Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমাপ্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৪৯+৫০

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৪৯+৫০

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪৯

ড. অরিত্রী সেহরীশ!
দরজার ওপর লেখা নামটায় নিজের আঙুল স্পর্শ করিয়ে আনমনেই হাসলো অর্ণব। নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো, পুরো ঘর বেশ অন্ধকার। জানালার মোটা পর্দা ভেদ করে ক্ষীণ আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। নিজের হাতে কপাল চাপড়ালো অর্ণব। বিরবির করে বললো,

“নাহ, এই মেয়ে শুধরাবে না!”

ঘরের দুপাশের দুটো জানালার পর্দা টেনে দিতেই পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো। শুভ্র দেয়ালে পেশাগত ডাক্তারি পোশাকের হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলো অর্ণব। ভ্রম কাটতেই সপ্রতিভ চোখে তাকালো সে। দুরন্ত পায়ে বেডের দিকে যেতে বললো,

“ঘুম থেকে কি আজ উঠবি না? বেলা কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আংকেল আর আন্টি ডেকে হয়রান হয়ে গেছে তোকে ডাকতে ডাকতে!”

বেডে থাকা ঘুমন্ত দেহটা হালকা নড়েচড়ে কম্বল মুড়ে উল্টো ঘুড়ে শুয়ে পড়লো। অর্ণব প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ কম্বল টেনে সরিয়ে বললো,

“ডিউটি আছে না তোর? পেশেন্টরা তোর জন্য ওয়েট করবে? আমারও মিটিং আছে। উট তাড়াতাড়ি!”

ঘুমন্ত মেয়েলি সুর ভেসে এলো হঠাৎ,

“কাম অন, ইয়ার! কাল সারাদিন ওটি-তে ছিলাম। আ’ম সো টায়ার্ড। আজ সারাদিন ঘুমাবো আমি!”

অর্ণব ঘড়ি দেখলো। নাহ্, আর দেরি করা যাবে না! তাহলে সে নিজেই লেইট হয়ে যাবে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

“আচ্ছা, ঘুম ভাঙলে আফনাদ আঙ্কেলের বিপিটা একটু চেক করিস। প্রেশার বেড়েছে মনে হয় ওনার! বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল, বলছিলো অরিত্রীকে ডেকে দিতে। বেশ অসুস্থ লাগছে বলছিলো আমাকে।”

অরিত্রী কম্বল সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো। অক্ষিগোলক বড় করে তাকিয়ে চকিত কন্ঠে বললো,

“হোয়াট? এটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”

উত্তর এলো না। অর্ণব মিটমিট করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অরিত্রী তড়িৎ গতিতে বিছানা ত্যাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটে এলো ডাইনিং রুমে। এলোমেলো দীর্ঘ চুলগুলো মুখে গায়ে লেপ্টে যেতেই সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করলো সে। সামনে তাকিয়ে দেখলো, মিস্টার আফনাদ হেসে হেসে মোহনার সাথে কথা বলছেন আর খাচ্ছেন। অরিত্রী ভ্রু যুগল একত্রিত করে বললো,

“বাবা, তুমি অসুস্থ?”

মিস্টার আফনাদ সামনে তাকালেন। অরিত্রীর পোশাক দেখে বুঝার বাকি নেই যে, সে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। নিশ্চয়ই অর্ণব ঘোল খাইয়ে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। মোহনা নিজের হাসি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বললেন,

“তোমার বাবা তোমাকে দেখেই সুস্থ হয়ে গেছেন। এখন ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও!”

বাবা-মাকে ওভাবে মিটমিট করে হাসতে দেখে অরিত্রী বুঝতে পারলো, অর্ণব ওকে মিথ্যে বলেছো। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে সে বললো,

“অর্ণব ভাই! বাজে লোক একটা! আমি তোমাকে ছাড়বো না।”

হসপিটাল থেকে বারবার কল আসছে। অরিত্রী কুর্তির ওপর এপ্রোন পরে কল রিসিভ করলো,

“ম্যাম, দেয়ার ইজ এন এমারজেন্সি! আ পার্সন ইজ ভেরি ব্যাডলি ইনজিওর্ড।”

“আ’ম কামিং উইথিন টেন মিনিট’স!”

অরিত্রী ফোন রেখে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসতেই বললো,

“আঙ্কেল, একটু ফাস্ট ড্রাইভ করবেন, ওকে?”

“কীভাবে ফাস্ট ড্রাইভ করবো, ম্যাডাম? কালকে সারারাত স্নোফল হয়েছে, আর কানাডার স্নোফল নিয়ে তো তোমার এতো বছরে বেশ ভালো আইডিয়া হয়ে গেছে আই হোপ‌!”

মেয়েলি কন্ঠ শুনে অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। খুশিতে ঝাপিয়ে পড়লো মেয়েটির ওপর,

“অর্থী আপি!! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুমি আসবে আমাকে আগে বলোনি কেন?”

অর্থীও অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী গলায় বললো,

“বলে দিলে তোর এই খুশিটা দেখতাম কীভাবে, হুম?”

“এজন্যই কয়েকদিন তোমাকে অনলাইনে পাচ্ছিলাম না। খুব রাগ হচ্ছিল! আমি ভাবছিলাম, তুমি বাংলাদেশ গিয়ে আমাকে ভুলে গেছো।”

অর্থী হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বললো,

“তোকে তো ভুলতে পারি না! কিন্তু বিডিতে গেলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়, ইয়ার। ভাইয়াকে দেখলেই চোখে পানি চলে আসে আমার। একটা এক্সিডেন্ট আমার হাসিখুশি ভাইটাকে কী বানিয়ে দিলো! এখন তো সে কথাও বলে না কারো সাথে ঠিক মতো।”

অরিত্রীর মন খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মুখে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,

“ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে অনেক কষ্ট হয়, আপি। মনে হয় যেন ভেতর থেকে প্রাণটাই বেরিয়ে এলো!”

অর্থী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাসলো। বললো,

“তোর কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই এসবে বেশ এক্সপেরিয়েন্সড!”

অরিত্রী মলিন মুখে হাসলো। আনমনে বললো,

“এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে তো জানি না! বাট কেন যেন মনে হয় বাবা-মা যা বলে, সেসব বাদেও আমার জীবনে আরো কিছু আছে। সাত বছর আগে সব অচেনা হয়ে গেলেও কিছু কিছু জিনিস আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। এই দেশটা আমার কাছে বড্ড অচেনা লাগে, জানো? কোনো আকর্ষণ কাজ করে না আমার মধ্যে। বাবা-মা ছাড়াও আমার কাছের কেউ ছিল। হয়ত এখনও আছে! মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে অনেক কিছু আমার সামনে ভেসে ওঠে, যেগুলো নিছকই স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। কিন্তু আমি আসলে কিছুই মিলিয়ে উঠতে পারি না!”

“আমার মনে হয়, তোর একবার বাংলাদেশে যাওয়া উচিত। হয়তো এতে তোর সাথে পজিটিভ কিছু ঘটতে পারে।”

অরিত্রী হতাশ গলায় বললো,

“কোনো লাভ নেই! আমি নাকি ছোটবেলা থেকেই এখানে বড় হয়েছি। বিডি-এর সাথে আমার কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না! তাছাড়া মা আর অর্ণব ভাই আমাকে যেতে দিবে না কখনো।”

অর্থী ক্ষীণ বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বললো,

“সবার কথা ছাড়! তোর যাওয়ার ইচ্ছে নেই, সেটা বল।”

অরিত্রী বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো নীরব মুখে। এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না একটুও। ভাবলেই ভয়ে, আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে যায় একদম!

মিস্টার আফনাদ বারান্দায় বইয়ে চোখ রেখে বসে আছেন। কিন্তু তার মনযোগ বইয়ে নেই। একটু অবসর পেলেই পুরনো অপরাধবোধ যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি কি ঠিক করেছেন? অরিত্রীর হাসি মুখটা দেখলে মনে হয়, মেয়ের সুন্দর জীবনের জন্য তিনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। সেদিন মোহনার কথা না শুনলে আজ অরিত্রী একজন সফল ডক্টর হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতো না। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মনে হয়, তিনি প্রতারণা করেছেন। সৌহার্দ্যকে ঠকিয়ে সদ্যোজাত দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে মাতৃহীন করেছেন। সেদিন মোহনার সাথে ওনার কথোপকথন ও কার্যকলাপ এখনো চোখে ভাসে তাঁর!

~সাত বছর আগে~

“আফনাদ সাহেব, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি! আমার মেয়ের জীবনে আমি আর কারো কালো ছায়া পড়তে দেব না। ওকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের এই দেশ ছাড়তে হবে।”

মিস্টার আফনাদ চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। মোহনার মুখে এমন কথা শুনে তিনি অবাক চোখে চাইলেন,

“মাথা ঠিক আছে তোমার? মেয়েটা জীবন-মৃত্যুর মধ্যে বসে আছে, আর তুমি….. পাগলামি করো না এসব নিয়ে আর!”

মোহনা চোখ মুছলেন। আজ তরীর এই অবস্থার জন্য তিনিই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। সেদিন যদি জোর করে তরীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে না লাগতেন, তাহলে আজ তরীর সাথে সৌহার্দ্যের বিয়ে হতো না। এগে তরীর জীবনও এমন বিপর্যয়ে পড়তো না! ভেবেই তিনি বিরস মুখে বললেন,

“আমার কারণেই আজ মেয়েটার এই অবস্থা। ওর জীবনে এতো দুঃখের জন্য আমিই তো দায়ী। আমার জন্য ওর বিয়ে সৌহার্দ্যের সাথে হলো, আর…. ”

অর্ণব ওনার কথার মাঝে দাড়ি টেনে দিয়ে বললো,

“আরেহ্ বিয়ে তো ভাগ্যের ব্যাপার! এটা নিয়ে নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন? তবে বিয়ের আগে ওর জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো।”

মোহনা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,

“আমার জন্য ওর কপালে কোনো সুখ জুটলো না। জন্ম দেইনি বলে ওর মা হতে পারিনি আমি। কিন্তু আর না! আমার করা ভুল আমি শুধরে নেবই। ওর জীবনে আমি আর দুঃখের ছায়া পড়তে দেব না। অর্ণব তুই সব ব্যবস্থা কর। আমরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো।”

আফনাদ আর অর্ণব দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। অর্ণব অবাক কন্ঠে বললো,

“তরীর এই অবস্থায় কীভাবে যাবো আমরা? আর সৌহার্দ্য মানবে না কোনোদিন! ওদের দুটো বাচ্চা আছে, আন্টি!”

“তরীর চিকিৎসা বিদেশে করার ব্যবস্থা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা সবাই জেনে গেছে, তাই ওখানে যাওয়া যাবে না। আমার এক বান্ধবী কানাডায় সেটেল্ড। আমরা সেখানে যাবো। আর সৌহার্দ্য বা অন্য কাউকে কিছু জানানো যাবে না। সবটাই লুকিয়ে করতে হবে।”

মিস্টার আফনাদ তেতে উঠে বললেন,

“পাগল হয়েছো? তুমি যেমন তরীর মা, তেমনি তরীও দুটো সদ্যোজাত বাচ্চার মা। ওদের থেকে তরীকে আলাদা করতে কীভাবে চাইছো তুমি?”

মোহনা কারো কথা কামে নিলেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অর্ণবকে সবটা করতে বাধ্য করলেন। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে রাতের প্রাইভেট ফ্লাইটে কানাডা পাড়ি জমালেন তারা।

প্রায় মাসখানেক পর তরী কোমা থেকে বেরিয়ে এলো। চোখ খুলতেই নিজেকে নিজেই চিনতে পারলো না সে। সে এরকম কীভাবে হলো? তার বয়স তো মাত্র সাত বছর হওয়ার কথা ছিল! তার মা কোথায়? মাকে কি সত্যি সত্যিই মেরে ফেলেছে? নাকি ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল? তরীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ডক্টর ক্লারা বললেন,

“উনি কি এর আগে কখনো কোনো এক্সিডেন্ট বা বাজেভাবে আহত হয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, অনেক ছোট ছিল তখন ও। ওর মায়ের মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছিল। এরপর ওর বাবা ওকে…..”

মিস্টার আফনাদ সবটা খুলে বলতেই ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। বললেন,

“আসলে এরকম কেইস অনেক রেয়ার। কিন্তু এটাই আপনাদের পেশেন্টের সাথে ঘটেছে। ওর সাত বছর বয়সের এক্সিডেন্টের পরবর্তী সময় থেকে রিসেন্ট এক্সিডেন্ট পর্যন্ত সময়টা ওর মেমোরি থেকে হারিয়ে গেছে। ওর এখন শুধু মনে আছে সেই এক্সিডেন্টের আগের সময়টুকু। খুবই ক্রিটিক্যাল স্টেজে আছে মেয়েটা। আপনারা সবাই ওর কাছে অচেনা।”

অর্ণব আর মিস্টার আফনাদ নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। মোহনার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“এক্সিডেন্ট দুটোর মধ্যবর্তী সময়ের স্মৃতি কি ওর আর কখনো মনে পড়বে না?”

“পড়বে। হিস্ট্রি রিপিট’স ইটসেল্ফ! যদি কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, পুরনো জায়গা ও মানুষগুলো ওর চোখে ধরা দেয়, তাহলে ধীরে ধীরে তরীর সবটা মনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

মোহনা সিদ্ধান্ত নিলেন, তরীকে তার আগের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলবেন। একটা নতুন জীবনের সাথে পরিচয় করাবেন, যার প্রতিটি প্রভাত হবে ভালোবাসায়। সারাজীবন যতটা ভালোবাসার ঘাটতি তরী অনুভব করেছে, তার সবটা পুষিয়ে দিতে হবে তাকে।

দুর্বলতার খোলসে আবৃত কঠিন সত্তার সেই তরী নামটা চিরতরে হারিয়ে গেল সেদিনই! কোমল, মিষ্টি ও প্রাণবন্ত অরিত্রীকে নিজের হাতে গড়ে নিলেন মোহনা। নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একবারও পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ দিলেন না ওকে।

বর্তমানে অরিত্রী একজন সফল কার্ডিওলজিস্ট। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হলেও কেন যেন মনে হয় এর জন্য বেশ বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। সৌহার্দ্য, মধু, দাদী, রায়হান, সুজাতাকে সে ভোলেনি। নিজের বাবার করা সেই নিষ্ঠুরতাও মনে আছে। কিন্তু সবটা সে এখন ভুলে থাকতে চায়। তবুও মনে একটা প্রশ্ন জাগে! সাত বছর বয়সের সেই এক্সিডেন্টের পর তারা কানাডায় চলে এলে এই দেশ তার কাছে এতো অচেনা লাগে কেন? তার মা-বাবা কি মিথ্যে বলছে নাকি এটা তার মনের ভুল? হয়তো সে-ই ভুল ভাবছে!

*
সৌহার্দ্য বেশ তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে ঢুকছে। একটা সার্জারি আছে আজকে। কিন্তু প্রণয়-প্রণয়ীকে স্কুলে দিয়ে আসতে গিয়ে জ্যামের কারণে লেইট হয়ে গেছে। চেম্বার থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো সে। হাতে গ্লাভস পরতে পরতে হাঁটার সময় সিনিয়র ডক্টরের সাথে ধাক্কা লাগলো। ডক্টর হেসে বললেন,

“বি কেয়ারফুল, মাই বয়! এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?”

“স্যার, অপারেশন ছিল একটা। তাই….”

“সেটা আরো আধাঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছি। অন্য একটা ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে হঠাৎ!”

“আচ্ছা? এটা তো আমাকে কেউ জানায়নি!”

“তুমি এলে আমিই জানাবো ভাবলাম। তোমার কিউট বাচ্চা দুটো কেমন আছে?”

সৌহার্দ্য মলিন হেসে বললো,

“বুঝে উঠতে পারি না, স্যার! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ভালোবাসা ওদের জন্য যথেষ্ট না।”

“মায়ের অভাব পূরণ করা কি এতো সহজ? তুমি সেকেন্ড ম্যারেজ করছো না কেন? আই হাইলি রেকমেন্ড ইউ টু ম্যারি এগেইন!”

সৌহার্দ্য ম্লান কন্ঠে বললো,

“আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন, স্যার?”

ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “আমার স্ত্রী আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি বোধহয় ততটা ভালোবাসি না।”

সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“কখনো ভালোবাসবেনও না। ভালোবাসা একটা ভুল, যা আমি করে ফেলেছি। হয়তো সারাজীবন এই ভুলের মাশুল গুনতে হবে আমায়।”

সৌহার্দ্য সামনের দিকে চলে গেল। ডক্টর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এতো বছরের জীবনে ভালোবাসার চেয়ে রহস্যময় জিনিস আর দ্বিতীয়টা দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। সৌহার্দ্য তারই ছাত্র ছিল। কিন্তু সৌহার্দ্যকে আজ নিজের থেকে বেশি অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। হয়তো ও জীবনবোধ বেশি করে অনুভব করেছে বলেই!

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫০ (অংশ-০১)

প্রণয়ী স্কুলের মাঠে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার পাশেই প্রণয় ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। তার দৃষ্টি খোলা আকাশে নিবদ্ধ। সাদা ড্রেসে ধুলোবালি লেগে বাদামি বর্ণধারণ করেছে। প্রণয়ী ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। বিরস মুখে বললো,

“আজকে মাদার্স ডে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম!”

প্রণয় ভ্রু-যুগল একত্রিত করে ফেললো। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বললো,

“তোর মনে থাকেটা কী? এখানে থাকতে বিরক্ত লাগছে আমার। আগে জানলে এই দিনে স্কুলেই আসতাম না!”

“মা ছাড়া জীবন অনেক কষ্টের! তাই না, ভাই? আমাদের মা থাকলে অনেক ভালো হতো!”

প্রণয়ীর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো প্রণয়। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,

“গাধী! পাপার সামনে এই কথা মুখেও আনবি না। পাপা যদি মন খারাপ করে, তখন?”

প্রণয়ী হালকা হেসে বললো, “আচ্ছা, বলবো না!”

কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলে প্রণয়-প্রণয়ী গাড়িতে উঠে বসলো। প্রণয় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,

“পাপা কেন আসেনি?”

“স্যার ব্যস্ত ছিলেন! সার্জারী ছিল শুনলাম।”

প্রণয় গাল ফুলিয়ে বললো, “আচ্ছা!”

অরিত্রী সবেমাত্র পেশেন্ট দেখা শেষ করেছে। আজকের মতো তার ডিউটি শেষ। সন্ধ্যার আগেই আজ বাসায় চলে যাবে ভেবে খুশিমনে কফিটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। এপ্রোনটা খুলতে যাবে এমনসময় নার্স ছুটে এসে জানালো,

“ম্যাম, ইট’স ইমার্জেন্সি। প্লিজ কাম উইথ মি!”

অরিত্রী এপ্রোনটা আর খুললো না। অগত্যা নার্সের সাথে ছুট লাগালো ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। নার্স তাকে একটা কেবিনে নিয়ে গেল। আগে থেকেই বেশ কয়েকজন ডক্টর সেখানে ছিল। তাদের সাথে ডক্টর ক্লারাও ছিল। তিনি অরিত্রীকে দেখে বললো,

“কাম, ডিয়ার! এই পেশেন্টটা তোমার জন্য নতুন। নতুন এক্সপেরিয়েন্স হবে তোমার। এজন্য তোমায় ডেকে আনতে বলেছি।”

ডক্টর ক্লারার মুখে স্পষ্ট বাংলা কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিল অরিত্রী। পরে জানতে পেরেছিল, ওনার মা বাঙালি ছিলেন। এজন্য তার বাঙালিদের প্রতি অদ্ভুত টানও আছে। ওনার সাহায্য ছাড়া অরিত্রী হয়তো এতো ভালোভাবে নিজের জীবনটাকে এগিয়ে নিতে পারতো না। তার ডাক্তার হওয়ার পেছনে ডক্টর ক্লারার অনেক অবদান।

অরিত্রী এগিয়ে এসে ডক্টর ক্লারার পাশে দাঁড়ালো। সামনে পেশেন্টের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে। মেয়েটার মুখের অর্ধাংশ পুড়ে ঝলসে গেছে একদম। অরিত্রী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। ডক্টর ক্লারার হাত খামচে ধরে বললো,

“ম্যাম, ওর এই অবস্থা কেন? কীভাবে হলো?”

“মেয়েটা স্টুডেন্ট। কেমিস্ট্রি ল্যাবে কাজ করার সময় দুর্ঘটনাবশত ওর মুখে…. এখন এসব কথার সময় না। লেট’স স্টার্ট আওয়ার ট্রিটমেন্ট!”

ডক্টর ক্লারার কথা শুনে অরিত্রী চোখ খুলে তাকালো। সবাই ইতোমধ্যে নিজ নিজ কাজ শুরু করে দিয়েছে। অরিত্রী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ঘনঘন পলক ফেললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক দুর্বিষহ রাতের অস্পষ্ট দৃশ্যপট। অরিত্রী আবছা আবছা মনে করতে পারলো, কেউ একজন তার দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলছে। কিন্তু পাশ থেকে আরেকজন এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেললো, আর তাৎক্ষণিক কারো তীক্ষ্ণ আর্তনাদ অরিত্রীর কর্ণকুহরে বাজতে লাগলো৷

অরিত্রী মাথার চুল খামচে ধরে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। গা থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে ওর। চোখ দুটো নিভে আসতে চাইছে। অকস্মাৎ দেহটা হেলে পড়তেই অর্থী এসে ওকে আগলে ধরে নিলো। চিৎকার করে বললো,

“ম্যাম! অরিত্রী সেন্সলেস হয়ে গেছে।”

ডক্টর ক্লারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারলেন না। শুধু গলা উচিয়ে বললেন,

“ড. অর্থী, ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।”

অর্থী আর নার্স মিলে অরিত্রীকে একটা বেডে নিয়ে শুইয়ে দিলো৷ অর্থী তাড়াতাড়ি অর্ণব কল দিলো। বললো,

“অর্ণব, তাড়াতাড়ি হসপিটালে আয়! অরিত্রী অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

অর্ণব হতভম্ব হয়ে বললো,

“হোয়াট? কীভাবে? আচ্ছা, আমি এখুনি আসছি!”

ডক্টর ক্লারা অরিত্রীকে চেকআপ করে বললেন,

“ব্রেইনে অতিরিক্ত প্রেশার দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! ওর খেয়াল রেখো, ড. অর্থী। সেন্স আসতে বেশ সময় লাগবে।”

ডক্টর ক্লারার কথার মাঝে অর্ণব ভেতরে প্রবেশ করলো। অর্ণবকে দেখে তিনি কিছুটা অপ্রসন্ন মুখে বেরিয়ে গেলেন। অর্থী বিষয়টা খেয়াল করলো। মনে একটু সন্দেহ জাগলেও প্রকাশ করলো না। অর্ণব অর্থীর সামনে এসে অরিত্রীর দিকে একবার তাকালো। চিন্তিত মুখে বললো,

“ও ঠিক আছে? কী হয়েছিল?”

“খুব চিন্তা হচ্ছে?”

অর্থীর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। অর্ণব সেটা দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,

“এখন অন্তত এসব ঢং বাদ দিতে পারিস? মেয়েটা অসুস্থ, তাই চিন্তা হচ্ছে!”

অর্থী নিজের মুখে কৃত্রিম অবাকতা ফুটিয়ে বললো,

“আচ্ছা? তুই যে ওকে নিয়ে এতো চিন্তা করিস, সেটার কোনো পরোয়া ও করে না। তোর এতো ভালোবাসার কথা তো অরিত্রী জানে না!”

“আগে জানতো! বুঝতো ও। কিন্তু এখন তো আমিই বুঝতে দেই না!”

অর্ণবের কথায় অর্থী মলিন হেসে বললো,

“ভালোবাসা অনেক অদ্ভুত জিনিস। মানুষের মাথা থেকে মুছে গেলেও মন থেকে সরে যায় না। অরিত্রীও সৌহার্দ্যকে কোনোদিন ভুলবে না। ওর মনে এই মানুষটা বেঁচে থাকবে সারাজীবন। তোরা যতই ওদের দূরে সরিয়ে রাখতে চাস না কেন!”

অর্ণব ক্রোধান্বিত চোখে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“সৌহার্দ্যের নাম তুই ওর সামনে উচ্চারণও করবি না। আমি চাই না তোর সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট করতে। এতো বছর চুপ করে ছিলি, এখনো মুখটা বন্ধ রাখ।”

অর্থী ঈষৎ হেসে বললো,

“আমি তো কিছু বলবো না! কিন্তু সত্যটা আর কতো বছর চেপে রাখবি? আজ অরিত্রী এসিড ভিক্টিম এক মেয়েকে দেখে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কেন, জানিস? ওর মস্তিষ্কে মধুর কথা নাড়া দিয়েছে। একদিন না একদিন ও সবটা জানতে পারবেই! সেদিন ও তোর আর মোহনা আন্টির কোনো পরোয়া করবে না।”

অর্ণব বিরক্ত হয়ে বললো,

“তোর ঘ্যানঘ্যান শোনার চেয়েও অনেক দরকারি কাজ আছে আমার। অরিত্রীর জ্ঞান ফিরলে আমায় জানাস। আমি বাইরে গেলাম।”

অর্ণব অর্থীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অর্থী ওর যাওয়ার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। এতো বছর ও যতবার দেশে গেছে, নিজের চোখে দেখে এসেছে, সৌহার্দ্য কতটা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে দুটো বাচ্চা সামলেছে! তবুও ও চুপ ছিল। কারণ ও অরিত্রীর ডক্টর হওয়ার পথে কোনো বাঁধা দিতে চায়নি। কিন্তু এখন আর কোনো কারণ নেই সময় নষ্ট করার। ঐ নিষ্পাপ দুটো বাচ্চার জন্য হলেও ওকে কিছু একটা করতে হবে! সবার আগে ডক্টর ক্লারার সাথে কথা বলতে হবে। অর্ণবকে দেখে ওনার মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট ছিল। এর পেছনে কারণ কী?

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কিন্তু ঘরে এখনো আলো জ্বলেনি। প্রহর নিজের হাতে কফি বানিয়ে ঘরের সামনে এলে। দরজা ঠেলে খুলতেই শব্দতরঙ্গের কারণে নীরবতায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইতি ঘটলো। প্রহর ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে নিলে ফোনকলে পা থেমে গেল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, অর্থী কল করেছে। রিসিভ করে বললো,

“একটু ব্যস্ত আছি।”

ওপাশ থেকে অর্থীর ব্যস্ত কন্ঠ ভেসে এলো,

“আমার তো তোমার সাথে অনেক দরকারি কথা ছিল, ভাইয়া!”

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো, “এখনই বলতে হবে?”

“তুমি ফ্রী হয়ে আমাকে একটু কল দিও। তোমার হেল্প লাগবে আমার, প্লিজ।”

“আচ্ছা, আমি কল ব্যাক করবো তোকে।”

অর্থী ফোন কেটে দিলো। সে জানে, প্রহর এখন কোথায় আছে! তাই ওকে বিরক্ত করলো না।

প্রহর কফির মগ দুটো বেডসাইড টেবিলে রাখলো। অন্ধকারে বাহির থেকে আসা অস্পষ্ট আলো কফি মগ থেকে ওঠা ধোঁয়াগুলো চোখে পড়ছে বেশ। প্রহর সুইচের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বালাতে যাবে, এমনসময় মেয়েলি সুর ভেসে এলো,

“আলো জ্বালিও না। অন্ধকারেই শান্তি পাই আমি!”

প্রহর ক্ষীণ তেজদীপ্ত কন্ঠে বললো,

“তোমায় দেখতে এসেছি। আলো ছাড়া দেখবো কী করে? দেখতে না দিলে তোমায় স্পর্শ করতে চাই। একবার তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার অনুমতি দেবে আমায়, মধু?”

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৫০ (অংশ-২)

প্রহর আলো জ্বালালো না। অন্ধকারেও বাহির থেকে আসা আবছা আলোয় সবকিছুর অবয়ব স্পষ্ট। সে দৃপ্ত পায়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেল বিছানায় হেলান দিয়ে বসা মানবীটির দিকে। ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতার মাঝে শুধু নিঃশ্বাসের ঘনতর শব্দ প্রবাহ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

প্রহর বিছানার প্রান্তভাগে বসলো। মধুর হাতের ওপর হাত রাখতে সেকেন্ড পেরোনোর আগেই মধু একটানে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি জুড়ে কাঠিন্য ভর করলো ওর। প্রহর ম্লান মুখে তাকালো মধুর অবয়বের দিকে। বললো,

“কষ্ট দিয়ে কি খুব ভালো লাগে তোমার? তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?”

মধুর কান্না পেল। চোখ ছাপিয়ে অশ্রু বেরিয়ে এলো। সে কীভাবে প্রকাশ করবে নিজের অসহায়ত্ব? প্রহর কেন বুঝতে চায় না? নীরব কান্নার মাঝে হঠাৎই হেঁচকি উঠে গেল মধুর। প্রহর বুঝতে পারলো, মধু কাঁদছে। মধুর গালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই মধু ওর হাত সরিয়ে দিলো। প্রহর বিরস মুখে হেসে বললো,

“তোমার চোখের প্রতিটা অশ্রুকণা সাক্ষী দিচ্ছে, তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো!”

“আমার জীবনের একমাত্র আফসোস এটাই যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

প্রহর এবার দূরত্ব ঘোচালো। অকস্মাৎ মধুকে নিজের বুকের মাঝে আগলে নিলো। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটলো যে, মধু দূরে সরার কথা ভাবার সুযোগও পেল না। মধুর চুলে অগুণিত বার ওষ্ঠ স্পর্শ করিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে। নির্মল কন্ঠে বললো,

“যা ঘটে গেছে, সেটাকে তো আর বদলানো যাবে না! কিন্তু সামনের দিনগুলো তো আমার সুন্দর করে কাটাতে পারি, তাই না?”

মধু লেপ্টে রইলো প্রহরের বুকে। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাছাকাছি থেকে নিজের মনের তৃষ্ণা কিছুটা তো মিটে যাবে অন্তত! বারবার দূরে ঠেলে দেওয়ার নিয়ম টই মুহুর্তে একটু ভঙ্গ হলে খুব একটা ক্ষতি তো হবে না! ভেবেই মধু অবসন্ন কন্ঠে বললো,

“কী বলতে চাইছো?”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মধুর মাথায় আরেকবার চুমু এঁকে বললো,

“যা হয়েছে, ভুলে যাও!”

মধু ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অবাধ্য জলগুলো ঝরে পড়তেই মধু প্রহরকে ঝাপটে ধরে বলতে লাগলো,

“আমি কীভাবে ভুলবো, প্রহর? ভুলতে চাইলেও আমি ভুলতে পারি না। আমার জীবনের সাথে সবটা এমন ভাবে জুড়ে গেছে, আমি চাইলেও সেটা মুছে ফেলতে পারবো না। আয়নায় তাকালে নিজেকে দেখেই আঁতকে উঠি আমি। আমার চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে, এক চোখের দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে গেছে। কীভাবে আমার সামনের দিনগুলো সুন্দর করবো বলো? আমাকে যে বাকি জীবনটা ঘরবন্দী হয়ে কাটাতে হবে! লোকে আমায় দেখলে কী বলবে? আমি কীভাবে গিয়ে দাঁড়াবো মানুষের মাঝে?”

“তুমি যেমন ছিলে, ঠিক তেমনভাবেই দাঁড়াবে সবার মাঝে। আমি তো আমার সেই মধুকে দেখতে চাই, যে কারো পরোয়া করতো না। আজ তার মুখে যা শুনছি, সেগুলো বড্ড বেমানান ঠেকছে।”

“পরিস্থিতি সবটা বদলে দিয়েছে, প্রহর। মধু তো সেদিনই মরে গেছে, যেদিন ওর লোকের সামনে দাঁড়ানোর সব যোগ্যতা হারিয়ে গেছে। এখন আমি বেঁচে আছি শুধুমাত্র শ্বাস-প্রঃশ্বাসের জন্য, প্রাণহীন, নির্জীব হয়ে।”

প্রহর হতাশার সুরে বললো,

“তাহলে কি আমার কোনো মূল্য নেই তোমার জীবনে?”

“আমার জীবন তো শেষই হয়ে গেছে! তোমার জীবনে এখন আমার কোনো অস্তিত্ব থাকাই উচিত না। কেন এখনো আমার জন্য নিজের জীবনটাকে থামিয়ে রেখেছো? আমি তো কোনোভাবেই তোমার জীবনের পরিপূরক হতে পারবো না! আমার সেই যোগ্যতা নেই।”

প্রহর আলিঙ্গনের প্রখরতা বাড়িয়ে বললো,

“তুমি আমার বউ, আমার সহধর্মিণী। আমাদের দুজনের জীবন তো অনেক আগেই এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে! তোমার হয়তো আমায় প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন।”

“তাহলে আমার একটা কথা রাখবে?”

“বলো!”

“আমি একবার বাবা-মা আর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই।”

প্রহরের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। কন্ঠে দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে বললো,

“আমি কাউকে জানতে দেবো না যে, তুমি বেঁচে আছো। তুমি আমার সাথে থাকবে শুধুমাত্র আমার হয়ে! আর কারো ছায়াও আমি পড়তে দেবো না তোমার জীবনে।”

প্রহরের কঠোর গলায় বলা কথাগুলো শুনে মধু ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। বললো,

“চলে যাও তুমি! কখনো আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তুমি আমায় এভাবে আড়াল করে রেখেছো। এর জন্য তুমি কারো কাছ থেকে ক্ষমা পাবে না, প্রহর! তোমার আর আমার দূরত্ব কখনো মিটবে না।”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

“কিন্তু আমি দূর থেকেই ভালোবাসবো, আজীবন ভালোবাসবো।”

অরিত্রীর জ্ঞান ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। অর্থী ওর পাশে এসে বসলো। কাঁধে হাত রেখে বললো,

“এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছিস?”

অরিত্রী চোখ তুলে তাকালো। আনমনে বললো,

“একজন আমার গায়ে এসিড মেরেছিল, কিন্তু একটা মেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় ওর মুখের ওপর এসিড পড়েছিল। এরকম একটা ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল। এটা কবে ঘটেছে? তুমি কি জানো?”

অর্থীর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। সে চকিত চোখে তাকিয়ে বললো,

“এগুলো তোকে কে বললো?”

“কেউ বলেনি। কিন্তু আমার কিছুটা মনে পড়েছে। তুমি কি জানো এর আগে-পরে কী হয়েছিল?”

অর্থী সচেতন চোখে বাইরের দেখা তাকালো। সপ্রতিভ কন্ঠে বললো,

“তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি তোকে দিবো। কিন্তু এখন না। অর্ণব আশেপাশেই কোথাও আছে। তোর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে, অরিত্রী! তুই সেগুলো পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে এসেছিস, তোর লক্ষ্যে পৌঁছেছিস। কিন্তু এবার তোকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। তোর জন্য যে অনেক প্রিয়জনেরা অপেক্ষায় আছে!”

অরিত্রী অবুঝ মুখে বললো,

“মানে? আমি তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছি না!”

“বোঝাবো তোকে! তুই শুধু….. ”

“কী বোঝাবি তুই?”

অর্ণবের গলা শুনে দুজনেই কিছুটা চমকে উঠলো। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো, অর্ণব ওদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। অর্থী হাসার চেষ্টা করে বললো,

“তেমন কিছু না। আমি তো ওকে এমনিতেই বলছিলাম! ওর মাথায় একটু পেইন হচ্ছে। তাই বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে, সেন্সলেস হওয়ার পর এরকম একটু-আধটু পেইন হওয়াটা নরমাল।”

অর্ণবের কথাটা বিশ্বাস হলো না তেমন একটা! তবুও কিছু বললো। অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“চল, তোর মেডিসিন গুলো নিয়ে নিয়েছি। এখন বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিলেই শান্তি লাগবে দেখিস!”

অর্থী অরিত্রীকে ধরে নিয়ে গেল গাড়ি পর্যন্ত। ওদের বিদায় করে দিয়ে অর্থী ডক্টর ক্লারার কাছে গেল। ওনার কেবিনে নক করে বললো,

“ম্যাম, মে আই কাম ইন?”

ডক্টর ক্লারা হেসে বললেন,

“ইয়েস, এসো। অরিত্রী চলে গেছে।”

“ইয়েস ম্যাম! আমি এখন ওর ব্যাপারে কথা বলার জন্যই আপনার কাছে এসেছি। বিগত সাতটা বছর অরিত্রী আপনার আন্ডারে, আপনার খুব কাছাকাছি ছিল। তাই আপনার থেকে বেশি আর কেউ আমাকে হেল্প করতে পারবে না।”

ডক্টর ক্লারা বিস্ময় নিয়ে বললেন,

“হেল্প? কিসের হেল্প?”

“ম্যাম, আমি চাই অরিত্রীর যেসব স্মৃতি হারিয়ে গেছে, সেসব আবার ফিরে আসুক।”

“সেটা তো আমিও চাই! কিন্তু ওর মা মিসেস মোহনা আর কাজিন মিস্টার অর্ণব আমার কথা মানতে নারাজ। তাদেরকে আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যেন বিডিতে অরিত্রীকে নিয়ে যায়। ওখানে গেলে ওর জন্য ব্যাপারটা পজিটিভ হবে।”

অর্থী চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“তার মানে অর্ণব আর মোহনা আন্টি জেনে বুঝে সবটা করছেন?”

“হ্যা, অতিরিক্ত ইমোশনাল হয়ে ওনারা অরিত্রীর-ই ক্ষতি করছেন। কিন্তু এটা তারা বুঝতে চাইছেন না।”

“আচ্ছা, তাহলে আমরা যদি অরিত্রীকে ওর জীবনে ঘটা সবকিছু বলে দেই, এতে তো কোনো সমস্যা হবে না, তাই না?”

“হবে। অলরেডি সাত বছর চলে গেছে। এখন আমরা হুট করে ওকে সবটা মনে করানোর জন্য প্রেশারাইজ করতে পারবো না। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার চান্স বেশি। এক মাত্র উপায় হলো ওকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া। ওখানে গেলে ও চেনাজানা পরিবেশে নিজে থেকেই সবটা মনে করার চেষ্টা করবে।”

অর্থী হতাশ হলো। অরিত্রীকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব না। মোহনা আর অর্ণব এমনটা কোনো দিন ঘটতে দেবে না। ব্যর্থ মনে অর্থী বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।

কারাগারের ছোট্ট একটা কোণে হাঁটুর ভাঁজে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে অরুণী। পরনে সাদা ধুলোবালি মিশ্রিত শাড়ির একপ্রান্ত মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। আজ সাত বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে অরুণী সূর্যের আলোও দেখে না। তার তো বেঁচে থাকার ইচ্ছে-ই মরে গেছে। আরমান আহমেদের লা*শের পাশে দাড়িয়ে সে নিজে আত্মসমর্পণ করেছিল। তার জীবনটা আজ কতই না সুন্দর হতে পারতো! কিন্তু একজনের খেলার গুটি হয়ে সেই সুন্দর জীবনটার এক বড় অংশ সে কারাগারেই কাটিয়ে দিলো। আর কয়েকটা মাস পরেই তার কারাদণ্ড শেষ হবে। অথচ নিজের মনে এখন এই জেলখানা থেকে বের হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে খুজে পাচ্ছে না অরুণী।

“পাপের তুলনায় শাস্তির বোঝাটা বড্ড কম হয়ে গেল। তবুও আত্মশুদ্ধি তো হলো! কী বলো, ড. অরুণী?”

-চলবে…..

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ