Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমাপ্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-২৭+২৮

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-২৭+২৮

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২৭+২৮

অতীত অসম্ভব সুন্দর! কল্পনায় তার অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে আজও মধু তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করে। তরীর উন্মুখ দৃষ্টি একবার অবলোকন করে নেয় সে। শীতল বাতাস বারবার তরীর গা হিম করে দিয়ে যাচ্ছে। কপালের চুলগুলো এলিয়ে পড়ছে তার মুখশ্রী জুড়ে। কিন্তু সেদিকে কোনো নজর নেই তরীর। তার কৌতুহলী মনে আজ তুমুল আন্দোলন চলছে। মধু সবটাই বুঝতে পারলো। ঠোঁট এলিয়ে ম্লান এক টুকরো হাসির রেশ দেখা দিলো তার অপরপ্রান্তে। ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করলো তার সেই স্মৃতি, যার সূচনা রংধনুর মতো রঙিন। কিন্তু পরিশিষ্টে রয়েছে এক বিষাদময় বিচ্ছেদ!

🍂
এক যুগেরও বেশি সময় পূর্ববর্তী কাল! ‘আহমেদ ভবন’ জুড়ে পরিবেশ তখন থমথমে। রায়হান আহমেদ ও আরমান আহমেদ দুইভাই। মিস্টার রায়হান সরকারি কর্মকর্তা আর আরমান পেশায় একজন ডক্টর। দুজনেই এক বাড়িতে এক সংসারে বেশ ভালো করেই দিন পার করছিলেন তখন। নিজেদের ভবিষ্যতে মনোনিবেশ করেছিলেন পুরোদমে।

আরমান নিজের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার ভবিষ্যৎ ঘুরিয়ে দেয় এই হাসপাতাল-ই! তার আয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কথায় বলে, অর্থ-ই অনর্থের মূল। আরমান সাহেবের ক্ষেত্রে কথাটা অনেকটাই মিলে গিয়েছিল। তার স্বাভাবিক জীবনযাপন অস্বাভাবিক হয়ে যায়। নিজের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তীব্র অনীহা সবারই চক্ষুগোচর হয় তখন। তবে বেশি বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করতে পারতেন না তিনি, কারণ ছিল মিস্টার রায়হান! গাম্ভীর্য সত্তার এই বড়ভাইকে আরমান সবসময়ই সমীহ করে চলতেন। ওনার পিতৃহীন জীবনের একমাত্র বটবৃক্ষ ছিল এই রায়হান। তাই ভাইয়ের প্রতি ভীতি ও শ্রদ্ধা, কোনোটাই কমিয়ে আনতে পারেননি তিনি। কিন্তু কালক্রমে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কেও ভাটা পড়ে। ক্রমশ আলগা হয় বন্ধন।

আরমান সাহেব তখন মান্যতা, ভদ্রতা ভুলে বসেছেন। নিজের স্ত্রীকে সহ্যই হতো না তার। হুটহাট গায়ে হাত তোলা, গালিগালাজের সীমাও পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অরুণী তখন বেশ বুঝদার হলেও অরিত্রী তখন অনেক ছোট। পুরো বাড়ির প্রাণ ছিল সে।

অরিত্রীর জন্ম হয়েছিল এক পূর্ণিমার রাতে। সৌহার্দ্য যখন ওকে প্রথম কোলে নেয়, বারান্দার ফাঁক গলিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলোয় অরিত্রীর উজ্জ্বল মুখটা ধরা দেয় সৌহার্দ্যের চোখে। জ্বলজ্বল করে উঠে সৌহার্দ্যের বাচ্চামো মাখা সেই চোখ দুটো। সৌহার্দ্য আমোদিত হয়ে বলেছিল সেদিন,

” বাবা, দেখেছো? আমাদের ঘরে একটা চাঁদ এসেছে। কাকিমনী আমাদেরকে একটা চাঁদ এনে দিয়েছে। আমার এই মিষ্টি চাঁদটা ঐ আকাশের চাঁদের চেয়েও সুন্দর। ও আমাদের চাঁদ। তাই না, বাবা? বলো! তাই না, মা?”

সৌহার্দ্যের বাচ্চামো দেখে সবাই হেসেছিলো সেদিন। সৌহার্দ্যের দেওয়া নামেই অরিত্রীর প্রথম পরিচয় হয়! সৌহার্দ্যের দাদী অরিত্রীর গলায় ঝুলিয়ে দেন চন্দ্রাকৃতির একটি লকেট। পুরো বাড়ি অরিত্রীর প্রতি এতোটা ঝুঁকে যাওয়ায় অরুণীর প্রচুর মন খারাপ হতো। আরমানও অরিত্রীর আগমনে খুশি ছিলেন না। অরুণীকে তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন অরুণীর পর একটা পুত্র সন্তান এসে তার পরিবার পরিপূর্ণ করুক! এমনটা না ঘটায় তিনি আশাহত হলেও মেনে নিয়েছিলেন সবটা।

অরুণীর চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ ছিল তার মা ও বোন। অরিত্রীর প্রতি অরুণীর প্রচুর ক্ষোভ। কেন এই মেয়েটাকে দেখলে সবাই এতো বিগলিত হয়ে যায়? সৌহার্দ্যসহ বাড়ির সবাই কেন সারাক্ষণ ওকে মাথায় তুলে রাখে? পরিবারের সবার প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে অরুণীর। মালিহা তার বড় মেয়েকে বোঝাতে চাইলেও অরুণী বুঝতে চাইতো না। তবে নিজের বাবার প্রতি সে ছিল মাত্রাতিরিক্ত দূর্বল। মেয়ের এই দূর্বলতার জন্য আরমান সাহেবও অরুণীকে অনেক ভালোবাসতেন।

কিন্তু আরমান সাহেবের হঠাৎ পরিবর্তন সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। একসময় দুই ভাইয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ দেখা দেয় এক অজানা কারণে। মিস্টার রায়হান আরমানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সৌহার্দ্যের দাদী তাকে পূত্র বলে মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বাড়ি ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

মালিহার সেদিন বলার মতো কিছুই ছিল না। অরিত্রীর বয়স তখন মাত্র সাত বছর। মধুর সাথে খেলছিল সে। কিন্তু সবার কথা শুনে সে এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, তার বাবাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। সৌহার্দ্য কলেজ থেকে এসে বাড়ির পরিস্থিতি দেখে অরিত্রী আর মধুকে নিয়ে পার্কে চলে গেল। অরুণী রাগী দৃষ্টিতে ওদের চলে যেতে দেখছিল। কেন ওকে রেখে সৌহার্দ্য চলে গেল? ভাবতেই বিরক্ত হচ্ছিল অরুণী!

” নিজের সবটুকু পরিশ্রম দিয়ে তোকে ডক্টর হিসেবে গড়ে তুলেছি আজ এই দিন দেখার জন্য? আমি ভাবতেও পারিনি আমার এই সিদ্ধান্ত আজ তোকে একটা প*শু*তে পরিণত করবে! ছি!! এজন্যই রোজ নিজের স্ত্রীর ওপর এতো বিতৃষ্ণা তোর? সব সহ্য করেছি এতোদিন! কিন্তু আজ সব সীমা পেরিয়ে গিয়েছিস তুই। তোর মুখ দেখতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার। আর কোনোদিন তোর মুখ দেখতে চাই না আমি।”

আরমান নিজের চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না মা আর ভাইয়ের দিকে। সৌহার্দ্যের দাদী পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছেন যেন। মিস্টার রায়হান এতোগুলো কথা বলেও নিজেকে দমাতে পারছেন না। মালিহা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছঁছেন। তিনি বুঝতে পারছেন তার স্বামী অনেক বড় অন্যায় করেছেন। কিন্তু আসল ঘটনা তিনিও জানেন না। আরমান সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর সাথে নিয়ে গিয়েছিল বড়ভাইয়ের প্রতি একবুক ক্ষো*ভ! অরুণীও বাবার হাত ধরে চলে যেতে চেয়েছিল। সে তখন আর অবুঝ নয়। তাই সৌহার্দ্যের দাদী তখন মুখ খুলে একটা কথাই বলেছিলেন অরুণীকে,

” ওর সাথে চলে গেলে তুই আর এই বাড়িতে কোনোদিন ঢুকতে পারবি না।”

অরুণী তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিল, “আসার ইচ্ছেও নেই। তোমরা থাকো তোমাদের চাঁদকে নিয়ে!”

“যদি কোনোদিন নিজেকে শুধরে নিতে পারিস, তাহলে আবার তোকে বুকে টেনে নিবো আমি। শুধু একবার চেষ্টা করিস!”

মিস্টার রায়হানের কথা শুনেও কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না করে অরণীকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আরমান। কারণ তিনি নিজেও জানতেন, তার পক্ষে নিজেকে শোধরানো সম্ভব নয়।

চলে গিয়েছিল কয়েক মাস। মালিহা অরিত্রীকে নিয়ে হসপিটালে গেছেন নিজের চেকআপের জন্য। হঠাৎই আরমানের বাড়ির দারোয়ান ফোন দিয়ে মিস্টার রায়হানকে জানায়,

” স্যার, ছোট ম্যাডাম আরমান স্যারের সাথে দেখা করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে আমার বউ বললো। কিন্তু স্যার তো শহরের বাইরে গেছেন। বাড়ির ভেতর আগুন লেগেছে। এখন ভেতরে কেউ আছে কিনা বুঝতে পারছি না।”

আগুন সত্যিই লেগেছিল। মালিহার দে*হে*র দিকে তাকাতে পারেনি কেউ। মনে হচ্ছিল, আগুন শুধু ওনাকেই পু*ড়ি*য়ে*ছে। কিন্তু অরিত্রীর দে*হকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতায় সবাই এটাই মেনে নিতে বাধ্য হয় যে, অরিত্রীও মা*রা গেছে। দারোয়ান আজাদ জানায়, আরমান অরুণীকে সাথে নিয়েই শহরের বাইরে গেছেন। কেউই ওনার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। এজন্য তারা মালিহাকে শেষবারের মতো দেখতেও পারেনি।

পুরো ‘আহমেদ ভবন’ থেকে প্রাণ হারিয়ে যায়। মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়েছিল প্রতিটি মানুষ। সৌহার্দ্য নিজের ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই নিজেকে বন্দী রাখতো। কাঁদত, হাহাকার করতো! সে কী করে বোঝাবে সবাইকে যে, সে তার চাঁদকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে? তার কৈশোরের প্রথম প্রেম যদি একটা অবুঝ মেয়ের সাথেই হয়ে থাকে, তবে কেন সেই পবিত্র মেয়েটা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল?

সুজাতা নিজের ছেলের এমন অবস্থা মানতে পারছিলেন না। তিনি তো আরেকটা ভ*য়া*বহ সত্য জানেন, যা এখনো কেউ জানে না। এটা জানালে সবাই আরো বেশি কষ্ট পাবে ভেবে তিনি সত্যটা কখনো প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন।

সৌহার্দ্যকে সামলানোর জন্য প্রহর তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া বাড়িয়ে দেয়। সৌহার্দ্যকে সেই অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনে প্রহর-ই! বছর খানেক পর সৌহার্দ্য কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ততদিনে পুরনো সৌহার্দ্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ফিরে এসেছে নতুন এক সৌহার্দ্য। যে হাসতে জানে না, কাঁদতেও জানে না। একাকিত্বে ধূমপান-ই যার সঙ্গী, আর জনসম্মুখে গাম্ভীর্য যার একমাত্র প্রতিক্রিয়া। সৌহার্দ্য নিজেকে সবসময়ই পড়াশোনায় ডুবিয়ে রাখতো। মাথায় সবসময় ফর্মূলা, থিওরি ও বিন্যাসের আনাগোনা দিয়ে ভরপুর রাখলেও তার চাঁদকে সে ভুলতে পারেনি কোনোদিন! কোনো এক পূর্ণিমার রাতে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরে জমে থাকা হাজারো অভিযোগ ব্যক্ত করতো সে। সেসব শুনে হয়তো আকাশেরও কাঁদতে ইচ্ছে করতো কিংবা চাঁদেরও!

প্রহর-ই সৌহার্দ্যকে সামলাতো। এজন্য সৌহার্দ্যের পরিবারের সাথে প্রহরের পরিবারের সম্পর্কও ভালো যাচ্ছিল। প্রহর হোস্টেলে থাকতো। কিন্তু তার মা ও বোন থাকতো গ্রামে, বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। প্রহরের মা ও বোন শহরে এলে সৌহার্দ্যের বাড়িতেই থাকতো। প্রহরের সাথে মধুর পরিচয়টা সেই সুবাদেই হয়। অরিত্রীর অনুপস্থিতিতে প্রহর হয়ে গিয়েছিল মধুর ভালো বন্ধুর মতো। মধু ছোট বেলা থেকেই বাউণ্ডুলে ধরনের। পড়াশোনায় অমনযোগী, কিন্তু প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। প্রহর একারণেই ওর প্রতি ঝুঁকতে থাকে। আর মধুরও কৈশোরের প্রথম প্রেম হয় প্রহর! সৌহার্দ্য সবটা দেখত, বুঝত আর জানতোও। প্রহরের প্রতি ওর প্রচুর বিশ্বাস ছিল। সে মনে প্রাণে মানতো প্রহর মধুকে ভালো রাখবে।

সৌহার্দ্যের সাথে অরুণীর আবার দেখা হয় এমবিবিএস কমপ্লিট করার পর। অরুণী তখন মেডিক্যালে নতুন ভর্তি হয়েছে। সৌহার্দ্যের সেই হসপিটালে প্রায়ই যাওয়া-আসা হতো। সৌহার্দ্যকে অরুণী অপরিকল্পিতভাবে ভালোবাসলেও সৌহার্দ্যের চিন্তা ভাবনা ভিন্ন ছিল। কিন্তু সেটা সৌহার্দ্য ছাড়া আর কেউ জানতো না। সুজাতা সবটা জানতে পেরে ছেলেকে বুঝায় যে, এই সম্পর্ক কোনোদিন পূর্ণতা পাবে না। সৌহার্দ্য মনে মনে হাসতো! সে তো নিজেও চায় না এটা পূর্ণতা পাক! তবে অরুণী সৌহার্দ্যকে প্রচন্ড ভালোবাসে, এটা সৌহার্দ্য বেশ ভালো করেই জানতো। তার চাওয়াও ছিল এটাই!

মধুর এইচএসসি পরীক্ষার পর প্রহরেরও মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়। প্রহর মধুর পরিবারকে জানায়, আপাতত সে এনগেজমেন্ট-টা করে রাখতে চায়। তার বছর খানেক পর নিজেকে ভালোভাবে গুছিয়ে নেয়ার পর সে মধুকে বিয়ে করবে। প্রহর যোগ্য ছেলে, তার ভবিষ্যৎ-ও সুন্দর। তাই মিস্টার রায়হান অমত করেননি। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।
🍂

“তারপর?”

তরীর উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাকালো মধু। মুখে ম্লান হাসির রেশ ফুটিয়ে বললো,

“তারপর আর কী? আমার ভাগ্য ভালো ছিল না। তাই বুঝতেই পারিনি প্রহর আমাকে এভাবে ঠকাবে! এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হয়েছিল আরও একসপ্তাহ পর। প্রহর নিজে দায়িত্ব নিয়ে সব কিছু করছিল। কিন্তু এনগেজমেন্টের তিন দিন আগে ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। সবাই অনেক চেষ্টা করেছিলাম। সৌহার্দ্য ভাইয়া পরে উপায় না পেয়ে প্রহরের গ্রামের আাড়ি যায়। কিন্তু সেখান থেকে জানতে পারে যে, প্রহর নাকি ওর মা-বোনকে নিয়ে কানাডা চলে গেছে। এর কারণও কেউ বলতে পারেনি তখন। আত্মীয়-স্বজন, বাবার বন্ধু-বান্ধব সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাবার প্রচুর অসম্মান হয়েছিল এতে। বাইরের মানুষের বাঁকা দৃষ্টি আমাকে আর আমার বাড়ির সবার জীবন বি*ষি*য়ে তুলেছিল। একে তো নিজের মন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে, তারওপর সবার কটুবাক্য সহ্য করতে পারিনি আমি। তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এতে আমিও বাঁচতে পারবো, আর আমার পরিবারও। এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। আমার জমানো বেশ কিছু টাকা ছিল। আবার টিউশনি শুরু করায় তেম সমস্যা হয়নি হোস্টেলে থাকতে। একবছর পর আবার এই শহরে ফিরে এসেছি। এতোদিনে নিজেকে পরিবর্তন করেছি, মনকে শক্ত করেছি। নিজেকে থামিয়ে রাখিনি আমি। পড়াশোনা শুরু করার সিদ্ধান্ত তখনই নিয়েছিলাম যদিও একবছর গ্যাপ পড়ে গিয়েছিল। তবুও সুযোগ তো ছিল!”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার অনুপস্থিতিতে এতো কিছু ঘটে গেছে, আর সে জানতেও পারেনি। আর জানবেই বা কী করে? তার নিজের জীবনটাও খুব বেশি সুন্দর ছিল না তখন। তরী জিজ্ঞেস করলো,

” এতো কিছুর পরেও মা প্রহরকে কিছু বলেনি! সেই নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে প্রহরকে। এরকম মানুষও হয়?”

মধু হেসে উঠে বললো,

“কারণ ঐটা আমার মা, বুঝলি? মা অনেক কিছু নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারে৷ প্রহরকে উনি অনেক বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া মা কারো উপরই রেগে থাকতে পারে না। তুই হাজারো অন্যায় করে মায়ের কাছে যাবি। দেখবি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছে! ”

“তবুও তোর কি মনে হচ্ছে না যে, প্রহরকে মা শুধু শুধু ক্ষমা করে দেননি। হয়তো প্রহর তোকে ইচ্ছে করে ছেড়ে যায়নি। এর পেছনে কোনো কারণ ছিল, যা তোর মা জানে!”

মধু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“তোর মাথা! তুই বেশি বেশি ভাবছিস। এমন কিছুই হয়নি। প্রহর বিট্রে করেছে আমার সাথে। যদি এর পেছনে কোনো কারণ থাকতো, তাহলে প্রহর এতোদিনেও আমাকে কিছু বলেনি কেন? এমন তো আর না যে আমি ওর কোনো কথা শুনিনি বা ওকে কিছু বলতে দেইনি! ও-ই বারবার অপরাধীর মতো আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। কিন্তু আমার মন এতো বড় নয় আর আমি ততোটাও উদার নই যে, ওর এতো বড় অন্যায় ক্ষমা করে দেবো।”

মধুর কথার পৃষ্ঠে বলার মতো আর কিছু পেল না তরী। তপ্ত শ্বাস ফেলতেই মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলো, মধু তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তরী ভ্রুকূটি করে বললো,

“কী হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

মধু শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

“তোর মুখের আদল একেবারে কাকিমনীর মতো! যদিও কাকিমনীর গায়ের রঙ একটু চাপা ছিল, কিন্তু তোর মুখের সাথে অনেকটা মিলে যায়!”

তরী বুক ভারী করে আকাশের দিকে তাকালো। ছোট বেলা থেকেই আকাশের দিকে তাকালে তার মনে হতো, তার মা তাকে দেখছে। মনের মধ্যে প্রায়ই একটা ইচ্ছে জাগে তার। যদি সে তার মাকে একবার সামনে পেত! কতোই না ভালো লাগতে মাকে খুব শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে পারলে! তখনই তরীর কানে বেজে ওঠে ওর মায়ের আ*র্ত*চিৎ*কা*র,

“আমার মেয়েটাকে মেরো না তুমি! আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও ওকে বাচিয়ে রেখো। ও যে তোমারই সন্তান!”

এদিকে,

সৌহার্দ্য ক্রোধান্বিত চোখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তুই আমার বোনটাকে অকারণেই কষ্ট দিয়েছিস। আমার বোনকে আমি আবার আমার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। একবার তোর মায়ায় জড়িয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে ও কষ্ট পেয়েছে। বারবার এক ভুল করবো না আমি। এবার মধুর একটা সুন্দর জীবন গুছিয়ে দেবো আমি। তোর মতো প্রতারকের ছায়াও পড়তে দেবো না ওর জীবনে!”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

“কিন্তু তুই নিজেও এটা ভালো করেই জানিস, তোর বোন এই প্রতারককে ছাড়া কারো সাথে সুখী হবে না।”

“শাট আপ! মধু তোকে ভুলে যাবে। দেখিস তুই?”

“ভালোবাসা ভোলা যায় না। তুই পেরেছিস তোর চাঁদকে ভুলতে? পারিসনি। কারণ তোর ভালোবাসায় একটুও খাঁদ ছিল না। মধুর ভালোবাসাও মিথ্যে নয়!”

সৌহার্দ্য হেসে বললো,

“চাঁদের সাথে নিজের তুলনা করিস না। চাঁদ তোর মতো প্রতারণা করেনি আমার সাথে। তুই তো সবাইকে ঠকিয়েছিস! আমাকে, মধুকে, আমার পরিবারকে। সবাইকে-ই!”

প্রহরের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল যেন! অসহনীয় একটা অনুভূতি নিয়ে সে মুখ খুললো,

“আমি কাউকে ঠকাইনি, কারো সাথে প্রতারণা করিনি। আমি তখন অসহায় ছিলাম। আমার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু আফসোস! তোরা একটুও বুঝতে চাইলি না। জানতেও চাইলি না আমার অনুভূতি!”

প্রহরের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্য।

-চলবে…..

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ