Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমাপ্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-২১+২২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-২১+২২

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২১

“সৌহার্দ্যের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। ও আপাতত ওর হসপিটালেই ভর্তি। এসে দেখা করে যান, মিসেস অরিত্রী সেহরীশ!”

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তব্দা খেয়ে রইলো তরী। প্রহরের বলা কথাটার দুটো দিক তার মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করলো অনেকক্ষণ। প্রথমত সৌহার্দ্যের এক্সিডেন্ট, দ্বিতীয়ত প্রহরের তার আসল নাম জেনে ফেলাটা। দ্বিতীয় বিষয়টার চেয়ে প্রথম বিষয়টা তরীর মধ্যে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব ফেললো। কিন্তু প্রহরের কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। রাগে ফোনটা কে*টে দিয়ে প্রহরকে একটা মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিলো তরী,

“আপনাকে বিশ্বাস করি না আমি। যদি এই ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে, তবে বাবা নয়তো মাকে কল দিয়ে জানান।”

প্রহর হতাশ হলো না। সে জানে তরী বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ তীক্ষ্ণ! তাই আর কালক্ষেপ না করে মিস্টার রায়হানকে কল দিয়ে জানালো। তরীর সারা শরীর কাঁপছে। মনের ভেতর ভয়েরা বাসা বেঁধেছে। সত্যি সত্যি যদি সৌহার্দ্যের কিছু হয়ে গিয়ে থাকে! প্রহর যদি সত্যি বলে থাকে, তখন কী হবে? তরী মনে মনে ভাবলো,

“যদি প্রহর মিথ্যে বলে, তাহলে আমি ওকে ছাড়বো না!”

তরীকে এভাবে কাঁপতে দেখে দাদী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এগিয়ে এসে বললেন, “কী রে, নাতবউ! তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?”

তরী কিছু বলার আগেই বাহির থেকে মিস্টার রায়হানের ক্রন্দনরত চিৎকার শোনা গেল, “সুজাতা, মা, বউমা! কোথায় তোমরা? আমার ছেলে হসপিটালে ভর্তি! তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ড্রাইভার! গাড়ি বের করো।”

তরীর চোখের সামনে সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এলো। ঝাপসূ চোখে কিছুক্ষণ পলক ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। তারপর! কঠিন হৃদয়ের অধিকারী মেয়েটার অবশেষে দূর্বলতায় আঘাত লাগায় তার মস্তিষ্ক একটা বাক্যই আওড়ালো, “কেন বারবার আমাকেই প্রিয়জন হারানোর বেদনা সহ্য করতে হয়?”

৩৩.
সৌহার্দ্য বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। সারা মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। প্রহর সৌহার্দ্যের বাবাকে কল দেওয়া শেষে আবার সৌহার্দ্যের কাছে ফিরে এলো। তাদেরকে এখনো জানায়নি যে, সৌহার্দ্য তেমন আ*হ*ত হয়নি আর এখন মোটামুটি সুস্থ। মূলত সৌহার্দ্যের মাথায় আঘাত লাগার পর প্রহর ওকে হসপিটালে এনে ওর সুস্থতা নিশ্চিত করার পরেই সৌহার্দ্যের পরিবারকে জানিয়েছে।

সৌহার্দ্য ভ্রুদ্বয় কুঁচকে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাথাটায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আধো আধো কন্ঠে প্রহরকে বললো,

“আমাকে হসপিটালে নিয়ে এলো কে?”

প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মুখ ভেঙিয়ে বললো, “তোর সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তো আমি ছাড়া আর কে নিয়ে আসবে? আমিই নিয়ে এসেছি তোকে এখানে।”

“তুই ওখানে পৌছলি কী করে? মানে ওখানে তোর উপস্থিতি…. ব্যাপারটা বুঝলাম না ঠিক! ”

“আমি ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। দূর থেকে দেখি তুই সেই বাড়িটা থেকে বের হচ্ছিস। তোকে ডাক দেওয়ার আগেই তুই গাড়ি টান দিয়ে চলে গেলি। আমিও তোর সাথে একই রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। তোর ভাগ্য ভালো যে তোর পিছনে ছিলাম আমি। হঠাৎ দেখি তোর গাড়ির স্পিড হুট করে বেড়ে গেল। প্রথমে বুঝিনি। কিন্তু পরে ব্যাপারটা বুঝলাম! যাইহোক, ঐ বাড়িটা থেকে বের হওয়ার সময় তোর সাথে একটা ব্যাগ ছিল। সেটা কোথায়?”

সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকালো। চোখ ছোট ছোট অবাক কন্ঠে বললো, “ব্যাগটা তো আমার সাথেই ছিল! ঐটা গাড়িতে পাসনি তুই।”

প্রহর মাথা নাড়িয়ে বললো, “না, তো! তোর গাড়ি এতো দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল যে, এক্সিডেন্ট এর পর তোর কাছে আসতে একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু তোর গাড়িটা পুরোটা চেক করে আমি কোনো ব্যাগ পেলাম না।”

সৌহার্দ্য নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললে, “ওহ্! শিট!! তারমানে আমি যেন সত্যিটা না জানতে পারি, এজন্যই আমার গাড়িটা এক্সিডেন্ট করানো হলো যেন ঐ ব্যাগটা সরিয়ে ফেলা যায় সহজেই!”

“মানে? ঐ ব্যাগে ছিলটা কী?”

“অনেকগুলো পেপারস! আজাদ চাচা মৃ*ত্যুর আগে আমাকে বলে গিয়েছিলেন ঐ পেপারস গুলোতেই আমার অজানা সব প্রশ্নের উত্তর পাবো আমি!”

“আর এটা তুই আমাকে আগে জানাসনি? নিজে নিজে বেশি বুদ্ধি খাটাতে গেলে এরকমটা-ই হবে!”

প্রহর বিরক্ত নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। রহস্যময় হাসি দিতে দিতে এগুতে লাগলো সে। মনে মনে বললো,

“তুই আমার থেকে যা লুকাতে চাইছিস, তা আমি খুব ভালো করেই জানি, সৌহার্দ্য! তোর তরী-ই আসল কালপ্রিট, এটা বুঝতে বাকি নেই আমার। আজ তোকে এক্সিডেন্ট করানোর পর থেকে ব্যাপারটায় আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি আমি। তোকে খুব বেশি আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক্সিডেন্টটা করায়নি ও। যতই হোক! ভালোবাসার মানুষ!! কিন্তু যতই বুদ্ধি খাটাক না কেন? আমি তো তার একধাপ ওপরে। ঐ কাগজের ব্যাগটা তোকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় সরিয়ে ফেলেছি আমি। ঐটা এখন আমার দখলে। এখন ঐটা থেকে সব রহস্য আমি উদঘাটন করবো।”

ভাবতে ভাবতে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসলো প্রহর। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, সৌহার্দ্যের মা আর বাবা দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু তরীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

মিস্টার রায়হান প্রহরের দুই বাহুতে হাত রেখে কান্নামাখা কন্ঠে বললেন,

“আমার ছেলে কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো!”

সুজাতা ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বললেন, “সৌহার্দ্যের কী হয়েছে? এখন কী অবস্থায় আছে আমার ছেলে? চুপ করে আছিস কেন? বল না?”

প্রহর শুকনো হাসি দিয়ে বললো, “সৌহার্দ্য ভালো আছে, আঙ্কেল! মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে। ওকে কেবিনেই রাখা হয়েছে।”

মিস্টার এবং মিসেস রায়হান দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলেন সৌহার্দ্যের কেবিনের দিকে। প্রহর তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, তরী কেন এলো না? সৌহার্দ্যের অসুস্থতার কথা শুনে তরী বাড়িতেই রয়ে গেল? এটা কীভাবে সম্ভব? এতোটা কাঁচা কাজ তো তরীর করার কথা না।”

প্রহরের সামনে ওর সেক্রেটারি রিয়াদ এসে দাঁড়াতেই সে রিয়াদকে বললো, “পেপারস গুলো ঠিকঠাক মতো আছে তো?”

রিয়াদ বললো, “ইয়েস, স্যার! রেখে এসেছি সেইফ জায়গাতেই!”

“গুড!”

“একটা কথা বলবো, স্যার!”

“বলো!”

“স্যার, এমনও তো হতে পারে যে, আপনার ধারণাটা হয়তো ভুল! না, মানে তরী মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝামেলা থাকলেও আমার কেন যেন ওকে এতোটাও ডে*ঞ্জা*রাস মনে হয় না! আর আমার মনে হয় না আজকে ডক্টর সৌহার্দ্যের এক্সিডেন্টের পেছনে তরীর কোনো হাত আছে।”

প্রহর শকৃত গলায় বললো, “আমার কোনো ধারণা আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি, রিয়াদ। এবারেরটাও হবে না। আর তিক্ত বাস্তবতার সাথে পরিচয় হওয়ার পর মানুষের মন পাথরের মতো কঠিন হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়! তরীর ক্ষেত্রে ও এমনটাই…… ”

প্রহরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর পাশ দিয়ে ঘেঁষে একটা মেয়ে ছুটে গেল। তার সুতি শাড়ির আঁচলের শেষপ্রান্ত মাটি স্পর্শ করে গড়িয়ে যেতে লাগলো মেয়েটার পিছু পিছু। মেয়েটার কোমড় অতিক্রান্ত চুলের ঢেউ দেখে প্রহরের চোখ চকচক করে উঠলো। তার বুঝতে বাকি নেই যে, এটাই তরী। সে ছুটে গেল তরীর পিছু পিছু।

সৌহার্দ্য তখন কেবিনে নিজের মাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। সুজাতার কান্নাকাটি থামছেই না। তিনি চোখ মুছছেন আর বলছেন, “আমার জীবনে তুই ছাড়া কে আছে আমাকে বল? অন্তত আমার জন্য হলেও তো একটু দেখে শুনে চলাফেরা করতে পারিস!”

সৌহার্দ্য কিছু বলবে তার আগেই তরী ছুটে তার কেবিনে প্রবেশ করলো। চোখমুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ওর। তরী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তরীর পিছু পিছু প্রহরও প্রবেশ করলো। তরী সৌহার্দ্যের মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিলো। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অবিরত।

সৌহার্দ্য মলিন হাসলো। ওর নিজের চোখেও পানি চিকচিক করছে। এটাই তার চাঁদ! আজও তার সামান্য আঘাতে যে চোখে বন্যা বয়ে যায়, সেই চাঁদ তার কাছে আবার ফিরে এসেছে। তরীর চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে ওর হাত দুটো নিজের দুহাতের মুঠোয় ভরে নিল সৌহার্দ্য। আশ্বস্ত কন্ঠে বললো,

“আমি ভালো আছি, সুস্থ আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার! দেখো। আর কেঁদো না৷ তোমার কান্না দেখে আমার যন্ত্রণা যাও কমেছিল, তা আরো কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে।”

তরী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। কান্নার কারণে বারবার কেঁপে উঠছে ও। সৌহার্দ্য তরীর গালে আবার হাত রাখতেই তরীর ঠোঁট কেঁপে উঠল। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ঠোঁট থেকে মিষ্টি কন্ঠে নিঃসৃত হলো,

“তোমার সামান্য কষ্ট আমার আজও সহ্য হয় না! আজ যদি তোমার কিছু হতো, আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকতাম? আমার আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকার কারণটাই যে তুমি!”

-চলবে….

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২২

সৌহার্দ্যের হাতটা তরীর মাথা থেকে চুল বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে পড়ে গেল। অতি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো তরীর মুখের দিকে। মুখ হা হয়ে গেছে ওর। ঘন ঘন পলক ফেলে বোঝার চেষ্টা করলো যে, সেঠিক শুনেছে কি না! নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পাশে মুখ ফিরিয়ে সবার দিকে চোখ বুলালো। সবার অবাকতার মাত্রা যে তার থেকেও কয়েক গুন বেশি, সেটা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার মানে এটা সৌহার্দ্যের ভ্রম ছিল না! সে ঠিকই শুনেছে।

সবটা বুঝে উঠতেই সৌহার্দ্য নড়েচড়ে বসলো। আসলেই তার চাঁদ কথা বলেছে! সে দু-হাত তুলে তরীর মুখটা নিজের আঁজলায় ভরে নিল। থেমে থেমে যাওয়া কন্ঠে বললো, “তুমি কী বললে? তুমি সত্যি কথা বললে! তুমি সত্যি সত্যি কথা বলেছো? আরেকবার বলো না? আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

তরী সুনয়নে তাকালো। অতি আবেগে সে সৌহার্দ্যকে অতীতের মতো করে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলেছে। বর্তমানে তার মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। অতি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তার গাল ছুঁয়ে থাকা সৌহার্দ্যের হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বললো, “আপনি ঠিকই শুনেছেন, ড. সৌহার্দ্য।”

সৌহার্দ্য নিজের ভ্রুদ্বয় একত্রিত করে বললো, “এভাবে বলছো কেন? একটু আগেই ঠিক ছিল!”

” কী ঠিক ছিল?”

“তোমার মুখের তুমি সম্বোধন এবং ভালোবাসাময় সেই স্বীকারোক্তি!”

তরী বিব্রত হলো। অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতিতে পড়ে নিজের খেই হারিয়ে ফেলেছিলো সে! কী অদ্ভুত কান্ড! মুখ খুলেছিল সে জেনে-বুঝেই! কিন্তু মুখ থেকে এমন ধরনের কথা বের হয়ে আসবে, সে ভাবতেও পারেনি।

প্রহর জানত, তরী আজকে কথা বলবে। কিন্তু সবকিছু জানা সত্ত্বেও আজ তরীর মুখ থেকে কথা শুনে সে অবাক হয়েছে। তরীর কথা শুনে মনে হচ্ছে না যে, ও কোনো অভিনয় করছে। সবটাই সত্য, বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। এই রহস্যময় মেয়েটা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে প্রচন্ড ভালোবাসে- এতে এখন তার কোনো সংশয় নেই। প্রহরের সন্দেহ এখন ক্রমশ ধোয়াশায় ঘনীভূত হচ্ছে। ভাবুক ভঙ্গিতে সে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।

“কী রে, নাতবউ? এতোদিন তুই আমাদের এই ভাবে ঠকাইলি? নাটক করলি? তুই তো অনেক খারাপ!”

বলেই দাদী তরীর কান ধরে টেনে বসা থেকে তুললো। তরী নিজের কানে হাত বুলিয়ে ঠোঁট উল্টে তাকালো। ইশারায় বোঝালো,

“আমার মুখ, আমার ইচ্ছে। আমার যখন কথা বলতে মন চাইবে, তখন কথা বলবো। নয়তো……”

তরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই দাদী তেড়ে ওর কান চেপে ধরে বললো, “আবার? আবার ইশারায় কথা বলিস? মুখ দিয়ে কথা বলবি আমার সাথে এখন থেইকা!”

সৌহার্দ্য ব্যস্ত গলায় বললো, “আহ!, দাদী! ওর কানে ব্যথা পাচ্ছে তো! ওকে ওর ইচ্ছে মতো কথা বলতে দাও না!”

“তুই চুপ কর! দুই দিন আগেও বউকে দেখতে পারতি না। আর এখন দেখো! দরদ কতো!! বলি এতো ভালোবাসা আসলো কই থেইকা তোদের মইধ্যে?”

দাদীর কথা শুনে সৌহার্দ্য হাসলো। তরীর মুখেও হাসির রেশ ফুটে উঠলো। মিস্টার রায়হান ওদের খুনসুটি দেখে বললো,

“যাক! আমার সংসারটা এখন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। আমি তোকে বলেছিলাম না, সৌহার্দ্য? আমি তোর জন্য সঠিক মানুষটা-ই সিলেক্ট করেছি। বাবা-মায়েরা সন্তানদের খারাপ চায় না কোনো দিন। কী বলো, সুজাতা?”

সুজাতা সন্তুষ্টির সাথে বললেন, “আমার এই সুন্দর সংসারে আর কোনো ঝড় না আসুক! কিন্তু তুই তো কথা বলতে পারিস না- এটা সবাই জানে। মানে আজকে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, সবাই ভুল জানতো। তুই এতোদিন এভাবে থাকলি কেন তাহলে?”

“আহ্! সুজাতা, ওকে এসবের কারণ জিজ্ঞেস করো না। এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাটাই ভালো হবে। চলো এখন আমরা বেরোই!”

মিস্টার রায়হানের কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়ালো না। সবাই একে একে বের হয়ে গেল। তরী ওদের পিছনে যেতে নিলে সৌহার্দ্য ওর হাত টেনে ধরে বললো,

“আরে, তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“বাবা বললেন তো বের হতে এখান থেকে!”

“তোমাকে বলেনি যেতে। বাকিদের বের হতে বলেছেন যেন আমরা একটু প্রাইভেসি পাই।”

তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, “প্রাইভেসি? মাথায় আঘাত লেগে কি মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি?”

সৌহার্দ্য টেনে তরীকে নিজের পাশে বসিয়ে বললো, “সে তো অনেক আগেই হয়েছে! সেই এক যুগ আগে, যখন এক কিশোরের মধ্যকার প্রেমিক পুরুষ জেগে উঠেছিল এক পরীর কারণে।”

“মানে?”

সৌহার্দ্য আনমনে বললো,

“মানে খুবই সাধারণ। এক রাজকুমার আর এক পরীর গল্প এটা। রাজকুমার খুব ছোট ছিল। তার জীবনে একটা পরী আসে। পরীটাকে সে খুব যত্ন করতো, দেখেশুনে রাখতো, সব খেয়াল রাখতো। ধীরে ধীরে পরীটা তার জীবনের অংশ হয়ে যায়। প্রেম-ভালোবাসার মানে সে বুঝতো না। কিন্তু বয়স বাড়তে বাড়তে সে বুঝদার হয়। বুঝতে পারে যে, সে ঐ পরীটাকে ভালোবাসে।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? ভালোবাসলেই তাকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। সে তো পরী! যেভাবে রাজকুমারের জীবনে এসেছিল, সেভাবেই তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। খুঁজে পাওয়াও সহজ ছিল না। বরং অসম্ভব ছিল। কারণ যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, সে স্বেচ্ছায় ফিরে না আসলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার এতো কিছু জানতে হবে না। তুমি বরং আমার সামনে বসো। আমি তোমাকে দেখি। তোমাকে দেখতে দেখতেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো, দেখো!”

তরী হাসলো। সৌহার্দ্যের সামনে বসে রইলো ওর কথা মতো। আর সৌহার্দ্য? সে তো এতো বছর পর তার চাঁদকে নতুন ভাবে নিজের করে ফিরে পেয়েছে! এতো অপেক্ষার পর নিজের তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে শান্ত করতে তাকিয়ে রইলো তার চাঁদের দিকে অপলক যেন এই চাঁদের পূর্ণিমায় তার জীবনের সকল অন্ধকার ফুরোবে আর সূচনা হবে এক সুন্দর প্রভাতের।

সৌহার্দ্যকে নিয়ে পরেরদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গেল সবাই। তবে ওকে সপ্তাহ খানেক সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলা হয়েছে। সৌহার্দ্য নিজেও জানে, ওর মাথায় আঘাত লাগায় নিজেকে শান্ত ও বিশ্রামের মধ্যে রাখতে হবে। রাতের খাবারটা তরী আলাদা করে সৌহার্দ্যের জন্য নিয়ে এলো। সবার সাথে এক সাথে বসে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কয়েকদিন ঘরের চার দেয়ালে নিজেকে বন্দী রাখাটাই ভালো মনে করলো সৌহার্দ্য। তাই এই ব্যাপারে তরীকে আর কিছু বললো না।

তরী সৌহার্দ্যের সামনে খাবার রাখলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো, “একটা প্লেট কেন?”

তরী অবাক হয়ে বললো, “একটা প্লেট-ই তো থাকবে! আপনি একজন মানুষ। কেন? আপনি কি দুই প্লেট খাবার খাবেন?”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো, “তোমার মনে হয়, আমি এখন দুই প্লেট খাবার খাবো? তুমি নিজে খেয়েছো?”

“না। আপনি খেয়ে নিন। তারপর না-হয় আমি খাবো।”

“আজ্ঞে না! আপনি আমার সাথেই খাবেন। আর শুধু আজকের জন্য না, প্রতিদিন খাবেন। বুঝলেন?”

“আপনি আমাকে এভাবে আপনি আপনি করে কথা বলছেন কেন?”

সৌহার্দ্য বললো, “কারণ তুমিও বলছো আপনি করে! তাই।”

তরী সুন্দর করে হাসলো। সৌহার্দ্যের পাশে বসে খাবার ঠিক করতে করতে বললো, “এসো, খাইয়ে দেই।”

সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকালো। সেই ছোটবেলায় সৌহার্দ্য রাগ বা অভিমান করলে তার চাঁদ এভাবেই তার কাছে খাবার নিয়ে এসে বলতো, “এসো, খাইয়ে দেই!” সৌহার্দ্যের অনুমতি চাইলেও অনুমতির অপেক্ষা সে কোনোদিনও করেনি। বরং নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে খাবার তুলে দিতো সৌহার্দ্যের মুখে। আজও কথাটা সৌহার্দ্যের কানে বাজে। কিন্তু কথাটা বলার মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল।

তরী সেই আগের মতোই সৌহার্দ্যের মুখে খাবার তুলে দিলো। সৌহার্দ্য খাবার খেতে খেতে তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো, “শুধু আমাকে খাওয়ালেই হবে? বললাম না? তোমাকে আমার সাথে খেতে হবে!”

“কিন্তু খাবার তো এক প্লেট!”

“খেয়ে দেখো। এই খাবারে লেগে থাকা ভালোবাসা দিয়েই পেট ভরে যাবে।”

তরী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, “হ্যাঁ, তোমার কথা বার্তা আজ অদ্ভুত ঠেকছে!”

সৌহার্দ্য কিছু বললো না। খাওয়া শেষে তরী হাত ধুতে ধুতে বললো, “আমি যদি সত্যি সত্যি কথা বলতে না পারতাম, তাহলে কি আমায় কখনো মেনে নিতেন না?”

“মেনে তো তোমায় অনেক আগেই নিয়েছিলাম! বহু আগে। তুমি জানতেও না তখন!”

তরী ভ্রু কুঁচকে বললো, “মানে?”

সৌহার্দ্য হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো, “না। মানে বলছিলাম যে, শুরু থেকেই মেনে নিয়েছিলাম। সেটাই বোঝালাম আর কি!কিন্তু তুমি এতো দিন কথা বলোনি কেন? ”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, “ইচ্ছে ম*রে গিয়েছিল কথা বলার। আমার জীবনের শেষ কথা বলেছিলাম সেদিন, যেদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে আমার নিজের চোখের সামনে ম*রে যেতে দেখেছিলাম। আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেদিন। সেদিনের পর থেকে আমার জীবন থেকে কান্না ও কথা বলার ইচ্ছে, দুটোই হারিয়ে গেছে। কালকে যখন শুনলাম আপনি হসপিটালে এডমিটেড, আমার আবারও সেই পুরনো ভয় মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল। দ্বিতীয় বার প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা সহ্য হতো না আমার। কান্না ও ভাষা- দু’টোই আমার মধ্যে ফিরে এসেছে আমার অজান্তেই!”

সৌহার্দ্য হাসলো। বললো, “তার মানে আমিও তোমার প্রিয় মানুষ। এতো ভালোবাসো?”

“বাসি তো! তোমার মতো না। আমাকে একটু ভালোবেসো, বুঝলে? একটু ভালোবাসাই চাইবো তোমার কাছে।”

বলেই তরী হাসতে হাসতে নিজের এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা করার জন্য হাত তুললো। সৌহার্দ্য বাঁধা দিয়ে বললো, “তোমার ঢেউ খেলানো খোলা চুলগুলো আমার খুব প্রিয়। এই চুলগুলো আমার সামনে সবসময় খোলা রাখবে। তুমি খোলা চুলে আমার কাছে এসে কিছু চাইলে আমি তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারবো না কখনো। আর একটু ভালোবাসার কথা বলছো? আমার ভালোবাসায় পা ফেললে তলিয়ে যাবে তুমি। বুঝলে?”

-চলবে….

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ