নোংরামি 1

0
6255

নোংরামি

মাথাটা পুরাই ব্লাংক হয়ে গেছে রিমা’র! নিজের স্বামীর সম্পর্কে গত কয়েকদিন যাবত এতকিছু ভেবে ভেবে ক্লান্ত হলেও মেনে নিতে মন চাইছিল না সত্যি সত্যি মারুফ এমন কিছু করবে!

দুই সন্তানের মা রিমা, বড় ছেলে মানাফ আর ছোট মেয়ে মানহা কে নিয়ে ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের, কিন্ত কিভাবে এমন হলো, কি অন্যায় ছিল তার? বিয়ের পর সবকিছু মেনে নিয়ে ঠিকই কেটে যাচ্ছিল দিন, শুধুমাত্র কেটে যাচ্ছিল বললে ভুল হবে বেশ ভালোই,,, না না অতি সুখেই কাটছিল দিন, কোন অভাব নেই, অভিযোগ নেই,
তার উপর সুখের নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে সদ্য কেনা নতুন গাড়িটি, আগে শ্বশুর বাড়ি যেতে খুব কষ্ট হত রিমার, এক কথায় লোকাল বাসে জার্নি করতে খুব অসহ্য লাগত তার, ও হ্যাঁ তার আগে বলে নেই রিমাদের ঠিকানা কোথায়,
শেরপুর, ময়মনসিংহ এ মারুফ দের বাড়ি, আর রিমাদের বাড়ি ময়মনসিংহ সদরেই,তারা আপন খালাতো ভাই বোন, সদ্য কিশোরী পেরিয়ে যৌবতী রিমা কিভাবে যেন তার থেকেও বারো বছর বয়সী খালাতো ভাই মারুফের প্রেমে পড়েছিল মনে নেই তবে মনের কোণে আজ অবধি মারুফ ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারেনা সে, কিন্ত বিয়ের সময় তার মামা ও বড় দুই ভাইয়ের কেউ যে রাজি ছিলনা তা আজকের এই অবস্থায় বারবার মনে পড়ছে, অথচ সে এই মানুষ টার জন্য হ্যাঁ এই মানুষ রুপী অমানুষ কে বিয়ে করার জন্য তার বড় ভাইয়ের পা ধরে কেঁদেছিল! ভাবতে ভাবতে রিমার চোখের কোণে পানি এসে গেল,,,

ভাবনায় ছেদ পড়ল তার দশ বছর বয়সী ছেলে মানাফ এর ডাক শুনে, এই বছর নভেম্বর এ পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে সে,এখন ক্লাস সিক্সে ভালো কোন স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্ত গত কয়েকদিনের পারিবারিক কলহে সে কতটুকু পড়া কমপ্লিট করেছে তার কোনই খোঁজ নিতে পারছেনা রিমা, কিভাবেই বা পারবে! যেখানে তার স্বামী তাকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে অন্য মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! সংসার সন্তান সবকিছু অসহ্য লাগছে তার!

এইতো সেদিন, মানে গত মাসের প্রথম দিকে সেই মেয়ে সরি, আসলে মেয়ে বললে ভুল হবে সেই মহিলা কে নিয়ে মারুফ এসেছিল এই বাসায়, সাথে ছিল মহিলার আট বছর বয়সী এক মেয়ে, মারুফের গাড়ির ব্যবসা, বিদেশ থেকে এস্কাভেটর গাড়ি নিয়ে এসে দেশে বিক্রি করে, দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় খুব সহজেই এই ব্যবসা শুরু করেছে সে, সেই সুবাদে অনেকেই আসে এই বাসায়, রিমাও আতিথেয়তার কমতি রাখেনা, যদিওবা ছেলের সমাপনী পরীক্ষা সামনে ছিল তবুও রিমা এক হাতে প্রায় আট পদের রেসিপি রান্না করে খাইয়েছিল তাকে, আহা! সেদিনও যদি বুঝত এই ডাইনি তার সুখের সংসার তছনছ করে দেবে তাহলে সেইদিন ই বিষ খাইয়ে মারত তাকে! কিন্ত এক হাতে তো তালি বাজেনা! মারুফ এর উপর প্রচণ্ড অভিমান হলো…

সংসার জীবনের প্রায় পনের বছর পার হবার পর তার মনে হচ্ছে এতদিন কি করে এসেছে! কার জন্য এসব করেছে! হিসেবের খাতায় সব শুন্য! সবকিছু! এখন সব চিন্তাধারা খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে, ঘটনার শুরু আসলে আজ থেকেও ছয় বছর আগে,তখনো একবার সন্দেহ হয়েছিল কিন্ত নিজের স্বামী কে সে অনেক বিশ্বাস করে বলেই মনে কোনপ্রকার সন্দেহের প্রশ্রয় দেয়নি,তাছাড়া শারীরিক চাহিদা পূরণে মারুফ সবসময় ই রিমার কাছে স্বপ্নপুরুষ, আর টাকা পয়সার দিক থেকেও রিমা যখন যা চেয়েছে, তার চেয়ে বরং বেশিই পেয়েছে, আর উপরওয়ালা র ইচ্ছায় এক ছেলে আর এক মেয়ের মা সে, আর কি চাই জীবনে! শুধুমাত্র গত তিন বছর আগে মা মারা যাবার পর রিমা প্রচণ্ড শক পেয়েছিল, বিয়ের সময় পরিবারের আর কারো সম্মতি না থাকলেও একমাত্র তার মা ই রাজী ছিল, শুধু কি তাই? দুইটা সন্তান হবার পর তার মা নিজে নাতি নাতনির জন্য জান দিয়ে সব করেছে, সন্তান একহাতে মানুষ করার কষ্ট বলতে গেলে রিমা বুঝতেই পারেনি!

আজও ছেলে মানাফ যখন জিজ্ঞেস করছিল –“মা কাঁদছো কেন?? ” সে তার ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে শুধু বলল তোর নানী র কথা খুব মনে পড়েছে রে বাবা…. আর কিছু বলতে পারলোনা, কিন্ত মানাফ জানে তার মা তাকে মিথ্যে বলছে,, গতকাল রাতে বাবা মার ঝগড়া র সব কথা শুনেছে সে, বাবার প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা জন্মেছে এই কয়েকদিনে!

সপ্তাহ খানেক আগে সদ্য চায়না ফেরত মারুফের ব্যাগ সার্চ করতে গিয়ে একটা বোতল খুঁজে পায় রিমা, ব্যবসার কাজে প্রায়শই দেশের বাইরে যেতে হয় মারুফ কে, দেশে ফেরার সময় এক ব্যাগ ভর্তি চকোলেট,কসমেটিক্স, মেকাপ আইটেম ছাড়াও অনেক কিছু নিয়ে আসে সে,, এর মধ্যে কিছুকিছু জিনিস আছে যা রিমা নিজেও জানেনা কোথায় কিভাবে ইউজ করতে হয়,বিশেষ করে মেকাপ আইটেম গুলো! বেশিরভাগ ই তার কাছের আত্নীয় স্বজন ছাড়াও আশেপাশে র প্রতিবেশী ভাবী দের গিফট করে সে, প্রচণ্ড ভালো লাগে তার,নিজের ভেতর একপ্রকার গর্বভাব কাজ করে কিন্ত এই বোতল দেখতে বেশ ভিন্ন, কি সব চাইনিজ ভাষায় লেখা, ইংরেজিতে লেখা থাকলেও হয়ত বুঝত সে, হাজার হলেও রিমা একসময় খুব ভালো ছাত্রী ছিল, ফার্স্ট হতে না পারলেও রোল সবসময় দুই হত তার, ক্লাস এইটে বাবা মারা যায়, অনেকেই তখন রিমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল কিন্ত রিমার মা আর ভাইদের ইচ্ছা একমাত্র বোনকে পড়ানোর, এস.এস. সি পাস করার পর ডিপ্লোমা নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয় সে,, এর মাঝে দেশের বাইরে থেকে ফেরত আসা মারুফ কে দেখে ভালোলাগা একসময় ভালোবাসায় রুপ নেয়, মারুফের দেয়া বিদেশি উপহার সামগ্রীর মাঝে ছোট্ট চিরকুট হয়ত অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে সেইক্ষেত্রে, কত রাত সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে সেই চিরকুট পড়েছে সে আর লজ্জায় কুটিকুটি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই,,,

কাছের বান্ধবী শায়লা অবশ্য আগেই হুশিয়ারি দিয়েছিল, বিদেশ ফেরত ছেলেদের একশটা মেয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে, একটাতে পোষায় না তাদের, কথাটা একেবারে ঠাশ করে গালে চড় মারার মত অপমানজনক বলে মনে হয়েছিল রিমার, কিন্ত মনের ভাবকে অপ্রকাশিত রেখে খুব দাম্ভিকের সাথে বলেছিল, আমার মারুফ এমন নয়,,,, সেদিনের পর থেকে ধীরেধীরে শায়লার সান্নিধ্য ত্যাগ করেছিল রিমা, এমনকি শায়লা কে বিয়ের দাওয়াত পর্যন্ত দেয়নি, হায়! আজ সেই কথাই সত্যি হলো!

আরে এইটা ছেলেদের জিনিস! সাবির ভাই অর্ডার করেছিল তাই নিয়ে এসেছি, একরকম চোরা হাসি খেলে যায় মারুফের চোখেমুখে, তারপরও রিমা নাছোড়বান্দা, অবশেষে বুঝতে পারে এইটা পেনিস এনলার্জমেন্ট সিরাম, লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে,,

কিন্ত না, এখন সব অংক মিলে যাচ্ছে, জীবনের কিছুকিছু অংক না মিললেই বরং বেশি সুখে থাকে মানুষ, গত সপ্তাহে ছেলে কে কোচিং এ দিতে যাবার সময় রিমা দেখে তিন্নি নামের সেই মহিলা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে, রিমা মারুফ কে বলে দাঁড়াও দাঁড়াও! তিন্নি আপা সামনে, মারুফ একটু বিরক্তি সূচক শব্দ করে গাড়ি থামায়, গত দুই মাস যাবত বিশ্বস্ত কোন ড্রাইভার খুঁজে না পাওয়ায় নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে মারুফ,দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিল, সেখানে মাঝেমাঝে ই গাড়ি ড্রাইভ করতে হত মারুফ কে,, গাড়ির জানালা নামিয়ে রিমা তিন্নি কে একপ্রকার জোরে করেই বলে, আপা আপনি এইখানে? কই যাবেন?? আসেন গাড়িতে… না না আমি সামনেই যাব, টাউনহল মোড়ে, এইখানে একটা কাজে এসেছিলাম, আপনারা যান বলে না সূচক সম্মতি জানায় তিন্নি,

কিন্ত কথায় আছেনা, চোরের দশদিন তো সাধুর একদিন, সেইদিন কি ভেবে ছেলেকে কোচিং এ দিয়ে ভাবল যে বিছানার চাদর কিনতে যাবে, জ্যাম দেখে রিকসাও নিলোনা রিমা! চার বছরের মেয়ে মানহা কে নিয়ে হেটেই যাচ্ছিল কিন্ত হঠাৎ চোখ গেল টঙ ঘরের দিকে,, তিন্নি আপা! আর তার পতিদেব মারুফ! একদম মুখোমুখি হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে! এতটা কাছে!যতটা কাছে আসলে একজন আরেকজনের নিশ্বাস এর বাতাস অনুভব করা যায়! আশেপাশে র এত এত পুরুষ মানুষের মাঝে দৃশ্যটা খুব বেমানান, তারপরও দুজনের কোন খেয়ালই নেই, যেন দুজন দুজনের চোখের গভীরে হারিয়ে গেছে! কিন্ত রিমার মনে হচ্ছিল, এ কি দেখলো সে? কেন মাটি দুই ভাগ হয়ে গেলনা! মাথা ঘুরছে তার, কোনরকম নিজেকে সামলে নিল, তার দুনিয়ার সব কিছু অন্ধকার লাগছে…

বাসায় আসতে আসতে হিসাব কষে সে,তারমানে আজ মানাফ কে গাড়িতে করে কোচিং এ না নিয়ে গেলে নির্ঘাত ঐ মহিলা তার স্বামীর সহযাত্রী হত! আর হ্যাঁ,এইত মনে পড়ছে! সেদিন মহিলার বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কসমেটিক্স গুলো দেখে চেনাচেনা লাগছিল, এইগুলো তো নিজের হাতে ব্যাগে গুছিয়ে দিয়েছিল রিমা, মারুফ বলেছিল, ব্যবসার খাতিরে ক্লায়েন্টদের হাতে রাখার জন্য তাদের বৌ কে এইটাসেইটা গিফট করতে হয়,, এই কাজ সে আগেও করেছে, রিমাও জানে, কিন্ত এখন বুঝতে পারছে সব, কিভাবে পারল সে?

জীবনটা বাংলা সিনেমা নয় যে, শাবানার মত সেলাই মেশিনে কাজ করতে করতে একদিন গার্মেন্টস এর মালিক হয়ে যাবে, কিন্ত বাপ মা মরা, দুই সন্তানের মা, ছত্রিশ বছর বয়সি রিমা কি করবে?? অথচ এই মারুফ ই একদিন বলেছিল তোমাকে কি কোন কিছুর অভাবে রেখেছি? তার কথা শুনে প্রচণ্ড খারাপ লাগলেও সরকারি নার্সিং জবের অফারটা ফিরিয়ে দিয়েছিল সেদিন, মারুফ সেদিন অনেক আদর এঁকে দিয়েছিল শরীরে যার ফলশ্রুতিতে মেয়ে মানহার জন্ম, সবকিছু বিবেচনা করে চাকরির বিষয়টা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল,,,

আসলেই তো! তিনটা বড় বেডরুম, কিচেন আর বিশাল ডাইনিং ড্রয়িং রুমের একচ্ছত্র কেয়ারটেকার রিমার কি কোন কিছুর অভাব আছে? মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের সুখ গুলো খুব সস্তা জিনিসের চাদরে মোড়া থাকে, কিন্ত সস্তায় পাওয়া ভালোবাসা কে কেউ অবহেলা করলে আর যাই হোক মেনে নিতে পারেনা কেউ, নিজের স্বামীর ভাগ অন্য কোন নারীকে দিতে চায় কয়জনা!

কিন্ত তিন্নি নিজেও তো বিবাহিত! সে কি করে পারলো! মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের ঘরে আগুন লাগাইতে! আচ্ছা, এই মহিলার স্বামী কি জানে এইসব?

আজ সকালে বের হয়ে যাবার পর বেশ কয়েকবার কল করে রিমা, নাহ ধরছেনা মারুফ! গতরাতের ঝগড়ায় রিমা খুব বেশি ই চিৎকার করেছিল, সেইসাথে তিন্নি কে গালিগালাজ ও, কিন্ত সকাল হতেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, নাহ! যে করেই হোক স্বামী কে ফেরাতে হবে এই নোংরামির খেলা থেকে… এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে,আশেপাশের কেউ জেনে গেলে মান সম্মান থাকবেনা, একটা সময় রিমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলনা,বছর তিন আগে থেকে ব্যবসাটা বেশ ভালো চলছে, টাকাপয়সাও হয়েছে অনেক, চেনাজানা লোকের সংখ্যাও বেড়েছে,, হাজার হোক টাকাপয়সা থাকলে শুভাকাঙ্ক্ষীদের অভাব হয়না,,আজই যাবে সে তিন্নির বাসায়,,,আজ সন্ধ্যা মারুফের চায়না যাবার ফ্লাইট,,, এই সুযোগ!

কোনরকম নাস্তা করে ছেলেকে কোচিং এ পাঠিয়ে দিল সে, গ্যারেজের ম্যানেজার শিপলুকে কল দিলো ,তার কাছ থেকে তিন্নির মোবাইল নম্বর নিয়ে মেয়ে মানহা কে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল তিন্নির বাসার উদ্দেশ্যে,,,

রিমা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে কিভাবে কথা শুরু করবে, প্রয়োজনে তিন্নির হাতেপায়ে ধরবে,,, এইসব ক্ষেত্রে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে,,, ক্রাইম পেট্রোলে দেখেছে সে, কিভাবে এইসব নোংরামির বলি হয় স্ত্রী সন্তান,, নাহ সে ভাবতে পারছেনা! রিকসা থেকে নেমে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল দিতে যাবে কিন্ত একি?

(চলবে…..)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে