের পর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই বেডের দিকে চোখ পড়লো। প্রণয়-প্রণয়ী বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। সৌহার্দ্য ওদের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হেসে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিলো।

ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসতেই সৌহার্দ্যকে দেখে দাদী বললো,

-রোজ রোজ দুপুরের খাবার দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর খাইলে চলবে? এতো দেরী করে বাড়ি ফিরিস ক্যান? একদিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কর!

সৌহার্দ্য খেতে খেতে বললো,

-কী করবো বলো, দাদী? ডক্টরদের জীবন এমনই হয়! হুটহাট ইমার্জেন্সি পড়ে যায়। আর তাছাড়া আজকে তো হসপিটালের জন্য দেরী হয়নি!

দাদী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো,

-তাহলে ক্যান দেরী হইসে?

-অরুণীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আর কয়েকদিন পরই তো ওকে ছেড়ে দেবে!

দাদী মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। সুজাতা সৌহার্দ্যকে খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন,

-কেন যে ওর সাথে দেখা করতে যাস! তোর বাবার সামনে ভুলেও একথা মুখে আনিস না।

দাদী বিরস মুখে বললো,

-ঐ মেয়ের সাথে আর দেখা করার দরকার-ই নাই তোর। ও তো ছাড়া পাইতেছেই! এখন নিজের মতো চলতে দে ওরে। ওর থেকে দূরে দূরে থাকাই সবার জন্য ভালো।

সৌহার্দ্য খেতে খেতে মাথা নাড়লো। খাওয়া শেষে ঘরে ঢুকতেই দেখলো প্রণয়ী ঘুম থেকে উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ওর পাশে বসে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-ঘুম কেমন হলো আমার প্রিন্সেসের?

প্রণয়ী মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালো না। কিছু বললোও না। প্রণয়ীর নীরবতা দেখা সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-মন খারাপ? ইজ দেয়ার এনিথিং রোঙ্?

-আমাদের মা কবে ফিরে আসবে, পাপা?

প্রণয়ীর প্রশ্ন শুনে সৌহার্দ্যের মুখ মলিন হয়ে গেল। প্রণয় হুট করেই শোয়া থেকে উঠে বসে প্রণয়ীর মাথায় নিজের হাত দিয়ে আঘাত করলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-গাধী, তোকে কী বলেছিলাম? স্টুপিড মেয়ে!

সৌহার্দ্য প্রণয় আর প্রণয়ী দুজনকেই নিজের দুই পাশে বসালো। দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,

-পাপা তোমাদের খুব একটা ভালোবাসতে পারে না, তাই না?

দুজনেই না-বোধক মাথা নাড়ালো। প্রণয়ী মলিন মুখ করে বসে রইলো। প্রণয় বললো,

-তোমাকে আমরা অনেক ভালোবাসি, পাপা। কিন্তু মাম্মাকেও অনেক মিস করি। আজকে মাদার্স ডে ছিল। এজন্যই প্রণয়ীর মুড অফ!

প্রণয়ী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি কেন এতোদিন পর্যন্ত আমাদের মায়ের ছবি পর্যন্ত আমাদের দেখাওনি? আমাদের মা কেমন ছিল, পাপা?

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-সে রূপের তরী ছিল। যদি আকাশের চাঁদ এবং তাকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হয়, তবে সবার দৃষ্টি তার দিকেই আঁটকে থাকবে। তার মেঝে গড়ানো আঁচল, ঢেউ খেলানো চুল, শুভ্র ও ঈষৎ রক্তিম রঙা মুখশ্রী আর সেই নিষ্পাপ হাসির বর্ণনা কেউ বলে শেষ করতে পারবে না। এমনকি আমিও না!

প্রণয় আর প্রণয়ী দুজনই সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে একসাথে বললো,

-মা কবে ফিরে আসবে, পাপা?

সৌহার্দ্য ম্লান মুখে হেসে বললো,

-যেদিন আমার অপেক্ষার পালা শেষ হবে!

-সাত বছরেও অপেক্ষার অবসান হলো না?

-অমাবস্যার অবসান ঘটিয়ে একদিনের ব্যবধানে।চাঁদের দেখা ঠিকই পাওয়া যায়। হয়তো আমাদের জীবনে অমাবস্যা সাতবছর ছিল! কিন্তু চাঁদকে তো একদিন দেখা দিতেই হবে, তাই না?

অর্থী বিরক্তি নিয়ে অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। অরিত্রী মনযোগ দিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। অর্থী বললো,

-এই চান্স মিস করিস না, ইয়ার! সুযোগ জীবনে বারবার আসে না।

অরিত্রী হেসে বললো,

-তোমার মনে হয়, মা মানবে কোনোদিন?

-কিন্তু তোর লাইফে সবকিছুরই এক্সপেরিয়েন্স নিতে হবে।

অরিত্রী আনমনে বললো,

-ইচ্ছে তো আমারও হয়! কিন্তু আবার ভয়ও হয়। মনে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না আসলে….

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫২

অর্থীর রোষান্বিত চোখ দুটো দেখে অরিত্রী কিছুটা ভড়কে গেল। বললো,

-ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? বাংলাদেশে যাওয়ার প্ল্যান আমারও আছে। কিন্তু মা যেতে দেবে না আমায়। আমি বাংলাদেশে যাওয়ার কথা বললেই মা অদ্ভুত রাগ দেখায়। আমি বুঝে উঠতে পারি না ব্যাপারটা।

অর্থী বিরবির করে বললো,

-তুই বিডিতে গেলে তাদের কুকীর্তি সব ফাঁস হয়ে যাবে না? ভয় সবার মনেই কাজ করে।

অর্ণব আর মোহনাকে মনে মনে বকাঝকা করতে করতে অর্থী বেরিয়ে গেল অরিত্রীর ঘর থেকে। বের হতেই মোহনার মুখোমুখি হলো সে। মোহনা কোনো কারণে অরিত্রীর ঘরের দিকেই আসছিল।

অর্থীকে মোহনা মনে মনে অর্থীকে প্রচন্ড অপছন্দ করেন, এটা অর্থী নিজেও বুঝতে পারে। এর কারণটাও ওর জানা। যেদিন মোহনা শুনেছে অর্থী-ই প্রহরের বোন, সেদিন থেকেই মোহনার চোখে নিজের প্রতি অদ্ভুত ক্ষিপ্ততা ও বিরক্ত দেখতে পেয়েছিল অর্থী। সেই বিরক্তি থেকেই অর্থীকে দেখে মোহনা চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন। বললেন,

-তুমি কখন এলে? আর এসেই মেয়েটার ঘরে সেঁধিয়ে গেছো? আশ্চর্য!!

অর্থী হাসি হাসি মুখে তাকালো। সপ্রতীভ কন্ঠে বললো,

-আপনি চাইলেও অরিত্রীকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। আমি ওর একমাত্র বান্ধবী প্লাস বোন, যার সাথে ও ওর মনের সব কিছু শেয়ার করতে পারে। আরনআমার সাথে ওর এতো মাখামাখি যে আপনার নিতান্তই অপছন্দ, সেটাও আমি জানি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি আপনাদের কথা দিয়েছিলাম না? অরিত্রীকে ওর অতীত সম্পর্কে কিছুই বলবো না আমি। আমার দেওয়া কথা আমি রাখবো। কিন্তু আপনারা যা করছেন, তা একদমই ঠিক করছেন না। আপনাদের জন্য দু’টো নিষ্পাপ বাচ্চা আজ মাতৃহীন, একটা ছেলে তার সন্তান দুটো নিয়ে দিনের পর দিন সংগ্রাম করছে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। আমার মুখ না-হয় কৌশলে বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু অরিত্রীর যেদিন সবটা মনে পড়বে, সেদিন আপনি আর অর্ণব-ই হবেন ওর চোখে সবচেয়ে বড় অপরাধী।

অর্থী মোহনাকে পাশ কাটিয়ে হন হন করে চলে গেল। মোহনা ওর যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি মনে মনে জানেন, তিনি যা করেছেন তা অন্যায়। কিন্তু নিজের যুক্তিতে তিনি অনড়।

সৌহার্দ্যের জীবন থেকে পৃথক হওয়ার পর থেকেই অরিত্রীর জীবন সুখের হয়েছে। তরী নামের মানবীটা সারাজীবন যতটা কষ্ট অনুভব করেছে, অরিত্রী নামক সেই মেয়েটি ততোটাই সুখের মাঝে দিন কাটিয়েছে। তাই মোহনা মনে প্রাণে চান, তার মেয়ে সারাজীবন অরিত্রী হয়েই থাকুক। কোনো দুঃখের ছিটেফোঁটাও যেন ওকে স্পর্শ করতে না পারে।

অরিত্রী জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে শো শো করে শীতল হাওয়া ঘরের ভেতর রবেশ করছে।

মোহনা অরিত্রীর পেছনে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলেন। অরিত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মোহনা ওর মুখের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বললেন,

-কী এতো চিন্তা করছিস?

অরিত্রী মলিন হেসে বললো,

-এমনিতেই! আজকে নাইট ডিউটি আছে। সেটা নিয়েই ভাবছিলাম।

-ওহ্! তোর সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি।

অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,

-বলো! কী বলবে?

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-তোর দাদী মারা গেছেন। গ্রামে ছিলেন সবসময়। বেশ কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। একটু আগে তো খবর এলো, উনি মারা গেছেন। এখন তোর বাবাও নিজের মাকে শেষবারের মতো না দেখে থাকতে পারবেন না। তাই আমাদের এইবার বাংলাদেশে না যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

অরিত্রীর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। সে আগেপিছে না ভেবেই বলে ফেললো,

-দাদীকে আমিও শেষবারের মতো দেখতে চাই। আমিও বাংলাদেশে যাবো তোমাদের সাথে।

মোহনা মুহুর্তেই বিরক্ত হলেন। ঈষৎ ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

-তুমি এখানেই থাকবে। শুধু আমি আর তোমার বাবা যাচ্ছি। তোমার ছোট ভাই হোস্টেলে থাকে। ওকে এদেশে একা ফেলে যাওয়া যাবে না।

অরিত্রী ম্লানমুখে তাকিয়ে বললো,

-অর্ণব ভাই তো আছেই! সমস্যা কোথায় তাহলে?

-আমি যা বলেছি, তা-ই হবে। আর কোনো কথা নয়। আজকে রাতের ফ্লাইটে আমরা চলে যাবো। তোকে জানিয়ে দিয়ে গেলাম যেন হসপিটালে চলে না যাস।

মোহনা গুরুতর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে প্রস্থান করলেন।

অরিত্রী মুখ গোমড়া করে বসে রইলো গালে হাত দিয়ে। কোনো অজানা কারণেই হয়তো বাংলাদেশ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। সে জানে না, ওখানে কী আছে! তবে তার মন বড্ড টানে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মনে বেশ ভালো একটা চিন্তা এলো। অরিত্রী সেটা ভেবেই অর্থীকে কল করলো। অর্থী কল রিসিভ করে বললো,

-কী হয়েছে? আবার কল দিলি কেন?

অরিত্রী আমতা আমতা করে বললো,

-আচ্ছা, তুমি যে বললে আমার পাসপোর্ট রেডি করে ফেলেছো তুমি! আসলেই পাসপোর্ট তোমার হাতে পেয়েছো?

-তো? তোর কি মনে হয় আমি এসব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মজা করবো? পাসপোর্ট সাথে নিয়েই তোর কাছে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তুই রাজী হবি আমার কথায়!

অরিত্রী কপট অবুঝের মতো করে বললো,

-মানে? কোন কথায় রাজি হওয়ার কথা বলছো?

অর্থী রাগী কন্ঠে বললো,

-তোর বাংলাদেশ যাওয়ার কথা বলেছি। এই সুযোগ আর তুই পাবি না, ইয়ার! হসপিটাল থেকে ডক্টরদের টিম বিডিতে যাচ্ছে। তুই যা, এটা সবাই চায়, কারণ আমাদের হসপিটালে তুই বেস্ট কার্ডিওলজিস্ট। তুই না গেলে অন্য কোনো কার্ডিওলজিস্ট যাবে। সবাই তো মুখিয়ে আছে যাওয়ার জন্য। সব ডিপার্টমেন্ট থেকেই একজন করে ডক্টর যাচ্ছে। তুই জানিস, এটা তোর ক্যারিয়ারের জন্য কতটা ইফেক্টিভ হবে? একমাসের একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে, পাশাপাশি বাংলাদেশ ঘুরে দেখা বোনাস।

অরিত্রী সবটা শুনে মনে মনে খুশিতে টইটম্বুর হয়ে গেল। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। বললো,

-হসপিটালে আসবে কখন?

-ফ্ল্যাটে ঢুকলাম এখন। ডিনার করে হসপিটালে যাবো।

-আচ্ছা, তাহলে আসার সময় পাসপোর্টটা নিয়ে এসো। আর কাল-পরশুর টিকেট ম্যানেজ করে ফেলো এন্ড আ’ম সিরিয়াস।

অর্থী হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু বলার আগেই অরিত্রী ফোন কেটে দিলো। মনে মনে হেসে নিজেই নিজেকে বললো,

-ফাইনালি!! গেট রেডি, বাংলাদেশ। ডক্টর অরিত্রী সেহরীশ ইজ কামিং।

৪৮.

সৌহার্দ্য সর্বশেষ রোগীর এপয়েন্টমেন্ট শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এখন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে একবার ঘুরে দেখে আসবে। আজকে রাতে কোনো সার্জারি না থাকায় কিছুটা নিশ্চিন্ত সে। প্রণয়-প্রণয়ীকে সময় দেওয়ার জন্য এখন সে চাতক পাখির মতো অপেক্ষার প্রহর গোনে।

সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বাইরে আসতেই প্রহরকে পার্কিং এরিয়ায় অপেক্ষারত অবস্থায় দেখতে পেল সৌহার্দ্য। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নাক-মুখ দিয়ে ফুরফুরে ধোঁয়া নির্গত করতে করতে সিগারেট টানছে প্রহর।

প্রহরের সিগারেট টানার ধরণ দেখে সৌহার্দ্যের নিজের ভেতরটাই কেমন যেন শিরশির করে ওঠে এখন। ভাবতে ভাবতেই সৌহার্দ্য এগিয়ে গেল প্রহরের কাছে।

ঝরঝরে হাসার চেষ্টা করে বললো,

-তুই হঠাৎ এখানে?

প্রহর নির্বিকার চোখে তাকালো,

-কেন? আসতে পারি না?

-সেটা বলিনি। তুই তো কখনো আসিস না! যাই হোক, বাদ দেই।

প্রহর ঈষৎ হাসার চেষ্টা করলো যেন! হাতের সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ঘষে লালাভ আলোটা নিভিয়ে দিলো। বললো,

-আমার গাড়িতেই চল!

সৌহার্দ্য বিনাবাক্যে গাড়িতে উঠে বসতেই প্রহরও ড্রাইভিং সিটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই সৌহার্দ্য বললো,

-সিগারেটটা ছেড়ে দেওয়া যায় না?

-ওটা ছাড়া জীবনে আর কিছুই বাকি নেই।

-তোর একটা বোন আছে, জীবনের অনেকগুলো দিন বাকি পড়ে আছে এখনো। সেটা একবার ভাবতে পারিস!

প্রহর ঠোঁট ভেঙে হাসলো। বললো,

-তোর ভাগ্যে যাকে পেয়েছিস, সে হারিয়ে যাওয়ার পরও তোকে বাঁচার মানেটা শিখিয়ে দিয়ে গেছে, তোর বেঁচে থাকার কারণ তোকে দিয়ে গেছে। আর আমি যাকে পেয়েছি, সে নিজে দূরে সরার সাথে সাথে আমার সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। আমরা দুজনেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম শুধু মাত্র আমাদের প্রিয় মানুষের কথা ভেবে। তারা দুজনেই হারিয়ে গেল। অথচ তুই সিগারেট আর ছুঁয়েও দেখলি না, আর আমি ওটাকেই জীবনের পরিপূরক বানিয়ে নিলাম। আমাদের পার্থক্য এখানেই। কিছু ভালোবাসা বাঁচার কারণ হয়ে থাকে সারাজীবন, আর কিছু ভালোবাসা বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ধ্বংস করে দিয়ে যায়।

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহরের কথা শুনে। ওর মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, “প্রহর, নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে! কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না।” কিন্তু বলতে গিয়ে ও নিজেই কোথাও আঁটকে যায়। কীভাবে বলবে এই কথাটা ও? বলে ফেলাটা যতটা সহজ, করাটা তার থেকে সহস্র গুণ কঠিন। সে নিজেই তো তার জীবনে তার প্রিয় মানবীর জায়গাটা কাওকে দিতে পারেনি! প্রহরকে কীভাবে এই উপদেশ দেবে সে?

সৌহার্দ্যের ভাবনার মাঝেই প্রহরের ফোন বেজে উঠলো। প্রহর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,

-অর্থী কল দিয়েছে! এই অসময়ে হঠাৎ কেন?

-চলবে….

(ভুলত্রুটি মার্জনীয়♥️)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে