#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
দীর্ঘ ছয় বছর পর নিজের বাড়িতে পা রাখতে চলেছে কাশফিয়া আয়মান মেঘ। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে একবার অবলোকন করে নিল সে। মেঘের ভেতর কি অনুভুতির মিশ্রন ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে না। রাগ নাকি অভিমান সে স্থির চোখে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ছয় বছর আগে তার বাবার হাত ধরেই এই বাড়ি ত্যাগ করা হয়েছিল তার।পাশে তার বাবা আয়মান চৌধুরী। তিনিও অনেক দিন পর আসলেন যদিও এই ছয় বছরে প্রথম তিন বছর তার এই বাড়িতে আসা যাওয়া হতো না তবে শেষের তিন বছরে তিনি স্বল্প সময়ের বা স্বল্প দিনের জন্য হলেও এই বাড়িতে আসতেন।বলতে গেলে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তিনিও ছয় বছর পর একেবারের জন্য নিজের পৈত্রিক বাড়িতে এলেন। মেঘ এক দৃষ্টিতে বাড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিল প্রায় তিন মিনিট হবে সে গাড়ি থেকে নেমেছে। আয়মান চৌধুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আম্মা ভেতরে যাওয়া যাক !”
মেঘ একবার আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। মেঘের পড়নে কালো বোরকা, কালো হিজাব আর নিকাব। এক কাঁধে একটা ব্যাগ রয়েছে। আয়মান চৌধুরীর ফর্মাল কোর্ট প্যান্ট পড়েছেন। তারা এসেছে এটা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে কি না জানা নেই তাদের। মেঘ গিয়ে কলিং বেল চাপলো তখন কেউ একজন দরজা খুলে মেঘ কে দেখে বলল,,
“কে আপনি আর কাকে চাই?”
যে দরজা খুলেছে সে বোধহয় পেছনে আয়মান চৌধুরী কে দেখেন নি। আয়মান চৌধুরী এগিয়ে এসে বলল,,
“ও মেঘ আমার মেয়ে সম্পর্কে তোমার কাকাতো বোন জায়মা!”
কথাটা শুনেই জায়মা নামক মেয়েটা হেঁসে বলল,,
“ও কাকাই তুমি আসলে মেঘকে চিনতে পারি নি নিকাবের জন্য, আর তোমাকে খেয়াল করি নি। আসো ভেতরে আসো। মেঘ কেমন আছিস তুই? কতোদিন পর দেখা হলো বল!”
মেয়েটা এগিয়ে এসে মেঘকে জরিয়ে ধরলো কিন্তু মেঘের কোন ভাবান্তর নেই। সে ছোট করে উত্তর দিল,,
“জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?”
জায়মা মেঘ কে ছেড়ে বলল,,
“কি ব্যাপার মেঘ আমি কি তোর পর যে আপনি করে বলছিস তুমি করে বল নাহলে ছোটবেলার মতো থাপ্পড় খাবি।”
এবার মেঘের মুখে একটু হাঁসি দেখা গেল যদিও নিকাবের আড়ালে সে হেসে বলল,,
“আরে জায়মা আপু তুমি কেন পর হতে যাবে, তবে কি বলো তো কতো বছর পর দেখা হলো তাই আর কি দেখলাম তুমি আমায় ভুলে গেছো নাকি।”
“তোকে ভুলবো আমি তুই হলি আমার পিচ্চি বোন!”
তখন পেছনে কেউ একজন এসে বলল,,
‘এতক্ষন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছো জায়মা?”
“কাকিমনি দেখো মেঘ আর কাকাই এসেছে!”
কথাটা শুনে মেঘের মা মায়মুনা চৌধুরী একটু থমকে গেলেন বোঝাই যাচ্ছে সে এদের আশা করেনি। মেঘ জায়মার পাশ কাটিয়ে মায়মুনা চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলল,,
“আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন আপনি? আমি মেঘ!”
মায়মুনা চৌধুরী মেঘের গালে হাত রাখতে গেল আবার কি মনে করে গালে হাত না রেখে মুখটা গম্ভীর করে বললেন,,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম! আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি!”
মেঘ মায়ের সবকিছুই পর্যবেক্ষন করলো। দীর্ঘ ছয় বছর পর মুখোমুখি হয়েছে তারা। মেঘের চোখটা একটু জ্বালা করছে তার মায়ের সাথে এতবছর পর দেখা অথচ একবারও জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে। সে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। কিন্তু ততক্ষনে ড্রয়িংরুমে সবাই জেনে গেছে কারা এসেছে মেঘ তার বাবার কাছে গেল। আয়মান চৌধুরী সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। হুট করে তখন মেঘের ছোট ফুপি আয়না চৌধুরী বললেন,,
“অবশেষে তাহলে মহারানীর পা পড়লো চৌধুরী বাড়িতে! এতদিন তো ঢং ধরে বাড়িতে আসার প্রয়োজন বোধ করে নি।”
তখন মেঘ হেসে বলল,,
“একদম ঠিক বলেছেন ছোট ফুপি এ বাড়িতে আসার প্রয়োজন পড়ে নি তাই আসি নি। যদিও আজও আসতাম না কিন্তু এই বাড়ির প্রয়োজন পড়লো তাই আসতে হলো।”
তখন মায়মুনা চৌধুরী বলল,,
“এটা কি রকম ব্যবহার তুমি আগের মতোই বেয়াদব রয়েছো একটুও পাল্টাও নি।”
তখন মেঘের দাদুভাই সমশের চৌধুরী বললেন,,
‘মেয়েটা আসতে না আসতেই কি শুরু করলে! এতদিন পর বাড়িতে এসেছে তার আপ্যায়ন করবে তা না করে কি করছো তোমরা।”
তখন আয়না চৌধুরী বলল,,
“ও তেমন ইম্পোর্টেন্ট কেউ না বাবা যে তার আপ্যায়ন করতে হবে।”
“আয়না একদম চুপ! বাবার বাড়িতে এসেছো সে ঠিক আছে। কিন্তু আমার সংসারে তোমার কথা আমি অ্যালাও করবো না। তাই কোন কথা না। সবথেকে বড় কথা আমার নাতনি কে কিছুই বলবে না তুমি। ও ইম্পোর্টেন্ট কি ইম্পোর্টেন্ট না সেটা তোমার থেকে জানতে হবে না।
বাবার কথা শুনে আয়না চৌধুরী চুপ মেরে গেলেন। মেঘ সমশের চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলল,,
“আসসালামু আলাইকুম দাদুভাই কেমন আছেন?”
তিনি মেঘের মাথায় হাত রেখে বলল,,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম! আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি তুমি কেমন আছো? আমার কথা রাখার জন্য শুকরিয়া!”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি! আপনি তো শের চৌধুরী আপনার কথা অমান্য করা কার সাধ্য!”
সমশের চৌধুরী হাসলো আর বলল,,
“আমি যদি শের হয়ে থাকি তাহলে তুমি হলে শেরনি! যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও তোমার রুম আমি পরিস্কার করিয়ে গুছিয়ে রেখেছি! জায়মা ওকে রুমে নিয়ে যাও। আর আয়মান তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।”
“দাদুভাই মুন আপু , আজান, জিয়ান ভাইয়া,শিফা ওরা কোথায়?”
“ওরা একটু মার্কেটে গেছে এসে পড়বে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।”
“ঠিক আছে!”
আয়মান চৌধুরী মেঘের কাছে এসে বলল,,
“চলেন আম্মা ওপরে যাই!”
হুম মেঘ আর আয়মান চৌধুরী নিজেদের ঘরে চলে গেলেন। ওরা যেতেই মায়মুনা চৌধুরী বলল,,
“বাবা আজকে ওরা আসবে আপনি বলেন নি তো সেই জন্যই কি এতো খাবারের আয়োজন করতে বলেছেন?”
“হুম ওদের জন্যই বলেছি। আর আসার কথা বললে কি ওয়েলকাম করার জন্য বরনডালা সাজিয়ে রাখতে নাকি! মনে তো হয় না ব্যাপারটা তোমাদের তাই আমি কিছু বলছি না। তবে মনে রেখো কিছু কিছু মানুষের আগমন হুট করেই হয় তাদের আগমনী বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। এখন ওপরে গিয়ে দেখো আয়মানের কিছু লাগবে কি না। তারপর খাবার সাজাও অনেক দিন হলো পরিবারের সবার সাথে খাবার খাওয়া হয় না। জাহানারা শাফিয়ানকে অফিস থেকে আসতে বলো আর জিয়ানদের ফোন দাও বাড়িতে আসতে বলো দেরি যেন না হয়।”
মায়মুনা চৌধুরী চুপ মেরে গেলেন। সমশের চৌধুরী সেখান থেকে চলে গেলেন। আয়না চৌধুরী বলল,,
“আমি বুঝি না বাবা আর ভাইয়া ঐ কালো মেঘের মাঝে কি দেখে মনে হয় পারলে সবসময় মাথায় করে রাখে। যত্তসব আদিখ্যেতা!”
বলে তিনি ও চলে গেলেন মায়মুনা কিছু ভাবতে ওপরে গেলেন হাজার হোক তার হাজবেন্ড এসেছে ওপরে গিয়ে দেখা প্রয়োজন।
______________
মেঘ নিজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো জায়মা মেঘের রুমের দরজা খুলে দিল । মেঘ আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো যেমনটা রেখে গিয়েছিল ঘরটা তেমনই রয়েছে বোধহয় এই ঘরটা কেউ পরিষ্কার করে রাখতো। মেঘ জায়মাকে গিয়ে বলল,,,
“আপু তুমি এখন যাও! আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যাবো।”
“আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের কষ্টকে আড়াল করতে চাইছিস!”
“কষ্ট! আর এই রুমের সাথে কষ্টের কি সম্পর্ক!”
“কিসের সম্পর্ক তা আমার থেকে তুই ভালো জানিস মেঘ!”
“উহু কোন সম্পর্ক নেই! তুমি যাও তো!”
“হুম যাচ্ছি যাচ্ছি নিজের রুম পেয়ে দখল নেওয়ার জন্য তাড়িয়ে দিচ্ছিস!”
“আপু প্লিজ এখন মজা কোরো না এখন, অহেতুক মজা করা আমার পছন্দ নয় এটা তুমি ভালো করেই জানো।”
“যা নিরামিষ মহিলা।”
বলেই জায়মা চলে গেল। মেঘের পুরোনো কথা ভেবেই চোখ ছলছল করে উঠলো। মেঘ ধীরে ধীরে গিয়ে ওর দক্ষিন পাশের জানালা খুলে দিল শা শা করে বাতাস প্রবেশ করলো ওর রুমে। মেঘ বোরকা হিজাব আর নিকাব খুলে ফ্রেশ হয়ে এলো। তার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো পরনে সাদা রঙের থ্রিপিস। মেঘ রুম থেকে বেরুবে কি বেরুবে না ভাবতে ভাবতে আয়মান চৌধুরী ওর রুমে প্রবেশ করলো মেঘ তার বাবাকে দেখে রুমে আসলো তখন আয়মান চৌধুরী বলল,,
“আম্মা আমার মনে হয় একেবারে বিয়ের মধ্যে আসাই উচিত ছিল। এখনো মুনের বিয়ের দশদিন বাকি! আপনার সমস্যা হতো না।
মেঘ হেঁসে বলল,,
“আব্বা আপনি হলেন কনের বাবা আপনার একটা দায়িত্ব আছে। দূরে ছিলেন বলে আপনার দায়িত্ব বদলে যায় নি সব বাবাদের আলাদা দায়িত্ব থাকে। মুন আপুর বিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থেকে সব দায়িত্ব পালন করবেন দেখবেন আপনার মেয়ের বিয়েতে যেন কোন অসুবিধা না হয়। যদিও আপনার দায়িত্ব আপনি ভালো করেই জানেন এবং সবার অগোচরে হলেও এতবছর ধরে পালন করে আসছেন।”
“দায়িত্ব থেকে কখনো পালাতে নেই সে যাই হোক না কেন আপনজন পর করে দিলেও নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালন অবশ্যই সঠিক ভাবে পালন করবো। আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন না তো?”
‘এটা আমার বাড়ি আব্বা তাহলে অস্বস্তি কেন হবে? হ্যা মানছি অনেক বছর এখানে থাকি নি তাই বলে বাড়ির প্রতি টান কমে যায় নি। তাছাড়া এখন থেকে আমি তো এই বাড়িতেই থাকবো।”
“হুম!”
“মায়ের সাথে সব ঠিক ঠাক আব্বা!”
“হুম চলুন নিচে যাই!”
“চলুন!”
মেঘ আর আয়মান চৌধুরী নিচে চলে গেল তারা দুজন সবার থেকে দূরে সোফায় বসে পড়লো। বাবা মেয়ে কিছু নিয়ে কথা বলছে সবাই দেখল কিন্তু কিছু বললো না। মেঘের একটা ফোন আসাতে ও উঠে রিসিভ করতে যাবে তখনি মুনরা চলে এলো আজান নিজের বোনকে দেখে মেঘ আপু বলে চিৎকার দিয়ে মেঘকে জরিয়ে ধরলো। সকলে অবাক কারন সবার জানামতে আজানের মেঘকে চেনার কথা নয়। কারন সে এই ছয়বছরে মেঘকে দেখেনি তাহলে । কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বললো না। এদিকে মেঘ একটু চমকালেও ভাই এর কান্ড দেখে মুচকি হেঁসে বলল,,
“আরে আজান কি করছিস ছাড় আমাকে আমি তো তোর জন্য কিমা হয়ে যাবো”
তখন আজান বলল,,
“আপু তুমি আসবে কেউ কিছু বললো না কেন তুমি কি আমাদের সারপ্রাইজ দিতে এসেছো!”
মেঘ হেসে আজানকে ছাড়িয়ে বলল,,
“হুম!”
তারপর মুনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“মুন আপু কেমন আছো?”
“তুই মেঘ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তুই এখানে?”
“কেন আসতে পারি না বুঝি আমার আপন বোনের বিয়ে আর আমি থাকবো না তা কি করে হয় বলোতো তবে তুমি যদি না চাও তাহলে বলো আবার চলে যাচ্ছি।”
মুন এগিয়ে এসে মেঘকে জরিয়ে ধরে বলল,,
“এই না না আমি এমনি বলেছি তুই বিয়ে অবশ্যই থাকবি তোর একমাত্র বোনের বিয়ে তোকে ছাড়া হবে না। কেমন আছিস তুই অনেক দিন পর দেখা হলো।”
“হুম আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো!”
“জিয়ান ভাইয়া শিফা তোমরা কেমন আছো?”
ভালো বলেই তারা দুই ভাইবোন চলে গেল। অতঃপর সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসলো সমশের চৌধুরীর ডান পাশে তিনি মেঘকে বসালেন আর বামপাশে আয়মান চৌধুরী কে। এই দুটি চেয়ার এতদিন শাফিয়ান চৌধুরী এবং তার ছেলে জিয়ান বসতো হুট করে তাদের জায়গা দখল হওয়ায় তাদের ভিশন রাগ হলো তবুও সমশের চৌধুরীর জন্য কিছু বললো না। সমশের চৌধুরী মেঘকে দেখে খাওয়াচ্ছে যা চৌধুরী পরিবারের কাছে অষ্টম আশ্চর্য ছাড়া কিছু নয়। আজান ছাড়া তার সব নাতি নাতনিরা তাকে দেখে যথেষ্ট ভয় পায় কেউ তার কাছে ঘেঁষে না এমনকি তিনিও কারো কাছে এগিয়ে আসেন না। তিনি মেঘকে দেখে দেখে খাওয়াচ্ছে এটা তাদের হজম হচ্ছে না কারন এই মেয়েটাকেই এক সময় সে সহ্য করতে পারতো না। মায়মুনা চৌধুরী ও অবাক চোখে দেখছে। আয়মান চৌধুরী মুচকি হাসছে । খাওয়া শেষ করে মেঘ নিজের রুমে চলে গেল। বাকি সবাই সোফায় বসলো সবাই মেঘকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলো।
(চৌধুরী পরিবারের হেড সমশের চৌধুরী। তার স্ত্রী মেঘের পাঁচ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। তাদের বড় ছেলে আয়মান চৌধুরী স্ত্রী মায়মুনা চৌধুরী। তাদের তিন সন্তান, বড় সন্তান মুনজেরিন ডাকনাম মুন তার পড়াশোনা শেষ আরো বছর তিন আগে তার তিনবছর আগে আকদ হয়েছিল কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কোন কারন বশত হয় নি এখন হচ্ছে। তারপর কাশফিয়া আয়মান মেঘ পড়াশোনা শেষ বলেই সবাই জানে তারপর আজান এইবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ছোট ছেলে শাফিয়ান চৌধুরী তার স্ত্রী জাহানারা তাদের তিন সন্তান জায়মা বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে, তারপর জিয়ান পড়াশোনা শেষ করে বাবা দাদার সাথে বিজনেস দেখছে তারপর শিফা এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। সমশের চৌধুরীর দুই মেয়ে আশা চৌধুরী আর আয়না চৌধুরী। )
_______________
দেখতে দেখতে মেঘের চৌধুরী বাড়িতে বিকেলটা ভালোই কেটে গেল। যদিও আজান আর সমশের চৌধুরী ছাড়া বাকি কারো সাথে তেমন কথা হয়নি। মেঘের কথা শুনে রাতে মেঘের বড় ফুপি আশা চৌধুরী তার হাজবেন্ড আর মেয়ে শায়লা কে নিয়ে এসেছেন। এসেই শায়লা মেঘের ঘরে ছুটলো তার ভিশন আদরের সে তাই তো আদর করে পিচ্চি ডাকে। মেঘ কিছু একটা করছিল হুট করেই কেউ মেঘের চোখ ধরলো মেঘ কিছু বুঝতে না পেরে বলল,,
“কে?”
“কে বলতো পিচ্চি?”
“শায়লা আপু!”
শায়লা চোখ ছেড়ে দিয়ে বলল,,
“কি করে বুঝলি আমি তো কন্ঠস্বর আলাদা করে বললাম!”
মেঘ হেসে বলল,,
“তোমার পিচ্চি শুনে কারন তুমি ছাড়া কেউ আমাকে পিচ্চি বলে না।”
“বাহ বাহ ভালো তো !”
“কেমন আছো, কে কে এসেছে দুলাভাই আর তোমার মেয়ে আমার ভাগ্নি ওরাও নাকি?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই জানলি কেমনে যে তোর দুলাভাই আছে আবার ভাগ্নি ও। তোকে তো আমাদের বিয়েতে ইনভাইট করা হয় নি তাছাড়া বিয়েটা পাঁচ বছর আগে হয়েছে তাহলে তোদের সাথে তখন যোগাযোগ ছিল না কেসটা কি বলতো।”
এ কথা শুনে মেঘ একটু থমকালো আর বলল,,
“বাড়ি ফিরেছি দুপুরে খবর পাবো না তাই কখনো হয়। তাছাড়া আব্বা তিন বছর ধরে এই বাড়িতে যাতায়াত করে তোমার মাথায় একটুও ও বুদ্ধি নেই।
“ওকে বুঝলাম! এখন যাই ফ্রেশ হয়ে নিই।”
“হুম যাও।”
শায়লা মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মেঘ কিছু ভাবলো তারপর গিয়ে বড় ফুপির সাথে দেখা করতে নিচে এলো। কিন্তু ঘটনা চক্রে মেঘ আশা চৌধুরীর হাজবেন্ড এর আয়মান চৌধুরী সম্পর্কে কিছু তিক্ত কথা শুনতে পেল।আয়মান চৌধুরী মাথা নিচু করে রেখেছে। তা দেখে রাগে মেঘের মাথা ফেটে যাচ্ছে। মেঘ কঠোর স্বরে একটু জোরেই বলল,,
‘আসসালামু আলাইকুম ফুপা!”
হুট করে মেয়ের আগমনে তিনি চমকে উঠলো। মেঘের ফুপা রেজাউল আহমেদ একটু হকচকিয়ে গেল সাথে বাকি সবাই। এখন ইয়াংস্টার রা নিচে নেই কিন্তু বড়রা মায়মুনা চৌধুরী, জাহানারা, শাফিয়ান আর আয়না চৌধুরী। সকলেই আছে সমশের চৌধুরী ছাড়া। রেজাউল আহমেদ বলল,,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম আরে মেঘ যে!”
“হ্যা আমি! তবে কি বলুন তো ফুপা সামনের মানুষটা চুপ করে আছে মানে এই না যে অন্যায়টা সে করেছে। আসলে মুর্খের সাথে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।এটা আমার আব্বা ভালো করেই জানে।”
মেঘের কথা শুনে অপমানে রেজাউল আহমেদ এর মুখ থমথমে হয়ে গেল। এক কথায় কিভাবে মুখ বন্ধ করতে হয় সেটা মেঘ ভালো করেই জানে। তিনি বলল,,
“মেঘ তুমি আমাকে মূর্খ বললে?”
“হ্যা বললাম আপনি তো মূর্খই না হলে সত্যতা প্রমান পাওয়ার পরও কেউ পুরোনো কাসুন্দি ঘাটে। সরি ফুপি কিন্তু তোমার জামাই এর এভাবে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল না তবে তিনি এমন কাজ করলো যে মন খারাপ করো না ঠিক আছে। আর বাকি সবাই কি দেখছেন তাকিয়ে প্রতিবাদ করার মুরদ না থাকলে সেই স্থানে থাকার কোন প্রয়োজন তো দেখছি না আমি। চৌধুরী বাড়ির ছেলেকে অপমান করছে আর বাড়ির সবাই মজা নিচ্ছে। শেম অন ইউ অল।
কথা গুলো সে আশা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল। সবাই মাথা নিচু করে ফেলল। আয়মান চৌধুরীর মুখে তৃপ্তির হাসি। আশা চৌধুরী কিছু বললো না তবে মুচকি হেসে মেঘকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করলো। এটা দেখে সবাই অবাক সমশের চৌধুরী সেখানে ছিলেন না তাই এ সম্পর্কে ধারনা নেই নাহলে কোন ভাবেই তার ছেলেকে অপমান করার জন্য ছাড় দিতেন না । মেঘ আশা চৌধুরী কে ছেড়ে ওর আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তাড়াতাড়ি সোফায় বসেন আপনার ওষুধের সময় হয়ে গেছে আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। খাবার আগে ওষুধ আছে তো।”
তিনি মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল মেঘের অবস্থা সে রেগে আছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে মেয়ের কাছে এলো বাকিরা বেশ অবাকই হলো।তিনি গিয়ে বলল,,
“আম্মা আমি!”
“চুপ করে সোফায় বসুন! ”
বলেই মেঘ ওপরে চলে গেল তিনি চুপ করে সোফায় বসলো। কেউ কিছু বললো না। কিন্তু রেজাউল আহমেদ রেগে ওখান থেকে চলে গেল আশা চৌধুরী ভাইয়ের কাছে এসে বলল,,,
‘সরি ভাই মাফ করে দিস। কিছু মনে করিস না, তুই তো জানিস ও কেমন?
“অন্যের ভুলের জন্য তুমি কেন মাফ চাইছো আপা। ছেড়ে দাও কিছুই মনে করি নি। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও ডিনার টাইম হয়ে গেছে।”
আশা চৌধুরী চলে গেল । তখন ইয়াংস্টার রা আর সমশের চৌধুরী সবাই নিচে আসলো ডিনারের সময় হয়ে গেছে। এখানে কি হয়েছে কেউ জানে না। আর হয়তো কেউ কিছু বলবেও না। সবার পরে মেঘ আসলো টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়মান চৌধুরীর হাতে ওষুধ আর পানি দিলো তিনি বিনা বাক্যে খেয়ে নিল। তারপর নিজের আব্বার জন্য একটা প্লেটে নিজ হাতে খাবার বাড়লো আর বলল,,
“আমি আর আব্বা সোফায় খাবো দাদুভাই আপনারা খেয়ে নিন।”
বলেই মেঘ উত্তরের অপেক্ষা না করে সোফায় বসলো। সকলে দেখলো মেঘ ভাত মাখিয়ে আয়মান চৌধুরীর সামনে তুলে ধরলো। আয়মান চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো কারন আর কেউ না বুঝলেও মেঘ বুঝতে পারে তার আব্বার মন খারাপ কখন হয়। আর মন খারাপ থাকলে সে খেতে পারে না তাই তো নিজ হাতে খায়িয়ে দেয় এই সময়টা। খাবার টা গালে নিচ্ছে না দেখে মেঘ বলল,,
“কি হলো আব্বা খাবারটা মুখে নিন!”
আয়মান চৌধুরী খাবারটা নিল। খাবার টা গিলে বলল,,
“আমি কিছু বলিনি বলে আপনি আমার ওপর রেগে আছেন আম্মা। মনে করেন কেউ আপনাকে অনেক কষ্ট দিলো, আপনার মনে প্রচুর আঘাত করলো, অপমান করলো ,কিন্তু না আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না আল্লাহ সবই দেখছে। সময় হলে তিনি ঠিকই বিচার করবেন। যেখানে কোনো দোষই আপনার ছিল না। অন্য কারও দোষ আপনার উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো, এতে আপনি মন খারাপ করবেন না। সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরশা রাখবেন। রাসূল (সা:)বলেছেন – তুমি জানো,তুমি সঠিক, তবুও তুমি তর্কে যেও না ।
[সহীহ বুখারী:৪০৭৯]
এই কারনে আমি কিছু বলি নি আম্মা।
মেঘ আরেক লুকমা এগিয়ে দিয়ে বলল,,,,
” আপনার কিছু না বলার জন্য আমি রেগে নেই আব্বা। কিন্তু কখনো মূল্যহীন মানুষের নিকট মাথা নত করতে নেই আব্বা। কিন্তু আজ আপনি ওখানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? ফুপা যা বলল তা সব মিথ্যে তাহলে আপনি মাথা নিচু করে ছিলেন কেন? আমি আপনাকে বলেছি না আমার আব্বা আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নিচু করবে না। মানলাম আপনি তর্কে জড়ান নি তাই বলে মাথা নিচু করে রাখবেন এটা আমি মানতে পারছি না।”
আয়মান চৌধুরী খাবারটা গিলে অসহায় মুখ করে বললেন,,
“পৃথিবীতে এমন কি আছে যা হয়তো মৃত্যুর যন্ত্রনার থেকেও বেশি যন্ত্রনা দেয়?”
কথাটা শুনে মেঘের হাত আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল।মেঘ আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চোখ ছলছল করছে। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে জবাব দিল,,
“সবার সামনে করা অপমান!”
আয়মান চৌধুরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল। মেঘ তাড়াতাড়ি করে বাম হাত দিয়ে তার আব্বার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,,
“আর একটাও কথা না আব্বা চুপচাপ খান। খাওয়ার সময় কথা বলতে হয়না অথচ আপনি বলেই যাচ্ছেন।”
আয়মান চৌধুরী চুপচাপ খাচ্ছেন মেঘ ও খাচ্ছে। এদিকে ড্রাইনিং টেবিল থেকে সকলেই এই দৃশ্য দেখলো। এখনো কেও খাবার শুরু করে নি। সবার দৃষ্টি যেন ওদের দিকেই। সমশের চৌধুরী বলল,,
“হুম অনেক হয়েছে খাওয়া শুরু করো। ওদের কে ওদের মতো ছেড়ে দাও।”
তখন আজান বলল,,
“দাদুভাই বাবা কি কাঁদছিল মেঘ আপু মুছে দিল।”
“না কাঁদছিল না হয়তো চোখে কিছু পড়েছিল। এখন খাবার খাওয়া শুরু করো। আর মায়মুনা আমি নিচে আসার আগে কি নিচে কিছু হয়েছিল?”
তখন আয়না চৌধুরী তাড়াতাড়ি করে বলল,,
“না বাবা কিছু হয় নি।”
মেয়ের কথা শুনে সমশের চৌধুরী কিছু বললেন না তবে এটা বুঝতে পারলো তার ছেলের চোখে কিছু পড়েনি তার ছেলে কাঁদছিল। তিনি খাওয়া শুরু করলো। খাওয়া শেষে মেঘ আয়মান চৌধুরীর হাত ধরে বলল,,
“পৃথিবীতে এমন কি আছে যা জীবনে সাময়িক কষ্ট আর বাঁধা হয়ে তো আসে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবনে সফলতার পথে সুগম করে দেয়।”
আয়মান চৌধুরী হাসলো আর বলল,,
“মানুষের অপমান।”
মেঘ হাসলো আর বলল,,
‘ঠিক বলেছেন আব্বা তাহলে এসব ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোন কারন নেই। তাদের দেওয়া কষ্টের জন্যই আমরা আজ সফল কিন্তু তাদের অগোচরে।”
“আমি তো সবাইকে ভালোবাসি আম্মা!”
“সবাই আপনার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না আব্বা। আপনি সবাইকে ভালোবেসেই তাদের ভালোর জন্য চুপচাপ মেনে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কি হলো আপনার ভালোবাসার মূল্য কে কে দিতে পারলো। মূল্যহীন মানুষের কাছে কখনোই ভালোবাসা দেখাবেন না। সবই স্বার্থের খেল স্বার্থের জন্য সবাই সবকিছু করতে পারে।”
” আম্মা এই স্বার্থপর দুনিয়ায় আপনি আমার নিঃস্বার্থ বিশ্বস্ত বন্ধু!”
মেঘ কিছু বললো না হেসে প্লেট নিয়ে কিচেনে রাখলো আর হাত ধুয়ে আসলো। তখন জায়মা বলল,,
“মেঘ আগেই ঘুমিয়ে পড়িস না আজ রাতে আমরা সব বোনেরা আড্ডা দেব।”
“সরি আপু আমার হবে না আমার কিছু কাজ আছে। ওগুলো করে ঘুমিয়ে পড়বো কাল সকালে আমার একটা জায়গায় যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরতে হবে।”
“আমি ভাবলাম আজ সবাই আড্ডা দেব। আগের মতো সবাই কতোদিন পর একসাথে হলাম।”
“এখনো অনেক সময় আছে আপু তাছাড়া আমি তো এখন থেকে বাড়িতেই থাকছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
মেঘ চলে যেতে নিল তখন সমশের চৌধুরী বলল,,
“মেঘ একটু পর আমার রুমে এসো তো কিছু কথা ছিল আর আয়মান কেও বলে দিও।”
“ঠিক আছে।”
মেঘ আয়মান চৌধুরীর কাছে গিয়ে তাকে বলে ওপরে নিয়ে গেল ওষুধ খেতে হবে। তখন শাফিয়ান চৌধুরী বলল,,
“বাবা ওদেরকে কেন ডাকলে তোমার ঘরে?”
“তেমন ইম্পোর্টেন্ট কিছু না ওদের সাথে একটু কথা ছিল।”
“ওহ আচ্ছা।”
আর কেউ কিছু বললো না। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার রুমে চলে গেল। মেঘ আর আয়মান চৌধুরী কিছুক্ষন পর সমশের চৌধুরীর ঘরে গেল।
অতঃপর,,
~ চলবে,,,,,
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। চলে এলাম আপনাদের পছন্দের গল্পের সিজন ২ নিয়ে। যারা ধূসর রাঙা মেঘ গল্পটা পড়েন নি তারাও পরতে পারবেন সমস্যা নেই। গল্পের সূচনাটা কেমন হলো অবশ্যই জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং!
ধূসর রাঙা মেঘ সিজন-১ পড়তে লিখাটির উপর ক্লিক করুন