#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
রাতের খাবারটা নিজ হাতে খাওয়ার মতো অবস্থা রইল না সেতুর হাতের।কাঁটা হাতের যন্ত্রনাই ক্ষিধে নেই বলেই কোনভাবে বেঁচে গেল।নীরু খাবার টেবিলে থাকলে হয়তো জেদ দেখিয়ে খাবার খাওয়ানোর জন্য রাজি করাত।কিন্তু নীরুও জ্বরের কবলে ঘুমিয়ে আছে।শ্বাশুড়ি বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই আর কিছু বলল না।নিষাদও বিশেষ আগ্রহ দেখাল না।সেতু যেন বিনা কৈফিয়তেই বেঁচে গেল।খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সবাই ঘরে গেল।সেতু বিছানার পাশে বসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই নিষাদ গমগমে সুরে বলে উঠল,
” তুমি না নিজের যত্ন নিতে পারো সেতু?তবে?”
সেতু চোখ তুলে চাইল।বলল,
” মানে?”
নিষাদ গম্ভীরভাবেই বলল,
” খাবার না খেয়ে নিজের যত্ন নিলে কিভাবে?”
” ক্ষিধে না থাকলে কি জোর করে খাব?জোর করে খেলেই বুঝি যত্ন নেওয়া হতো?কি আশ্চর্য!”
নিষাদ মুখ টানটান করল।ভরাট কন্ঠে শীতল রাগ মিশিয়ে বলল,
” চুপচাপ উঠে চেয়ার টেনে বসো। ”
সেতু বুঝল না।বলল,
” কেন?”
” বলছি তাই।”
কথাটা বলেই নিষাদ আর দাঁড়াল না।পা ফেলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।সেতু চুপচাপ তা দেখল।কিয়ৎক্ষন পরই নিষাদ ফিরে আসল আবারও।হাতে থালাভর্তি খাবার।সেতু কপাল কুঁচকাল।আগের মতোই বসে থেকে শুধাল,
” এসব কি?বললাম তো ক্ষিধে নেই।শুনেননি আপনি?”
নিষাদ সেতুর কথার জবাব দিল না।চাপস্বরে রাগ সমেত বলে উঠল,
” বললাম না চেয়ার টেনে বসতে?কথা কি শুনতে পাওনি তুমি?”
সেতু দমে গেল।নিষাদের কথার বিনিময়ে কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসে নিষাদের দিকে তাকাতেই নিষাদ বলল,
” এইবার ঠিক আছে।”
কথাটা বলে সেও বসল পাশে চেয়ার টেনে। নিজের হাতে সেতুর মুখে খাবার এগিয় দিয়েই বলল,
” চুপচাপ খেয়ে নিবে সেতু।”
সেতু চুপচাপ হা করল।নিষাদ আবারও বলল,
” তুমি মানে আমি,আমি মানে তুমি এমন একটা সম্পর্ক চেয়েছিলাম আমি সেতু।যেখানে তোমার সব কথা আমি জানব, আমার সব কথা তুমি জানবে।স্বামী -স্ত্রী হবে একে অপরের পরিপূরক, একে অপরের বন্ধু।এমনটাই কি নয়?”
সেতু স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে রইল।খাবার চিবুতে চিবুতেই বলল,
“হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?”
” আমি কি সত্যিই তোমার মনে জায়গা করে উঠতে পেরেছি সেতু?”
সেতু চমকে তাকাল।নিষাদ মৃদু হেসে আবারও বলতে লাগল,
” আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কে কোন আড়াল থাকবে না সেতু।তোমার সবটা যেমন আমি জানব, তেমনই আমার সবটাও জানার অধিকার তোমার থাকবে।আমি চেয়েছিলাম আমাদের মাঝে কারোরই কোন সংকোচ না থাকুক এই সম্পর্কে।আমার সমস্যায় তুমি যেমন ঢাল হয়ে থাকবে তেমনই তোমার সমস্যায় আমি থাকব।তবে এত সংকোচ কেন সেতু?এত আড়াল কেন?এত সংকোচ, এত আড়াল নিয়ে কি একটা পুরো জীবন সংসার করা যায় সেতু?”
সেতু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বলার মতো খুঁজে পেল ও না কিছু।চুপচাপ নিষাদের হাতে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।তারপর বলল,
” আপনি আমার সকল সংকোচ বুঝে নিতে পারেন নিষাদ, সকল আড়াল ভেদ করতে পারেন।আপনি আমায় অনেকটুকুই বুঝেন।তাই নিজেকে আর খোলা বইয়ের মতো মেলে ধরে আপনার সামনে বুঝিয়ে উঠতে পারি না নিষাদ।”
নিষাদ মানল না এই উত্তর। ত্যাড়া চাহনীতে তাকাল সেতুর দিকে।বলল,
” হ্যাঁ, আমি তো সবজান্তা! আমি তো মাল্টিট্যালেন্ট যে কোন বই না মেলেই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তু বুঝে যাব।তাই না?শোন মেয়ে, আমি কোনকালেই অতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলাম না যে বই না খুলেই সব বুঝে ফেলব।”
সেতু হালকা হেসে জবাব দিল,
” কিন্তু আপনি তো ভালোবাসার ক্ষেত্রে শুধু ব্রিলিয়ান্ট না সুপার ট্যালেন্ট ছাত্র!”
” তবে তো আমার উচিত ভালোবাসার একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।যেখানে আমি হবো ভালোবাসা সাবজেক্টের শিক্ষক।ছাত্রছাত্রীদের বসে বসে ভালোবাসা কাহাকে বলে, ভালোবাসা কি,ভালোবাসায় কি কি হতে পারে সব বুঝাব।তাই না?”
সেতু নিঃশব্দেই চমৎকার হাসল।মুখ চেপে বলল,
“সুন্দর হবে নিষাদ।আমি অপেক্ষায় রইলাম।”
নিষাদ গম্ভীরভাবে বলল,
” সত্যিই বলছি সেতু।এসব আড়াল, সংকোচ আমার কাছে ভালো লাগে না।তোমাকে সর্বপ্রথম আমাকে আপন ভাবতে হবে, ভালোবাসতে হবে, সব আড়াল আর সংকোচের অবসান ঘটাতে হবে।তোমার সব সমস্যার কথা আমায় জানাতে হবে।দুঃসময়ে পাশে থাকতে দিতে হবে।যত্ন করার সুযোগ দিতে হবে।নাহলে সত্যি সত্যিই আঁছাড় মেরে তোমায় রাস্তায় ফেলে চলে আসব। বলে রাখলাম।”
সেতু শেষের কথায় অবাক না হয়ে হেসে দিল। নিষাদ তাকাল গহীন চাহনীতে।কি সুন্দর মিষ্টি হাসি!ঠোঁট চওড়া করে বলল,
” ওভাবে হাসবে না সেতু।”
” হাসলে?”
নিষাদের ঠোঁটের হাসি গাঢ় হলো। জবাবে সাংঘাতিক ভঙ্গিতে বলল,
” মে’রে দিব একদম!”
” সত্যি?”
” না, মিথ্যে।”
কথাটা বলে আর ফিরে চাইল না নিষাদ।আলো নিভিয়ে দ্রুত বিছানায় অন্যপাশ ফিরে শুঁয়ে পড়ল।
.
হঠাৎ ঐ মধ্যরাতে মোবাইলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীরুর।জ্বরে জুবুথুবু শরীর নিয়ে তখনই ঘুম দিয়েছিল।এতক্ষনের শান্তির ঘুমটার বারোটা বাঁজানোর জন্য মোবাইলের অন্য পাশের ব্যাক্তিটাকে মনে মনে কয়েকটা কথা শোনাল।মেজাজ খারাপ করে কপাল কুঁচকাল।তারপরই মোবাইল হাতে তুলল।ততক্ষনে কল কেঁটে গিয়েছে।নীরু তাকিয়ে রইল মোবাইলের স্ক্রিনে।পুনরায় কল আসতেই থমকে তাকাল।রঙ্গনের নাম্বারটা মুঁছে দিলেও এখনও প্রত্যেকটা সংখ্যাই মনে আছে তার।কাঁপা হাতে কলটা রিসিভড করেই কানের সামনে ধরল।ঘুমুঘুমু স্বরে নিজের খারাপ গলা নিয়ে সেই প্রথম বলে উঠল,
” নমস্কার গাঁধা, কেমন আছো?”
রঙ্গন খুশি হলো না নীরুর কথায়।প্রথম দিয়ে নমস্কার বলে সম্মান দেখিয়ে পরে দিয়ে গাঁধা বলে আবারও অপমান করে দিল।রঙ্গন গলা ঝাড়ল।ব্যস্ততা নিয়ে বলে উঠল,
” যাক তোকে অন্তত পাওয়া গেল।তোর ভাই তো লাপাত্তা সে কবে থেকে!”
নীরু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” লাপাত্তা?লাপাত্তা হবে কেন?ও তো ওর রুমেই ছিল দেখেছিলাম।”
” তাহলে কল তুলছে না কেন তোর ভাই?তোর ভাইয়ের বোনকে কি চুরি করে তুলে এনেছি?হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ার কারণ কি কিছুই তো বুঝলাম না।”
” গরুর বরাবরই অভিমান বেশি।হয়তো তুমি ও কিছু করেছো, যার কারণে কল তুলছে না। আই ডোন্ট শিউর,তবে মেবি তুমি বিয়ের বিষয়টা জানাওনি বলেই ও কষ্ট পেয়েছে।”
” কষ্ট পেয়েছে?ও কি তবে আশীর্বাদের অনুষ্ঠানে আসবে না?কি আশ্চর্য!মা বারবার বলছে ও যাতে আসে।”
নীরুর হঠাৎ মন খারাপ হলো।কিয়ৎক্ষন চুপ রইল।তারপর বলল,
” আমি সকালে ওর সাথে তোমার কথা বলিয়ে দিব।হবে না?”
রঙ্গন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” তোর গলা এমন ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো শোনাচ্ছে কেন নীরু?”
নীরুর মন খারাপ ভাব কেঁটে গেল মুহুর্তেই। তেঁতে উঠে বলল,
” কি বললে আমার গলাকে?ভাঙ্গা রেকর্ড?এই এক মিনিট,তুমি এত রাত পর্যন্ত জেঁগে আছো কেন?”
রঙ্গন খুশীমনে উত্তর দিল,
” তিয়াশার সাথে কথা বলেছি এতক্ষন।তারপর তোর ভাইকে কল দিলাম। কল তুলল না, তাই তোকে কল দিলাম।”
নীরু ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে বলল,
” তিয়াশা কে?”
” যেই হোক তোর তাতে কি?”
নীরু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।অন্য সময় হলে হয়তো ঝগড়া করত।কিন্তু আজ মন চাইল না।মৃদু হেসে বলল,
“আমার কিছুই না।তিয়াশা যদি অন্য কোন মেয়ে হয় তবে এই যে রাত ধরে প্রেমালাপ করার বিষয়টা তোমার বউকে জানাতে হবে না?তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
রঙ্গন আগের মতোই খুশি গলায় শুধাল,
” তিয়াশা আমার বউয়ের নামই!উল্টো ভাবে ধরলে তুই হলি অন্য মেয়ে।তোর সাথে এত রাতে কথা বলাটা বেমানান।ইশশ, আমার বউ জানলে কি ভাববে? ”
নীরু চঞ্চল গলায় বলল,
” হু, তো আমি কি বলেছিলাম আমায় কল করতে?কল রাখো দ্রুত।আর কখনো যোগাযোগ করবে না, আর এতরাতে তো একদমই নয়।মনে থাকবে?”
” থাকবে না।তুই যে এতদিন আমায় কল করে করে আমার ঘুমের বারোটা বাঁজিয়েছিস তার প্রতিশোধ নিতে হবে না?”
নীরু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দিল,
” তখন বিষয়টা একরকম ছিল।এখনকার বিষয়টা আরেকরকম।তোমার বউ যদি জানতে পারে অন্য একটা মেয়ের সাথে তুমি কথা বিষয়টা বিচ্ছিরি দেখাবে।তোমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।তাই না?আর তাছাড়া আমি তো তোমার মতো স্বার্থপর নই যে নিজের স্বার্থের কারণে কারো কথায় মজা লুটব বলে কল তুলব। আমি নিজেই তোমার কল দেখলে কল তুলব না।কাল থেকে কন্ট্যাক্ট নাম্বার চেঞ্জ করব।ভালো থেকো।”
” তুই এমন ভাব করছিস যেন তোর সাথে প্রেমালাপ করতে কল দিয়েছি?আশ্চর্য!নিষাদের কারণেই তো কল দিয়েছি।”
নীরু এবার রাগের চূড়ায় পৌঁছে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তো এই বিষয়টা সারাদিন মনে ছিল না?আশ্চর্য!তুমি যোগাযোগ করবে না আর।রাখলাম।”
কথাটা বলে মুখের ওপরই কল রাখল নীরু।চুপচাপ মোবাইলটা বন্ধ করে ছুড়ে মারল রুমের ফ্লোরে।
.
নিষাদদের বাড়িতে নিলিরা আসল দুপুরের দিকেই।সাথে ছোট নিলু।পরনের লাল টকটকে জামা।নীরু একনজর তাকিয়েই চোখ উঁচিয়ে বলল,
” কিরে নিলুপাখি, তোর দাঁত নাকি তোর সাথে আর নেই?”
নিলু মুখ ফুলাল।চুপচাপ পাশে এসে বসে বলল,
” তাতে তোমার কি?তোমার নাকি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে?একদম ভালো হয়েছে।”
নীরু মুখ কুঁচকাল।উঠে গিয়ে পা বাড়িয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতেই বলল,
” তোর যে দাঁত পড়ে গিয়েছে, এটাও ভালো হয়েছে। এবার তোর দাঁত আর উঠবে না।জীবনেও না।”
কথাটা বলেই রুমে গিয়ে সটান শুঁয়ে পড়ল।জ্বরে মাথা ব্যাথাটা বেড়েছে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল এখন দুপুর।এতক্ষনে নিশ্চয় রঙ্গনের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান শেষ বা শেষের দিকে।আচ্ছা, তার ভাই কি যাবে সে অনুষ্ঠানে?কে জানে!এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কানে আসল সেতুর কন্ঠ,
” মোবাইলটা এভাবে নিচে ফেলে রেখেছো কেন নীরু?”
নীরু সচেতন চোখে তাকাল।কাল রাতেই ফেলে রেখেছিল।আর খেয়ালই ছিল না।চোখ বন্ধ করে চঞ্চল গলায় রাগ মিশিয়ে উত্তর দিল,
” ঐ গাঁধা কল করেছিল তাই।নিজে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করে ফেলছে।আমায় কল দিবে কেন?আমার অনুভূতি সম্পর্কে জানে না সে?”
সেতু নীরুর পাশে বসল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” কষ্ট হচ্ছে নীরু?”
নীরু আগের মতোই চঞ্চল গলায় বলল,
” কষ্ট হবে কেন?তার সাথে কি আমার প্রেম ছিল?নাকি সে আমার স্বামী ছিল?”
” ভালোবাসতে তো।”
নীরু পাত্তা দিল না।বলল,
” উহ!আবেগ!আরো অনেকেই আসবে এমন।”
সেতু মলিন হাসল। বলল,
“আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে।কেঁদে নাও নীরু।এত হাসিখুশি থেকে নিজেকে এতোটা কঠোর প্রমাণ কেন করছো?”
নীরু চোখ বুঝে নিল।বলল,
” হাসিখুশি থাকলে কঠোর হয় কিভাবে?”
সেতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” যেভাবে তুমি হয়েছো।”
কথাটা বলে সেতু চলে হেল।নীরু চোখ মেলে চুপচাপ চেয়ে চেয়ে সেতুর যাওয়াটা দেখল।সত্যিই কি সে কঠোর হয়েছে?হাসিখুশি থাকলেই কি কঠোর হওয়া যায়?কিসব বলে গেল সেতু?
#চলবে…
#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_২০
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ
সকাল সকালই রঙ্গন পরিবার সমেত হাজির হলো।একপাশে তার বাবা, একপাশে তার মা।মাঝখানে সে।নিষাদ কপাল কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র সকাল সাতটা।এই অসময়ে তাদের বাসায় রঙ্গনের আসার কারণ খুঁজে পেল না।তবুও হাসল।রঙ্গনের বাবা মায়ের সাথে ভাব বিনিময় করে অল্প কথা বলল।বসার ঘরে উনাদের বসতে বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকাল।রঙ্গন বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে রইল।নিষাদ তাকাতেই দু পা এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” বন্ধু?তোর বোনের বিয়ে দিবি?”
নিষাদের কপালের ভাজ আরো গাঢ় হলো।রঙ্গনদের আসার কারণ একটু হলেও এবার বোধ হয় তার বোধগম্য হলো।দুই পা পিঁছিয়ে রঙ্গনকে বসতে বলে চলে গেল সে।নিষাদের মা এতক্ষন চুপচাপ এসব দেখছিলেন।হালকা হেসে রঙ্গনের মা বাবার সাথে কথা বলতেই রঙ্গনের মা বলে উঠল,
” আপনার মেয়ে কোথায় দিদি?”
নিষাদের মা রান্নাঘরের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল,
” মেয়ে আর বউমা রান্নাঘরেই আছে।”
রঙ্গন চোখ কপালে তুলল।অবাক হয়ে বলল,
” নীরু রান্না করা কবে শিখল আন্টি?”
নিষাদের মা রঙ্গনের দিকে তাকাল।বলল,
” না, নীরু নয়। নিলির কথা বলেছি আমি।নীরু তো ঘুমাচ্ছে।”
রঙ্গন ফিসফিস করে বলল,
” ওহ, তাই বলুন।”
রঙ্গনের কথা বুঝে উঠল না নিষাদের মা।সরু চোখে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,
“কিছু বললে রঙ্গন?তোমার না কাল আশীর্বাদের অনুষ্ঠান ছিল?সব ঠিকঠাক মিটেছে?বাড়িতে তো নিশ্চয় অনেক কাজ এখন।সামনে বিয়ে বলে কথা।এসব ফেলে হঠাৎ এখানে? ”
নিষাদের মায়ের প্রশ্নের উত্তরে রঙ্গন কিছু বলতে পারল না।আগ বাড়িয়ে রঙ্গনের মা ই জবাব দিল,
” আসলে আশীর্বাদের অনুষ্ঠানটা হয় নি দিদি।ছেলের অন্য মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।মেয়েটা আপনারই ছোট মেয়ে।আমি জানি না আপনারা রঙ্গনকে পছন্দ করবেন কিনা তবে অনেকটা অসহায়ের মতোই এসেছি আপনাদের কাছে।নীরুর জন্য কি রঙ্গন যোগ্য হবে না দিদি?”
নিষাদের মা মুহুর্তেই অবাক হলো।চোখ চকচক করে উঠল। চোখ ফিরিয়ে রঙ্গনের দিকে কিয়ৎক্ষন তাকাতেই রঙ্গন অস্বস্তিতে অন্যদিকে নজর রাখল।নিষাদের মা মিনিট দুই পরেই মুখ খুললেন।শান্ত স্বরে বললেন,
” আপনারা কি নীরুর বিয়ের কথা বলতে চাইছেন?কিন্তু নীরু কে তো আমরা এখনই বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিনি।পাত্র পছন্দ করা তো দূর, পাত্র দেখার কথাও মাথায় আসেনি।হঠাৎ এই অসময়ে এমন প্রস্তাব আশা করিনি।”
রঙ্গনের মুখ হঠাৎ ভোতা হয়ে গেল।মৃদুস্বরে বলল,
” তাহলে যখন বিয়ে দিবেন তখনই বিয়ে করব।”
রঙ্গনের আকস্মিক কথায় অবাক হলো এইবার নিষাদের মা।এতক্ষন চুপচাপ অস্বস্তিতে মাথা নত রাখা ছেলেটা হঠাৎ ই লাজলজ্জ্বার মাথা খেয়ে সবার সামনে এমন কথা বলে বসবে ভাবেননি তিনি।বললেন,
” সেটা নীরুর উপর নির্ভর করে।নীরু যদি সারাজীবন বিয়ে করবে না বলে?তাহলে আমার কিছু করার নেই।আর যদি বিয়ে করে বলেও তবে তোমাকেই করবে এই নিশ্চায়তা আমি দিতে পারব না রঙ্গন।তোমার উচিত নীরুর সাথে কথা বলা।”
রঙ্গন হতাশার সাগরে ডু্ব দিল।বসা ছেড়ে উঠেই বলল,
” নীরু কোথায় আন্টি?কথা বলব।”
” নীরু ঘুমাচ্ছে।পরে কথা বলে নিও।”
এই সোজা জবাবটা রঙ্গনের একদমই পছন্দ হলো না।মা বাবার দিকে করুণ চোখে তাকাতেই রঙ্গনের মা বলল,
” রঙ্গন কিছুদিন পর দেশের বাইরে চলে যাবে।একবার কথা বলে নিলে ক্ষতি হতো কি দিদি?একটু ডেকে দিন না।”
নিষাদের মা ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাল। দু পা বাড়িয়ে সেতুকে বলল নীরুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে। সেতু ও শ্বাশুড়ীর কথা মতো পা এগিয়ে নীরুর ঘরে গেল।হাত পা ছড়িয়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমানো মেয়েটাকে আপাদমস্তক খেয়াল করেই ডাকল,
” নীরু?তাড়াতাড়ি উঠো।”
নীরু ঘুমুঘুমু চোখে তাকাল।কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে সন্দেহী কন্ঠে বলল,
” তাড়াতাড়ি উঠব কেন সেতু দি?”
সেতু নীরুর কন্ঠ শুনে মৃদু হাসল। বলল,
” তোমার গলার দেখি খুব খারাপ অবস্থা।জ্বর নেমেছে?”
কথাটা বলেই নীরুর কপালে হাত রাখল।জ্বরটা আবারও এসেছে।কপাল কুঁচকে নিয়ে বলল,
” তোমার জ্বরটা আবারও বাড়ল।”
নীরু উঠে বসল না।আগের মতোই শুঁয়ে থেকে ঘড়িতে চোখ বুলাল।এই সাতসকালে তাকে ডেকে তুলার মানে না বুঝে বলল,
” জ্বর তো এই আসে আবার এই যায়।এবার বলো তাড়াতাড়ি উঠতে বললে কেন সেতু দি?”
” রঙ্গন দা কথা বলবে, উঠে এসো।”
নীরুর চোখ চকচক করল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল,
“আবারও কল করেছে ঐ গাঁধা?”
সেতু জবাবে বলল,
” না, বাড়িতে এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।সঙ্গে উনার মা বাবাও আছে।উঠো তাড়াতাড়ি।”
ঘটনা পুরোটা বুঝে উঠতে কিয়ৎক্ষন সময় লাগল নীরুর।উঠে বসে ঝিমঝিম করা মাথা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” গাঁধার না আশীর্বাদ হয়ে গেছে?কিসব বলছো?”
সেতু ঠোঁট চওড়া করল।বলল,
” তোমার গাঁধার নাকি অন্য মেয়েকে পছন্দ তাই আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হয় নি।আর যে মেয়েটাকে পছন্দ সেই মেয়েটা স্বয়ং তুমি। এবার দয়া করে তোমার গাঁধার সাথে সাক্ষাৎ করে উদ্ধার করো আমায়।”
নীরু মুহুর্তেই নাকোচ করল সেই প্রস্তাব।ঠোঁট উল্টে বলল,
” জীবনেও না।আমি কোন সাক্ষাৎ টাক্ষাৎ করতে পারব না।আমি ঘুমাব৷ তুমি আর কথা পেলে না ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলার জন্য?”
সেতুর চোখ ছোট ছোট হলো।দৃষ্টি অসহায় করে বলল,
” আমাকে মা পাঠিয়েছে!গিয়ে কি বলব আমি?”
নিরু চোখ বুঝে ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান ধরেই বলল,
” বলবে নীরু ঘুমাচ্ছে।এখন কথা টথা বলা পসিবল নয়।”
সেতুর মুখ চুপসে গেল।বারকয়েক বলেও নীরুকে রাজি করানো গেল না।অবশেষে উপায় না পেয়ে বেরিয়ে আসল ঘর ছেড়ে।বসার ঘরে উদ্গ্রীব হয়ে বসে থাকা মানুষগুলোকে নীরুর শেখানো কথাটাই বলে বসল।রঙ্গন মানল না কথাটা।উঠে দাঁড়িয়ে বলে বসল,
” নীরুর ঘর কোনটা?আমি গেলে বোধহয় ও ঘুম ছেড়ে উঠে যাবে।”
নিষাদের মা বাঁধা দিয়ে বললেন,
” ওর জ্বর রঙ্গন।হয়তো তাই ঘুম ছেড়ে উঠছে না।তুমি বরং পরেই কথা বলে নিও।সমস্যা কি?”
রঙ্গনের চোখ সরু হলো।করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,
” আন্টি, একবারই তো কথা বলব।আমি ওর রুমে গিয়ে কথা বলে আসছি,প্লিজ অনুমতি দিয়ে দিন।”
নিষাদের মা প্রথম দিকে গম্ভীর ভাব ধরে রাখলেও পরে কি বুঝে হালকা হাসল।সেতুর দিকে তাকিয়ে বলল,
” নীরু কি সত্যিই উঠে নি?যদি উঠে থাকে রঙ্গনকে নিয়ে যাও।বলো রঙ্গন ওর সাথে কথা বলবে।”
সেতু হালকা হাসল।রঙ্গনকে নিয়ে নীরুর ঘরের সামনে গেল।ভিড়িয়ে রাখা দরজা ঠেলে দিয়ে হালকা উঁকি দিল।বলল,
” নীরু?রঙ্গন দা এসেছে, তোমার সাথে কথা বলতে।”
নীরু আগের মতোই চোখ বুঝে রইল।কাঁথাটা গলা অব্দি টেনে বলল,
” উহ শুনেছি তো ঐ গাঁধাটা এসেছে।আমি তো বললামই কথা বলব না।তুমি গিয়ে বলোনি সেতু দি?”
সেতু উত্তর দেওয়ার আগেই রঙ্গন ইশারায় চুপ থাকতে বলল।দু পা বাড়িয়ে নীরুর ঘরে ডুকে অগোছাল রুমটার দিকে তাকাল।ছিঃ!কি বিচ্ছিরি!কোন ছেলের রুমও এর থেকে গোছাল থাকে।পড়ার টেবিলের বেহাল দশা।মনে হচ্ছে এই মাত্রই কেউ হামলা চালিয়েছে।বিছানার এপাশ ওপাশে জামাকাপড়ের ছড়াছড়ি।নীরুর মাথার বালিশটা মাথার নিচে আছে ঠিক তবে আরো একটা বালিশ ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।ড্রেসিং টেবিলের চিরুনি হতে প্রসাধনী সামগ্রী কোনকিছুই ঠিকঠাকমতো রাখা নেই।রঙ্গন কপাল কুঁচকাল।এর আগেও দুয়েকবার এই অগোছাল ঘরটা সে দেখেছে।সেই দুয়েকবারের দেখা ঘরটা যে এখনো পাল্টায়নি তা দেখে অবাক হলো না সে।চোখজোড়া সরু করে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমানোর ভান করা নীরুর দিকে চাইল।ঘরের সাথে সাথে সে নিজেও অগোছাল।চুলগুলো যেন বহুবছর আঁছড়ায়নি।চোখ বুঝে রাখা চেহারাটা সে অগোছাল চুলে সুন্দর বোধ হলো রঙ্গনের কাছে।কিয়ৎক্ষন সেই মুখের পানে তাকিয়ে থেকে গমগমে সুরে বলে উঠল,
” এক্ষুনি ঘুমের নাটক বন্ধ না করলে ঠাস করে তোর গালে একটা চ’ড় বসাব নীরু! ”
নীরু অবাক হলো।চমকে গিয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকাল।একি!রঙ্গন!আগেপিঁছে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুকনো ঢোক গিলল নীরু।শুকনো গলায় বলল,
” তুমি?তুমি কোথায় থেকে টপকালে?আমি তো সেতু দির সাথে কথা বলছিলাম।বিনা অনুমতিতে আমার ঘরে ডুকেছো কেন?”
রঙ্গন ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।বলল,
” অনুমতি তোর মায়ের থেকে নিয়ে এসেছি।আমার তোর সাথে কিছু কথা আছে নীরু।”
নীরু সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল,
” শুনব না।”
রঙ্গনের এবার রাগ হলো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” কেন শুনবি না?”
নীরু আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল এইবার।রঙ্গনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ইচ্ছে করছে না শুনতে। ”
” তোর শুনতে ইচ্ছে করা ম্যাটার না, আমার বলতে ইচ্ছে করছে। এটাই ম্যাটার করে।বুঝলি?”
নীরু মাথা এপাশ ওপাশ করে দুলিয়ে বলল,
” বুঝলাম না।”
রঙ্গন আবার রাগল।বলল,
” ফাইজলামি হচ্ছে?এক চ’ড়ে তোর আলুথালু তুলতুলে গালের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস?”
নীরু ত্যাড়া চোখে চাইল।গলা উঁচু করে চঞ্চল গলায় শুধাল,
” মে’রে দেখাও! দেখি তোমার সাহস কত।”
” তোর না জ্বর?একটু আগে জ্বরের জন্য ঘুম ছেড়ে উঠতে পারছিলি না, আর এখন এইভাবে কথা বলছিস কি করে?”
কথাটা বলেই রঙ্গন এক হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখল নীরুর কপাল। নীরু তৎক্ষনাৎ সেই হাত সরিয়ে দিল।গলায় একরাশ জেদ ঢেলে বলল,
” ছোঁবে না।”
রঙ্গন সরু চোখে বলল,
” তোর তো সত্যিই অনেক জ্বর।গলাও তো ফাঁটা বাঁশের মতো হয়েছে।”
কথাটা বলে রঙ্গন চাপা হাসল।নীরু সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
” তো?তোমার কি?আমি অসুস্থ। তোমার সাথে এই মুহুর্তে কথা বলার ইচ্ছা নাই।পরে কথা বলব।আমার গলা ব্যাথা করছে।”
রঙ্গন হার মানল।নরম গলায় বলল,
” কবে বলবি তাহলে?তোর মোবাইল ও তো বন্ধ।কাল সারাদিন কল দিয়েছিলাম।”
” কেন দিয়েছিলে?”
রঙ্গন ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।বলল,
” মন চেয়েছে তাই দিয়েছি।অসুবিধা?আজ গেলাম।এরপর কথা না বলার জন্য বাহানা দিলে সোজা তুলে নিয়ে চলে যাব।আর হ্যাঁ কল দিলে কিন্তু কল তুলবি।”
কথাটা বলে রঙ্গন পিঁছু ঘুরল।নীরু তব্দা মেরে বসে রইল।তাকে হুমকি দিয়ে গেল এই রঙ্গন?কত্ত বড় সাহস!সঙ্গে সঙ্গে রাগে মুখ লাল হলো।নাক ফুলে উঠল।
.
রাত হলো।অন্ধকার আকাশে মস্ত বড় চাঁদ।অসংখ্য তারা জ্বলমল করছে পুরো আকাশজুড়ে।চারদিকে হালকা ঠান্ডা বাতাস।আবহাওয়া গুমোট।যেন এক্ষুনিই বৃষ্টি নামবে।সেতু খাটে নীরকে দেখতে পেল না।ভ্রু জোড়া কুঁচকে পা ফেলে নীরুর ঘরে যেতেই দেখল নীর আর নিলু ঘুমিয়ে গেছে।ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দশটা।নিলিদের বাড়িতে অনুষ্ঠান।সেই উপলক্ষ্যেই নিলি আর নিষাদের মা সন্ধ্যায় রওনা হলো।নীলুকে অনেক জোর করেও নেওয়া গেল না। সেতু হালকা শ্বাস ফেলল।দুই দুটো ছোট বাচ্চা, অসুস্থ নীরু! সামলাতে পারবে তো সে?অবশেষে মৃদু স্বরে বলল,
” তুমি ও তো অসুস্থ নীরু।নিলুকে একা সামলাতে পারবে?”
নীরু মুখ কুঁচকাল।নিলুকে এক ধাক্কা দিয়ে বলল,
” এই নিলুর বাচ্চা নিলু?একদম ঘুমের মধ্যে লা’থিপাতি মারবি না।মনে থাকবে?”
ঘুমন্ত নিলু শুনলও না।সেতু হালকা হাসল।নীরুর খাট পরিষ্কার করে গুঁছিয়ে নিয়ে বলল,
” আজ নাহয় চারজন একসাথে ঘুমাই।তুমি, নিলু, আমি, নীর।জায়গা হবে না?”
নীরু এক লাফে উঠে দাঁড়াল।চোখ চকচক করছে খুশিতে। হাসি হাসি মুখে বলল,
” জায়গা হবে সেতু দি।আমি খুব খুশি হবো।রাত ধরে তোমার সাথে গল্প করব।ইশশ!নীরকে নিয়ে ঘুমানোর কতদিনের ইচ্ছা আমার।তুমিই তো দাও না।”
সেতু হালকা হাসল। বলল,
” তুমি বরং ঘুমাও।আমি বলে আসছি।”
নীরু মিষ্টি হাসল।চোখ টিপে বলল,
” যাও, যাও, বলে এসো তোমার প্রাণনাথ কে।”
.
সেতু রুমে এসে চোখ বুলাল।বেলকনির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখল নিষাদ চেয়ারে বসা। মুখচোখ শুকনো তার।দু পা এগিয়ে নিষাদের সামনে দাঁড়াল।নরম গলায় বলল,
” নিষাদ?আপনার কি মন খারাপ?”
নিষাদ চোখ তুলে চাইল।চোখের সামনে সেতু নামক রমণীর দিকে ঘোর লাগানো চাহনীতে তাকাল মুহুর্তেই। পরণে গোলাপি রাঙ্গা সুতি শাড়ি।সিঁথিতে লাল রাঙ্গা সিঁধুর।স্নিগ্ধ ফর্সা কপালে ছোট লাল ফোটা।ডান গালে সদ্য ফুলে উঠা লালচে ব্রন।নিষাদ চেয়ে রইল।বড্ড আবেদনময়ী লাগল সেই রমণীকে।মুখ থেকে এবার চোখ গিয়ে থামল গলার নিচের কালো তিলে।গলা ঝেড়ে সেতুর হাত ধরল।বলল,
” মন খারাপ হলে তোমায় বলতাম মন ভালো করে দিতে।”
” তবে এমন উদাস?”
নিষাদ গমগমে সুরে উত্তর দিল,
” ভাবছিলাম, রঙ্গন আর নীরুর পরিণতি কি হবে?যদি পরিণতিটা ওদের মিলনই হয় তবে কতটুকু যৌক্তিক হবে?রঙ্গন দিয়াকে ভালোবাসত। পাগলের মতো ভালবাসত।যেমন আমি তোমায় বাসি।আমি যদি তোমায় ভুলতে না পারি, তবে রঙ্গনও কি দিয়াকে ভুলতে পেরেছে?নীরু যদি সবটা মেনেও নেয় রঙ্গন কি আসলেই ওকে ভালোবাসবে সেতু?দিয়ার জায়গা মুঁছে আমার বোনকে জায়গা দিতে পারবে?নাকি নীরুকে সবসময়ের জন্য দ্বিতীয় অপশনের তকমা বয়ে বেড়াতে হবে?”
সেতু উত্তরে বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।চোখজোড়া সরু করে তাকিয়ে রইল নিষাদের দিকে।নিষাদ আবারও বলল,
” আমি সবসময় চাই নীরুর জীবনে আমার মতোই কেউ আসুক।যে তার ভালোবাসাকে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করবে।যে তার ভালোবাসাকে সবসময় মাথা তুলে রাখবে।সম্মান করবে, ভালোবাসবে, দিনশেষে তার সবটুকু বুঝবে।তাই ভয় হচ্ছে।অস্থির লাগছে।”
সেতু নিজের কোমল হাতটা নিষাদের মাথায় রাখল।চুলগুলোতে হাত বুলিয়েই বলে উঠল,
” চিন্তা করবেন না, যা হবে ভালোই হবে।নীরুর জীবনেও সবটা ভালো হবে।সবটাই!”
নিষাদ হালকা হাসল।নিজের মন খারাপি ভাব লুকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতেই মুখে হাসি ঝুলাল। বলল,
” কিছুক্ষন পর বৃষ্টি নামবে, চারপাশ নিরব,ঠান্ডা পিনপতন বাতাস।প্রেম প্রেম আবহাওয়া না একদম?”
সেতু চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ করল।উত্তরে কিছু না বলে নিশ্চুপ রইল।নিষাদ সেতুর হাতটা নিজের কাছে এনে ঠোঁট ছোঁয়াল।সেতুকে একটানে আরো একটু কাছে এনে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল।মৃদু স্বরে বলল,
” আমার কি তবে প্রেম করা নিষেধ সেতু?”
সেতু বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলল।নিষাদের প্রশ্নের জবাবে কোন উত্তর না দিয়ে বলল,
” মা নেই, নীরু ও অসুস্থ। আমি নীরুর ঘরে ঘুমাচ্ছি নিষাদ।এটা বলতেই এসেছিলাম।”
নিষাদের মুখটা চুপসে গেল।সেতুর হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” এটা কেমন সমাধান?”
” কেন?”
নিষাদ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলল।সেতুকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে থুতনি রাখল সেতুর মাথার উপর।সঙ্গে সঙ্গে সিঁথির সিঁধুরের কিছুটা লেগে গেল নিষাদের থুতনিতে।নিষাদ সেভাবে থেকেই বলল,
” আমার ঘুম ধরবে না।”
সেতু জবাবে উত্তর দিল,
” আপনার তো এমনিতেও রাতে ঘুমানোর অভ্যাস নেই নিষাদ।আমি ও ঘরে ঘুমালে তাহলে ঘুম না ধরার কি আছে?আমি কি ঘুমের ঔষুধ নাকি?”
নিষাদ হাসল।বলল,
” তুমি জ্বালার ঔষুধ মেয়ে।বুকে বড্ড বেশি জ্বালা হলে তোমার মুখের দিকে চাইলে সেই জ্বালা উপশম হয়।”
” জ্বালা হবে কেন?”
” বুঝবে না তুমি। এই যুবকের জ্বালা তুমি বুঝবে না।যদি বুঝতে বারংবার প্রেমের চাকায় পিষে দিয়ে চলে যেতে না।”
সেতু নিঃশব্দে হেসে দিল।নিষাদ ও সেই হাসি অনুভব করল।কিছুটা ঝুঁকে নিজের পুরু ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিল সেতুর কপালে।বার কয়েক সেই স্নিগ্ধ কপালে উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,
” আমার বুকে উথাল পাথাল প্রেমের ঢেউ মেয়ে।প্রেমনদীতে আজ ভীষণ জোয়ার ভাঁটা! এই জোয়ার ভাঁটা বড্ড সাংঘাতিক। তোমায় ছুঁয়ে দিয়ে যাবে মেয়ে।ডুবিয়ে দিয়ে যাবে।পালাও, দ্রুত পালাও!”
সেতু নিঃশব্দে হাসল।নিষাদের হাতের বাঁধন আলগা হতেই দ্রুত পা বাড়াল। পেঁছনের পুরুষটির তীব্র কামুক আর গহীন দৃষ্টি ফেলে দ্রুত পালাল সে।
.
সেতু যখন নিষাদের রুম ছেড়ে নীরুর রুমে এল তখন ও নীরু বসে আছে।সেতুকে আসতে দেখেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষন।সেতু অস্বস্তিতে পড়ল।ইশারায় নীরুর দিকে প্রশ্ন ছুড়তেই নীরু দুষ্টুমিভরা হাসি হাসল। আধভাঙ্গা গলায় গাইল,
” তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি,
বলো সে কি মোর অন্যায়?”
সেতু মিনমিনে কন্ঠে বলল,
” উহ!অপরাধ হবে। ”
নীরু পাত্তা দিল না।চোখ টিপে বলল,
” সে একটা হলেই হলো।”
.
তখন মাঝরাত।বাইরে কি ভীষণ বৃষ্টিপাত।সঙ্গে শীতল পরিবেশ।সেতুর হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল।নীরু, নিলু, নীর সবাই ঘুমোচ্ছে দেখে উঠে বসল।জলের তৃষ্ণা পাওয়ায় এদিকসেদিক জলের বোতল খুঁজল।নীরুর ঘরটা এত অগোছাল কোথাও জলের বোতল চোখে পড়ল না। হয়তো নীরু জলের বোতল রাখে ও নি ঘরে।সেতু পা বাড়িয়ে রান্না ঘরে গেল।জল খেয়ে আবারও চলে আসতে নিতেই নিষাদের ঘরের আলো জ্বালানো দেখল।কৌতুহলবশতই নিষাদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।দরজা ভিড়িয়ে রাখা।সেতু দরজা ঠেলে এদিকসেদিক উঁকি দিল।কোথাও নিষাদকে দেখা গেল না।কিন্তু হঠাৎ ই নিষাদের গমগমে স্বর কানে আসল,
” আমায় ছাড়া ঘুম হচ্ছে না বুঝি?এদিকে এসো। ভালোবাসা দিয়ে দিই।”
সেতু চমকাল।শুকনো ঢোক গিলে তাকাতেই নিষাদকে বেলকনি থেকে এগিয়ে আসতে দেখল।মুখে চমৎকার বাঁকা হাসি।সেতু কিছু বলল না বিনিময়ে।উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিতেই দ্রুত হাতে টান পড়ল।পেঁছনের লোকটা হাত চেপে এক টান মারল।সেতু সামলাতে পারল না।সোজা মুখ থুবড়ে পড়ল নিষাদের শক্তপোক্ত বুকে।নিষাদ হাসল।ফিসফিসিয়ে বলল,
” বলেছিলাম, মেয়ে পালাও।পালাও!পালালে না তুমি।বরং নিজেই ধরা দিয়ে দিলে। এবার কি হবে?”
সেতুর দৃষ্টি ক্ষীণ হলো।নিষাদ কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম।তুমি দিলে না।এইবার শাস্তি কে পাবে? আমি নাকি তুমি?”
সেতুর বুকের ভেতর কম্পন হলো। নিষাদের চাহনী, কথন সবকিছুর মানে বুঝতে পেরেই নুঁইয়ে এল তার চাহনী।মিহি ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। মস্তিষ্ক দ্রুত বার্তা পাঠাল,” সেতু, তোর আজ সর্বনাশ!প্রেম আজ তোকে ডুবিয়ে মা’রবে।”
#চলবে….