দূর আলাপন ৩১ (শেষ পর্ব প্রথম অংশ)
———————————–
ভাদ্রের শেষাশেষি। আজকাল আকাশ থাকে বড় অশান্ত। কখনো রৌদ্র ঝলোমলো তো কখনো মেঘের গম্ভীর নিনাদে ভারী। দোচালা টিনের বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশ ঘেরাও করে আছে নানান প্রজাতির ফলজ বৃক্ষরাজি। মাঝ উঠোনে বসে শিউলি কুলোয় ঝেড়ে আলগা করছেন ধানের কুড়া। ঘন দুপুর। মাথার ওপর চড়া রোদ। ঘামে, ধূলিতে শিউলির পরিশ্রান্ত মুখ বদলে ধারণ করেছে অন্য রঙ। ধান ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লান্ত হয়ে একসময় কুলো নামিয়ে রাখেন। নিবন্ত চোখে তাকান সম্মুখের আকাশ পানে। কয়েক হাত দূরে রোদে শুকোতে দেয়া ধান পায়ের সাহায্যে মেলিয়ে দিচ্ছে পাশের বাড়ির খুশি। খুশি শিউলির অগণিত পোষ্যদেরই একজন। খাইয়ে পড়িয়ে, মাস শেষে হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে খুশিকে তিনি নিজের ভক্তকূলের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। তার সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়েই ধান ভানা থেকে মশলা বাটা পর্যন্ত সবেতে এখন খুশির অপার দক্ষতা।
আকাশ দেখতে দেখতে আনমনে শিউলি বলেন, ‘কাইল বেইন বেলায় আর ধান রোদে দিস না রে খুশি। বাদলা নামবার পারে।’
‘আইচ্ছা খালা।’
কপালের ঘাম আঁচলে মুছে শিউলি ক্রমশ তার দৃষ্টি নামিয়ে আনেন নিচে। আকাশের নিম্নভাগ জুড়ে ছিন্নভিন্ন সাদা মেঘ, তার নিচে ঘন পাহাড়ের ন্যায় দূরান্তে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি, তারও নিচে জমিন…
কিন্তু শুধুই কি জমিন? ওই দূরে ওটা কি দেখা যায়? করতলে একবার নীরস চোখ দুখানা ডলে নিলেন। তারপর আবারো ভালো করে চাইলের মাঠ শেষের ওই দূরান্তের পথের পানে। হ্যাঁ, সত্যিই কারা যেন আসছে এই পথে!
‘ও খুশি, দেখ্তো কেডা আসে।’
ধান নাড়া স্থগিত রেখে খুশি সম্মুখপানে চাইল গভীর আগ্রহে। এক মিনিট.. দুই মিনিট.. হঠাৎ উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে খুশি।
‘খালাম্মা ওইডা দেহি আমাগর নিনাদ ভাই! কিন্তু লগে যেন কেডা… লম্বা মতো, বোরকা পরা…
একটু বিরতি নিয়ে,’ ওমাগো! নিনাদ ভাই দেহি বউ নিয়া আইসে! ও খালাম্মা শুনছেন?
দেহেন দেহেন… আইসা দেহেন এইহানে।’
ধান কুলো কুড়া সব ফেলে সচকিত শিউলি সত্বর উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত ভাবে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টে পথের পানে। ভেতর টা অল্প অল্প কাঁপছে। অস্বস্তিটা বাড়ছে ক্রমশ। দূরের ছায়াগুলো একসময় দৃষ্টির খুব কাছে চলে এলো। বিস্ময়ের মোহ ভেঙে শিউলি দেখলেন মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা!
নিনাদ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল হাত। অনুতাপ জর্জরিত গলায় অকস্মাৎ ডাকল,’ফুআম্মা.. এহনো রাইগা আছো আমার ওপর?’
শিউলি আজ আর কোথায় যান? কি করে এতদূর চলে আসা ছেলেমেয়ে দুটোকে ফেরান? তবু শতভাগ টললেন না। তিতিক্ষার সালামের জবাবে অল্প হাসি, গলায় সামান্য সৌজন্য মেশানো স্বর, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছোস তোরা?’
এবার তিতিক্ষা এগিয়ে এসে শিউলির অপর হাতটিও ধরল।
‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। কিন্তু আপনাকে ছাড়া পুরোপুরি ভালো কি আর থাকা যায়? আর আপনিও যে আমাদের ছাড়া খুব ভালো নেই তা কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একমাসেই কত শুকিয়েছেন আপনি!’
হুড়মুড় করে একগুচ্ছ আবেগ এসে জড়িয়ে যায় শিউলির চোখে। চোখে বালি পড়েছে হঠাৎ এমন করে আঁচলে দ্রুত চোখ মোছেন।
‘না গো বউ। এইডা তুমার চোখের ভুল। আসো, ভিতরে আসো তুমরা। এতডা রাস্তার জার্নি। আমি শরবত কইরা আনি।’
শিউলির পাশাপাশি হেটে ওরা ভেতরে এলো। আপ্যায়নের অজুহাতে শিউলি উঠতে চাইতেই নিনাদ ফের চেপে ধরল তার হাত।
‘কোথাও যাইবা না তুমি। এহানে বসো। তোমার সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে আমার।’
ভাতিজার ছদ্ম গম্ভীর মূর্তি দেখে শিউলি অকাতরে হাসলেন। ‘ক দেহি, শুনি কি তোর বোঝাপড়া?’
‘তুমি যে আমার ওপর রাইগা আছো এইকথা বলনাই কেন্?’
‘ওমা, পোলার কথা শুনো! রাগ করলে সেই রাগের কথা কেউ মুখে জানান দেয়রে বোকা?’ বলে শিউলি খুব হাসতে থাকেন। সে হাসিতে অস্পষ্ট ভাবে যোগ দেয় তিতিক্ষাও। নিনাদ ক্ষোভিত চোখে দুজনকে দেখে। সম্মোধনে তিতিক্ষাও আছে বলে এইবার আপনা থেকেই ওর মুখ আসে শুদ্ধ ভাষা।
‘তোমরা হাসছো কেন?’
‘এই যে তুই এহনো কতো আলাভোলা আছোস, তা দেইখা হাসি। ভাবছিলাম বিয়ার পর বউয়ের ছায়ায় ছায়ায় থাইকা একটু চালাক হবি। এহন দেখি তোর চেয়ে তোর বউডাও কম বেকুব না।’
‘বেকুব কেন ফুআম্মা?’ তিতিক্ষা না বুঝে প্রশ্ন করল।
‘মানুষ চায় ঝামেলা এড়াইতে। আর তুমরা দুইজন পায়ে হাইটা সেই ঝামেলার কাছে হাজির হইছো। তুমরা বেকুব না তো কি?’
‘দুর! আপনি বুঝি ঝামেলা হলেন?’
‘ঝামেলাই গো মায়া। তুমরা দুইজন সহজসরল বইলাই অতসত পেচগোজ বুঝো না।’
বলতে বলতে তিতিক্ষার গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ান শিউলি।
‘মায়া গো, তুমি বড় ভালা। আমি বুঝবার পারি নাই। পোলার জন্য নিজে পছন্দ করলাম যেই মাইয়ারে, তার চোক্ষেও যহন শেষমেশ আমার জন্য বিরক্তিই দেখলাম তহন মনে হইল শহরের মাইয়া হইয়া তুমি আর তার চেয়ে কত ভালা হইবা?
এহন বুঝি, আমিই ভুল আছিলাম। যাইহোক এহন জলদি জলদি আমার পোলার পাশে একবার বসোতো। দুইজনরে একলগে দেইখা একটু চোখ জুরাই।’ বলে শিউলি নিজেই হাত ধরে টেনে তিতিক্ষা কে বসালেন নিনাদের পাশে। প্রাণ ভরে দেখলেন ওদের।
‘মা শা আল্লাহ। নজর না লাগুক। তোরা দুইডারে আল্লাহ তাআলা সবসময় কল্যাণের সাথে একত্রে রাহুক। আমিন। সুম্মা আমিন।’
শিউলির মুখে সত্যিকারের সুখের হাসি প্রস্ফুটিত হলো। আরো কিছু বলবার আগেই শুনলেন উঠোনে লোকের গুঞ্জন। নিনাদ বউ নিয়ে এসেছে, খুশি নিশ্চয়ই এ খবর এতক্ষণে পাড়ায় রটিয়ে দিয়েছে..
.
বহুকাল পর আজ বড় পরিতৃপ্তির সঙ্গে ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে একবেলা খেলেন শিউলি। পাশের ঘরে এখনো লোক ভীড় করে আছে। পাড়া ভেঙে মেয়ে বউরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। তিতিক্ষা সবার সাথেই হেসে হেসে কুশল বিনিময় করছে, তিনি একফাঁকে দেখে এসেছেন। পান মুখে দিয়ে এবার ফিরলেন নিনাদের দিকে।
‘ও নিদু। এইবার তো কিছু একটা ব্যবস্থা করন লাগে।’
‘কিয়ের ব্যবস্থা ফুআম্মা?’
‘বিয়ার পর তুই পরথম বউ নিয়া আইলি। পাড়া পরশিরা সবাই আমারে ধরছে বউভাত করতে হইব। তুই কি কস?’
‘আ.. আমি.. কি বলতাম.. তোমার ইচ্ছা হইলে.. কিন্তু টাকাপয়সা তো সাথে কিছু নিয়া আসিনাই।’ অপ্রস্তুত গলায় বলে নিনাদ।
‘ওমা! টাকার চিন্তা তোরে করতে কইসে কেডা? তোর বাপে যে ফসলি জমি রাইখা গেছিল। ফসল বেইচা তো সেই টাকা প্রতিবছর আমার কাছেই জমা রাখছি। জোর করলেও তুই কহনো নেস নাই। কইসস কোনো সময় বিপদে আপদে দরকার হইলে নিবি। সেহান থাইকা কিছু নিয়া আর বাকিটা আমি দিমু।’
‘না না.. তুমি কেন্? যা লাগে ওইখান থাইকাই নাও তাহলে।’
‘চুপ থাক। আমার ভাতিজার বউভাত। আমি যেভাবে ইচ্ছা আয়োজন করুম। তোর কোনো এখতিয়ার নাই আমারে থামানোর।’
শিউলির হুঙ্কারে নিনাদ দমে যেতে বাধ্য হয়, ‘আচ্ছা.. আচ্ছা… তোমার যা ইচ্ছা।’
.
বিকেল তখন কমলা রঙ ধরেছে। আকাশের দু’ধারে থরে থরে এসে জমেছে সফেন মেঘের পশরা। শরতের বেলাশেষের আকাশে রঙধনুর রঙ, মেদুর বাতাসে ঈষৎ আরাম আরাম আবেশ। তিতিক্ষা পেছন পানে চাইল, ফিঁকে হাসির আভা ঠোঁটের কোণে, ‘আসছি ফুআম্মা।’
‘যাও বাছা। সাবধানে যায়ো। ও নিদু, দেইখা রাখিস আমার বউরে।’
শিউলির শেষ সতর্কবাণীর যথাযথ উত্তর করলো না নিদু। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ব্যস্ত পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ওদের দুজনের গমন পথে শিউলি চেয়ে আছেন। যতক্ষণ ওদের ছায়া হারিয়ে না যায় ততক্ষণ চেয়েই রইলেন।
.
‘একি! এই রাস্তায় এত কাঁদা কেন?’
পেছন থেকে নিনাদ দায়সারা উত্তর করে, ‘গ্রামের পথঘাট তো। একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদা জমে যায়।’
‘আমাদের কি এর ওপর দিয়েই যেতে হবে?’ ভয়ে ভয়ে জানতে চায় তিতিক্ষা।
হাটতে হাটতে তিতিক্ষা কে ছাড়িয়ে সামনে চলে এসেছে নিনাদ। তার অনুসন্ধানী চোখ আশপাশ ভিড়তে থাকে। শেষে তিতিক্ষার ওপর চোখ স্থির করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, ‘এছাড়া তো আর পথ দেখছি না!’
নিরুপায় তিতিক্ষা হার মানল, ‘আচ্ছা, আপনি আগে আগে চলুন। আমি পেছন পেছন আসছি।’
‘তুমি শুওর হাটতে পারবে? সমস্যা হলে নাহয় আমার হাত ধরো।’
‘না।’ কড়া উত্তর ভেসে এলো পেছন থেকে।
‘ঠিকাছে, তোমার যেমন ইচ্ছে।’ বড় বড় পা ফেলে কাঁদার ওপর দিয়ে অক্লেশে হেঁটে চলে গেল নিনাদ। তার অনুগামী হতে গিয়ে দ্বিতীয় পদক্ষেপেই তিতিক্ষার পা পড়ল নোংরা জলকাঁদার পাকে।
‘ইন্না-লিল্লাহ। ছিঃ… এবার কি হবে!’
‘কি?’
‘দেখতে পাচ্ছেন না কি?’ নিনাদের বোকা প্রশ্নে সে কটমট করে তাকায়।
‘আগেই বলেছিলাম। আমার হাত ধরো। একলাফে পার করে দিচ্ছি।’
‘বাজে কথা ছেড়ে এখন সমাধান বলুন।’
‘সমাধান একটাই। এই পা নিয়েই হেঁটে বিল পর্যন্ত যেতে হবে। বিলের পানিতে পা ধুয়ে নিয়ো। ব্যস!’
ক্ষণকাল অসহায় চোখে তাকিয়ে রয় তিতিক্ষা। একসময় পরিস্থিতি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই বুঝে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঠিকাছে তা চলুন…’
.
বিলের আনাচ কানাচ থৈথৈ করছে জলে। জলাভূমির ফাঁকে ফাঁকে তূলনামূলক উঁচু ভিটেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিস্তর ধানক্ষেত। জলের আকাশী রঙের গায়ে মিশে আছে কাঁচাপাকা ধানের হলুদ সবুজ শীষ। তারই অন্যপাশ জুড়ে কচুরিপানা আর বাঁকে বাঁকে ডিঙি নৌকা চলাচল উপযোগী সরু জলপথ। ওপরে আকাশের গায়ে জলরঙের বাহারি শেডের ছোঁয়া।
বিস্তীর্ণ এই বিলের খানিক গভীরে স্থিত পদ্ম ফুলের বিশাল এক বন। আশপাশের কয়েক গ্রামের ছেলেমেয়ের কাছে সে এক দর্শনীয় স্থান।
ওদের ছোট্ট ডিঙি নাও ধীরে ধীরে বিলের সে অঞ্চলের দিকেই এগোচ্ছে। নিনাদ বইঠা বাইছে আর বিলের অপার সুষমাময় রূপ দেখছে। তখন নাওয়ের অন্যপাশে আঁটসাঁট হয়ে বসে তৃতীয় বারের মতো সন্দিহান স্বরে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটাল তিতিক্ষা।
‘আপনি সত্যিই নৌকা বাইতে জানেন তো?’
মুহুর্মুহু এক প্রশ্নে নিনাদ ততক্ষণে চূড়ান্ত মাত্রায় বিরক্ত। চোখেমুখে প্রবল নিরাসক্ত ভাব নিয়ে প্রতুত্তর করল, ‘না জানলেই কি বা করা যাবে? বিয়ে করে মাথায় ভূত হয়ে চেপে বসার মতো এই নৌকাতেও চেপে বসেছো যখন, তখন বুঝতে হবে নৌকা উল্টোলে এখন আমার যা হয় তোমারো তাই হবে।’
‘মানে?’
‘কোনো মানেফানে নেই।’
‘আমি আপনার মাথায় ভূত হয়ে চেপে আছি?’
‘সরি, ভূত না। পেতনি হয়ে।’
‘কিহ! আপনি…’ রাগে তোতলাতে আরম্ভ করে তিতিক্ষা।
‘হ্যাঁ আমি…’
‘এ.. এ একটা অসভ্য লোক আপনি!’
‘এই কথাটা আর কতবার বলবে? সেই কলেজের সময় থেকে শুনছি আমি নাকি মহা মহা অসভ্য। অথচ অসভ্যতাটা কি করেছি আজও জানলাম না!’
‘এখন যা করছেন সেসব কি অসভ্যতা নয়?’
‘এই যদি হয় তোমার দৃষ্টিতে অসভ্যতা, তাহলে বলতে হয় অসভ্যের সঠিক সংজ্ঞাই তুমি জানো না।’
প্রতি উত্তর করতে গিয়েও তিতিক্ষা দমে। তর্কে আজ কিছুতেই নিনাদকে পরাস্ত করতে পারছে না বুঝতে পেরে একেবারে নিরব থাকাই স্থির করে।
.
আরো কিছুটা এগোতেই জলাভূমির ভেতর ছোট ছোট দ্বীপের মতো অসংখ্য মাটির উঁচু ঢিবি নজরে পড়ে ওদের। বিকেল শেষে পাখিরা সেসব নির্জন ক্ষুদ্রকায় দ্বীপে বসেছে দিনান্তের শেষ আহারের সন্ধানে।
‘দেখুন দেখুন ওইযে বক!’ তিতিক্ষা কিশোরির মত উচ্ছাসে ভেসে হাতের ইশারায় একঝাঁক বক দেখালো।
‘দেখেছি’
‘ওটা কি পাখি? হাঁসের মতো দেখতে আবার আকাশে উড়ছে..’
‘ওগুলো পাতিহাঁস।’
‘আর দূরে কুব কুব শব্দ করছে যে পাখিটা?’
‘কুব পাখি।’
‘আপনি সব চেনেন?’ ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে তিতিক্ষা।
‘গ্রামের ছেলেমেয়ে মাত্রই এসব চেনে।’
প্রকৃতির বিমোহন মাধুর্য দেখতে দেখতে অন্যরকম উৎসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল তিতিক্ষার মন। অন্যমনস্ক ভাবে একসময় বলে, ‘মণীদ্র গুপ্তের সেই বিখ্যাত আত্মজীবনীতে প্রথম পড়েছিলাম কুব পাখির নাম। নামের সঙ্গে এর ডাকের যে এত মিল হতে পারে ভাবতেই পারিনি!’
‘আত্মজীবনীর নাম?’
‘অক্ষয় মালবেরি’ নামটা সুন্দর। তাই না?’
একহাতে বইঠা সামলে অন্যহাতে চুল ঠিক করতে করতে নিনাদ গম্ভীর মুখভাব করে বলে, ‘হুম।’
‘নামের মতোই বইটাও ভীষণ সুন্দর জানেন! আমার খুব প্রিয় বই। সুযোগ পেলে বইটা আমি এখনো পড়ি! নির্দিষ্ট কোনো অংশ নয়। বই খুলে প্রথম যে পৃষ্ঠা চোখে পড়ে, পড়া শুরু করি।’ প্রিয় বইয়ের কথা বলতে গিয়ে আনমনে হেসে ফেলে তিতিক্ষা। নিনাদ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে খেয়াল হতেই গম্ভীর হবার মিথ্যে চেষ্টায় রত হয়।
‘কি হলো?’
‘হবে আবার কি?’
‘বন্ধ করলে কেন?’
‘কি বন্ধ করলাম?’ তিতিক্ষা অসস্থি নিয়ে জিজ্ঞেস করে। সে বুঝতে পারছে না আজ এত বেশি কথা কেন বলছে!
‘কথা বলা বন্ধ করলে কেন তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। শুনতে তো বেশ…’ বেফাঁস কিছু বলে ফেলছে বোঝা মাত্র চুপ হয়ে যায় নিনাদ।
অপ্রতিভ হয়ে তিতিক্ষাও ফেরে অন্যপাশে। মিনিট পাঁচেক পর পদ্ম বিলের প্রথম দৃশ্য নজরে আসতেই আবারো চেঁচায়।
‘ওটাই বুঝি পদ্মবিল? এতো ফুল একসাথে ফুটেছে! সুবহানাল্লাহ।’
বিলের এই দিকটা বেশ শুনশান। কোনো কোনো জায়গায় পদ্মবিলের মাঝখান দিয়েই মাটির ঢিবিতে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় কাশফুল। কাশফুলের বন কয়েকটা আড়াল সৃষ্টি করেছে বিলের মধ্যে। দু’ধারে জেগে ওঠা কাশবন আর মাঝের জলে প্রস্ফুটিত বড় আকৃতির কিছু পদ্মফুল সমেত সরু খালের মতো স্থানটা দেখিয়ে তিতিক্ষা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ওদিকে যাওয়া যায় না?’
‘সবদিকেই যাওয়া যায়।’ শুনে দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন কিংবা অনুরোধ করল না তিতিক্ষা। একপাশে ঝুঁকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পদ্মফুল তোলায়। হাতভর্তি ফুল নিয়ে যখন সামনে ফিরল, চমকিত হয়ে দেখল ওদের ডিঙি নাও সেই খালের ধারেই যাচ্ছে। মানুষটার অনুগ্রহে সে কৃতজ্ঞ না হয়ে পারল না। ফলস্বরূপ শত চেষ্টার পরও মুখ এঁটে রইল চাপা উচ্ছ্বাস মাখা হাসি।
.
নির্জন বিলমধ্যে তখন আস্তে আস্তে নেমে আসছে সন্ধ্যের অন্ধকার। নিনাদ নাও ঘোরাতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ হলো তিতিক্ষাও নিশ্চুপ। একসময় নিনাদের কানে আসে একা একা বিরবির করে কি যেন বলছে মেয়েটা। চেয়ে দেখে জলের ওপর ঝুঁকে ও গভীর ধ্যানে কিছু একটা দেখছে।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। আশাহত চোখে পেছনে ফেলে আসা খালের শেষ প্রান্তে তাকিয়ে অন্যমনে বলে, ‘ওই ফুলগুলোর রঙ অন্যগুলোর চেয়ে একদম আলাদা। বোধহয় অন্য কোনো প্রজাতির পদ্ম। না?’
‘হুম’ নাও ঠিক করতে করতে তিতিক্ষার অন্যমনস্ক ভাব খেয়াল করতে থাকে নিনাদ।
‘খালের ওই পাশটা তো বেশ সরু। ওদিকে বোধহয় যাওয়া যায় না…’
‘যায়.. তবে নাওয়ে করে নয়।’
‘তাহলে কিভাবে? ‘
‘সাঁতরে।’
‘ও আচ্ছা… ‘ এবার আরো মলিন হয় তিতিক্ষা।
‘কি হয়েছে? ফুল লাগবে?’
সে ঝট করে উত্তর দেয়, ‘না না!’ অপ্রস্তুত হেসে দ্রুত চোখ ফেরায় সেদিক থেকে। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলে, ‘একটা মজার ঘটনা মনে পড়েছে। ছোট বেলায় একবার নানুবাড়িতে গিয়ে এমনি এক পদ্ম বিলে ঘুরতে গেছিলাম আমরা। ভাড়ার নৌকায় করে। নৌকা থেকে দূরে একটা ফুল ভালো লেগেছিল আমার। কিন্তু মাঝি সেদিকে যেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বাবা তখন কি করল জানেন? ধুপ করে ঝাপ দিল জলে। আমরা সবাই তো চিৎকার জুড়ে দিয়েছি ভয়ে। কিন্তু কয়েক মিনিট পেরোতেই দেখি বাবা ঠিক ওই ফুলটাই সাঁতরে নিয়ে ফিরে আসছেন। দেখে সবার কি খুশি! জানেন, ওই ফুলটা এখনো আমার কাছে আছে! শুকিয়ে রেখে দিয়েছি ডায়েরিতে।’
ওরা তখন ঘন কাশফুলের বনে ছাওয়া একটা বাঁক পেরোচ্ছে। সরু সেই খাল পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে অনেকটা দূর। বাঁকের জন্য খালের কোনো অংশ এখন আর নজরেই পরছে না। সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে ঘন। নাওয়ের শেষ প্রান্তে জলে পা ডুবিয়ে বসে তিতিক্ষা আয়েশ করে দেখছে জলের সূর্যাস্ত। হঠাৎ পেছনে একটা ভোতা আওয়াজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠল ডিঙি। ডিঙিটা অতিশয় ক্ষুদ্র বলে নড়াচড়া করতে হয় খুব সাবধানে। দেখেশুনে ঘুরে বসল তিতিক্ষা। অতঃপর সামনে তাকিয়ে যা দেখল হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জন্য সেটা যথেষ্ট। বৈঠা যথাযথ স্থানে পড়ে আছে কিন্তু নিনাদ কোথাও নেই!
প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর শব্দ করে তিতিক্ষা ডাকতে আরম্ভ করে নিনাদকে।
‘নিনাদ…’
‘কোথায় আপনি?’
‘নিনাদ… অ্যাই নিনাদ… শুনছেন আমার কথা?’
নানান দুর্বিনীত অভিশঙ্কায় স্বর কেঁপে ওঠে তার। মনষ্যবিহীন নিরালা বিলের মাঝে হতবিহ্বল হয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ফেরে নিনাদের সন্ধানে। ওর ব্যস্ত সঞ্চালনে ছোট্ট নাও ঘনঘন বিলের জলে তরঙ্গ তোলে। সে যে সাঁতার জানে না, এত দোলালে নৌকাটা যে হঠাৎ উলটে যেতে পারে এসব আশঙ্কার বেমালুম বিস্মৃত হয় তিতিক্ষা। সহসা ওর সন্দেহ হয় মানুষটা জ্ঞান টেন হারিয়ে জলে পড়ে যায়নি তো? নয়তো নিমিষের মাঝে কোথায় হারাবে?
চিন্তাটা মস্তিস্কে ঠাই পাবার সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষা ঝুঁকে পড়ল জলে। জলে কতরকম তরঙ্গ খেলা করছে, দিক দিক ছড়িয়ে যাচ্ছে তার আওয়াজ। কত বিচিত্র প্রাণীর অস্তিত্বও সেখানে। আর সেই জলেই চিরকালের ভয় তিতিক্ষার। কিন্তু সব ভুলে পদ্মপাতার ফাঁকে ফাঁকে হাত গলিয়ে আজ জলের গভীরে একটা গোটা মন্যষদেহ খুঁজে বেরাচ্ছে সে।
‘ইয়া আল্লাহ সাহায্য করুন। ইয়া আল্লাহ সাহায্য করুন। লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ্ জ্বলিমিন…’
বির বির করে বলতে বলতে চোখের জল মোছে তিতিক্ষা। মুখের ওপর থেকে কখন নিকাব সরে গেছে সে হুশও থাকে না। তখন প্রচন্ড বেগে নৌকাটা দুলে ওঠে আবারো। তিতিক্ষা মুখ ফিরিয়ে দেখে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে দাঁড়িয়ে আছে নিনাদ। হাতে একগুচ্ছ ফুল।
তিতিক্ষার বিমূঢ় মূর্তির সামনে আস্তেধীরে নিনাদ নাওয়ে উঠে এলো। গায়ে লেপ্টে থাকা জলজ লতাপাতা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’কি হলো? এমন হা করে তাকিয়ে আছো কেন?
একি! কাঁদছিলে নাকি?’
এতক্ষণে কথা ফোটে তিতিক্ষার নির্বাক মুখে। ‘আ প নি… তারমানে আপনি ইচ্ছে করে… ‘
‘হ্যাঁ মানে… ফুল আনতে গেছিলাম খালের কাছে …’
‘ফুল আনতে! আপনি ফুল আনতে গেছিলেন! আর এদিকে আমি… ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম আমি!’ আক্রোশের আতিশয্যে আবারো জল গড়ায় তিতিক্ষার চোখ থেকে।
‘কি আশ্চর্য! এতো রাগছো কেন? শুধু তো কয়েক মিনিটেরই ব্যাপার। এজন্য জানিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।’
‘আপনি বলেননি আর আমি ভেবেছি সাঁতার না জেনে পানিতে পড়ে এতক্ষণে…’ কথা শেষ না করেই চোখ মুছতে আরম্ভ করে তিতিক্ষা। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে নিনাদ মিটমিটিয়ে হাসছে।
‘হাসছেন কেন?’ সে ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন ছোড়ে।
‘ভাবছি কত বোকা হলে কেউ এমন ভাবনা ভাবতে পারে!’
এই শেষ অপমানটা সহ্য হলো না তিতিক্ষার। জল থেকে এক এক করে উঠিয়ে জমা করা পদ্মফুল গুলো হাতের নাগালেই ছিল। নিয়ে ছুড়লো নিনাদকে লক্ষ্য করে।
‘আমাকে বোকা বলছেন আপনি? আমি কি করে জানব আপনার মতলব কি ছিল?’
নিনাদ হাসতে হাসতে বলে, ‘সে নাই বা জানলে। কিন্তু গ্রামের ছেলে হয়ে আমি সাঁতারও জানব না এমন ধারণা কি করে হলো?
উঃ কি সৌভাগ্য আমার! রেগে গেলে মানুষের বউ ছোড়ে আলো টমেটো নয়তো জুতো। আর আমার বউ ছুড়ছে ফুল! বাপরে!’
কিছু বলতে গিয়েও তিতিক্ষা থামে। ঠোঁটের কোণে আভাসিত হাসি গোপন করা মুশকিল হয়ে পড়ে ওর জন্য।
‘যাইহোক, এখন জলদি জলদি ফুলগুলো নিয়ে আমায় উদ্ধার করো। হতচ্ছাড়া ফুলের জন্য বউয়ের মারও আজ কপালে জুটল।’
‘ফুল ছু্ড়ে মেরেছি বেশ করেছি!’ বলে ফুলগুলো হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে দেখে তিতিক্ষা। উদার গলায় বলে, ‘ফুল এনেছেন এজন্য শুকরিয়া। তবে জেনে রাখবেন এই ফুলগুলো যত সুন্দর আপনি তত বাজে।’
‘জানি জানি। এই বদনাম আর জীবনে ঘুচলে হয়… ‘
‘কিসব বলছেন বিরবির করে?’
‘কিছু না।’
‘এখন জলদি জলদি পাড়ে চলুন। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে।
‘যাব… তার আগে একটা শেষ কথা শুনবে?’ নিনাদের স্বরে কিঞ্চিৎ আবদারের সুর।
‘কি?’ ফুল দেখতে ব্যস্ত তিতিক্ষা আড়চোখে তাকায়।
‘এই ফুলগুলোও শুকিয়ে রাখবে ডায়েরির ভাঁজে?’
চলবে….
দূর আলাপন (শেষ অংশ)
—————————–
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শিউলির উঠোন আজ জনারণ্য। একাধারে গোল হয়ে বসে মেয়েরা সবজি কুটছে, অন্যধারে মশলা বাটছেন জনাকতক মধ্যবয়সী। খোশগল্প আর গুঞ্জনে মুখর সারাবাড়ি। খুশির ভাই সজীবকে শিউলি শেষ রাতে পাঠিয়েছেন আড়ত থেকে বড় দেখে গোটাকতক মাছ আনতে। এই ভোরবেলা মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে বাকিসব কাজের তদারক করছেন তিনি। রান্নাঘর থেকে ভুরভুর করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে নজরে আসতেই এবার চপল পায়ে ছুটলেন সেদিকে।
নতুন বউয়ের ইচ্ছে সবাইকে চা করে খাওয়ায়। শহুরে মেয়ে, মাটির চুলোয় কি করে রাঁধতে হয় জানে না। কিন্তু বউয়ের রান্নার বড় শখ। শুনে শিউলি বেশ তৃপ্ত হলেন। যদিও শুরুতে নিষেধ করেছিলেন। কে জানে, গনগনে আগুনের আঁচে মোমের মতো গাত্র না আবার পুড়ে মলিন হয়। কিন্তু ওই মুখের মিষ্টি অনুরোধে শেষতক নিমরাজি হতেই হলো।
রসুইঘরে উঁকি দিয়েই শিউলি চমকিত হন। লাকড়িজ্বলা ধোয়ায় কাশতে কাশতে, নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়েছে বউয়ের মুখ।
‘দেহি বউ সরো সরো। আমি করতাসি।’
তিতিক্ষাকে জোর করে তুলে তার স্থানে নিজে বসলেন শিউলি।
‘শহরের মাইয়া হয়া লাকড়ির ধুয়ায় কি তুমরার অভ্যাস আছে? দেহি, কি সর্বনাশ! এত কালি ভরাইলা কেমনে? যাও, জলদি গিয়া কলপাড়ে মুখ ধুয়া আসো।’
‘আর একটু…’
‘না না… এহনি যাও। গায়ের রঙ জ্বইলা যাইব যে। চা নামায়া আমিই তুমারে ডাকমু। তহন নাহয় সবাইরে দিয়া আইসো।’
অগত্যা তিতিক্ষা কে উঠতে হয়। মুখ হাত ধুয়ে এক পা দু পা করে রসুইঘরের চালার পাশে দাঁড়িয়ে সে বিস্ময় নিয়ে দেখে গোটা বাড়ি ঘিরে চলতে থাকা অতগুলো মানুষের অবিরাম ব্যতিব্যস্ততা। কত মানুষ, কত হাসি আর কত তাদের আয়োজন। মানুষে মানুষে এমন মিল সে আর দেখেনি কোথাও। অনুষ্ঠান এক বাড়ির অথচ কাজ করছে পুরো পাড়ার সব মেয়ে বউ।
বেলা বাড়লে বাড়তে থাকে সমারোহ। বাড়ে ওদের শশব্যস্ত ভাব আর গল্পের ডালপালা। ঘরে বসে বাইরের পৃথিবীর সেসব মিশ্র শব্দ তিতিক্ষা নিঃশব্দে শোনে। কখনো একা একা বাক্য বিনিময় করে রিনরিনের সাথে। শিউলি ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। আজকের আয়োজন তাকে ঘিরে। অনুষ্ঠান শুরু হলে এমনিই তো আত্মীয়ারা দেখবে। তার আগ পর্যন্ত ঘরে থাকাই শ্রেয়।
ঘড়ির কাঁটা যখন বারো ছুই ছুই। বাইরে তখন হঠাৎ একটা শোরগোল পাওয়া গেল। আনমনা তিতিক্ষা রিনরিনের পাশে গালে হাত রেখে বসে ভাবছিল নিজের পরিবারের কথা।
‘জানো রিনরিন? বাবাকে ছেড়ে কখনো এত দিন দূরে থাকিনি আগে। বুবুকে ছেড়েও না। ভীষণ মনে পড়ছে ওদের কথা। ছেলে আর সংসার নিয়ে বুবুর নিশ্চয়ই এখন ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে? এত ব্যস্ত যে একটা কল করার ফুরসত পর্যন্ত নেই! অথচ আমাদের এখানে আসার পেছনের মূল হোতা কে বলতো?
সেই বুবুই!
আফরিনের সঙ্গে কথা বলে ফুআম্মার অভিমানের ব্যাপার টা নিশ্চিত হলাম যখন, তখন বুবুই পরামর্শ দিয়েছিল বুঝলে? ফুআম্মার রাগ ভাঙানোর জন্য যেন সোজা এখানে চলে আসি…’
অকস্মাৎ হৈচৈয়ে মোহ ভাঙলে রিনরিনকে ছেড়ে লঘু পায়ে তিতিক্ষা এসে দাঁড়ায় জানালার কাছে।
উঠোনে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। দূর থেকেও তাদের ছেড়া ছেড়া কথা ভেসে এলো তার কানে। তারপর অল্প কিছুকাল, আচমকা জানালার গরাদ ছেড়ে তিতিক্ষা ছোটে দরজার অভিমুখে। কপাট খুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রহর গোণে, সবচেয়ে কাছের, সবার চেয়ে পছন্দের মানুষ টা কখন আসবে ওর সনে দেখা করতে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা রত থাকতে হলো না। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করেই মেয়ের খোঁজ জেনে মারুফ ঘরের দাওয়ায় উঠে এলেন।
‘আসসালামু আলাইকুম। আমার আম্মাজান কেমন আছে?’
দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে তিতিক্ষা অস্পষ্ট গলায় সালামের জবাব দেয়। চোখে গড়ায় জল।
‘ছি ছি আম্মাজান। শশুর বাড়ির লোকের সামনে বাবাকে দেখে অমন করে কাঁদতে আছে? ওরা ভাববে মেয়ে নিশ্চয়ই ছিচকাঁদুনি। কেঁদে কেঁদে বাপকে আমাদের নামে বিচার দিচ্ছে!’
‘ভাবলে ভাবুক!’
‘হা হা.. কি বলে আমার মা! শুনলাম এখানে এসেও আমার মা নাকি খুব মন মরা হয়েছিল? বেয়ান অনুরোধ করলেন চলে আসতে। তা মেয়েকে দেখার এমন সুযোগ ছাড়ি কি করে? চলে এলাম। ভালো করিনি?’
দু পা এগিয়ে বাবার হাত ধরে তিতিক্ষা, ‘খুব ভালো করেছো বাবা। আফরিন আর মিমহাজ ভাইও তো দেখলাম এসেছে। কিন্তু তুমি একা যে? বুবুরা আসেনি?’
‘আসেনি আবার! তোর বুবু এসেই বাকিদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে হেশেলে ঢুকেছে যে।’
‘আমার সঙ্গে দেখা না করেই সোজা হেশেল?’
‘তোর মায়ের মেয়ে না? হেশেলের গন্ধ পেলে ওর কি হুশ থাকে? রেহনুমাও এমন ছিল। রান্নার ক্ষেত্রে নো কম্প্রোমাইজ! হা হা…’
.
শাড়ি দেখে হারিয়ে গেল তিতিক্ষার মুখের রঙ।
‘এতো জমকালো শাড়ি! আরেকটু সাদামাটার মধ্যে পেলে না বুবু?’
তিহা দমে না। শাড়ি নিয়ে যে ছোট বোনটি প্রশ্ন তুলবে এ তার জানাই ছিল। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
‘আরে অত ভাবলে চলে? বিয়ে জীবনে মাত্র একবার। একটু সাজগোছ করবি না?’
‘বিয়ে! বিয়ে কোথায়? এ তো ওয়ালিমা।’
‘ওই একই হলো।’
দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে তিতিক্ষা গম্ভীর হয়।
‘কিরে রাগলি নাকি? মাত্র তো একটা দিন। পড়ে নে না।’
‘ঠিকাছে পড়ব। কিন্তু এক শর্তে।’
‘কি?’
‘অন্য কেউ নয়। আমার সাজ আমি নিজেই সাজবো।’
‘বলিস কি! বউ সাজাতে পার্লারের মেয়েরা এসে বসে আছে যে।’
‘ওদের খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করে দাও।’
‘পাগল হলি?’
‘হইনি তবে ওদের কাছে সাজলে হবো নিশ্চয়ই।’
‘নিদুটার সঙ্গে সারাক্ষণ তর্ক করে করে একেবারে তার্কিক বনে গেছিস তুই। বুঝলি!’
‘বুঝলাম’
‘বড় বোনের কোনো ইচ্ছের মূল্য নেই তোর কাছে…’
‘এও বুঝলাম!’
‘বড্ড দেখছি বাচাল হয়েছিস!’
‘তুমি তো তাই চেয়েছিলে।
‘আমি! কবে? কখন?’
‘যখন একা ঘরে বসে কাঁদতাম, তখন যে বারবার বলতে ‘কথা বল তিতি। তোর যা ইচ্ছে তাই বল। তবুও শুধু কথা বল…..’
‘ফের ওসব কথা মুখে আনছিস?’
‘ওসবও তো জীবনেরই অংশ। পুরোপুরি ভুলে যাই কি করে বলো? ‘
‘আচ্ছা আয় বুবুর কাছে। বুবু আদর করে দিচ্ছি।’
তিতিক্ষা এসে বোনের কোলে মাথা রাখে। আলতো হাতে ওর চুলে বিলি কেটে দেয় তিহা।
সস্নেহ গলায় বলে, ‘তিতি, আমার ওপর তোর কোনো রাগ নেইতো?’
‘না তো। রাগ কেন থাকবে?’
‘এইযে, তুই চাইছিলি না তবুও নিদুর সঙ্গে তোকে জুড়ে দিলাম। হয়তো ভেবেছিস তোর চেয়ে নিদুর ভাবনাটাই আমার বেশি।
না রে। আসলে ব্যাপার ঠিক উল্টো। নিদু যেমনি হোক, কিন্তু ওর কাছে তোর একটা বিশেষ মূল্য আছে। অনেকদিন ধরে তো ওকে চিনি। এসব অল্প অল্প টের পাওয়া যায়। তাই একসময় মনে হলো আর কেউ না হোক, আল্লাহ চাইলে হয়তো নিদু তোকে ভালো রাখতে পারবে। সৃষ্টিগত ভাবে দুর্বল আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই হয়তো তারও কখনো তোর প্রতি বিরাগ বিতৃষ্ণা আসবে। ঝগড়া, মনকষাকষি তোদের মধ্যেও হবে। কিন্তু দিনশেষে নিনাদ জানবে তুই ওর শেষ গন্তব্য। এর পথটা কিন্তু দুর্গম। তোকেই তৈরি করে নিতে জানতে হবে। এমন আসনে অধিষ্ঠিত হতে হবে যেখান থেকে চাইলেই কেউ টেনেহিঁচড়ে নামাতে পারে না।’
‘কিরে?’
‘কি…’
‘চুপ করে আছিস যে? পারবি তো এমন কেউ হয়ে দেখাতে?’
‘জানি না বুবু…’
‘ধুর, তোর মধ্যে কোনো কনফিডেন্স নেই।’
‘নাইবা থাকল।’
‘নিদুটার কপালই দেখছি মন্দ।’
‘সে আর বলতে!’
‘ফের মুখে মুখে কথা!’
‘আচ্ছা আফওয়ান’
‘তাহলে এতক্ষণ যা বললাম, একদিন সত্যি হয়ে দেখাবি বল?’
‘আচ্ছা বাবা। হবো হবো হবো…’ বলে তিতিক্ষা বোনের গাল টিপে দেয়।
তিহার অস্ফুট স্বরে মেকি বিরক্তি ঝরে, ‘উফফ দিনে দিনে কিযে হচ্ছিস তুই…। পেতনীর রাণি একেবারে!’
‘তুমিও আমায় পেতনী বললে?’
‘আমার আগে আরো কেউ বলেছে নাকি?’
‘কি হলো কথা বলিস না কেন?’
‘তোমার বন্ধু বলেছে।’
‘এতো বড় সাহস নিদুর! আমার বোনকে পেতনী বলে! আচ্ছা যা তুই পেতনী হলে ও একটা মেছো ভূত। শুধু মেছো ভূত না মেছো ভূতের সর্দার!’ শুনে হেসে ওঠে তিতিক্ষা।
‘আবার হাসি! বিশ্বাস কর, মিথ্যে বলছি না রে। হাসলে তোকে সত্যি পেতনীর মতো দেখায়!’
‘ভালো, তবু আমি হাসবো।’ বলে আবারো হাসে তিতিক্ষা।
বোনের দিকে অপলক চেয়ে থেকে তিহা চোখের জল মোছে। মনে মনে প্রার্থনা জানায় রবের কাছে,’ইয় রব, আপনি এই হাসির রেখা আর কখনো ম্লান হতে দিয়েন না। চিরটা কাল আমার বোন যেন এভাবে দ্বিধাহীন হাসতে পারে।’
.
কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হলো সমস্ত আয়োজন। উঠোনের একাধার জুড়ে টানানো শামিয়ানার নিচে জোড়ো হওয়া শতেক মানুষের হাসিতে, গুঞ্জনে, কল্লোলে সন্ধ্যাতক মুখর রইল সারাবাড়ি। পাড়াপড়শি মেয়েবউরা কনে দেখতে এসে কত রঙ বেরঙের গল্প আর অশেষ দুআ রেখে গেল তিতিক্ষার জন্য। তবে সন্ধ্যে নামতেই ওদের সব কলরোলে যেন ভাটা পড়ল। গ্রামের চিরাচরিত জীবন রীতি অনুসারে সন্ধ্যের পরই গৃহস্থরা ধীরে ধীরে রাত্রির বিশ্রামের আয়োজন শুরু করে। তাছাড়া সারাদিন স্বেচ্ছায় কাজে অংশগ্রহণ করে ওরা তখন ক্লান্তও ভীষণ। ফলাফল রাত আটটা বাজতে না বাজতে ফাঁকা হয়ে গেল উঠোন।
ভেতর বাড়িতে তখন যদিও অন্য চিত্র। শিউলির দোচালা টিনের বাড়ির ঘরে ঘরে জমেছে রমরমা আড্ডার আসর। মিনহাজ রওশান নিনাদ আর শহর থেকে আগত নিনাদের জনাকতক বন্ধুর সহযোগে ওদের গল্পগুজব তখন তুঙ্গে। একের পর এক নাশতার ট্রে যাচ্ছে আর খালি হয়ে ফিরে আসছে। সজীব আর খুশি ভাইবোন দুজনে অক্লেশে অক্লান্তভাবে আপ্যায়ন করে যাচ্ছে সবাইকে। একঘর পরের চিত্রও তাদৃশ।
খুশির বয়োবৃদ্ধ দাদি গল্প বলায় ওস্তাদ। প্রাচীন মানুষ, ঝুলিতে অদ্ভুত গল্পের অভাব নেই। তিনি এক একটি অদ্ভূতুরে কাহিনি নিজের ঝুলি থেকে বের করেন। আর সবাই মুখিয়ে ওঠে শোনার জন্য। গরম গরম পেয়াজু আর চানাচুরে মাখানো বোলভর্তি মুড়ি ভর্তা মাঝখানে রেখে ওরা গোল হয়ে বসেছে খাটের চারপাশে। শিউলির গা ঘেঁষে তিহা আর বিছানার উল্টোপাশের দেয়ালে হেলে আফরিন। বুড়ির কথাতে সামান্যমাত্রায় হাস্যরস পেলেই হাসতে হাসতে সে এলিয়ে পড়ছে এর ওর গায়ে।
এবার একটু কনের কাছ থেকে ঘুরে আসা যাক।
বাড়ির শেষ কামরা, দোচালা ঘরের কয়েক হাত দূরে একটা আলাদা একচালা ঘরে স্থান হয়েছে তিতিক্ষার। বলা ভালো মাথা ব্যথার প্রাবল্যে ও নিজেই গল্পের আসর ছেড়ে ঠাই নিয়েছে এখানে। সে এখন গুরুতর ভাবে জবড়জং এই শাড়িখানা ছুড়ে ফেলার পায়তারা খুঁজছে। জানলে ফুআম্মা রাগ করবেন নিশ্চিত তবে ভাদ্রের উত্তাপে, মাথার যন্ত্রণায় আর শাড়ির ওজনে ওর অবস্থা এখন বিভীষণ। আরেকটু হলে যেন মাথাটাই ব্যথায় ছিড়ে পড়ে যাবে ঘাড় থেকে। পরিস্থিতি এমন যে কারো রাগ জেদের পরোয়া করলে আর চলছে না।
মাথা ব্যাথায় ওষুধ সে খায়না কখনো। একটু ঘুমোতে পারলে হয়তো ব্যথাটা কমে যেত। অথচ এখনো এশার সলাত বাকি। বাকি বোধহয় আরো অনেক কিছু। হয়তো খানিক পরেই শিউলি এসে ডেকে বলবেন ভাত খেতে চলো, নয়তো মুরুব্বি কেউ এসেছে শুনে দেখা করতে চলো…
বিরক্তিতে দুহাত কপালে চাপে তিতিক্ষা। কি রেখে কি করবে তা ভেবে উঠতে পারে না কিছুতেই। ঘরজুড়ে পায়চারি করতে করতে শেষে সিদ্ধান্ত নেয় শাড়ি বদলে সলাত পড়ে ও এখন একটু ঘুমোবে। যা হবার হোক…
.
তখন নিশুতি রাত। সারাদিনের কর্মব্যস্ত বাড়ি রাতের অন্তিম হাতছানিতে ঢলে পড়েছে গভীর গাঢ় সুষুপ্তির কোলে। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে কোলাহলে মত্ত ঝিঁঝিঁর দল। দূরের বনের ওপারে বিরহিণীর করুণ সুরে গান ধরেছে সন্তানহারা একজোড়া ডাহুক। নির্জন নিশীথের রহস্যে ক্রমে এসে মিশে যাচ্ছে ঘনঘোর আঁধারের বিভ্রম। রাত্রী তার রহস্যের উত্তরীয় উন্মোচন করে আবরণে ঢেকে দিচ্ছে সমস্ত ঊষর চরাচরকে…
একা ঘরে হঠাৎ ছুটে গেল তিতিক্ষার ঘুম। চোখ মেলতেই ওর চারপাশে একটা ভয়ের চিত্রপট রচিত হলো। অন্ধকার ঘর, একবিন্দু আলো কোথাও নেই, দূরে কোথায় যেন অবিশ্রান্ত ভাবে ডেকে চলেছে একদল শেয়াল। রাতের নিবিড়তা ভেঙে দেয়া সে ডাক শোনায় কি ভয়াবহ! তড়াক করে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিতিক্ষা। নিজের বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শব্দটা ও এত স্পষ্ট শুনতে পেল যে চমকে উঠল। সেখানে দাঁড়ালো না আর এক মুহুর্ত। দরজার নিচ গলিয়ে আসা একফালি চাঁদের আলো অনুসরণ করে ছুটে এসে হাতড়াতে হাতড়াতে খুললো দরজার কপাট। তারপর এক পা চৌকাঠের বাইরে রাখতেই আবারো গা হিম!
একটা মনুষ্যমূর্তি চৌকাঠের নিচে দুইধাপ বিশিষ্ট সিড়ির একপাশে, সিমেন্টের মাচায় বসে আছে। দেখামাত্র কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যাহ জায়গায় জমে যায় তিতিক্ষা। পর পর কয়েকটা বিট মিস করে শীতল গলায় সাহস করে জিজ্ঞেস করে,’কে?’
মনুষ্য মূর্তি উঠে দাঁড়ায়। ফেরে ওর পানে। পিছিয়ে যেতে গিয়েও তিতিক্ষা থমকায়।
‘আপনি!’
নিনাদের শান্ত প্রতুত্তর, ‘ঘুম ভেঙেছে তাহলে?’
‘হ্যাঁ.. মানে… আ… আপনি এতরাতে এখানে বসে আছেন যে? রাত ক’টা বাজে? আ আমি কি এতক্ষণ ধরেই পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি?’
‘বেশি নয়। মাত্র বারোটা দশ। ঘুমিয়েছ ভালো করেছো। তোমার মাথা ব্যথা কি কমেছে?’
‘হ্যাঁ… আলহামদুলিল্লাহ…’
‘হাটতে পারবে?’
‘পারবো…’
‘তাহলে এসো আমার সাথে।’
‘কিন্তু… এতরাতে কোথায়.. ‘
‘আমার ওপর ভরসা নেই?’
নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে তিতিক্ষা। কিয়ৎকাল অপেক্ষা করে নিনাদ একসময় হাত বাড়ায় ওর দিকে।’
উঠোনে নেমে হাত ধরতে গিয়েও তিতিক্ষা ফের থামে, ‘বাইরে যাব? বোরকা পড়িনি যে!’
‘বোরকা!’ নিনাদ এবার একটু শব্দ করেই হাসে। ‘এতরাতে কে দাঁড়িয়ে আছে তোমার পর্দা নষ্ট করার জন্য বলতো?’
‘কিন্তু… ‘
‘শোনো, এটা শহর নয় যে আধরাত পর্যন্ত লোকজন কাজের জন্য বাইরে থাকবে। এ হলো গ্রাম। ঘোর গ্রাম। এখানে রাত নটা’র পর কোনো জনপ্রাণীই গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোয় না।’
‘এখনো আমার কথায় সন্দেহ আছে? আচ্ছা থাক, তাহলে বরং…’
‘যাবো।’ বলে দ্রুত প্রাঙ্গণে নেমে আসে তিতিক্ষা। চাঁদের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে তার শাড়ি। নিনাদ একবার তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকায়।
‘শাড়ি পড়ে হাটতে অসুবিধে হবে না তো?’
‘হলেও বা। এ ছাড়া তো আর পথ নেই!’
‘বেশ, এসো।’
.
নির্জন মাটির রাস্তা ধরে ওরা হাটছে। মাথার ওপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ মাঠ বন পেরিয়ে ওদের সঙ্গ নিয়েছে। ওদের ফিসফিসিয়ে বলা কথার গুঁজন আলোড়ন ছড়াচ্ছে বাতাসে। নিরবতা ভেঙে একসময় তিতিক্ষা মেদুর গলায় শুধায়,
‘এত রাতে আপনি বাইরে কি করছিলেন বলুন তো!’
‘তোমার অপেক্ষা করছিলাম।’ তেমনি হালকা অথচ সৌষ্ঠব স্বরে উত্তর দেয় নিনাদ,
‘আমার ঘুম নিয়ে কেউ কোনো কথা তোলেনি তো?’
‘তোলার সুযোগ পেল কই? আমিই সবাইকে বললাম তিতিক্ষা ঘরে আছে। আমি যাচ্ছি ওর কাছে। কিছু দরকার হলে ও নিজেই এসে নিয়ে যাবে। ব্যস, সবাই চুপ করে গেল।’
‘এরকম ভাবে কথা বলেছেন আপনি!’
‘কি করবো। আর কিছু আমার মাথায় আসছিল না।’
‘আচ্ছা, সে যাক। বাবা কোথায় শুয়েছে বলুন তো? বিকেলের পর আর বাবাকে একবার দেখলাম পর্যন্ত না।’
‘পূবের ঘরে’
‘কাল আপনি যে ঘরটাতে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ’
‘আর ফুআম্মা বুবু আফরিন… ওরা?’
‘ফুআম্মার ঘরে।’
‘ছোটন কার সাথে ঘুমালো?’
‘তোমার বাবার সাথে।’
‘রওশান ভাই আর বাকিরা…’
‘থাকার জায়গা হচ্ছিল না বলে ওদের সবাইকে নিয়ে মিনহাজ নিজের বাড়িতে গেছে আজ রাতের জন্য।’
‘ওহ, ভালো।’
ক্ষণকাল ওদের কেউ আর কোনো কথা বলল না।
একসময় তিতিক্ষাই ফের জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, পশ্চিমের এই ঘরটাই তো আমাদের থাকার জন্য কাল রঙ করা হয়েছিল, না? যেখানে আজ ঘুমিয়েছি।’
‘হ্যাঁ। ফুআম্মার খুব শখ ছিল আমি বিয়ে করলে সামনে বাগানবিলাসের ঝাড় ওঠা ওই পশ্চিমের ঘরে বউ নিয়ে উঠব। কিন্তু কাল আমরা হুট করে চলে আসায় ঘরটা গোছাতে পারেন নি৷ কিছু মেরামতও জরুরি ছিল। সেজন্য আমাকে পূবের ঘরে থাকতে বললেন। আর ওই ঘরেই আমাদের প্রথম থাকতে দেবেন বলে তোমাকে রাখলেন নিজের ঘরে নিজের সাথে।
আসলে ফুআম্মার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষী ব্যপার স্যপার রয়ে গেছে এখনো।’ বলতে বলতে নিনাদ আনমনে একটু হাসে।
মাথা নিচু করে তিতিক্ষা, ‘তবে উনি খুব ভালো মনের মানুষ।’
মনে মনে তখন একটা নতুন প্রশ্ন উদয় হয়েছে তার। এতক্ষণ ধরে হাটছে। অথচ কিছুই তো নজরে আসছে না। ওদের গন্তব্য আদতে কোথায়?
তিতিক্ষার মনে মনে সাজানো প্রশ্নের সন্ধানই যেন নিনাদ পেয়ে যায় টেলিপ্যাথির মাধ্যমে। সহসা নিজ থেকে বলে,’ আমরা প্রায় এসে এসেছি। ওইতো দিঘির ঘাট দেখা যাচ্ছে। তার আগে একবার এদিকে এসো।’ নিনাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলে তিতিক্ষা।
‘ওইযে সারি সারি নারকেল গাছ দেখছো। ওর নিচে আমার বাবা মায়ের আর.. ছোট ভাইয়ের কবর।’
‘ওহ..’ একটু অপ্রস্তুত মনে হয় তিতিক্ষাকে। সে কবর দেখার দুআ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর…’
.
মধ্যাকাশে স্থিত চাঁদের আলো পড়ে ঝলমলায় দিঘির স্বচ্ছ জলে। টলমল জলের কালো রঙ দেখায় অন্যরকম। হিমানী বাতাসে তিরতির করে সেই কালো জলে স্রোত বইতে থাকে। বাতাসের অনুষ্ণ ভাব গায়ে জন্ম দেয় মৃদু শিরশিরে অনুভূতি। পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে নীল জ্যোৎস্নায়। শাঁন বাধানো ঘাটের শীতল সিড়ির ধাপে বসে চাঁদের আলোয় ওরা দেখে নিশীথের অন্য আরেক রূপ ও রঙ। কতক্ষণ কেঁটেছিল কে জানে! স্মৃতি কাতরতায় সমাচ্ছন্ন নিনাদ সহসা বলতে আরম্ভ করে কথা,
‘ছেলেবেলায় এই ঘাট আর এর আশেপাশেই গড়েছে আমার শৈশব কৈশোরের সবচেয়ে সুন্দর কিছু স্মৃতি। যখন আম্মা ছিল, আব্বা ছিল আর ছিল আমার ছোট ভাই… বনের পরে ওই জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙা কাঠের বাড়িতে আমরা থাকতাম। রোজ ভোরে ঘুম ছেড়ে উঠেই দিঘির পাশের ওই মাঠে ডাংগুলি খেলতে চলে আসতাম আমি আর বন্ধুরদল। তারপর সারাদিন ওই মাঠেই পড়ে থাকতাম খেলা নিয়ে। কখনো আম্মা এসে কান ধরে বাড়ি নিয়ে যেত। কখনো আব্বাকে পাঠাতো। আব্বা এলে আর কান ধরাধরি নেই। সোজা কাঁধে চড়িয়ে ফিরতেন বাড়ি।’
‘তাহলে তো বলতে হয় বেজায় আনন্দে কেটেছে আপনার ছেলেবেলা।’
‘হ্যাঁ, ততকাল আনন্দেই কেটেছে আব্বা আম্মা বেঁচে ছিল যতকাল..’
‘তারপর কি হলো? ‘
‘যা হবার তাই হলো! ভাগ্যের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে এলো। সেই থেকে জীবনের সঙ্গে আজও যুঝছি।’ খানিকটা অন্য মনা হয়ে পড়ে নিনাদ।
‘আপনার জীবনের শুরুটা বেশ করুণ। তবে যাদের শুরুটা মন্দ দিয়ে হয়, সাধারণত তাদের শেষটা হয় সুন্দর। কিন্তু আফসোসের কথা হলো শুরুর মতো আপনার শেষটাও বোধহয় মন্দই হবে। দুর্ভোগ, দুরাকাঙ্ক্ষায় একদিন সুখ নামের পাখি চিরতরে পিঞ্জর ছেড়ে পালাবে।’
সম্বিৎ ফিরে অবাক গলায় প্রশ্ন করে নিনাদ, ‘তারমানে?’
‘সত্যি জানেন না?’ একটু কাষ্ঠ হাসি হাসে তিতিক্ষা।
‘অনেক দুঃখ দুর্দশায় এতটা পথ পাড়ি দিয়ে একজীবনে যাকে অর্জন করেছেন, তার জীবন আবার কলঙ্কের হাজার প্রলেপে কালিমালিপ্ত। আজ হোক কিংবা কাল, আপনার প্রিয় মানুষেরা যখন এই সত্য জানবে, ধীরে ধীরে আপনার বিতৃষ্ণা জন্মাবে এই সম্পর্কের প্রতি, আমার প্রতি। মনে হবে সবাই নির্ভেজাল কাউকে নিজের করে পেল, আর আমি পেলাম…’
নেমে এলো মৃত্যুর মতো নিদাঘ নিরবতা। তিতিক্ষা ভেবেছিল নিনাদ সেই মুহুর্তেই ওর কথার প্রতিবাদ করে উঠবে। করল না দেখে ওর ধারণাই আরো দৃঢ় হলো। এই অল্প কিছু কালের তরে ওরা যতটা কাছে এসেছিল হটাৎ তার থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে ছিটকে পরল দুজনে। পূর্বানুরূপ খেয়াল অনুসারে তিতিক্ষার আবারো মনে হলো পৃথিবীকে শোনানোর জন্য যে যত নীতিকথার বুলিই আওড়াক না কেন, দিনশেষে ওরা সবাই মানুষ, ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে না ওঠা সাধারণ স্তরের মানুষ। কম্প্রোমাইজ করতে করতে ওদেরও মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় জিতে যেতে। প্রতিবার অন্যের সুখের জন্য ছাড় দিতে দিতে একবার অন্তত নিজের করে কিছু পেতে। নিনাদকে কি সে এসবের ঊর্ধ্বে কেউ মনে করেছিল? ভেবেছিল কি নিনাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হবে আর দশজনের চেয়ে? এমন ভাবাটা কি উচিত না যুক্তিসংগত?
‘তিতিক্ষা..’
ডাক শুনে মোহ ভাঙে তিতিক্ষার। ও পাশ ফেরে।
‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপমা কি জানো? চাঁদের সাথে মানুষের তুলনা। যুগে যুগে প্রিয়র মুখকে তুলনা করা হয়েছে চাঁদের অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে। অথচ সেই চাঁদের গায়েও আছে কলঙ্ক।’
নিঃসাড়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে তিতিক্ষা, ‘কিন্তু আমি তো চাঁদ নই…’
‘চাঁদ হওয়া বুঝি খুব ভালো? নক্ষত্রের চাঁদের মতো ঐশ্বর্য নেই। নেই বলে ওদের দুঃখও নেই। ছায়াপথ জুড়ে অগণিত নক্ষত্রেরা কি সুন্দর মিলেমিশে থাকছে দেখো। অথচ আলোহীনা চাঁদ, সূর্যের আলোয় আলোকিত হবার দুঃখে সবার চেয়ে বিচ্ছিন্ন। নিজের গায়ে অযাচিত কলঙ্কের ছাপে সদাসর্বদা বিব্রত। এই দ্বিধা ওর কোনো উপকারে আসেনি। কেবল দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে সবার থেকে।
যে বিপর্যয়ে তোমার কোনো হাত ছিল না তার জন্য সবার থেকে দূরে সরে যাওয়াই কি একমাত্র সমাধান?’
‘আমি দূরে সরে যেতে চাইনি।’
‘অবশ্যই চেয়েছো। আগে প্রকাশ্যে চাইতে। এখন অন্য কিছুর মধ্যস্থতায় চাইছো।’
‘আমি কি চাই না চাই তা বুঝি আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন?’
‘জানি। তুমি চাইছো আমি, আমরা সবাই যেন তোমাকে একা ছেড়ে দিই। নিজের কষ্টদায়ক অতীত অধ্যায় নিয়ে তুমি একা বাঁচো।’
‘না, এমন কিছু কখনো চাইনি আমি!’
‘সত্যি চাওনি?’
কয়েক মুহুর্ত ভাবে তিতিক্ষা। তারপরই পূর্বের সেই দৃঢ়চেতা ভাবটা ওকে ছেড়ে দূরে কোথায় পালিয়ে যায়।
‘যদি তাই হয় তাহলে যে অতীতের কথা ভুলে আমরা সবাই তোমাকে আগের তিতিক্ষা হিসেবে মানতেই বেশি আগ্রহী, তুমি নিজে কেন তা পারছো না? কেন আমরা ভুলতে চাইলেও তুমি বারবার সেসব মনে করো? তোমার এসব আচরণের জন্য প্রতিটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। যখনি স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাইছে, তোমার আর্তনাদ থামিয়ে দিচ্ছে তাদের।
আর কি বলছিলে? আমার প্রিয় মানুষেরা কখনো এসব জানলে ওদের কথায় প্রভাবিত হয়ে তোমার নিয়ে আমি আফসোস করবো?
এত নীচ ধারণা আমার সম্পর্কে তোমার?’
ক্রুদ্ধ চোখে ওর মুখপানে তাকিয়ে রয় নিনাদ। ভাঙবে না বলেও একসময় কান্নায় ভেঙে পড়ে তিতিক্ষা। মনে হতে থাকে সত্যিই প্রতিটি মুহুর্তে সে শুধু ধোঁকা দিয়ে গেছে তার প্রিয় মানুষ দেরকে। সবাই ওকে আগের নির্মল তিতিক্ষা হিসেবে মেনে নিতে চেয়েছে, আর সে নিজে… পলে পলে কষ্ট পেয়েছে অতীতকে ভেবে।
তিতিক্ষার মনে হলো চিৎকার করে পৃথিবীকে শোনায়, ‘আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। কখন জেনেবুঝে কষ্ট দিতে চাইনি তোমাদের। বিশ্বাস করো, একবার বিশ্বাস করো আমাকে..’
‘তোমার কি সত্যিই ধারণা যে সমুদয় অতীত সহ তোমায় আমি কখনো গ্রহণ করতে পারবো না? হলে অকপটে জানাও। একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার আমাদের।’
তিতিক্ষা বিহ্বল হয়ে চাইল।
‘কিছু একটা বলো।’
স্তব্ধতা ভেঙে বলল,’ যদি বলি ‘না’। তাহলে কি আপনি আমায় ছেড়ে দেবেন?’
‘তুমি কি এটাই চাও?’
‘আমার চাওয়ার কথা বলছি না। আপনার ছেড়ে দেবেন কিনা তাই বলুন।’
উত্তর করতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হল নিনাদের,’তুমি যদি চাও তাহলে হয়তো…. ধরে রাখবো না…’
‘যেতে দেবেন যেখানে খুশি?’ তিতিক্ষা সজল চোখে তাকায়।
‘কোথায় যাবে তুমি?’
‘দেখতে চান?’
নিনাদ কিছু বলে না। দুর্বোধ্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষণকাল পরে ওর চোখের সামনে দিয়ে তিতিক্ষা নিচে নামতে থাকে দিঘির সিড়ি বেয়ে।
‘কোথায় যাচ্ছো?’ দ্রুত সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে নিনাদ। বিস্ময়ভারাতূর দৃষ্টি ওর চোখে।
‘আপনি না রাখলে যেখানে যাওয়ার কথা…’
‘তাই বলে দিঘির জলে?’
তিতিক্ষা চোখের জল মুছে বলে, ‘আপনি ছেড়ে দিলে তো যাওয়ার জায়গা নেই। আর কোথায় যাব?’
দু পা এগিয়ে এসে হঠাৎ তিতিক্ষার ধরে ফেলে নিনাদ। রাগত স্বরে বলে, ‘তিহা যে বলে তুমি বাচাল হয়ে যাচ্ছো। মিথ্যে বলে না।’
‘আপনাকে যে মেছো ভূতের সর্দার বলে সেটাও তাহলে সত্যি।’
‘এইসব বলেছে তিহা!’
‘আরো অনেক কিছু বলেছে।’
‘কি বলতো?’
‘বলা যাবে না।’
‘কেন?’
‘আমার ইচ্ছে তাই!’
‘সবসময় শুধু তোমার ইচ্ছে? আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই?’
‘নেই নাকি?’
‘না নেই৷ এই যেমন ধরো আমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রেখে সারারাত এই ঘাটে শুয়ে চাঁদ দেখি। ইচ্ছেটা কি পূরণ হবে?’
তিতিক্ষা গুরুতর ভঙ্গিতে বলে, ‘হবে না। কারণ এখন আমি আপনার কোলে শুয়ে বকবক করবো আর আপনি আমার মাথায় বিলি কেটে দেবেন।
কি হলো, মুখে রা নেই কেন? দেবেন না?’
‘আসলেই তুমি একটা পেতনি!’
‘আর আপনি মেছো ভূতের সর্দার।’ বলে ওরা দুজন একসাথে হেসে ওঠে। দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে সে হাসির রিনরিনে ঝংকার।
————সমাপ্ত