প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-৩৩+৩৪

0
1840

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৩

সৌহার্দ্য সারা ঘরময় সাজানো মোমবাতি গুলো প্রজ্বলিত করছে আর সম্মোহনী দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকাচ্ছে। তরী শাড়ির আঁচল হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবটা অস্বাভাবিক ঠেকছে। সৌহার্দ্যের মতিগতি কিছুটা আঁচ করতে পারছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে ওর।

নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে তরী তাকালো মোমবাতির আড়ালে থাকা সৌহার্দ্যের মুখের দিকে। সৌহার্দ্যের চশমাবিহীন চোখ দুটো তরীর দিকে তাক হয়ে আছে যেন। একবারও পলক পড়ছে না। তরীর শুভ্র-সুন্দর গায়ে বাদামী বর্ণের সুতি শাড়িটা একেবারে মিশে গিয়েছে যেন! খোলা জানালা গলিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলো তরীর মুখের ওপর পড়ছে। শীতল হাওয়ায় লম্বা চুলগুলো মুখের ওপর অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সৌহার্দ্যের কেমন যেন অদ্ভুত ঘোর লেগে আসছে! এরকম তো আগে কখনো হয়নি!

অন্য দিকে, মধু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দু’চোখে ঘুম নেই। বারবার এদিক-সেদিক ছটফট করছে সে। ড্রিম লাইটের লালচে আলোয় ঘরটা অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু মধু এই আলোয় ঘুমিয়েই অভ্যস্ত। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে মধু সটান হয়ে শুয়ে ঘুমানোর মনস্থির করলো। ঘুমটা আসবে আসবে মনে হচ্ছে। কিছু মুহুর্ত পরে হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো মধু। কেউ ওর পাশে এসে বসলো যেন! মধু তড়িৎ গতিতে চোখ মেলতেই আবছা আলোয় নিজে পাশে বসা এক ছায়ামূর্তিকে দেখলো। আকস্মিক ঘটনায় মধু ভড়কে গিয়ে গলা ছেড়ে এক চিৎকার দিতে গেলে তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরলো কেউ!

“ষাড়ের মতো চেঁচালে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবো। আমি এসেছি, কোনো বাঘ-ভাল্লুক বা ভূত-পেত্নী না! স্টুপিড!!”

ফিসফিসানির আওয়াজে কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই মধু চোখ গোল গোল করে তাকালো। মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,

“প্রহর! তুমি এখানে? এতো রাতে? কেন? কীভাবে?”

“এমন ভাবে বলছো যেন আজ নতুন এলাম! তোমার জন্য এ জীবনে কম তো আর পাইপ বেয়ে এই ঘরে আসিনি! আজও এলাম। তুমি আসতে বাধ্য করেছো।”

মধু চাপা স্বরে রাগ দেখিয়ে বললো,

“মাথা ঠিক আছে তোমার? আগেকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতির মাঝে অনেক তফাৎ! কেউ তোমায় এতো রাতে আমার ঘরে দেখলে কী ভাববে বলো তো? সবকিছুতে এতো হঠকারিতা ঠিক নয়, প্রহর!”

প্রহর মুখ অন্ধকার করে ফেললো মধুর কথা শুনে। মিনমিনে স্বরে বললো,

“আমি তো তোমারই রাগ ভাঙাতে এসেছিলাম, ল্যাভেন্ডার! তোমার মনে আর বিন্দু মাত্র রাগ, ক্ষোভ বা কষ্ট জমতে দিতে চাই না আমি। যাইহোক! এতো রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনো এভাবে আসবো না।”

প্রহর পা ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলো বারান্দার দিকে। মধু কপাল চাপড়ালো! আসলেই মানুষ বদলায় না। রাগ ভাঙাতে এসে প্রহর নিজেই রেগে গেল, কষ্ট পেল! এটা কোনো কথা!!

এই দিকে,
সৌহার্দ্য একহাতে একটা মোম নিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে আসছে। পুরো ঘর হলুদ আলোয় ঝলমল করছে। সৌহার্দ্য তরীর কাছাকাছি এসে মোমের আলো তরীর মুখের ওপর ধরলো। তরীর সৌহার্দ্যের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। হাতে হাত ঘষে আমতাআমতা করে বললো,

“আব্… ঘুমাবে না? এতো রাতে এসব কী করছো? এতো মোম কেন জ্বালিয়েছো?”

সৌহার্দ্য অদ্ভুত কন্ঠে বললো,

“কেন? তোমার পছন্দ হয়নি?”

তরী হকচকিয়ে গেল। বললো,

“হ..হয়েছে! অনেক সুন্দর লাগছে। সব তো দেখা শেষ! এবার আলোগুলো নেভাও। আলো জ্বালিয়ে দেই আর আমরা ঘুমোই। এমনিতেই অনেক রাত হয়েছে। কালকে আবার ক্লসে যেতে হবে আমার!”

বলেই তরী উল্টো দিকে গিয়ে আলো জ্বালাতে উদ্যত হতেই সৌহার্দ্য ওর শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। তরীর হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার যোগাড়!

“কালকে ফ্রাইডে। তোমার ক্লাস নেই। আর আমার বিকেলে ডিউটি।”

তরী সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

“ওহহ! ভুলেই গিয়েছি, দেখেছো?”

সৌহার্দ্য হাত থেকে মোমটা রেখে দু’পা এগিয়ে গেল। তরীর হাত ধরে টেনে নিজের কাছাকাছি এনে বললো,

“চাঁদ!! ”

তরী ঈষৎ কেঁপে উঠে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না এখন। কী অদ্ভুত কান্ড! সৌহার্দ্য হয়তো সেটা বুঝতে পারলো। নিঃশব্দে হেসে বললো,

“তোমাকে হারিয়ে আমি শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম, চাঁদ। বিশ্বাস করো! আমার শুধু শ্বাস চলতো, কিন্তু প্রাণটা তোমার সাথেই হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাণহীন সৌহার্দ্য রায়হানকে সবাই দেখেছে, জানো?”

তরীর চোখে পানি জমে এসেছে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তরী নিজের চোখে জল আসতে দেয়নি। নিতান্তই পরিস্থিতির দায়ে লোক দেখানো কান্না কাঁদতে হয়েছে। তরীর খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,

“ম*রে তো আমিও গিয়েছিলাম! কিন্তু কেউ সেটা জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি।”

বলতে চেয়েও কিচ্ছু বলে উঠতে পারলো না তরী। গলার ভেতর সব কথা জমাট বেঁধে আছে যেন। কিন্তু গাল বারবার ভিজে যাচ্ছে তরীর। সৌহার্দ্য তরীর মুখটা দু’হাতে আগলে নিলো। যত্ন সহকারে চোখের পানিগুলো মুছে দিতে দিতে ফিচেল হেসে বললো,

“তুমি বলতে না পারলেও তোমার না বলা কথাগুলো বুঝি আমি। আমার থেকে বেশি কষ্টে তুমি ছিলে। জানো? আমি কখনো ভাবিনি তোমায় আবার ফিরে পাবো। মৃ*ত মানুষ তো কখনো ফিরে আসে না! তোমার ফেরার দুরাশা করতাম কী করে বলো? আর তোমায় বিয়ে আমি নিজের ইচ্ছাতেই করেছিলাম। আমি আগেই চেয়েছিলাম এমন কাউকে বিয়ে করতে, যে কখনো আমার কাছে ভালোবাসা, অধিকার দাবী করতে পারবে না। মায়ের কাছে শুনেছিলাম তুমি কথা বলতে পারো না। মা-বাবা দুজনই চিন্তিত ছিলেন তোমার বিয়ে নিয়ে। কারণ বরপক্ষ নাকি জানতো না যে, তুমি কথা বলতে পারো না। সবটা জেনে আমি নিজে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করার। বিয়ের আগমুহূর্তে বরপক্ষের কানে তোমার কথা বলতে না পারার সত্যটা আমিই তুলেছিলাম। ফলশ্রুতিতে তোমার বিয়েটা ভেঙে যায়। কেউ তোমায় বিয়ে করবে না, এটা জানা-ই ছিল আমার! আমি নিজেই তোমায় বিয়ের প্রস্তাব দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার কাজকে আরো সহজ করে দেয় আমার বাবা।”

তরী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“এরকম কাজ করতে পারলেন আপনি? এতো প্ল্যান করে আমাকে বিয়ে করেছেন! সিরিয়াসলি!!”

সৌহার্দ্য হেসে বললো,

“নিজের স্বার্থের জন্য একটু বোকা তো বানাতেই হয়েছে সবাইকে। তবুও তোমাকে প্রথম বার দেখে অবাক হয়েছিলাম। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কথা বলতে পারে না! আফসোস হচ্ছিল তোমার ভাগ্য দেখে। আমার সাথে বিয়ে হওয়ায় তোমার জীবনটা-ই নষ্ট হয়ে গেছে মনে হচ্ছিল বারবার। কারণ আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই আমার চাঁদের বসবাস ছিল। সে জায়গায় কাউকে কোনোদিন বসাতে পারতাম না আমি। তবুও সময়ের পরিবর্তনে হয়তো তোমার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হতো। তোমার নীরবতাকে নিবিড়ভাবে ভালোবেসে ফেলতাম, দ্বিতীয় প্রেমের জোয়ার আসতো। কিন্তু চাঁদকে যে কোনো দিন ভুলতে পারতাম না। চাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো বিন্দু পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েই চলছিল ক্রমাগত। ওর অনুপস্থিতিতেও! এখানে আমার কী দোষ বলো? মনের ওপর তো আর জোর খাটানো যায় না!”

সৌহার্দ্য থামলো। তরী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে। ছেলেটা পাগল! সৌহার্দ্যের চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে দিতে দিতে তরী বললো,

“পাগল ডাক্তার আমার! এতো বেশি ভালোবাসতে নেই। জীবন সবসময়ই আমার সাথে নিষ্ঠুরতা করেছে, জানো? আমাকে এতো বেশি ভালোবেসো না! পরে আমার দেওয়া কোনো আঘাতের কষ্ট সহ্য হবে না তোমার। আবার এমনও তো হতে পারে! তুমি-ই আমাকে আঘাত করলে। সেই যন্ত্রণার বি*ষ অনেক ভয়ংকর! ”

সৌহার্দ্য তরীকে তড়িৎ গতিতে বুকে আগলে নিলো। বললো,

“আকাশের বুকে যেমন একটা মাত্র চাঁদ, তেমনি আমার জীবনেও একটা মাত্র চাঁদ তুমি। তোমায় নিজের বুকে আগলে রাখবো সবসময়। পারলে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবো। সৌহার্দ্য অরিত্রীর জন্য সব করতে পারে।”

তরী হাসলো। কিছু বললো না। সৌহার্দ্যকে কিছু বলে লাভ নেই। বেশ কিছু মুহুর্ত নীরব কাটলো। হঠাৎ সৌহার্দ্য নীরবতা ভেঙে বললো,

“চাঁদ!! ”

“হুম…”

“দাদীর সাথে আজকে আমার একটা ডিল হয়েছে।”

তরী ভ্রু কুঁচকে সৌহার্দ্যের বুক থেকে মাথা তুললো। উৎসুক দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কী ডিল?”

সৌহার্দ্য তরীর কানে ফিসফিস করে বললো,

“দাদী তার নাতির ঘরে বংশধর চেয়েছে। দাদীর ইচ্ছে কীভাবে অপূর্ণ রাখি বলো?”

তরী হতভম্ব হয়ে বললো,

“তার মানে এসব আপনাদের প্ল্যান ছিল? দাদী এজন্য আমাকে এতোক্ষণ আটকে রেখেছিল? আপনি দাদীর সাথে এতো কিছু বলেছেন? লাজলজ্জা কী সব পানি দিয়ে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছেন? মানে আপনি…..

সৌহার্দ্য তরীর মুখ চেপে ধরে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য বললো,

” আপনি আপনি করে কথা বলতে নিষেধ করেছি না? আর যা করেছি, বেশ করেছি। বয়স থার্টি-প্লাস হয়ে গেছে আমার। আর কতো অপেক্ষা? এবার বলে দাও না যে, আমাকে ভালোবাসো!”

তরী কিছু বললো না। সৌহার্দ্যের হাতের বাঁধন আলগা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্যের মুখে আধার নেমে এলো। মুখ ঘুরিয়ে নিতেই হুট করে তরী এসে সৌহার্দ্যের গালে অধর ছুঁইয়ে দিলো। সৌহার্দ্য চোখ বড়বড় করে তরীর দিকে তাকাতেই তরী সৌহার্দ্যকে ঝাপটে ধরে বললো,

“ভালোবাসি তো!”

খুশিতে সৌহার্দ্যের চোখে পানি চলে এলো। পরম আবেশে নিজের বুকে আগলে নিলো নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে। তারপর? প্রজ্বলিত মোমগুলো কেঁপে কেঁপে উঠে নিজ দায়িত্বে নিভে গেল। চাঁদ হঠাৎ-ই মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় ভাসিয়ে দিলো পৃথিবীকে। প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমার পরিণয় থেকে পরিণতি পেল অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই!

-চলবে…..

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৩৪

প্রহর আজ বিকেলে ক্যাম্পাসে এসেছে। সারাদিন অফিসে থাকতে হয়েছে আজকে। কিছু ফর্মালিটি আর একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য মিটিংয়ে ঐদিকের ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। তাই ক্যাম্পাসে তিনদিনের বেশি ক্লাস রাখেনি সে।

আজ কোনো ক্লাস নেই প্রহরের। এই অসময়ে ক্যাম্পাসে আসার প্রধান কারণ হলো মধু। মেয়েটার সাথে একবার দেখা না করে থাকা-ই যাচ্ছে না আর। আর মেয়েটাও অদ্ভুত! একটু বুদ্ধিও হলো না এখন পর্যন্ত! ও নিজে রাগ করে চলে এলো গত রাতে। একবার রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করলো না। না ফোন দিয়েছে আর না তো কোনো টেক্সট! ভেবেই গাল ফুলালো প্রহর। গাড়ি নিয়ে আর গেইটের ভেতর ঢুকলো না। একসাইডে পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। গাড়ির ভেতরে রিয়াদ আর ড্রাইভার আছে। প্রহর রিয়াদকে বললো,

“তুমি গাড়িটা নিয়ে যাও। বাসায় পৌঁছে আবার গাড়িটা পাঠিয়ে দিও না হয়!”

রিয়াদ অসম্মতি জানিয়ে বললো,

“দরকার নেই, স্যার! আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। আমার বাসা তো কাছেই!”

“আমি যা বলেছি, সেটাই হবে। যাও!”

প্রহরের শক্ত কন্ঠ শুনে রিয়াদ আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

প্রহর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই ওর ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল। কপালে ভাজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে আর মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তো অরুণী! কিন্তু ছেলেটা কে? এই ছেলেকে প্রহর কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।

অরুণী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বেশ গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে। দেকে বোঝা-ই যাচ্ছে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে ওরা। প্রহর শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো দূর থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে এগিয়ে গেল ওদের দিকে প্রহর। অরুণী চোখ ঘুরাতেই প্রহরকে এগোতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। প্রহর এক দেখায়-ই বুঝে ফেললো সেটা! অরুণী ঢোক গিলে আশেপাশে তাকাতে লাগলো।

প্রহর অরুণীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম নজরে দেখলো দুজনকে। ভ্রু উঁচিয়ে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“কী রে? তুই হঠাৎ আমাদের ক্যাম্পাসের সামনে। এদিকে তো তোর আসার কথা না! তুই তো এখন তোর ইন্টার্নশিপ নিয়ে ব্যস্ত আমি যত দূর জানি।”

অরুণী আমতা আমতা করে বললো,

“ঐ তো! আসলে এমনি একটু ঘুরতে এসেছিলাম। কখনো এখানে আসা হয়নি তো, তাই!”

প্রহর বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করে বললো,

“ওহ! আই সি! তো তোর সাথে এই ছেলেটা কে? রিলেশন চলছে নাকি ওর সাথে আবার?”

অরুণী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“মানে পাশে কোনো ছেলেকে দেখলেই সেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এক জায়গায় নিয়ে বসাও কেন তোমরা সবাই? ও আমার বয়ফ্রেন্ড কেন হবে?”

“তাহলে কে?”

অরুণী কন্ঠে চাপা রাগী কন্ঠে বললো,

“সেটা তোমার না জানলেও চলবে! মাইন্ড ইয়র অয়্যুন বিজনেস!”

বলেই আবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো, “অর্ণব! চলুন।”

অরুণী উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। অর্ণবও ওর পিছু পিছু গেল। প্রহর ওদের যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো,

“অর্ণব! এই ছেলে কোত্থেকে এসে জুটলো আবার? নাহ্! ব্যাপারটা তো স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না! নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। খোঁজ লাগাতে হবে।”

প্রহর ভেতরে ঢুকে মধুর ডিপার্টমেন্টের দিকে গেল। মধু একটা ছেলেকে প্রচুর গালিগালাজ করছে। মাঝেমধ্যে ঠুস-ঠাস চড়ও দিচ্ছে। তরী পাশে দাড়িয়ে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মধু তো কারো কথা শোনার মেয়ে-ই না! প্রহর হতভম্ব হয়ে মধুর দিকে এগিয়ে গেল।

“অনেক দিন ধরে খেয়াল করছি আমাকে ফলো করিস তুই। একবার ওয়ার্নিং দেওয়ার পরও শুনিসনি। এই তোকে বলেছি না আমার বর আছে, বিবাহিত আমি। তবুও আমাকে ডিস্টার্ব করিস!”

ছেলেটা কিছু বলতে নিলে মধু ধমকে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“আব্বে চুপ! আরেকটা কথা বললে আজ তোর একদিন নয়তো আমার। তোর সাহস হয় কী করে আমার দিকে তাকানোর, তাও আবার ঐ রকম নজরে!! তোর চোখ দুটো যদি আজকে না তুলসি, তাহলে… তোকে তো আমি….”

মধু আরেকটা চড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই প্রহর ওকে আটকে দিয়ে বললো,

“হোয়াট দ্য হ্যাল! কী করছো তুমি এসব, মধু?”

মধু নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

“ছাড়ো তুমি আমাকে। ওকে তো আমি আজকে দেখে নিবো! ছাড়ো!!”

প্রহর মধুকে টেনে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। তরী ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়ের হুটহাট হাত চলার অভ্যাস এ জীবনে যাবে বলে মনে হয় না।

প্রহরকে এভাবে মধুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে দেখে আশেপাশের স্টুডেন্টরা কানাঘুষা শুরু করে দিলো। প্রহর বিব্রত হলো ব্যাপারটা খেয়াল করে। মধু ফোঁস ফোঁস করছে। রাগী দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমাকে কে বলেছে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে আসতে? ঐ বদটাকে আরো দুটো লাগিয়ে দিয়ে আসতে পারলে আমার শান্তি হতো।”

প্রহর বিরক্ত হয়ে বললো,

“শাট আপ, মধু! এভাবে মানুষের ওপর হুটহাট হাত তোলা ঠিক না। মুখে বলেও অনেক কিছু বোঝানো যায়। ভুলে যেও না, তুমি একটা মেয়ে। আর মেয়েদের সবসময়ই ভদ্রতা মেইনটেইন করে চলতে হয়। এভাবে মানুষের গায়ে হাত তোলা কখনো কোনো ভদ্র মেয়ের কাজ হতে পারে না। ইউ শ্যুড আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ফ্যাক্ট, ওকে?”

মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“শোনো, আমি নিজেকে বদলাতে পারবো না। আর না আমি চাই নিজেকে বদলাতে। আমি কোনো ভদ্র মেয়ে নইও! আর তোমারও সেটা ভালো করে জানা থাকা উচিত।”

প্রহর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

“আমি তোমাকে বদলাতে চাইছি না, মধু। তুমি ভুল বুঝছো আমায়। আশেপাশের সবাইকে দেখো কী ভাবে দেখছে আমাদের? আজকে তুমি এসব না করলে এরকম একটা পরিস্থিতিতে অন্তত পড়তে হতো না।”

“তোমাকে তো আমি বলিনি আমাকে আটকাতে! বাঁধা কেন দিয়েছো আমায়? আর সবাই এভাবে দেখছে তো দেখুক! ওদের চোখ আছে ওরা তো দেখবেই! দু’দিন পরে তোমার আমার বিয়ে হলে জানতেই পারবে সবটা। এতে এতো হাইপার হওয়ার কী আছে? ”

প্রহর হতাশ হয়ে বললো,

“তোমাকে কোনো কিছু বুঝানো-ই বেকার! কোনো কথার সোজা মানে বুঝতেই চাও না। চলো, একটা জায়গায় যাবো তোমায় নিয়ে।”

প্রহর এগিয়ে যেতে লাগলো। মধু প্রহরের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে গাল ফুলিয়ে বললো,

“এখন তো আমাকে ভালোই লাগবে না। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছি না? আবার আমি তো ভদ্রও না! হুহ্!!”

প্রহর সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিটমিট করে হাসলো। মেয়েটা আসলেই পাগল!

তরী বুঝতে পারলো, মধু প্রহরের সাথেই বাসায় যাবে। ওদেরকে আর ডিস্টার্ব করলো না তাই। একা একা চলে যাওয়ার জন্যই গেইটের দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎ সামনে কারো সাথে ধাক্কা লাগলে তরী চমকে উঠলো।

“কী, রে? কেমন আছিস, তরী? ভুলেই তো গিয়েছিস আমাকে মনে হয়!”

তরী চোখ তুলে সামনে তাকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“ওহ! অর্ণব ভাইয়া, তুমি? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম!”

অর্ণব ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে হেসে বললো,

“তুই আবার ভয় পাওয়া শুরু করলি কবে থেকে? মনে ভয়-ডর আছে নাকি তোর!”

“সব মানুষের মনে-ই ভয় আছে , বুঝলে? যাইহোক! তুমি এখানেনকী মনে করে হঠাৎ?”

“কিছু মনে করে না। বাবার কোম্পানিতেই জয়েন করেছি আমি। এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। তোর সাথে তো অনেকদিন দেখা হয় না! কথা বলার পর মাত্র একবার ফোনে কথা বলেছিলি আমার সাথে। আজকে কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, দেখা করে যাই!”

তরী হালকা হেসে বললো,

“ওহ! ভালো করেছো। চলো না? সামনে গিয়ে বসে কথা বলি।”

অর্ণব মলিন হেসে বললো,

“নাহ! বসবো না। তোকে দেখার ইচ্ছে ছিল একটু। দেখা শেষ। যদিও তোকে দেখার সাধ এজীবনে ফুরাবে না আমার! কিন্তু এখন তোকে নিয়ে এসব ভাবাও পাপ আমার জন্য।”

তরী চোখ নামিয়ে ফেললো। হাতে হাত ঘষে কিছু মুহুর্ত নীরব রইলো। পুণরায় অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কেন আমাকে নিয়ে এতো ভাবো, অর্ণব ভাই? ভুলে যাও না আমাকে! আমার জীবন তো অন্য কারো সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে। এই বন্ধন ছিন্ন হওয়ার নয় আর ছিন্ন করার ইচ্ছেও নেই আমার। তুমি তোমার জীবনটা গুছিয়ে নাও!”

অর্ণব ম্লান কন্ঠে বললো,

“গুছিয়ে নিবো নিজেকে আমি। তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না। শুধু আমাকে এটা বল যে, তুই ভালো আছিস তো? সুখে আছিস তো?”

“তরী সুখেই আছে। ভালোও আছে। ড. সৌহার্দ্য রায়হান বেঁচে থাকতে আর যা-ই হোক, তার চাঁদের জীবনে ভালোবাসার কোনো অভাব পড়তে দিবে না। বুঝতে পেরেছেন, মিস্টার অর্ণব?”

বলেই সৌহার্দ্য তরীর পাশে দাড়িয়ে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো। অর্ণবের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“বেটার হয় যে, আপনি তরীকে নিয়ে আর মাথা না ঘামান! ও আমার বউ। আমার বউকে নিয়ে আমি প্রচন্ড পজেসিভ। ওর সুখের কোনো কমতি আমি রাখবো না। কাজিন হিসেবে তরীকে নিয়ে আপনি একটু কনসার্ন হতেই পারেন। কিন্তু সেটার কোনো প্রয়োজন নেই। চলো, চাঁদ!”

সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। পেছন থেকে অর্ণব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমি মানি যে, তুমি আর তরী একে অপরের জন্য তৈরী। তবে আগেও বলেছি, আজও বলছি! যেদিন তরীর চোখের এক ফোঁটা অশ্রুর কারণ তুমি হবে, সেদিনই তুমি ওকে হারাবে। আই সোয়্যার, দুনিয়ার যেই প্রান্তেই আমি থাকি না কেন! তরীর চোখের জল মোছাতে ছুটে আসবো-ই!”

-চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে