#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৫
“সৌহার্দ্যকে এনে দাও, বাবা! ওকে ছাড়তে পারবো না আমি। সৌহার্দ্যকে এনে দাও!!!”
অরুণীর অস্বাভাবিক আচরণ বেশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করছেন আরমান সাহেব। মেয়ের এমন আচরণ-ই তার প্রত্যাশিত। মনে মনে ক্রূর হেসে তিনি ভাবলেন,
“তোমাকে তো এমন এগ্রেসিভ রূপেই দেখতে চেয়েছিলাম আমি, অরুণী। আমার দীর্ঘায়ুর জন্য হলেও তোমায় গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে হলো আমায়। বাট আই ডোন্ট হ্যাভ এনি রিগ্রেট ফর দিস।”
আরমান সাহেব স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে আছেন অরুণীর দিকে। কিন্তু অরুণীর চোখ দুটো র*ক্তি*ম বর্ণ ধারণ করেছে। থেমে থেমে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। চোখের কোণে জমে থাকা নোনাজল গুলো কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে মুছে সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে এমন কেন বানিয়ে দিলে, বাবা? তুমি… তুমি আমার শরীরে কীসের ইনজেকশন পুশ করেছো এতো দিন? তুমি নাকি আমাকে ড্রা*গ*স দিতে? এটা কি সত্যি?”
আরমান সাহেব অরুণীর দিকে বি*স্ফো*রিত চোখে তাকালেন। তড়িৎ গতিতে নড়েচড়ে বসে বললেন,
“এসব কী বলছো তুমি, অরুণী? আমি তোমার সাথে এমনটা কীভাবে করবো? আমি তোমার বাবা! বাবারা কখনো পারে নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে?”
অরুণী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“সেটা তো আমার ভাবনাও ছিল, বাবা! একজন বাবা কীভাবে তার মেয়ের সাথে এমনটা করতে পারে? আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, জানো? স্যারের মুখে এমন কথা শুনে আমি ওনার সাথে প্রচুর খারাপ আচরণ করে এসেছি। স্যার কয়েকটা টেস্ট দিয়ে বললেন, নিশ্চিত হয়ে নিতে। আজকে আমি জানতে পেরেছি যে, উনি ঠিকই ছিলেন। ভুল তো আমি ছিলাম! তোমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। আর অন্য দিকে, আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তুমিই করলে!”
আরমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কী বলা উচিত, সেটা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি এই মুহুর্তে। অরুণী ওনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তোমার এমন কাজের পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে, আমি জানি না। তবে তোমার এই কাজের জন্য আমার জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি আমি। এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না আমি। আজ বিকেলে যখন অরিত্রী আর সৌহার্দ্য একে অপরের হাত ধরে ক্যাম্পাসে হাঁটছিল, ওদের মধ্যকার প্রেম, খুনসুটি, কেয়ারিং সহ্য হচ্ছিল না আমার। আমি বুঝে গিয়েছি, সৌহার্দ্য আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওকে কারো সাথে শেয়ার করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল। ওদের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েও পারছি না আমি। ‘ভালোবাসা’ আজ আমার মধ্যে প্র*তি*হিং*সার আ*গু*ন জ্বা*লি*য়ে দিয়েছে। তাতে অরিত্রী আর সৌহার্দ্য, দুজনকেই পু*ড়*তে হবে। সৌহার্দ্যের জীবনে শুধু আমার আধিপত্য থাকবে। ড. সৌহার্দ্য রায়হান! তুমি চাইলেও তুমি আমার, তুমি না চাইলেও তুমি আমার! হয় তুমি আমার হবে, নয়তো কারো নয়। হা হা হা!”
অরুণী ভ*য়ং*ক*র ভঙ্গিতে হাসছে। আরমান সাহেব শিউরে উঠলেন অরুণীর এমন হাসি দেখে। অরুণীর চোখ দুটোতে আজ কোনো মায়া দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। অরুণীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ধীরে ধীরে হাসির মাত্রা কমে গেল। অরুণী শব্দ করে কেঁদে দিলো। আরমান সাহেবের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলো সেই কান্না। তিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই ভ*য়ং*ক*র কান্নার দিকে। অরুণী কান্নার তোড়ে গর্জে উঠে বললো,
“সৌহার্দ্য শুধু আমার হবে। নয়তো ওকে মরতে হবে। তার আগে আমি তোমাকে মারবো। এরপর অরিত্রী আর সৌহার্দ্য। তারপর নিজেকে মা*র*বো। প্রেমের সৌন্দর্য দেখে এসেছো সারাজীবন। এখন থেকে দেখবো প্রেমের সবচেয়ে কুৎ*সি*ত রূপটা! যেখানে থাকবে শুধু কান্না, মৃ*ত্যু ও ধ্বং*স!! ”
•
“নিকষ কালো আকাশ, আর আকাশ জুড়ে তারার মেলা! কেমন লাগছে দৃশ্যটা?”
প্রহর হালকা হেসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো মধুর দিকে। মধু আশে পাশে তাকিয়ে সবটা অবলোকন করায় ব্যস্ত। একটা রেস্টুরেন্টের রুফটপে বসেছে ওরা দুজন। পুরো রুফটপ বেশ সুন্দর করে সাজানো আর তার মাঝে একটা টেবিলে শুধু ওরা দুজন বসেছে। কাঁচা ফুলের সুগন্ধ মধুর নাকে এসে লাগছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো মধুর। অস্ফুটস্বরে বললো,
“এতো সুন্দর! এতো কিছু আয়োজন করেছো কেন আজকে? কোনো স্পেশাল ডে আছে নাকি? আমার তো মনে পড়ছে না!”
প্রহর মুখ বাকিয়ে বললো,
“স্পেশাল ডে লাগে নাকি? তোমার সাথে কাটানো সব ডে-ই স্পেশাল আমার জন্য। শুধু তুমিই বুঝলে না!”
মধু মনে মনে হাসলো। কিন্তু সেটা প্রহরকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
“আমাকে এসব বলে পাম্পিং করে লাভ নেই। আমি গলছি না! যাইহোক! এখানে কি শুধু এসব সৌন্দর্য দেখাতেই নিয়ে এসেছেন? নাকি কিছু খাওয়ার মতো আছে? আমার প্রচুর খিদে লেগেছে!”
প্রহর বিরক্তিতে কপলা কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ, সেই! সকল রোম্যান্টিক মোমেন্টে-ই তোমার ক্ষুধা লেগে যায়। এতো পেটুক কবে থেকে হলে? আশ্চর্য!”
মধু চোখ পাকিয়ে তাকালো। বললো,
“কী বললে? আমি পেটুক?”
প্রহর কপট হেসে বললো,
“জি। শোনো! আমি না এখানে তোমার সাথে প্রেম করতে এসেছে! খাওয়া-দাওয়া পরে হবে।”
“কিন্তু খিদে আটকে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতর থেকে অদ্ভুত ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে!”
প্রহর অবাক হয়ে বললো,
“হোয়াট?”
মধু অসহায় কন্ঠে বললো,
“হ্যা! দুপুরে লাঞ্চ করতে পারিনি ক্লাস ছিল বলে। সেই সকালে খেয়েছিলাম!”
প্রহরের প্রচন্ড রাগ লাগলো। ফোস করে একটা উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“স্টুপিড! কবে মানুষ হবে তুমি?”
মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“মানে কী বুঝালেন? আমি মানুষ না?”
প্রহর রাগমাখা মুখে নাটকীয় হাসি টেনে বললো,
“না, কোনো মানুষ কখনো এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকে না।”
প্রহর কল দিয়ে খাবার অর্ডার করলো। মধু আশে পাশে তাকাচ্ছে আর পা দোলাচ্ছে। প্রহর মধুকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মনে মনে হাসলো আর ভাবলো,
“আই উইশ, তুমি সারাজীবন এমনই থাকো! তোমার এই শিশুসুলভ মনটাকেই আমি ভালোবাসি আর এরোগেন্ট রূপটাকেও!!”
•
কেটে গেছে মাস খানেকের মতো সময়। দিনকাল স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। তরীর রোজকার ক্লাস, সংসার আর সৌহার্দ্যময় প্রেম! সারাটা দিন কীভাবে এসবে মত্ত থেকে কাটিয়ে দেয়, তরী বুঝেই উঠতে পারে না।
“কী রে, নাতবউ! আজকে ক্লাস করতে যাইবি না? তোর তো পারলে শুক্র-শনিবারও যাইতে মন চায় ভার্সিটি!”
দাদীর দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলো তরী। বললো,
“আজকে যাবো না, দাদী! মধু একাই গেছে।”
দাদী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“ক্যান যাবি না? কী হইসে বল তো? তোর মুখটা এমন ফ্যাকাসে হয়ে যাইতেছে ক্যান? চোখ দুটো তো গর্তে চলে গেছে একেবারে! চোখের নিচে এতো কালি পড়সে!! ঘুমাস না রাতে?”
তরী মলিন হেসে বললো,
“রাত জাগতে হয় একটু! প্রতিদিন পড়তে না বসলে পড়াশোনার খেই হারিয়ে ফেলি আমি। এজন্যই!”
“তোর শরীর ভালো আছে তো?”
“আরে হ্যাঁ! সুস্থ-ই আছি আমি। আজকে একটু রেস্টের জন্য বাসায় আছি। এই আর কি!”
দাদী তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“তাহলে যা! ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। বাইরে বসে থাকার দরকার নাই। যাহ্!”
তরী ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করে আসছে ওর। সৌহার্দ্যের দাদী পেছন থেকে জহুরি নজরে পরখ করছেন তরীকে। কেন যেন সবটা স্বাভাবিক লাগছে না! তরীকে তো মোটেই না।
বিছানায় বসা মাত্রই তরীর সারা শরীর ঝিমঝিমিয়ে উঠলো। বুক ভার হয়ে ভেতর থেকে মুচড়ে সব বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। বেরিয়ে এলো প্রায় আধা ঘণ্টা পর। দুই হাত দিয়ে মাথার দুইপাশের চুল খামচে ধরে বিছানায় আসে পড়লো তরী। হাত গলিয়ে সাদা রঙের প্রে*গ্ন্যা*সি কিটটা ফ্লোরে পড়ে গেল! সেটা গায়ে লাল বর্ণের দাগ স্পষ্ট। নিজের পেটের ওপর সযত্নে হাত রাখলো তরী! চোখ থেকে ছিটকে জলরেখা গড়িয়ে পড়ছে। কেন এমনটা হলো? কীভাবে এমনটা হলো? এমনটা না হওয়ার জন্য তরী নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। তবুও ভাগ্য কেন এমন নির্মম খেলায় নামালো তরীকে। কাঁদতে কাঁদতে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে তরী বললো,
“কেন এলি তুই? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একটা অ*ভি*শ*প্ত জীবন দিতে চাই না আমি তোকে। এখন কীভাবে কী করবো আমি?”
কান্নায় মুষড়ে পড়ার এক পর্যায়ে তরী নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। নিজেকে শক্ত করলো। তার নিষ্ঠুর রূপটা আর আড়াল করা যাবে না। আর এই নিষ্ঠুরতার শুরুটা মিজের অনাগত সন্তানকে দিয়েই হবে, ভাবতেও পারেনি সে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের চোখের জল মুছে ফেললো সে। চোখ বুজে নিজেই নিজেকে বললো,
“তোর মাকে ক্ষমা করে দিস! হয়তো আমি পৃথিবীর নি*কৃ*ষ্ট মা হবো। কিন্তু নিজের সন্তানের খু*নী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না আমার!”
-চলবে….
#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৬
তরী হসপিটালে এসেছে প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে কনফার্ম হওয়ার জন্য। সৌহার্দ্যের হসপিটালে মোটামুটি সবাই ওকে চেনে। তাই এই হসপিটালে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরী। সময় নষ্ট করাটা ঠিক মনে হয়নি বলে কাছের এই হসপিটালে টেস্ট করানোটা-ই ভালো মনে হয়েছে তরীর। তবে পরের কাজগুলো এতো কাছাকাছি কোথাও করবে না সে। সবার আড়ালে লুকিয়ে সবটা করতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পায়, তাই সচেতনতার সাথে সবটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরী।
টেস্ট করানোর পর তরী ওয়েটিং রুমে বসে আছে। রিপোর্ট রেডি হতেও কিছু সময় লাগবে। তরী চেয়ারে বসে হাতে হাত ঘষছে আর চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সন্ধ্যার আগে তো বাসায় পৌঁছাতে হবেই। সৌহার্দ্য বাসায় যাওয়ার আগেই ওকে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। ভাবতে ভাবতে তরী সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো। সামনে অরুণী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে হাত ভাজ করে তরীর দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে সে।
তরী হতবাক হয়ে উঠে দাড়ালো। অবাক লাগে তাকিয়ে বললো,
“ত্… তুমি? এখানে….”
অরুণী হাসলো। বললো,
“আমার বাবার হসপিটাল! আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”
“কিন্তু এটা তো….”
“এটাও আমার বাবার-ই হসপিটাল। আমার বাবার তিনটা হসপিটাল আছে। এটাও তার মধ্যে একটা। হয়তো তুই জানিস না! সেটা তোর ব্যাপার।”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো অরুণীর দিকে। এতো বড় বোকামি সে কীভাবে করলো? তাড়াহুড়ায় এমন কাজ করায় অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন অরুণী কিছু জেনে গেলে কীভাবে কী করবে তরীর মাথায় আসছে না।
“এই গাইনোকলিস্টের চেম্বারের সামনে তুই কী করছিস হঠাৎ? আর সৌহার্দ্যের হসপিটাল ফেলে এখানে কেন?”
তরী বিব্রত হয়ে বললো,
“তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি!”
তরী পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলে অরুণী পেছন থেকে বললো,
“এমন তো নয় যে, তুই সৌহার্দ্যের কাছ থেকে লুকোচ্ছিস? আর এই গাইনী ডক্টরের চেম্বারে! ম্যাটার্নিটি রিলেটেড কিছু হয়েছে নাকি?”
তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরুণীর দিকে। অরুণী সেটা দেখে হাসতে হাসতে বললো,
“আরেহ্! ডোন্ট বি প্যানিকড্! যতই হোক, আমার একটা মাত্র বোন তুই। তোর ভালোমন্দ নিয়ে তো আমাকে ভাবতেই হবে। তাই না?”
তরী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“নিজের চরকায় তেল লাগাও। আমাকে নিয়ে কিছু ভেবে থাকলে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে। এতে অন্তত বেঁচে থাকতে পারবে।”
অরুণী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো ,
“বেঁচে থাকার সব কারণ তো তুই-ই শেষ করে দিয়েছিস! এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাবিস। যতদিন তোর প্রতি সৌহার্দ্যের ভালোবাসা আছে, ততদিন তোর জীবনে শান্তি। ভালোবাসা শেষ, তো শান্তিও শেষ।”
তরী হেসে দিলো। বললো,
“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, বরং দিন যেতে যেতে বাড়তেই থাকে। আর তুমি যেই ভালোবাসার কথা বলছো, সেটা ভালোবাসা না! সেটাকে মোহ বলে, যা সৌহার্দ্যের প্রতি তোমার রয়েছে। আর বাকি রইলো সৌহার্দ্যের আমার প্রতি ভালোবাসা শেষ হওয়ার কথা। সেটা কোনোদিনও ফুরোবে না! সৌহার্দ্যের পুরো অস্তিত্ব জুড়েই আমি আছি, আর আমার জীবন জুড়ে ও। তোমার এই দিনের আকাশে তারা গোনার অভ্যাসটা যত তাড়াতাড়ি দূর করতে পারবে, ততই তোমার জন্য ভালো।”
“আমার অভ্যাস, আমার মোহ নিয়ে তোর ভাবতে হবে না এট লিস্ট! নিজেকে নিয়ে ভাব। ছেলে মানুষের মন খুব তাড়াতাড়ি রং বদলায়। সৌহার্দ্যও তোকে ভুলবে।”
তরী শক্ত কন্ঠে বললো,
“আ*গু*ন নিয়ে খেলছো তুমি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করো। সৌহার্দ্য আমাকে ভুলতে পারবে না। এতো বছরেও যেটা আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেনি, সেটা আমার উপস্থিতিতে ঘটবে এমনটা তুমি ভাবলে কী করে? আমার বরকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। একটু লজ্জাবোধ রেখে কাজ করো! এটাই তোমার জন্য বেটার।”
তরী দ্রুত পায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। রিপোর্ট কালকে গিয়ে নেওয়া যাবে। এখন বাসায় ফেরাটা জরুরি। তরী একটা রিকশা ডেকে তাড়াহুড়ো করে সেটায় উঠে বসলো। ফোনে কাউকে মেসেজ করে জানালো,
“অরুণীর ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করো। ওর সব আপডেট আমি চাওয়া মাত্রই যেন পাই!”
৪০.
সৌহার্দ্য প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যার পর পরই ডিউটি শেষ করে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বলে সিটে আরামে বসে গা এলিয়ে দিলো। গাড়ি স্টার্ট হওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায়ই একজন সিনিয়র ডক্টরের কল এলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো, স্যার! আসসালামু আলাইকুম! ”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম! সৌহার্দ্য, পেশেন্টের ব্যাপারে কিছু ডিসকাশন ছিল। আমার কাছে তোমাকেই এপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়েছে এই ইস্যুর জন্য। সো, লেট মি নো ইফ ইউ হ্যাভ এনি প্রব্লেম! ”
“নো, স্যার! আমি এখন ফ্রী-ই আছি।”
“আচ্ছা। তাহলে আমার চেম্বারে এসো। এন্ড হারি আপ! ইট’স আর্জেন্ট।”
“ওকে, স্যার। ড্রাইভার, গাড়ি ঘুরাও। পেছনের প্রাইভেট হসপিটালটায় চলো।”
হসপিটালে পৌঁছাতেই সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই হসপিটালেই অরুণী ইন্টার্নশিপ করছে। সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল। মনে মনে অরুণীর সাথে দেখা না হওয়ার প্রার্থনা করলো। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। হুট করেই অরুণী সৌহার্দ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আচমকা এমন হওয়ায় সৌহার্দ্য চমকালো।
“কী ব্যাপার? আজ হঠাৎ….. ”
অরুণীকে থামিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য বললো,
“তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে, সময় বা প্রয়োজন, কোনোটাই আমার নেই।”
বলেই সৌহার্দ্য হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। অরুণী পেছন থেকে অনেক বার ডাকলো৷ কিন্তু সৌহার্দ্য সেসবে কর্ণপাত করলো না। অরুণী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে।
৪১.
মধু গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। ঘড়িতে এখন রাত দশটার ওপরে বাজে। তার বাবা তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিল আটটার মধ্যে বাড়ি ফেরার জন্য। মধু যেহেতু সব টিউশন-ও ছেড়ে দিয়েছে, তাই অযথা এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা মিস্টার রায়হান একদম পছন্দ করেন না। মধুও তার বাবাকে অনেক সমীহ করে চলে।
মধু ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলো, মিস্টার রায়হান সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেটা ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মধু কোনোরকমে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, বাবা!”
মিস্টার রায়হান চোখ মেলে তাকালেন। মধুকে দেখে থমথমে গলায় সুজাতাকে ডাকলেন,
“সুজাতা! তোমার মেয়ে এসেছে। খেতে দাও ওকে!”
সুজাতা দ্রুত গতিতে আসতেই মধু একবার নিজের মাকে দেখে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, তুমি এখনো ঘুমোওনি কেন? কালকে অফিস নেই তোমার?”
মিস্টার রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“জেগে তো আছি তোমার জন্য-ই! এতো লেইট করে বাড়ি ফেরা ঠিক না। এটা তোমায় আগেও বুঝিয়ে বলেছিলাম।”
“বাবা, আসলে আমি টাইমলি-ই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম ছিল প্রচুর! সরি, বাবা। আর কখনো এমন লেইট হবে না। আমি খেয়াল রাখবো।”
মিস্টার রায়হান মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“খেয়াল তো তোমায় রাখতেই হবে। প্রহর নামিয়ে দিয়ে গেছে তোমায়, রাইট?”
“জি, বাবা!”
“ঠিক আছে। প্রহরকে বলো, কালকে আমার সাথে দেখা করার জন্য। কথাবার্তা একটু এগিয়ে রাখা দরকার।”
মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কথাবার্তা? কী ব্যাপারে কথা বলতে চাইছো, বাবা?”
“সেটা প্রহর এলেই জানতে পারবে। এখন খেয়ে নাও গিয়ে। অনেক রাত হয়েছে।”
মধু গাল ফুলিয়ে বললো,
“যা-ই বলো না কেন, বাবা! আমি এখন বিয়ে-টিয়ে করছি না।”
সৌহার্দ্যের দাদী এদিকেই আসছিলেন। মধুর মুখে এমন কথা শুনে বললেন,
“ক্যান রে? তোর বয়স কম হইসে? এখন বিয়ে না করলে কবে করবি তুই? বিয়ের বয়স পার হইয়া যাওয়ার পর?”
“উফ্! দাদী, চুপ করো না!”
“ক্যান চুপ করবো? সৌহার্দ্য আর ওর বউকে দেখ একবার! তরীর বয়স তোর সমান-ই। ওর বিয়ে হইলে তোর সমস্যা কই?”
সুজাতাও দাদীর সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
“হ্যা, তোমার দাদী তো ঠিকই বলছেন! সব স্বাভাবিক থাকলে তো এতো দিনে তোমার বিয়ে হয়েই যেতো! এখন হলে সমস্যা কোথায়?”
মধু সবার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললো,
“সমস্যা তো নেই! ব্যাস, আরো কয়েকদিন তোমাদের সাথে থাকি! অনেকগুলো দিন দূরে ছিলাম। আবার দূরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সুজাতা হাসলেন এমন কথায়। দাদী মুখ বাকিয়ে বললেন,
“তো সেইটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তোর মাথায় রাখা উচিত ছিল! এখন ঢং করে কী হবে? যাহ্! খেয়ে গিয়ে ঘুমা! আপদ একটা!”
দাদী পা ঘুরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মধু দাদীর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বললো,
“এ্যাহ্! বুড়ির বয়স হলেও তেজ কমেনি। তোমাকে তো আমি কালকে দেখে নেবো!”
মধুও নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মিস্টার রায়হান সুজাতার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“এই দুজনের লাগালাগি এ জীবনে শেষ হবে না!”
সুজাতাও হেসে বললেন,
“কারো তেজ তো কারো থেকে কম না! যেমন মধু, তেমন তোমার মা! সমানে সমানে লাগালাগি।”
•
সৌহার্দ্য ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো, তরী বেডে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য গলা ঝেড়ে বললো,
“কী ব্যাপার? মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান কিছুটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে। ”
তরী নড়েচড়ে বসলো সৌহার্দ্যের কথায়। সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি চলে এসেছো? এতো লেইট হলো আজকে হঠাৎ!”
সৌহার্দ্য নিজের হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,
“ইমার্জেন্সি ছিল। তাই না চাইতেও লেইট হলো!”
তরী বিছানা থেকে উঠে বসে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খাবার নিয়ে আসি।”
সৌহার্দ্য বাধা দিয়ে বললো,
“আমি ডিনার করে এসেছি। তুমি এখানে বসো।”
“ওহ! আচ্ছা!! ”
তরী আবার বিছানায় বসে পড়লো। তরীকে কেমন যেন অগোছালো, বিধ্বস্ত ও চিন্তিত লাগছে সৌহার্দ্যের চোখে। এপ্রোনটা হাত থেকে রেখে তরীর সামনে হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসলো সৌহার্দ্য। তরীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“আর ইউ আপসেট?”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে টলমলে চোখে তাকালো। কাছের মানুষের সামান্য যত্নে ভেতরে চেপে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে আসতে চায়। তরী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে না-বোধক মাথা নাড়ালো।
সৌহার্দ্য তরীর চোখের কোণের জলগুলো মুছে দিয়ে বললো,
“তাহলে কাঁদছো কেন? কী নিয়ে এতো ভাবছো? মন খুলে বলে ফেলো আমায়!”
তরী নাক টেনে বললো,
“আপনি আমায় কতটা ভালোবাসেন?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন!! ”
“আপনি বলুন আমায় আগে!”
“অনেক! সীমাহীন!! অন্তহীন!!!”
“আমাকে ভুলতে পারবেন কখনো?”
সৌহার্দ্য হেসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“এসব কী কথা বলছো, চাঁদ? এতো বছরেও যেটা সম্ভব হয়নি, সেটা….”
“সম্ভব! সময় খুব নিষ্ঠুর। একটা মুহূর্ত-ই যথেষ্ট সবকিছু বদলে দেওয়ার জন্য।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমার এসব কথার কারণ তো বুঝছি না! কিন্তু আমি একটা কথা-ই বলতে পারি। সৌহার্দ্য নিজেকে ভুলে গেলেও তার চাঁদকে ভুলতে পারবে না। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো, সব পরিস্থিতিতে, সারাজীবন। তোমার হাত তো আমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধরিনি। কেন এতো ইনসিকিউরড ফিল করছো?”
তরী চোখ মুছতে মুছতে বললো,
“যদি আমি কোনো অন্যায় করি, তাহলে কী করবেন?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“তাহলে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব থাকলেও আমি তোমার পক্ষে থাকবো, তোমার জন্য লড়বো। কারণ আমার বিশ্বাস আছে তোমার ওপর। তুমি কোনো অন্যায় করতে পারো না। আমার চাঁদ পবিত্র! সবচেয়ে পবিত্র। আর যদিও সে কোনো অন্যায় করেও ফেলে, সেটার পেছনে অবশ্যই কোনো যৌক্তিক কারণ থাকবে।”
তরী এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো। সৌহার্দ্যের বুকে হামলে পড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো, “আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি, সৌহার্দ্য! খুবই বাজেভাবে ঠকাচ্ছি।”
তরীর এভাবে কান্নার মানে সৌহার্দ্য বুঝে উঠতে পারলো না। চিন্তিত ভঙ্গিতে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
-চলবে…….