থুঃ
মিলি উদ্বিগ্ন মুখে কোর্ট হাজতের সামনে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। থানার পিকআপ ভ্যান এখনও আসামিদের নিয়ে কোর্টে পৌঁছে নি।
বদরুল। হালকা-পাতলা গড়ন। হাসি-হাসি মুখ। কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। কম্পিউটার তার নেশা। ক্লাসের চেয়ে নিজের চেষ্টায় হাতে-কলমে শিখেছে অনেক বেশি। চাকরি মেলে নি। ফার্মগেটের যমুনা কম্পিউটার সেন্টারের প্রশিক্ষণ শাখায় খণ্ডকালীন প্রশিক্ষকের কাজ করে নিজের খরচটা চালিয়ে নেয়। মিলির সাথে বদরুলের বন্ধুত্ব একেবারে আকস্মিক।
মিলি গ্রাফিক্স ডিজাইনের কয়েকটি কাজ নিয়ে সেন্টারে এসেছিল। বদরুলের কাজ নয় কিন্তু মালিকের কথায় না বলতে পারে নি। কাজ করতে করতে বদরুল মিলিকে প্রস্তাব দিল, ‘একঘেয়েমি লাগছে। আমি চা খেতে একটু বাইরে যাব। ফার্মগেটে আমার চা খাবার একটি নির্দিষ্ট দোকান আছে। ফুটপাতে। বড় ভালো চা বানায়। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সাথে যেতে পারেন। আপনি খাবেন সেখানে?’
মিলি স্মার্ট-চটপটে স্বভাবের। চাল-চলনে জড়তা নেই। সম্মতি জানিয়ে বদরুলের সাথে বেরিয়ে এলো।
চা খাওয়া শেষ। বদরুলের অন্যমনস্কতার সুযোগে মিলি বিল দিতে গেলে দোকানদার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখিয়ে দিয়ে বাধা দিল, ‘আফা, জমসেদ আলি আপনাগো চায়ের বিল দিয়া দিছে।’
দোকানদারের দেখিয়ে দেয়া জমসেদ আলির দিকে তাকিয়ে মিলির চক্ষু স্থির। জমসেদ আলি ফার্মগেট ওভার ব্রীজের নিয়মিত ভিক্ষুক। একটি হাত নেই। আরেকটিও প্রায় অকেজো। রেগে ফিরে এসে মিলি বদরুলকে বলল, ‘একি! আপনি আমাকে ফকিরের টাকায় চা খেতে নিয়ে এসেছিলেন?’
বদরুল উত্তর দেয়ার আগেই জমসেদ আলি এগিয়ে এসে মিলির উদ্দেশে কথা শুরু করল, ‘আফা, ফকিরগোরে কেউ আফনি কয় না। গেন্দা পোলাপানরাও আমাগোরে তুমি কইরা ডাহে। বদরুল ছার এক্কেবারে আলাদা কিছিমের মানুষ। আমাগোর মইদ্যে যারা ছারের বড়, ছার হেগোরে আপনি ডাহে, সম্মান করে। আমাগোর বালা-মন্দের খবর লয়। আমরা কেডা, কোনহান থেইক্কা আইছি, কোনহানে থাহি সব ছারের জানা। আমাগোর কারো বিপদ অইলে ছাররে কওন লাগে না। নিজের থেইক্কা আগাইয়া আহে। ছাররে তহন বড় আপনা মনে অয়। আপনা মানুষের মেমানের চায়ের দাম দেওন কি অপরাধ?’
মিলি হতভম্বভাব গোপন করে সহাস্যে বলল, ‘না, অপরাধ না। ঠিক করেছেন। আজ আপনি খাওয়ালেন, আরেকদিন আমি এসে আপনাদের খাওয়াব।’
মিলি নিজের কাছে ধাক্কা খেল। সুন্দর অনুভূতি। বড় হবার পর এই প্রথম অন্তর থেকে কোনো ভিক্ষুককে সম্মান দেখিয়ে তার আপনি সম্মোধন করা।
সেন্টারে ফেরার পথে মিলি রসিকতা করল, ‘জমসেদ আলির কথায় মনে হলো, ওদের টাকায় আজ আপনার প্রথম চা খাওয়া নয়। আপনি দেখছি, ফকিরের রাজা।’
বদরুলও রসিকতা করতে মিলিকে ছাড় দিল না, ‘জমসেদের টাকার চা কিন্তু এখনও আপনার হজম হয় নি। আমি ফকির-রাজা হলে আপনিও এ মুহূর্তে ফকির-রাণী।’
ভিক্ষুকের টাকায় চা খাওয়া থেকে উদ্ভূত রাজা-রাণীর সম্মোধন আপনি থেকে তুমিতে নেমে দুজনের মধ্যে নিখাদ বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। মাঝে মাঝে দেখা হয়। বন্ধুত্বের টান বদরুলের চেয়ে মিলিরই বেশি। বদরুলের স্বল্পসন্তুষ্টি-সম্মানবোধ-আত্মবিশ্বাস মিলিকে টানে।
মিলি স্বচ্ছল-শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। ঢাকায় নিজেদের পাঁচতলা বাড়ি। সরকারি চাকরির জন্য মিলি পারিবারিকভাবে জানাশোনা দুএকজন আমলার কাছে বদরুলকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বদরুল প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘মিলি, আমার বাবা চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। আমি তখন সবেমাত্র ডিপ্লোমায় ভর্তি হয়েছি। বাবার হার্টে ব্লক ধরা পড়ল। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু ছিল না। ধার-দেনা করে বাবার ওপনেহার্ট সার্জারি করালাম। দেনা শোধ করতে গিয়ে বাবার বেতনের টাকায় বাড়িভাড়া-চিকিৎসা-সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। ভেঙে পড়ি নি। বিকেল বেলা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গার্মেন্টসের রিজেক্ট সার্ট-প্যান্ট বিক্রি করতাম কিন্তু পড়ালেখাটা ছাড়ি নি। বড় চাকরির আশা করি না। কম্পিউটারের কাজ যতটুকু জানি তাতে পিছনের দরজা দিয়ে নয়, নিজের মেধা-শ্রম-যোগ্যতা দিয়ে ঠিকই একদিন আমি সরকারি চাকরিতে ঢুকে যাব। একটি সরকারি দপ্তরে একশজনের বেশি কম্পিউটার অপারেটর নিবে। লিখিত-ব্যবহারিক-মৌখিক পরীক্ষার তিনটিই খুব ভালো দিয়েছি। আশা করি চাকরিটা হয়ে যাবে।’
বদরুলের এমন উত্তরে মিলির কিছু বলার থাকে না। একদিন কথায় কথায় বদরুল যে অধিদপ্তরে পরীক্ষা দিয়েছে মিলি সেই অধিদপ্তরের নামটি জেনে নিল।
কয়েকদিন পর মিলি হঠাৎ বাসায় এসে মোবাইল বন্ধ রাখার জন্য প্রথমে বদরুলের সাথে রাগারাগি করল। তারপর বদরুলকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাজারবাগ অফিসার্স কলোনির গেটে দাঁড়িয়ে মিলি বদরুলকে কলোনিতে নিয়ে আসার কারণ বলল, ‘বদরুল, আমি জানি, কম্পিউটার অপারেটরের চাকরির জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন তোমার যোগ্যতা তার চেয়ে অনেক বেশি। তবু একটু যোগাযোগ রাখার দরকার হয়। তুমি যে অধিদপ্তরে পরীক্ষা দিয়েছ সেই অধিদপ্তরের বড়বাবু এই কলোনিতে থাকেন। তোমার চাকরিটার নিয়োগ কবে দিবে না-দিবে সেই খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য আমি ছোটোমামাকে অনুরোধ করেছিলাম। ছোটোমামা অধিদপ্তরের এক পরিচালকের সাথে কথা বলেছেন। পরিচালক সাহেবই তোমাকে বড়বাবুর সাথে দেখা করতে বলেছেন। দেখা করলে ক্ষতি কী বলো? তুমি তো আর ঘুষ হাতে নিয়ে যাচ্ছো না। শুধু গিয়ে অনুরোধ করব, যদি মেধা তালিকায় থাক তাহলে যেন দয়া করে তোমাকে বাদ না দেন। প্লিজ, আমার কথা রাখ।’
মিলির চোখে মিনতি। বদরুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারল না।
মিলি পরিচয় দিতেই বড়বাবু বললেন, ‘ভিতরে এসো, মা। বদরুল আলম নামের একজন প্রার্থীর আমার সাথে দেখা করার কথা পরিচালক সাহেব গতকাল আমাকে বলেছেন। অফিসে না গিয়ে বাসায় এসে ভালো করেছো।’
বড়বাবু আকার-ইঙ্গিতে যা বললেন তার জন্য মিলি-বদরুল কেউ প্রস্তুত ছিল না- লেনদেন সমাচার। দুজনের কারও বুঝতে দেরি হল না যে, এই চাকরির লেনদেনের মধ্যস্থতার দায়িত্বে আছেন বড়বাবু।
মিলি সদালাপী বদরুলের নতুন একটি রূপ দেখতে পেল। বদরুল মুখটা কঠিন করে বড়বাবুর উদ্দেশে বলে গেল, ‘ক্ষমা করবেন। একজন ছিনতাইকারি উপস্থিত যা পায় সেটা নিয়ে বিদায় হয়। নিয়োগবোর্ডের সদস্যগণের স্বজনপ্রীতি আর অর্থের মোহে যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া আর যোগ্য প্রার্থীর সারা জীবনের আশা-আকঙ্খা, সুখ-স্বপ্ন, রুটি-রুজি, অধ্যাবসায়-পরিশ্রমের সুফল ছিনতাই করে নেয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রাস্তার ছিনতাইকারিকে মারধোর করি কিন্তু চেয়ারে বসা ছিনতাইকারিদের আমরা কিছুই করতে পারি না।’
কথা শেষ করেই বদরুল মিলিকে বলল, ‘উঠো, আর এক মিনিটও নয়। এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। টাকা ছাড়া চাকরি হলে হবে, না-হলে না হবে।’
বড়বাবুকে সালাম জানিয়ে বদরুলকে নিয়ে মিলি বের হয়ে গেলে বড়বাবু দরজাটা বন্ধ করার সময় বদরুলের উদ্দেশে মনে মনে বললেন, ‘ত্যাদড় ছেলে।’
চাকরিটির আশা বদরুল ছেড়েই দিয়েছিল, কিন্তু এই চাকরি যে তার আত্মসম্মানে এমনভাবে আঘাত হানবে তা কখনও ভাবে নি। বদরুলের প্রশিক্ষণার্থী ফিরোজ নিজের এক খুশির সংবাদ নিয়ে কম্পিউটার সেন্টারের সবার সাথে দেখা করতে এলো। চাকরি হবার সুসংবাদ। ফিরোজ যুব উন্নয়ন অধীদপ্তরের অধীনে কম্পিউটার শিক্ষার উপর তিন মাসের একটি কোর্স করেছিল। চর্চার অভাবে অনেকটাই ভুলে গেছে। চাকরিতে আবেদন করার পর ঝালিয়ে নিতে যমুনা কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি হয়। অধিদপ্তরের নিয়োগপ্রাপ্ত একশজনের তালিকায় বদরুলের ঠাঁই হয় নি কিন্তু যে ফিরোজকে নিয়ে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের প্রথম অধ্যায়ের পুরোটা জানে কি-না সন্দেহ রয়েছে সেই তালিকায় ফিরোজের জায়গা হয়েছে। এ যেন প্রশিক্ষণার্থীর কাছে প্রশিক্ষকের নির্মমভাবে হেরে যাওয়া। এমন তালিকার নেপথ্যের কারিগরদের উপর বদরুলের ঘৃণা চরমে উঠে গেল।
সন্ধ্যার দিকে মিলি সেন্টারে এলো। বদরুলের মনমরা ভাব দেখে মিলি বুঝে গেল কিছু একটা হয়েছে। মিলি বদরুলকে প্রশ্ন করল, ‘বদরুল, মুখ দেখে বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ। বড়বাবুর বাসায় নিয়ে যাবার জন্য তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
মিলির কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বদরুল মন খারাপের বিষয়টি চাপা দেবার চেষ্টা করল কিন্তু সফল হল না। মিলির চাপাচাপিতে ফিরোজের চাকরি হবার কথাটি মিলিকে জানাতেই হল। বদরুলের মন খারাপের কারণ জেনে মিলি বড়বাবুর উদ্দেশে একটি কুমন্তব্য করে প্রশ্ন করল, ‘এদেরকে শিক্ষা দেবার কি কোনো উপায় নেই, বদরুল? যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে টাকার জন্য অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেয়া বিরাট অন্যায়, এতে দেশেরও ক্ষতি হয়। ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, যে দেশে গুণের কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মায় না।’
মিলির প্রশ্নের উত্তরে বদরুল বলল, ‘মাথায় একটি আইডিয়া এসেছিল কিন্তু তোমার কথা ভেবে বাতিল করে দিয়েছি। তোমার মামার রেফারেন্সে বড়বাবুর কাছে গিয়েছিলাম। সেটা করলে তোমার মামা রাগ করতে পারেন। তুমিও জড়িয়ে যেতে পার।’
ওটা আমার ব্যাপার। আগে আইডিয়াটা বলো। তারপর আমার ব্যাপারটা ভেবে দেখব। বদরুলের আইডিয়ার কথা শুনে মিলি নেচে উঠল, ‘কি দারুণ আইডিয়া! আমাদের কিছু হবেনা। হলেও আমি সামাল দিয়ে নিব। আমি জরুরি কাজে তিনদিনের জন্য আগামিকাল কুমিল্লা যাব। ফিরে এসে দুজনে মিলে কাজটি করব। বদরুল, কাজটি শেষ হলে তোমাকে আমার একটি কথা জানাবার আছে।’
বদরুলের বাস্তবিকই মন খারাপ। অন্যদিন হলে হয়ত মিলির কথাটি শোনার জন্য বদরুল তখনই চাপাচাপি করত।
গতকাল মিলি কুমিল্লা চলে গেছে। বদরুল ভাবল, ভালোই হয়েছে, কেউ মিলিকে জড়াতে পারবে না।
বদরুল প্রতিবাদের প্রস্তুতির কাজে নেমে পড়ল। ফার্মগেটের ভিক্ষুকরা কতটা ভালোবাসে বদরুল তা জানে। দুপুর পর্যন্ত বদরুল ফার্মগেটে একটানা ব্যস্ত সময় কাটাল। একবারের জন্যও সেন্টারে ঢোকার সময় পেল না। বিদায়ের সময় সবাইকে বার বার মনে করে দিল, ‘ঠিক বিকেল চারটায় যেতে হবে।’
বদরুল এসে দেখল তার পৌঁছানোর আগেই ফার্মগেটের পরিচিত ভিক্ষুকদের সাথে সাথে আরও অনেক অপরিচিত ভিক্ষুক রাজারবাগ অফিসার্স কলোনির গেটের পাশে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। কলোনির বাসিন্দারা ভিতরে-বাইরে যাবার সময় প্রথমে ভেবেছিল, হয়ত কারও বাসায় ফকির-মিসকিন খাওয়াবে। চারটের পর ভিক্ষুকের ভিড় আরও বাড়তে থাকল। বদরুলকে অবাক হতে দেখে জমসেদ আলি এগিয়ে এসে বলল, ‘ছার, বাকীগুলারে আমরা নিয়া আইছি। আমাগোরে বন্ধু-বান্ধব।’
বদরুল ইশারা করতেই সবাই কলোনির দিকে মুখ করে বদরুলের শেখানো কথা স্লোগান আকারে বলা শুরু করল—
‘ঘুষ খাইবি খা,
লগে আমাগো থুতুও খা।
থুঃ’
পথচারীদের অনেকেই মজা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিক্ষুকদেরকে সবাই করুণ কণ্ঠে ভিক্ষে চায়তে দেখেছে। সেই ভিক্ষুকদের গলায় যে এমন জোর থাকতে পারে তা কখনও কেউ কল্পনা করতে পারে নি। কয়েক মিনিট না যেতেই আশেপাশের বস্তির উৎসাহী ছোটো-বড় অনেকেই এসে ভিক্ষুকদের সাথে গলা মিলিয়ে লাগাতার চিৎকার করতে শুরু করল। সবার মুখে একই কথা।
এতগুলি মানুষের চিৎকার কালোনির বাসিন্দাদের কানে পৌঁছাতে অসুবিধা হল না। কলোনির বাসিন্দাদের কেউ বাইরে এসে, কেউবা জানালা খুলে গেটের ঘটনা দেখতে লাগল। ধিক্কারদাতারা পারলে সবাই কলোনির গেটের দারোয়ানদের বাধা অতিক্রম করে গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
বদরুল যতটা চেয়েছিল ধিক্কার তার চেয়ে অনেক বেশি দেয়া হয়ে গেছে। ঢাকার রাস্তায় জ্যাম বাধতে দেরি হয় না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বদরুল সবাইকে সরে পড়ার নির্দেশ দিল। বদরুলের কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। কিছুক্ষণ না যেতেই জ্যামে এসে একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকা পড়ল। কাজ হল। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনকে পুলিশের সাইরেন ভেবে যে যেমনভাবে পারল দৌড়ে পালিয়ে গেল। বদরুলও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভিড়ে মিশে গিয়ে সরে পড়ল।
ঘটনার মূল হোতা যে বদরুল তা বুঝতে বড়বাবুর দেরি হল না। গেটের দারোয়ানদের একজন বদরুলকে চিনতে পেরেছিল। বদরুলের অভিনব কর্মকাণ্ডে কলোনির সৎ অফিসারেরা মনে মনে আনন্দ পেলেও স্বস্তি পেলেন না। কলোনির শমসের সাহেব সৎ অফিসার। ঘুমাতে যাবার সময় আক্ষেপ করে স্ত্রীকে বললেন, ‘ঘুষখোরেরা থুতু কেন আরও কিছু খেতে হলে খাবে কিন্তু ঘুষ খাওয়া ছাড়বে না। এদের জন্য সব অফিসারের বদনাম হয়।’
সৎ অফিসারেরা যতটা খুশি হয়েছিলেন অসৎ অফিসারেরা বদরুলের উপর তার চেয়ে শতগুণ বেশি চটে গেলেন। বদরুল এখন কলোনির ঘুষখোর অফিসারদের কাছে বদ-বদরুল।
বদরুলের সাথে মোবাইলে মিলির কয়েকবার কথা হয়েছে কিন্তু কলোনির ঘটনাটি ইচ্ছে করেই বলে নি। মিলির অনুপস্থিতিতে ঘটনা ঘটিয়েছে জানলে রাগ করতে পারে।
বদরুল আগুন দিয়েছিল। সেই আগুনে ঘি পড়ল পরের দিন। কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই জানে কলোনির কোন কোন অফিসার ঘুষ খান। বদরুলের জমায়েত করা ভিক্ষুকদের কর্মকাণ্ডে তারাও আমোদ পেয়েছিল। কলোনির মধ্যে একটি স্কুল এ্যান্ড কলেজ আছে। কলোনির ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগই সেখানে পড়ে। যাদের বাবারা ঘুষ খান না তারা পরদিন ক্লাশের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে ছড়া কেটে হাসাহাসি করল—
‘ঘুষ খাইবি খা,
লগে আমাগো থুতুও খা।
থুঃ’
ছেলে-মেয়েদের ছড়া কাটার ঘটনা কানে যেতেই ঘুষখোর অফিসারদের একটি অংশ ক্রোধ-উন্মাদে পরিণত হলো। বদরুল সাপের লেজে পা দিয়েছে। বিষধর সাপ।
রাত বারোটার দিকে পুলিশ বদরুলকে ধরে থানায় নিয়ে গেল। কলোনিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মামলা। বদরুলের পরিবার মামলা-মোকদ্দমাকে ভয় পায়। পুলিশ বদরুলকে নিয়ে যাবার পর পরই বদরুলের বাবা থানায় রওনা দিল।
বদরুলের মোবাইল বাজছে। মিলির ফোন। বদরুলের ছোটোবোন সুফিয়া ফোন ধরে বলল, ‘ভাইয়াকে কিছুক্ষণ আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’
সুফিয়ার মুখে ধরে নিয়ে যাবার কারণ শুনে মিলি আশ্বস্ত করল, ‘ভয় করো না। আমি খুব ভোরে ঢাকায় রওনা দিব।’
বদরুল শারিরীক নির্যাতন সহ্য করতে পারল কিন্তু ভোরের দিকে যখন তার নামে আরেকটি মামলার বিবরণ শুনল তখন মুষড়ে পড়ল। টাকা আর ক্ষমতার জোরে অনেক কিছুই হয়। বদরুলের মামলার বাদীদের দুটোই আছে। থানার দুএকজন অফিসার আপত্তি করেছিল কিন্তু টিকল না। সামনের টেবিলে রাখা পঁচিশ-ত্রিশ পিস ইয়াবা, তিন বোতল ফেনসিডিল আর তেরো-চৌদ্দ গ্রাম হেরোইনসহ মিডিয়াকে দেবার জন্য বদরুলের ছবি তোলা হলো। বদরুলের কপালে মাদক কারবারির তিলক সেঁটে দেবার জন্য যা যা করার দরকার তার কোনোটাই বাদ গেল না।
থানা হাজতে বসে ছাদের দিকে চোখ তুলে উপর ওয়ালার কাছে বদরুল আর্তনাদ করল, ‘হে আল্লাহ, আমি সারা জীবন সৎভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজেছি। অবশেষে আমাকে কি-না মাদক কারবারি সাজাল! এই অপবাদ নিয়ে আমি কি করে বাঁচব? আমার যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যাচ্ছে।’
কুমিল্লা থেকে আসার পথে মিলি ফোন করলে সুফিয়া জানিয়েছিল বদরুলকে সকাল এগারোটায় কোর্টে চালান দেয়া হবে। দেরি হবে ভেবে থানায় না গিয়ে মিলি সোজা কোর্টে চলে এসেছে। কোর্টের নতুন ভবনের চারতলায় এজলাস কক্ষ। উকিল সাহেবের সাথে কথা বলা হলে মিলি বদরুলের বাবা-মাকে সেখানে রেখে নিচে কোর্ট হাজতের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
কোর্ট হাজতের সামনে থানার পিকআপ ভ্যান এসে থামল। বদরুলকে নামানো হলো। বদরুলের হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি বাঁধা। দড়ির মাথাটা একজন কনস্টেবলের হাতে ধরা। বদরুলের বিষাদে ভরা চোখ দেখে মিলির অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। মিলির সাথে কথা হবার আগেই কোমরের দড়িতে টান পড়ল। বদরুল কথা বলার সুযোগ পেল না। কোর্ট হাজতে ঢুকে গেল।
বদরুলের উপর শারিরীক নির্যাতন। মিলির বুকের ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কুমিল্লা থেকে ফিরে এসে মিলি বদরুলকে যে কথাটা জানাতে চেয়েছিল মনে মনে সেটাই একবার বলল, ‘বদরুল, আমার কাছে তুমি শুধু বন্ধু নও। তার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি কিছু। তোমাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি।’
কোর্ট চত্ত্বর লোকারণ্য। উকিল সাহেবের সাথে মিলি আরেকবার কথা বলে এজলাস কক্ষের দিকে ফিরে গেল।
কোর্ট পুলিশরা উকিলদের চেনা লোক। বদরুলকে কনস্টেবল হারুন যখন নিয়ে যাচ্ছিল চারতলার সিঁড়ির মুখে এক উকিল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিসের মামলা?’
কনস্টেবল হারুন তাচ্ছিল্যের সাথে ঠোট উল্টিয়ে উত্তর দিল, ‘এ মাদক কারবারি, স্যার।’
কনস্টেবলের উত্তর শুনে বদরুল আবারও শিউরে উঠল। বদরুলের পক্ষে মাদক কারবারির অপবাদ নিয়ে জীবন পার করা অসম্ভব। বদরুল ভাবল, তার বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে বদরুল চরম সিদ্ধান্ত নিল।
এজলাস কক্ষের দরজা থেকে সিঁড়ি ঘর ত্রিশ কদমের দূরত্ব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাঁধের উপরের ফাঁক দিয়ে মিলি সিঁড়ির মুখে বদরুলকে দেখতে পেল।
বদরুল সামনে, পিছনে কনস্টেবল হারুন। বারান্দায় গ্রীল নেই। বদরুল সুযোগ নিল। হঠাৎ দুধাপ পিছনে সরে এসে সর্বশক্তি দিয়ে কোমর সমান রেলিং টপকে নিচে লাফ দিল। আকস্মিক হ্যাঁচকা টানে শরীরের টাল সামলাতে গিয়ে হারুনের হাত থেকে দড়ি ফসকে গেল। নিচের কংক্রিটের রাস্তার উপর বদরুল আছড়ে পড়ল।
মিলি বদরুলের নাম ধরে গগনভেদি চিৎকার দিয়েই নিচে দৌড় দিল। ভিড় ঠেলে মিলি সামনে এগিয়ে গেল। বদরুল উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা একেবারে থেতলে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বদরুলের প্রাণ প্রদীপ যে নিভে গেছে তা বুঝতে কারও দেরি হল না।
চোখের সামনে একটি জলজ্যান্ত যুবককে মরতে দেখে লোকের আহাজারি আর বদরুলের বাবা-মার বুকফাটা কান্নাকাটিতে কোর্টের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। শুধু একজন কাঁদতে পারল না। মিলি নিদারুণ শোকে পাথর হয়ে বদরুলের পায়ের কাছে সর্বক্ষণ বসে থাকল।
এক বদরুল চলে গেছে। দেশে চাকরি প্রার্থী আরও লাখ-লাখ শিক্ষিত বেকার বদরুল আছে কিন্তু বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়ে তাদের এই বেঁচে থাকাটাকে বেঁচে থাকা বলে না।
চাকরির ঘুষ প্রসঙ্গে লোকজন বদরুলের করুণ মৃত্যুর কাহিনি স্বজনদেরকে বললে কেউ কেউ ভাবে মনগড়া গল্প, বিশ্বাস করতে পারে না কিন্তু ঘুষখোরদের উদ্দেশে মনে মনে এ কথা বলতে ভুল করে না—
‘ঘুষ খাইবি খা,
লগে আমাগো থুতুও খা।
থুঃ’
শরীফ উদ্দীন