প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব-১৭+১৮

0
2274

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৭

তরী জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আর কিছুক্ষণ বাকি। গোধূলির হলুদ আভা ছেয়ে গেছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। জানালা ভেদ করে সেই হলুদ বর্ণ আছড়ে পড়ছে তরীর মুখে, শাড়ির আশেপাশে। হঠাৎ ঘরের আলো জ্ব*লে ওঠায় তরী চমকে উঠলো। পাশে তাকাতেই দেখতে পেল সুজাতাকে। তিনি শুকনো হাসি দিয়ে বললেন,

-“এভাবে ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন, মা? মন খারাপ করিস না। তোকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে।”

তরী তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, তার একদম মন খারাপ হয় নি। বাইরে আঙুল দিয়ে ডুবন্ত সূর্যের দিকে দেখিয়ে বোঝালো, সে তো সূর্যাস্ত দেখছিল। হেসে হাত নাড়িয়ে ইশারা করলো, তার ভীষণ ভালো লাগে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে।

মিসেস সুজাতা তরীর গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। হেসে বললেন,

-“আচ্ছা, বুঝলাম! এখন দেখ তো এই বইগুলো! সৌহার্দ্য যাওয়ার আগে এই বইয়ের নাম দিয়ে আমাকে বলে গেল, তোর জন্য বইগুলো আনিয়ে নিতে। এগুলো দিয়েই হবে? নাকি আরো কোনোটা লাগবে দেখে নে।”

তরী বইগুলো দেখে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালো, আপাতত লাগবে না। সুজাতা পুনরায় সুন্দর করে হেসে বললেন,

-“পরে লাগলেও তোর বলতে হবে না। আমার ছেলে-ই আনিয়ে দিবে, দেখিস! তোর আঁচলে বাঁধা পড়তে খুব বেশি দেরী নেই আমার ছেলের, যা বুঝতে পারছি।”

সুজাতা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। তরী কিছুটা অপ্রস্তুত হলো কথাটা শুনে। তবুও বিষয়টা নিয়ে তেমন একটা ভাবলো না। বইগুলো টেবিলে রাখতে গিয়ে সৌহার্দ্যের মোটা মোটা মেডিক্যাল সায়েন্সের বইয়ের ভাঁজে একটা অতি সুন্দর ডায়েরি দেখতে পেল। এতো বইপত্রের মাঝে তরীর নজর ডায়েরিটাতেই ঠেকলো, কারণ জিনিসটা অসাধারণ সুন্দর আর চোখে পড়ার মতোই। তরী সেটা হাতে নিলো। তরীর চোখ চকচক করে উঠলো, যখন সে বুখতে পারলো এটা সৌহার্দ্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি। সৌহার্দ্যের মনে ঠিক কী চলছে, সেটা হয়তো এই ডায়েরি থেকে জানা যাবে।

অনেক আশা নিয়ে তরী ডায়েরিটা নিয়ে বসলো পড়ার জন্য। সেটা খুলে দেখলো, প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় বড় করে লেখা,

❝প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা❞

তারিখ দেখে বুঝলো, সৌহার্দ্য সেই কৈশোরকাল থেকে এই ডায়েরিটা লিখছে। কিন্তু কয়েকবছর লেখা কন্টিনিউ করার পর সৌহার্দ্য লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। ডায়েরির সবগুলো লেখায় তরী চোখ বুলালো। “চাঁদ” ব্যাতিত আর কাউকে নিয়ে একটা শব্দও লিখেনি সৌহার্দ্য এখানে। শেষ লেখাটা বারো বছর আগের। সৌহার্দ্য লিখেছে,

“আমার আকাশ অন্ধকার করে দিয়ে আমার চাঁদ হারিয়ে গেল। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। জীবন থেকে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। যেখানে চাঁদ-ই নেই, সেখানে পূর্ণিমা আসবে কোত্থেকে? তাহলে কি ‘প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা’র যাত্রায় এখানেই ইতি ঘটলো? হয়তো!”

তরী পরের পৃষ্ঠাগুলো ঘাটলো। বেশ কয়েকটা ফাঁকা পেইজ উল্টে দেখলো, একটা পৃষ্ঠায় দুদিন আগের তারিখ বসিয়েছে সৌহার্দ্য। কিন্তু এখনো কিছু লেখেনি সে। তার মানে সৌহার্দ্য ডায়েরিটা পুনরায় লেখা শুরু করেছে! কী লিখবে সৌহার্দ্য? তরী ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে মনে মনে ভাবলো, সৌহার্দ্য যা-ই লিখুক, সেটা তাকে জানতে হবে। আর তার জন্য এই ডায়েরিটা তাকে রোজ চেক করতে হবে।

২৮.
সৌহার্দ্য প্রহরের দিকে বেশ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রহর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আপনমনে ড্রাইভ করছে।

-“আজ সারাটা দিন আমার ব*র*বা*দ করে কী লাভ হলো তোর? আমি আজকে কতগুলো এপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে তোর সাথে দেখাকরতে এসছি, তোর কোনো আইডিয়া আছে? এপয়েন্টমেন্ট গুলো রাতে শিফট করেছি৷ কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার বেশ রাত হবে। মানে আমার যতটুকু ফেইম এ কয়দিনে এচিভ করেছি, তোর জন্য সব ব*র*বাদ হবে মনে হচ্ছে।”

সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে প্রহরকে কথাগুলো বললেও প্রহর সেগুলো গায়েই মাখলো না। সশব্দে হেসে বললো,

-“কাম অন, ইয়ার! আগে তো পুরোই আঁতেল ছিলি! আর এখন কাজ-পাগল।”

বলেই আরো দ্বিগুন শব্দ করে হাসতে লাগলো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,

-“কী? আমি আঁতেল ছিলাম?”

-“আজ্ঞে হ্যাঁ! নাকের ডগায় চশমা আর হাতের মধ্যে বই ছাড়া তোকে দেখা-ই যেত না। ডিএমসি-এর অন্যতম পড়ুয়া বালক তো আপনি-ই ছিলেন!”

প্রহর হাসতে হাসতে গাড়ি ব্রেক করলো। ঠোঁটের মাঝে একটা সিগারেট চেপে ধরে লাইটার দিয়ে সেটা জ্বালালো। একটা টান দিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো, সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রহর ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বললো, কী?

-“এই অভ্যাস আবার কবে থেকে হলো? টিচিং প্রফেশনে থেকে স্মোক করিস কীভাবে তুই?”

-“ঠিক যেভাবে তুই ডাক্তারি পেশায় থেকে করিস, সেভাবেই! ”

প্রহরের সোজাসাপ্টা উত্তর। সৌহার্দ্য বেশ বিরক্ত হলো। বললো,

-“আমার ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু তোকে এসবে মানায় না। এসব কেন করিস তুই? বাদ দে এসব!”

-“আচ্ছা, বাদ দিলাম। নে, ধর!”

বলেই ঠোঁটের সিগারেটটা সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে দিলো। সৌহার্দ্য সেটা হাতে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। প্রহর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“তুই কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি স্মোকিং? আই ডোন্ট থিংক সো!”

সৌহার্দ্য রেগে বললো,

-“শাট আপ! এমনি দুপুরে লাঞ্চের কথা বলে দেরী করলি। তারপর পার্কে নিয়ে গেলি, অথচ তুই ভালো করেই জানিস যে, পার্কে কথা বলার পরিবেশ নেই। এখন আবার নিজের বাসায় নিয়ে যাচ্ছিস। তুই যদি মনে করে থাকিস যে, আগের পুরোনো স্মৃতি আমার চোখের সামনে এভাবে তুলে ধরলে আমি তোর করা অন্যায় ভুলে যাবো, তোকে ক্ষমা করে দিবো, তো সে গুড়ে বালি। তুই একটা প্র*তা*র*ক! আর প্র*তা*র*কের কোনো ক্ষমা নেই।”

প্রহর মলিন হাসলো। বললো,

-“অথচ সেই প্র*তা*র*ককেই আজও বিশ্বস্ত মনে হয় তোর। এজন্যই শুধু আমার কাছে এসেছিস আজ, নিজের মনে জমে থাকা সংশয়গুলো দূর করার জন্য। আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারিসনি, তাই না? ”

সৌহার্দ্য অপ্রস্তুত হলো। প্রহর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,

-“তোর কথা গায়ে মাখি না আমি। এগুলো বলা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু সব কিছুর আড়ালেও একটা সত্য থাকে। সেই সত্যিটা আমি সঠিক সময়েই প্রকাশ করবো।”

প্রহর গাড়ি থেকে নেমে গেল। সৌহার্দ্যও নামলো। প্রহরের কথাগুলোর মানে সে বুঝে উঠতে পারলো না। ওকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে সৌহার্দ্য প্রহরের পিছু পিছু ওর বাড়িতে ঢুকলো।

-“যেই প্রহরের কিছুই ছিল না, সেই প্রহরের আজ এমন আলিশান বাড়ি-গাড়ির অভাব আর নেই। কিন্তু এতো কিছু থেকেও প্রহরের আজ কিছুই নেই।”

প্রহরের বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে সৌহার্দ্য ড্রয়িং রুমের আশে পাশে তাকালো। বললো,

-“অর্থী, মনিমা- এরা কোথায়? পুরো বাড়ি ফাঁকা কেন?”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

-“অর্থী তো কানাডায়! স্কলারশিপে সেখানে পড়তে গেছে দুই বছর আগেই। আর মা…… আছে কোথাও! তুই রুমে এসে বস। ডিনার করেই তো যেতে হবে! আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি।”

সৌহার্দ্য প্রহরের ঘরে গিয়ে বসলো। প্রহর ফ্রেশ হয়ে ওর হাতে এক মগ কফি এনে দিলো। মুখোমুখি বসে বললো,

-“সারাদিন আমার সাথে থেকে নষ্ট করেছিস। সেজন্য সরি বলবো না। আসলে আমি সেজন্য বিন্দুমাত্র দুঃখিত না। হা হা হা!”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো প্রহরের মুখের দিকে। প্রহর হাসি থামিয়ে বললো,

-“আচ্ছা বল! তোর রহস্যময় বউকে নিয়ে কী জানতে পেরেছিস?”

সৌহার্দ্য সিরিয়াস হলো। থমথমে মুখে বললো,

-“চাঁদ বেঁচে আছে, প্রহর। ও মা*রা যায়নি!

প্রহর মুখের ভেতর কফি নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। সৌহার্দ্য ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে এই সিরিয়াস কথার মাঝেও ফিক করে হেসে দিলো। বললো,

-“তুই একদম বদলাসনি! জোকার কোথাকার! ”

প্রহর একঢোকে কফিটা শেষ করলো। অত্যাশ্চর্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-“হোয়াট? চাঁদ বেঁচে আছে? কীভাবে? সেদিন ঐ বাড়িটাতে যখন আ*গুন লেগেছিল, তখন তো চাঁদও ঐ বাড়িটার ভেতর ঢুকেছিল! তাহলে ও বেঁচে থাকে কীভাবে?”

-“দারোয়ান বলেছিল যে, চাঁদ আর ওর মা একা ঢুকেছিল৷ কিন্তু আ*গুন নেভানোর পর তো শুধু চাঁদের মায়ের পো*ড়া মৃ*ত দে*হ পাওয়া গিয়েছিল! চাঁদকে পাওয়া যায়নি।”

সৌহার্দ্যের কথা শুনে প্রহর মাথা নাড়ালো। আসলেই পাওয়া যায়নি। বললো,

-“ধারণা করা হয়েছিল যে, চাঁদ অনেক ছোট ছিল। আর ওর দে*হটা এমনভাবে পু*ড়ে*ছি*ল যে, আর খুজে পাওয়া যায়নি। তবে এই যুক্তিটা আমার কাছে নিতান্তই অমূলক লেগেছে। সে যাই-হোক! তুই হঠাৎ চাঁদকে নিয়ে পড়লি কেন?”

সৌহার্দ্য তরীর বাবার কাছ থেকে শোনা সব ঘটনা প্রহরকে খুলে বললো। পকেট থেকে লকেটসহ চেইনটা বের করে দেখিয়ে বললো,

-“এটা চাঁদের গলায় থাকতো সবসময়। এটা যদি ঐ সময় তরীর গলায় পাওয়া গিয়ে থাকে, তার মানেটা কী বুঝতে পারছিস?”

-“তার মানে তরী-ই চাঁদ!”

সৌহার্দ্যের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহর অবাক কন্ঠে বললো,

-“তাহলে সেদিনের ঘটনার পেছনে কেউ ছিল! এটা সম্পূর্ণ-ই পরিকল্পিত। তরীর মাকে খু*ন করা হয়েছে আর তরীকেও ওভাবে পুঁ*তে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কে আছে এসবের পেছনে? আর ঐদিন দারোয়ান মিথ্যে বলেছিন তাহলে?”

সৌহার্দ্য ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,

-“সবটা জানতে হলে আমাদের ঐ দারোয়ানকে খুজে বের করতে হবে আগে। ও অনেক কিছু জানে। রহস্যভেদ না-হয় ওকে দিয়েই শুরু করা যাক!

-চলবে…….

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১৮

-“তরীর প্রতি আমার যে সন্দেহ ছিল, ধীরে ধীরে সেটা পাকাপোক্ত হচ্ছে শুধু! আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম যে, ওর আইডেন্টিটিতে অনেক বড় একটা কোয়েশ্চন মার্ক আছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা খু*ন হয়েছে, যার সবাই তোদের পরিচিত মানুষ। সেই
সন্দেহ থেকেই তরীর প্রতি সংশয় চলে আসে আমার মনে। খোঁজ নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারি আমি। আর এটাও জানতে পারি যে, তরী-ই তোর চাঁদ!”

প্রহরের অকপট স্বীকারোক্তি শুনে সৌহার্দ্য চমকালো। বি*স্ফো*রিত চোখে তাকিয়ে বললো,

-“তুই তাহলে আগে থেকেই জানতি সবটা? এজন্যই সারাদিন আমাকে ঘুরিয়েছিস? তাহলে একটু আগে এতো অবাক হলি যে! নাটক ছিল সবটা?”

সৌহার্দ্যের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহর কিটকিটিয়ে হেসে দিলো। বললো,

-“তোকে বোকা বানাতে আমার বরাবরই ভাল্লাগে। সবটাই জানি। ইনভেস্টিগেটর আমি। সব খোঁজ খবর রাখতে হয়।”

-“তাহলে আমাকে বললি না কেন? জানিস, প্রথম দিকে তরীর সাথে কতটা রুড বিহেভ করেছি আমি? যদিও ঐটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তোর আমাকে জানানো উচিত ছিল!”

-“তোকে কেন জানাবো? তুই জেনে কী করবি? এখন বললাম কারণ তুই তো সব জেনেই গিয়েছিস! এখন আর লুকিয়ে কী লাভ? আর তাছাড়া আমি তো জানতাম তুই অরুণীকে ভালোবাসিস! ছোটবেলার ঐ চাঁদ-টাদ ভুলে উড়িয়ে দিয়েছিস। বাই দ্য ওয়ে, অরুণীর ভুত তোর ঘাড় থেকে নামলো কী করে সেটা আমাকে বল?”

প্রহর সন্দিগ্ধ ও প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সৌহার্দ্য প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো,

-“অরুণীর প্রসঙ্গ এখানে এলো কোথা থেকে? ওর বিষয় নিয়ে কিছু বলতে বা শুনতে আসিনি আমি। সো, অফ-টপিক কথাবার্তা বলে টাইম ওয়েস্ট করিস না!”

-“রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা, যা! অরুণীর টপিক বাদ। কাজের কথায় আসি। তুই যে ঐ বাড়ির গার্ডের সাথে কথা বলতে চাইছিস, সেটার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আমি। যদি বেঁচে থেকে থাকে এখনো, তাহলে খুঁজে বের করতে দুই-তিনদিন লাগবে। আচ্ছা, আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলবি?”

সৌহার্দ্য প্রহরের অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গি দেখে ভ্রু কুঁচকালো। বললো,

-“এভাবে বলার কী আছে? তোকে মিথ্যে বলবো কেন আমি?”

-“তোর চেম্বারে যেদিন খু*নটা হলো, ঐ দিন তরী সত্যিই তোর সাথে ছিল?”

-“এগেইন! তুই আবার তরীকে সন্দেহ করছিস? তোকে বলেছি না? তরী এট-লিস্ট কোনো খু*ন-টুন করতে পারে না! আর ও আমার চাঁদ। ওকে নিয়ে অহেতুক কোনো সন্দেহ মনে পুষিস না। ওর দিকে আঙুল তুললে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না। ইভেন তোকেও না!”

সৌহার্দ্য রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল। প্রহর ওকে পেছন ডেকে বললো,

-“সৌহার্দ্য, দাঁড়া! আরে ডিনারটা তো করে যা, ইয়ার!!”

সৌহার্দ্য শুনলো না। দ্রুতপদে চলে গেল বাসা থেকে। প্রহর আর এগোলো না। নিজের বেডরুমে এসে বেডের পাশের দেয়াল ঢেকে রাখা চাদরটাকে এক টানে সরিয়ে ফেললো। সাথে সাথে দৃশ্যমান হলো মধুর প্রাণবন্ত হাসির এক বিশাল আকৃতির ক্যান্ডিড। প্রহর ছবিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে মধুর খোলা উড়ন্ত চুলে হাত বুলালো। হঠাৎ একটা কল এলো প্রহরের ফোনে। ওপাশ থেকে কিছু শুনে প্রহর দ্রুত গতিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

মধু টিউশন পড়িয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলো। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো নয়টার ওপরে বেজে গেছে আজকে। তাড়াতাড়ি খোলাচুল গুলো পেছনে ঠেলে হেলমেট পরে নিয়ে স্কুটার স্টার্ট দিলো। মনে মনে বিরক্তি নিয়ে নিজেই নিজেকে বললো,

-“উফ! এতোগুলো পড়া বাকি!! আজও রাত জাগতে হবে, বুঝতে পারছি।”

মধু ঝড়ের গতিতে স্কুটার চালাচ্ছে। হোস্টেলের গলিতে ঢুকতেই মধুর পেছনে দুটো বাইক ধাওয়া করা শুরু করলো।

কয়েক মুহুর্ত পর মধু বুঝতে পারলো যে, বাইক দুটো ওকে ফলো করছে। কারণ ওরা ঠিক মধুর পিছু পিছু আসছে। মধু কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। দুই বাইকে মোট চার-পাঁচ জন আর এদিকে ও একা। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ছে বারবার। মধু স্কুটারের স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। বাইক দুটো তীব্র গতিতে ওর দুই পাশে চলে এলো।

-“আজই তোমার শেষ দিন! তোমাকে যে ম*রতেই হবে আমাদের হাতে!”

বাইকে থাকা ছেলেগুলো কথাটা বলে শব্দ করে হাসতে লাগলো। রাস্তা পুরো ফাঁকা হওয়ায় মধু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“আমাকে মা*রবি? শা*লা কা*পু*রু*ষের দল! সামনাসামনি আঘাত করার সাহস নেই বলেই পেছন থেকে হাম*লা করতে চাস। আজ যদি তোদের ভাগে আনতে পারি না? জাস্ট বাপের নাম ভুলিয়ে দিবো।”

ছেলেগুলো ওর সামনে বাইক থামালো। বাইক থেকে নামার প্রস্তুতি নিতেই ওদের সামনে পুলিশ ফোর্সের গাড়ি গিয়ে থামলো। পুলিশের গাড়ির হেড লাইট দেখে ওরা ঝড়ের বেগে বাইক নিয়ে চলে গেল। পুলিশের গাড়ির পেছনেই প্রহরের গাড়ি থামলো। প্রহর হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে একবারে পুলিশ ফোর্স, আরো একবার মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“অল ওকে? কোনো ঝামেলা করতে পারেনি তো ওরা?”

-“ওরা পালিয়ে গেছে, মিস্টার শাহরিয়ার! চেষ্টা করেছিলাম ওদের ধরার। কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। ওরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে।”

পুলিশ প্রহরকে আশ্বস্ত করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মধু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে প্রহরের মুখের দিকে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,

-“আপনি আমাকে ফলো করছিলেন?”

প্রহর মলিন হেসে বললো,

-“আর যা-ই হোক, তোমার ক্ষতি তো আর হতে দিতে পারিনা! এজন্যই তোমায় ফলো করেছি, খোঁজ রেখেছি।”

-“তোর এইসব মিষ্টি কথায় আমি কোনোদিনও ভুলবো না। আর ক্ষতি?আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো তুই করেছিস! ভুলিনি আমি কিছু-ই!

মধু দ্রুততার সাথে স্কুটার নিয়ে চলে গেল। প্রহর ওর যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।

২৯.
সৌহার্দ্য তার বাড়ি ফিরলো রাত এগারোটার দিকে। এতো রাত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রহরের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ইমার্জেন্সি পেশেন্ট দেখার তাগাদা পড়ায় বাড়ি ফিরতে এতো দেরি হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে সৌহার্দ্য অবাক হলো। কারণ পুরো ঘর অন্ধকার। তরীর কোনো খোঁজ নেই। সৌহার্দ্য কয়েক বার তরীর নাম ধরে ডাকলো। কিন্তু তরীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সৌহার্দ্য এবার জোরে জোরে সুজাতাকে ডাকা শুরু করে দিলো।

-“মা! মা!! কোথায় তুমি? এখানে এসো তাড়াতাড়ি! ”

সুজাতা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সৌহার্দ্যের কাছে এসে বললো,

-“কী হয়েছে? বল! কাজ করছিলাম আমি। আর তুই চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছিস! কী হয়েছেটা কী?”

-“তরী কোথায়?”

-“তরী তো ওর বাবার বাসায় গেছে! ওর বাবা নাকি ওকে ডেকেছে। ড্রাইভার দিয়ে এসেছে ওকে ওর বাড়িতে। ওখানে থাকবে নাকি কয়েকদিন!

সৌহার্দ্য ওর মায়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-“আমাকে কিছু না জানিয়ে তরী চলে গেল? আর তুমি ওকে যেতে দিলে? আমাকে না জানিয়ে কেন গিয়েছে ও? তুমি তো অন্তত আমাকে একবার জানাতে পারতে! ডিজগাস্টিং!! ”

সৌহার্দ্য যে কাপড়ে ঘরে ঢুকেছিল, সেই কাপড়েই বেরিয়ে গেল। শুধু হাতে থাকা এপ্রোন ও স্টেথোস্কোপটা ফেলে গেল। সুজাতা পেছন থেকে ডাকলেও শুনলো। তিনি অবাক হয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। বুঝতে পারলেন না, তার ছেলে তরীর প্রতি এতো পজেসিভ কবে থেকে হলো!

সৌহার্দ্য যখন তরীদের বাসায় পৌঁছালো, তখন তরীদের বাড়ির গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দারোয়ান চেয়ারে বসে বসে নাক ডাকছে। সৌহার্দ্য গেইটের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে দারোয়ানকে ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘুম ভাঙালো। দারোয়ান হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্যকে দেখে চিনতে পেরে গেইট খুলে দিলো। সৌহার্দ্য তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকে তৃতীয় তলায় চলে গেল সিড়ি বেয়েই।

সৌহার্দ্য কলিং বেল বাজানোর সময় খেয়াল করলো মেইন দরজা খোলা-ই আছে। এতো রাতে দরজা খোলা দেখে সৌহার্দ্য অবাক হলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে তরীকে বসে থাকতে দেখলো। কিন্তু তরীকে কিছু বলার আগেই ওর কানে ভেসে উঠলো,

-“তোর বড় তোকে সত্যি সত্যি মেনে নিয়েছে, তরী? তুই আমাকে না জানিয়ে কেন বিয়ে করলি? তোর বিয়ে তো আমার সাথে হওয়ার কথা ছিল!”

-চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে