#ত্রিকোণ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#দ্বিতীয়_পর্ব
— ‘হ্যাঁ সবই জানি, তো এতে অবাক হওয়ার কি আছে? আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করে ও, মাস গেলে অতগুলো টাকা পায়, সেই হিসেবে তো ও আমাদের চাকর, যাদের নুন খায় তাদের জন্য এটুকু করবে না ও?’
— ‘প্লিজ গীতা, প্লিজ! চুপ করো তুমি, তোমার কথাগুলো শুনলে ঘেন্নায় গা রি রি করে, প্লিজ চুপ করো!’
— ‘হুঁ, তা তো করবেই! বাই দ্য ওয়ে, সরে যাও আমার সামনে থেকে, এখন আমি রেডি হব!’
— ‘কোথায় যাবে? তন্ময়ের সাথে দেখা করতে?’
— ‘ও ব্বাবা! আমার পেছনে আবার স্পাইও লাগিয়েছ নাকি তুমি? শোনো, আমি যেখানে খুশি যাব, তার জন্য তোমায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি, সরো!’
আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে গীতালি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইমন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ঐশিককে, ‘বাবা!’
ঐশিকও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
একটু পরেই তৃষা ঘরে এলেন। হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘ভালো ঘরের মেয়ে আনলাম ঘরে, ভাবলাম, তুই সুখী হবি, কিন্তু এ কাকে নিয়ে এলাম আমরা? তোর জীবনটা একেবারে শেষ করে দিলাম রে আমরা!’
— ‘মা প্লিজ এভাবে বোলো না, মানুষকে কি আর আগে থেকে বোঝা যায়?’
হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ। দরজাটা খুলতেই দেখা গেল, অভিনন্দা এসেছে। হাতে চকোলেট আর খেলনা।
— ‘ওমা তুই? আয় আয়।’ তৃষা অভিনন্দাকে নিয়ে গেলেন ঐশিকদের ঘরে।
— ‘অভিনন্দা, তুমি?’
— ‘হ্যাঁ স্যার, আসলে যখন থেকে শুনেছি যে সোনাবাবু কাল রাতে কান্নাকাটি করেছে, ওকে দেখার জন্য খুব উশখুশ করছে মনটা। তাই চলে এলাম।’
অভিনন্দাকে দেখেই ইমন এক রকম ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর কোলে, ‘অভি আন্টি!’
— ‘সোনাবাবু, দেখো তো কি এনেছি আমি তোমার জন্য!’ বলেই চকোলেট আর খেলনা গুলো ইমনের হাতে দিল ও।
ইমন তো সেসব পেয়ে মহা খুশি।
ঐশিক হেসে বলল, ‘ইমনের অভ্যেসটা খারাপ করে দিচ্ছ অভিনন্দা, এবার তো ও তোমায় ছাড়া আর একটা মিনিটও থাকবে না!’
— ‘তাতে কি? আমার সোনাবাবু যখনই ডাকবে আমায়, আমি ছুট্টে চলে আসব।’
অভিনন্দা চলে যাওয়ার পর তৃষা নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন, ‘কেন যে তোকে আরেকটু আগে দেখিনি মা, তাহলে তোকেই ঐশিকের বৌ করে আনতাম রে!’
কেটে গেল কয়েক মাস। অভিনন্দা একদিন একটু দেরি করে অফিস গেল। ও যেতেই ঐশিক হেসে বলল, ‘সূর্যদেব কি আজ পশ্চিমে উঠেছেন? আজ অভিনন্দা সবার পরে এল?’
কিন্তু অভিনন্দার মুখে অন্যদিনের মতো আর হাসির ঝিলিক খেলে গেল না। থমথমে মুখে ও বলল, ‘আসলে স্যার শরীরটা ভালো নেই তো, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।’
— ‘জ্বর টর বাধিয়েছ নাকি? এখন শুনছি অনেকেরই ডেঙ্গু টেঙ্গু হচ্ছে….’
— ‘না না স্যার, ওসব কিছু না।’
— ‘তাহলে?’
অভিনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই ও সেন্সলেস হয়ে গেল। ঐশিক তাড়াতাড়ি ওকে ধরল, নইলে হয়ত ও পড়ে যেত।
অভিনন্দার যখন জ্ঞান এল, ও দেখল ঐশিক চিন্তিত মুখে বসে আছে, আর ডাক্তারবাবু ওকে দেখছেন।
— ‘আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের এই এক সমস্যা বুঝলে ঐশিক’, ঐশিকের দিকে ফিরে বললেন, ‘খালি কাজ আর কাজ, শরীর স্বাস্থ্যের দিকেও যে নজর টজর দিতে হয় সেটা এদের কে বোঝাবে?’
— ‘হুম ডাক্তারবাবু, সে আর বলতে?’ ঐশিক সায় দিল, ‘একটা ফাইল এদিক ওদিক হবে না, অফিসে আসতেও লেট হবে না, বাড়িতে ডেকে পাঠানো হলেই তাড়াতাড়ি চলে আসেন ম্যাডাম, কিন্তু নিজেকে দেখার বেলায়? গোল্লা!’
— ‘আচ্ছা, আমি আপাতত কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আর কিছু টেস্টও লিখে দিচ্ছি, করিয়ে নিও।’
ভাবলেশহীন মুখে মাথা নাড়ল অভিনন্দা।
ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পরেই ঐশিক বলল, ‘আজ তুমি রেস্ট নাও অভিনন্দা, আজ তোমার ছুটি।’
অভিনন্দা হেসে বলল, ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে স্যার, এই সামান্য অসুখে আমার কিছু হবে না।’
— ‘তুমি বড্ড বেশি কথা বলো! তুমি আজ ছুটি নেবে, এটা আমার অর্ডার!’
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ঐশিক ফোন করল অভিনন্দাকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবেই ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল।
— ‘আমাদের জন্য মেয়েটা অনেক করেছে রে, ওর অসুস্থতার সময়ে আমাদেরও তো ওর পাশে দাঁড়ানো উচিত, তাই না?’
— ‘হুম মা, একদমই তাই।’
একটু পরেই অভিনন্দার ফ্ল্যাটে কলিং বেল বাজল। দরজাটা খুলতেই অভিনন্দা দেখল, ঐশিক আর তৃষা দাঁড়িয়ে আছেন।
— ‘এ কি স্যার আপনারা?’
— ‘তা না এসে আর উপায় কি বলো অভিনন্দা, ফোনটা ধরলে না, আজ অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে তুমি,চিন্তা হয় না বলো তো?’ গম্ভীর মুখে জবাব দিল ঐশিক।
— ‘স্যার আপনারা শুধু শুধুই টেনসন….’
ওকে থামিয়ে দিয়ে ঐশিক বলল, ‘দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি ভেতরে আসার অনুমতিটাও দেবে?’
— ‘এমা ছি ছি স্যার, আসুন না, ভেতরে আসুন আপনারা প্লিজ।’
ঐশিক আর তৃষা এসে বসলেন ভেতরে।
একটু পরেই মিষ্টি আর জল নিয়ে এল অভিনন্দা, ‘এই ফ্ল্যাটে তো এ.সি. নেই, খুব কষ্ট হবে আপনাদের।’
— ‘থাক, আমাদের কষ্ট নিয়ে অনেক ভেবেছিস, এবার একটু তোর কথা বল।’ তৃষা বললেন।
— ‘হুম সেটাই। আর ফোন কেন ধরোনি সেটাও বলো।’ ঐশিক বলল।
— ‘আমি একদম ঠিক আছি স্যার, আসলে তখন ওয়াশরুমে ছিলাম…’ বলতে না বলতেই সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
একটু পরে যখন জ্ঞান এল ওর, ঐশিক চিন্তিত মুখে বলল, ‘তোমার ফোন না ধরার কারণটা এইবার আমার কাছে ক্লিয়ার হল। দেখেছ মা, ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম, নইলে তো উনি কিছুই জানাতেন না, কাল আবার ড্যাংড্যাং করে অফিস চলে আসতেন!’
চলবে,,