#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
(শেষ পর্ব)
শহরের অপর প্রান্তে তাদের পরিত্যক্ত ব্রিজে পৌঁছানোর আগে কোনো কথা হলো না দুজনের মধ্যে। বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে নামল রাইয়ান।
অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে তাদের প্রিয় ব্রিজের ভাঙা জায়গাটায় পা ঝুলিয়ে বসল এলিনা। নিচে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে নদীর কালো পানি।
রাইয়ান এসে তার পাশে বসার পর এলিনা শুধু বলল, “বল।“
“তার আগে বল আমার এই ব্রেসলেটের বাগ দিয়ে সাউণ্ড ট্রান্সমিট হয়ে কোথায় যাচ্ছে?”
“রেকর্ড হচ্ছে অফিসে আমার ডেস্কটপের একটা ফোল্ডারে।“
“কে কে জানে এটার কথা?”
এলিনা নিচের কালো পানির ওপরে চোখ রেখে বলল, “সত্যি কথা বলতে, কেউই জানে না। প্রথমে জানাইনি কারণ আমি পুরোপুরি শিওর না হয়ে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চাইছিলাম না। আর পরেও কেন জানাইনি, আমি আসলে জানি না।“
এলিনার চোখে অশ্রু টলটল করছে।
“গুড”, আচমকাই বলে বসল রাইয়ান। “চলো আমরা পালিয়ে যাই। প্লিজ!”
“পালিয়ে কোথায় যাব? আর তুমি তো আমাকে এখনো বললে না যে তুমি কাদের জন্য কাজ কর?”
রাইয়ান ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “খন্দকার গ্রুপ। আমাকে এসাইন করা হয়েছিল কিবরিয়া গ্রুপের উইক পয়েন্ট আর স্ট্রং পয়েন্ট বের করার জন্য। সো আমি তোমাকে টার্গেট করলাম। রাস্তায় সেই মেয়ের ওপর হুলিগানদের আক্রমণ, সবটাই ছিল আমার সাজানো। আমাদের বসকে তোমাদের সিইও ভীষণ অপমান করেছিল গত বছর। অপমানটা তিনি ভুলতে পারেননি। প্ল্যান ছিল এই শাড়িটা মার্কেটে এনে তোমাদের শেষ করে দেওয়ার। আর আমি এসব আমাদের ফ্ল্যাটে বলতে চাইনি কারণ ওখানে সিসি ক্যামেরা ফিট করা। আরিয়ান কেমিক্যালস কিছুই জানে না। নিহিলিন বিষটা পরে মেশানো হতো।“
“জানি, আমি শুনেছি।“
এলিনার হাত খপ করে ধরে ফেলল রাইয়ান। “সবই তো শুনলে, সখী, প্লিজ, চলো, আমরা এবার পালিয়ে যাই!”
উঠে দাঁড়াল এলিনা। “এখন আর তা সম্ভব নয়।“
ব্রিজের অন্ধকার থেকে হেঁটে হেঁটে আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এলিনা, রাইয়ানও তার পেছনে ছুটতে ছুটতে পেছন থেকে কাকুতি মেশানো কন্ঠে বলল, “কিন্তু কেন? আই লাভ ইউ! প্লিজ! আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি! আমি…”
অন্ধকারের গা ফুঁড়ে কোথা থেকে উদয় হলো আরো দুজন লোক। কঠিন মুখে এগিয়ে যেতে শুরু করল রাইয়ানের দিকে।
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রাইয়ান। “সখী, তুমি…”
এলিনা গিয়ে দাঁড়াল সেই লোক দুজনের সাথে। তার মুখ পাথরের মত, কোনো আবেগের ছাপ সেখানে পড়ল না।
রাইয়ানেরন শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে জানে ধরা পড়লে কী করা হবে তার সাথে।
প্রচণ্ড বেগে সে ছুটে যেতে লাগল ব্রিজের ভাঙা অংশের দিকে। এখান থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়লে অন্তত বেঁচে যাওয়া যাবে।
অন্য লোক দুজনের গতি আরো বেশি। তারা ক্ষিপ্রগতিতে ধরে ফেলল রাইয়ানকে।
একজনের হাতে উঠে এল খাপখোলা ক্ষুর। চেঁচিয়ে উঠল এলিনা।
“এসব কী? বস বলেছেন ওকে জীবিত ধরে নিতে!“
রাইয়ান লড়ছে, কিন্তু এরা প্রফেশনাল। ক্ষুরটা কেড়ে নেওয়ার জন্য হাতাহাতির মাঝখানে পড়ল এলিনা।
প্রচণ্ড ভয়ে তার মাথা কাজ করছে না। ডিফেন্সের সব স্টেপ সে ভুলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
নিজেও বুঝতে পারছে না এমন কেন হচ্ছে? অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ভালো।
আচমকা ক্ষুরটা হাতে চলে এল তার। কিন্তু একই সাথে অন্য লোকটা রাইয়ানকে আক্রমণ করল ছোরা হাতে।
রাইয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল এলিনা। কিন্তু নিজেও বুঝতে পারল না যে কখন সে চলে গেছে রাইয়ানের কাছে।
এলিনার বাম পাঁজরের নিচে আমূল গেঁথে গেছে ছোরাটা। তীক্ষ্ম ব্যথায় ককিয়ে উঠল এলিনা, তীব্র ভয়ে টান মেরে বের করে আনল সেটা।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, এলিনার পরনের লাল শাড়ি ভিজে উঠছে। অন্ধকারে সেই রক্তের রঙ মনে হচ্ছে কালো কালির মত।
এলিনা পড়ে যাবার আগে রাইয়ান ধরল তাকে।
সেই লোক দুজন আবার এগিয়ে আসছে, রাইয়ান এবার হিংস্রভাবে তাদের প্রতিহত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
এলিনা আর রাইয়ান যখন ভাঙা ব্রিজটা দিয়ে একই সাথে নিচে পড়ছিল তখন রাইয়ান শেষ বারের মত বলার চেষ্টা করল, “সখী, তোকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম রে! বিশ্বাস কর আমি সত্যিই পালাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না…”
সবটুকু বলা হলো না, তার আগেই নদীর কালো পানি বুকে টেনে নিল ওদের। আহত ফুসফুস নিয়ে পানির সাথে লড়াই করে ভেসে থাকার মত যথেষ্ট শক্তি ওদের আর ছিল না।
ডুবে যেতে যেতে রাইয়ান ভাবছিল, আচ্ছা এলিনার বাচ্চাটা জন্মালে কার মত হতো দেখতে? ওর মত? নাকি এলিনার মত?
পরদিন খবরে প্রকাশিত হলো, “পরিত্যক্ত ব্রিজের নিচে তরুণ তরুণির লাশ উদ্ধার। সাথে থাকা ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে জানা যায়, তরুণের নাম রাইয়ান হাসান, বয়স ২৯ বছর। লাশের গায়ে ক্ষতচিহ্ন দেখে অনুমান করা হয় স্থানীয় দুর্বৃত্ত ও ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে মৃত্যু। ব্রিজের ভাঙা অংশে স্ট্রীট ল্যাম্প ও সিসি ক্যামেরার অনুপস্থিতি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই নির্দেশ করে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।“
সমাপ্ত,,