#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া_মনি
পায়চারী করছে রাদ। উত্তেজিত হয়ে নয়, বরং তীব্র রাগ নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে রেহানা আনসারীর সঙ্গে দ্রুত কথা শেষ করে আপাতত পায়চারীতে মগ্ন সে। ইমরানের ওপর সে ক্ষি’প্ত। কখন কোথায় ওঁকে কথার মাধ্যমে হেনস্তা করে বসে নিজেও জানে না। সঙ্গে উত্তম-মধ্যম ফ্রী! গায়ে পড়ে ইসানার সঙ্গে কথা বলছে। অধিকার দেখাচ্ছে। যেটা তার একদম অপছন্দ।
রাদের পায়চারীর এক পর্যায়ে মুরাদের আগমন ঘটে।
ওঁকে ক্রোধান্বিত দেখে কারণ ধরে ফেলে। মেজাজ আরেকটু বিগড়াতে সে বলল,
‘শোন রাদ, ইমরানের সঙ্গে ইসানা আপুকে বেশ মানায়। আর এমনিতেও ইমরান ইসানা আপুর থেকে বড়ো। একদম পারফেক্ট জুটি হবে কী বলিস?’
কা’টা ঘা’য়ে নুনেরছিটে পড়েছে। জ্বলছে বিক্ষিপ্তভাবে। রাদ ফুঁসে তাকিয়ে বলল,
‘ইউ মেড, আই হেইড দিস পার্সোন। স্টপ ইট!’
‘তোর লাগছে কেন? তারও তো একটা ভবিষ্যত আছে তাই না।’
‘তো ইন্টারফেয়ার কে করলো?’
‘তুই করছিস।’
‘সেটআপ!’
‘কখনো স্টপ বলিস, কখনো সেটআপ বলিস। আসলে আমি করবটা কি?’ মেকি রাগ নিয়ে বলল মুরাদ।
‘আপাতত তুই প্লিজ চুপ থাক। আমাকে ভাবতে দে।’
‘ভালোবাসা কীভাবে আপুকে বলবি সেটা?’
রাদ তড়িঘড়ি হ্যাঁ বলে ফেলে। পরক্ষণেই তার মনে হয় সে ভুলে হ্যাঁ বলেছে। মুরাদের পানে তাকাতেই ওঁকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে। রাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেডে দপ করে বসে।
মুরাদ হেসে রাদের পাশাপাশি বসে বলে,
‘ভালোবাসা এমন একটি জিনিস যার উপরে আসে, তীব্রভাবে আসে। তুইও ভালোবাসা নামক রোগে আ’ক্রা’ন্ত। মেনে নে বিষয়টি।’
রাদ নরম ভঙ্গিতে তাকিয়ে সরসা কণ্ঠে বলল,
‘এটা ভালোবাসা?’
‘হুম, ইসানা আপুকে ভালোবেসে ফেলেছিস তুই।’
রাদ নজর সরিয়ে নেয়। মস্তিষ্ক জুড়ে ইসানার সঙ্গে অতিবাহিত সময় গুলো ভাবছে। তার জীবনে প্রথম ভালোবাসা বলতে ইসানাই! সে কখনো ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করেনি। লাইফে অনেক মেয়েদের কাছ থেকে প্রেমের প্রপোজাল পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে। কোন গুনে, কোন মায়া মুগ্ধতায় ইসানার ওপর আটকে গেছে বেমালুম!
হৃদমাঝারে বিন্দু বিন্দু ন্যায় বিশাল জায়গা করে নিয়েছে সে। রাদের চৈতন্য ফিরে মুরাদের স্পর্শে। কাঁধে হাত রেখে মুরাদ নরম স্বরে বলে,
‘রাদ শোন।’
‘বল।’
‘সোহানার মতো ইসানা আপুর জীবন না। সে কিন্তু ছোট থেকেই অনেক কষ্ট করেছে।’
রাদ প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। ইসানার সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা নেই৷ মুরাদের মুখে ইসানার ক্লেশময় কথা শুনে কিছুটা থমকালো। মুরাদ হাত সরিয়ে সরু নিশ্বাস নেয়। বলে,
‘সোহানা আমাকে সব বলেছে আপুর বিষয়ে। মামার সংসারে বড়ো হয়েছে সে। মামা পছন্দ করতো না। এজন্য নানান কষ্ট পোহাতে হয়েছে। তার অমতে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয় তার মামা। স্বামী আপুকে অস্বীকার করে পরদিনই পালিয়ে যায় বিদেশে। সেখানেও সুখী হতে পারেন না তিনি। চার বছর শত বেদনা লাঞ্ছনা নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় সে বাড়িতেই রয়ে যায়।
ফিরে না সে। শেষে ডিভোর্স পেপার পাঠান হয়। বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করে সোহানার কাছে উঠে। সেখান থেকেই তার জব হয় তোর ফ্যাক্টরিতে। তোর অগ্রীম টাকা গুলো মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে দিয়েছে ইসানা আপু।’
রাদের মনে পড়ে সেদিনের কথা। জরিমানার টাকা চাওয়ার পর ইসানা টাকা নেই বলে জানিয়েছিল। এখন রাদ টাকা না থাকার কারণটি বুঝতে পারে। তার প্রতি ভালোবাসাটা যেন তিরতির করে বৃদ্ধি পেলো।
‘তাকে ভালোবেসে আগলে রাখবো। বিন্দুমাত্র কষ্ট তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে দিবো না।’
‘খুশি হলাম দোস্ত!’ মুরাদ হেসে বাহবা দিয়ে বলল।
‘সে কি আমায় ভালোবাসবে?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
‘মন জয় করে নিতে হবে।’
নিরুত্তর থাকে রাদ। মুরাদ রাদকে কিছু আইডিয়া দেয়।
রাদ সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে।
_
সকালে এক সঙ্গে সবাই নাস্তা করছে। সবার খাওয়ার গতি দ্রুত হলেও ইসানা আনমনা হয়ে খাচ্ছে। চোখ হালকা লালচে। মুখে উদাসিনী ছাপ! রাদ আড়চোখে ইসানাকে বার বার খেয়াল করছে। মনে প্রশ্ন, কিন্তু জিজ্ঞেস করার ওয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। ভিতরটা তার বলছে কিছু একটা হয়েছে তার প্রিয়তমার! রাদ স্যুপের বাটির মধ্যে চামিচটি রেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘কাল গ্রিন কোম্পানির CEO এর সঙ্গে দ্বিতীয় মিটিং। আজকে তোমরা নতুন শহরটি ঘুরে দেখতে পারো।’
‘ওয়াও! কোথায় যাওয়া যায় বলো তো রাদ?’ খুশি মুখে বলল লিসা।
‘নো আইডিয়া।’ রাদ জবাব দিলো।
‘চলো সবাই একত্রে ঘুরতে যাই।’
‘হোয়াই নট! খাবার খেয়ে রেডি হয়ে নেও সকলে।’ মুরাদ বলল।
‘ওকে।’
যাওয়ার জন্য সকলে সম্মতি জানালেও ইসানা বলে না কিছু। সবার আগেভাগে খাবার অর্ধেক রেখে কামরাতে ফিরে আছে। রাদ প্রচণ্ড অবাক হয়। কালকের দিন থেকেই ইসানার এমন অদ্ভুত আচরণ মানানসই নয়। জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধাবোধ কাজ করছে। মুরাদ রাদের চিন্তিত ফেইস দেখে বুঝে নেয় বিষয়টি। হঠাৎ রাদের হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট আসে। সেটি করেছে ইভান। ফোন ওপেন করে ইভানের বার্তাটি পড়ে কপাল কোঁচকায় রাদ। কারণ ইভান ইসানার ফোন নাম্বার চাইছে। রাদ প্রথমে দিতে না চইলেও পরক্ষণে নাম্বার সেন্ড করে। ইভান ‘থ্যাংকস’ বার্তাটি পাঠিয়ে ইসানার নাম্বারে কল দেয়। বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল ইসানা। কাল রাত তার নির্ঘুম কেঁটেছে। পুরো প্রহর কেটেছে যন্ত্রণাদায়ক পুরনো স্মৃতিতে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। মোটা মোটা অশ্রু বর্ষিত হচ্ছে। হঠাৎ বিদঘুটে আওয়াজে ফোনটি বেজে উঠে। ইসানা আলতোভাবে চোখের পানি মুছে ফোন হাতড়িয়ে পীক করে। নাক টেনে সালাম দেয়। ইভান সালামের জবাব দেয়।
‘চিনতে পেরেছেন?’
‘কে?’
‘ইভান! ইভান আহমেদ।’
নাম শুনে হৃদয়ে তীর যেন এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে গেল। চোখ জোড়া আলতোভাবে বন্ধ করে নেয়। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘চিনতে পেরেছি।’
‘গুড! হাউ আর ইউ।’
বক্ষে শত বেদনা ধামাচাপা দিয়ে ইসানা বলে,
‘আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?’
‘ফাইন। কি করছেন?’
‘নাথিং!’
‘আমরা কি মিট করতে পারি?’
ইভানের এমন প্রশ্নে ইসানা অবাক হয় না৷ শান্তভাবে জবাব দেয়,
‘আমি যেহেতু রাদ স্যারের পি.এ। তার পারমিশন ছাড়া বাহিরে বের হওয়া নিষেধ।’
‘ওকে! কথাটা মাথায় রাখলাম।’
‘রাখছি।’
‘ঠিক আছে। টেক ইয়ার বাই!’
ইসানা ফোন রেখে সেভাবেই শুয়ে থাকে। টুপটাপ অশ্রুগুলো বর্ষিত হচ্ছে বিনাশব্দে।
সন্ধ্যার দিকে রাদ, মুরাদ বাহির থেকে হোটেলে ফিরে। তারা মূলত শপিংমলে গিয়েছিল শীতের পোষাক ক্রয়ের জন্য। ইসানা বাহিরে ঘুরতে যায়নি দেখে বাকিদেরও যাওয়া হয় না। এতে লিসা কিছুটা রেগে আছে। বাংলাদেশের তুলনায় আমেরিকায় অনেক শীত। নিজেদের জন্য ও লিসা, ইসানার পোষাক কিনেছে। রাদ লিসার ব্যাগটি মুরাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুই লিসাকে দিয়ে দিস।’
‘ইসানা আপুরটাও দে আমি দিয়ে দেই।’
রাদ সরু চোখে তাকায়। মুরাদ সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে,
‘তাকিয়ে লাভ নেই। ব্যাগটি দে আমাকে।’ বলতে বলতে লিসা ও ইসানার দরজায় করাঘাত করল। রাদ ব্যাগ পিছন দিকে সরিয়ে রাখে। মুরাদ পিছনে এসে নিতে নিলে এক প্রকার কাড়াকাড়ির অবস্থা সৃষ্টি হয়।
‘মুরাদ ছাড় বলছি।’
‘তুই ছেড়ে দে।’
‘ছাড়!’ বলেই মুরাদ রাদকে জোরেশোরে ধাক্কা দেয়। রাদ পড়ে যেতে নেয় কিন্তু মুরাদের গলার মাফলারটি খপ করে ধরে ফেলে। যার দরুন মুরাদ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাদের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আর রাদ দুপাশ করে ফ্লোরে চিৎ!
ইতিমধ্যে ইসানা ও লিসা দু’জনেই এক সঙ্গে কামরা থেকে বের হয়। ওদের দু’জনকে এ অবস্থায় দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। এই দৃশ্যটি ছিল হালুয়া মিশ্রিত সেদিনের নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক মুহূর্তের মতো। আজও তারা হতবিহ্বল! এ নিয়ে দ্বিতীয় বার হলো তাদের এমন অবস্থায় দেখেছে তারা। রাদ, মুরাদ দু’জনই লজ্জায় মাখোমাখো। তাদের ইজ্জতভ্রষ্ট! সময় বিলম্ব না করে দু’জনে উঠে দাঁড়ায়। লিসা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হচ্ছিল?’
‘এই ইডিয়েট আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।’ মুরাদকে দেখিয়ে মেকি রাগ নিয়ে বলল।
‘তাহলে মুরাদ কীভাবে পড়লো।’
‘আমার গলার মাফলার টেনে ধরেছিল।’
‘বুঝেছি, বুঝেছি আর বলার প্রয়োজন নেই। ডেকেছো কেন সেটা বলো।’
মুরাদ শপিং ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে অপরটি দিতে দ্রুত এগিয়ে যায় ইসানার দিকে। সেটি ইসানার নিকট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘শীতের পোষাক আছে ভেতরে।’
ইসানা শুকনো মুখে ‘থ্যাংকস’ বলে ভেতরে চলে এলো। লিসা দু’জনার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গ করে বলল,
‘তোমাদের দু’জনার বিহেভিয়ার কাঁপলসদের মতো। আমি বলছি না, যে কেউ দেখলেই বলবে। আগে থেকে সাবধানে থেকো। কেউ আবার তোমাদের লেসবিয়ান না বলে বসে।’ মিটমিটিয়ে হেসে লিসা রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।
দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রেগে বলল,
‘ইতর!’
‘বাঁদর!’
‘সব সময় আমার কাজে বাঁ হাত না দিতে পারলে ভালো লাগে না।’
‘না লাগে না। তুই তো আগে টানাটানি শুরু করেছিলি খাদ।’
‘কথা বলিস না আর।’
‘তুই বলিস না।’ দু’জনে গাল ফুলিয়ে একে অপরের রুমে গেলো।
.
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি
টানা আধা ঘণ্টা পর মিটিং শেষ হয়। গ্রিন কোম্পানির অফিসের ভেতর থেকে বের হবার সময় ইভান রাদকে পিছন থেকে ডেকে নিকটে এগিয়ে আসে। তিনি খুব সৌজন্যসূচক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
‘ফ্যাভোর চাই!’
‘বলুন মি.ইভান।’
‘আপনার পি.এ ইসানাকে আমেরিকা শহর ঘুরে দেখাতে চাই।’
‘অবশ্যই! যেতে পারেন। যদি সে যেতে চাই তো!’
‘মিস.ইসানা আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’ কথাটা বলতে বলতে ইসানার পানে তাকাল ইভান। বাকিরাও তাকিয়ে আছে। রাদ মনে মনে চাইছে ইসানা যেন না বলে দেয়। সে এক প্রকার বাধ্য হয়েই যেতে দেওয়ার কথাটি বলেছে। রাদের এই একই চাওয়া ইমরানও চাইছে। ইসানা জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘মাথায় পেইন হচ্ছে আজ যেতে চাইছি না।’
‘কোনো সমস্যা নেই। কাল সকালে বের হবো।’
ইসানা চোখের পলক ফেলে মাথা হালকা দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। ইভান প্রচুর খুশি হয়।
‘ওকে সি ইউ টুমোরো।’ বাক্য উচ্চারণ করতে করতে চলে যায়। ইসানা সবাইকে উপেক্ষা করে আগেভাগে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসে। রাদ, ইমরান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে বিপদের আভাস পুরোপুরি ভাবে কাটেনি। লিসা ইসানার পাশাপাশি না বসে রাদের পাশে এসে বসে। তার মনে কিঞ্চিৎ রাগ এসে ভর করেছে। সে ইসানাকে নিয়ে ঈর্ষা অনুভব করছে। সিনিয়র অপারেটর হয়েও তার থেকে ইসানাকে সবাই প্রায়োরিটি বেশি দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জাগ্রত হচ্ছে ইসানার ওপর। মুরাদ ইসানার পাশে বসেছে। রাদের ফেইস দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে। অনিচ্ছুক কাজ তাকে করতে হচ্ছে মানবতার খাতিরে। অন্যসব বিষয় আলাদা হলেও, ইসানার বিষয় রাদ একটু বেশিই সেনসিটিভ। প্রেয়সী বলে কথা! তার গুরুত্ব সবার থেকে কয়েক গুন বেশি।
হোটেলে ফিরে ইসানা বিছানার নিচে বসে পড়ে। আস্তেধীরে কার্পেটের উপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে রয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাঁধা সৃষ্টি করছে। এক সময় যে স্বামী তাকে রিজেক্ট করেছিল, এখন সে তাকে কয়েক গুন বেশি মূল্যায়ন করছে। আঁখিযুগল বন্ধ করে নেয় সে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। যেটা ভাষায় প্রকাশ করা বড্ড দায়!
মিনিট পাঁচেক পর রাদ ইসানার দরজায় নক করল। ইসানা শোয়া থেকে উঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দেওয়ার পর পরই রাদ ইসানার দিকে মেডিসিনের পাতা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘খেয়ে ঔষধ নিন, পেইন সেরে যাবে।’
ইসানা হাতে নিয়ে বিনাবাক্যে দরজা বন্ধ করে দিলো। সে তখন মাথা ব্যথার বিষয় মিথ্যা কথা বলেছিল। কারণ ইসানা যেতে চাইনি তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে। কিন্তু তবুও সে ফেঁসে গেছে। কাল তাকে না চাইলেও যেতে হবে।
এদিকে ইসানার নিরবতা রাদকে ভেতরে ভেতরে পীড়া দিচ্ছে। রুমের দিকে এগোতেই মুরাদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে বাক্য টেনে উচ্চারণ করল ‘কী?’
রাদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর কী সমস্যা? সেদিন আইডিয়া দিলি কীভাবে তাকে পটাবো। আর আজকাল দেখছি তুই সাহায্যের বদলে আমাকে ইর্রিটেট করছিস।’
‘তোর ব্যবহারে আমি ইর্রিটেট।’
‘হোয়াই?’
‘জীবনেও প্রেম না করার নতিজা এটা।’
‘তুই নিজেও তো করিস নি। সিঙ্গেল থেকেছিস। এখন আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস।’
‘তবুও তো আমারটা হলো।’
‘আমারটিও হবে।’
মুরাদ কানের মধ্যে কেনি আঙুল ঢুকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘স্বপ্নে!’
‘বাস্তবে হবে।’
‘দেখা যাক। চ্যালেঞ্জ এক্সেন্টেড!’
‘আমি কোনো চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি না।’
‘দিতে হবে। আপসে না হলে জোর করে নিবি।’
রাদ বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে ‘ফালতু’ উচ্চারণ করে চলে গেল।
মুরাদ শুনে ফেলে চেঁচিয়ে বলে,
‘তুই ফালতু।’
রাদ ওর এক পায়ের জুতো ছুঁড়ে দেয় মুরাদের নিকট। মুরাদ জুতোটি ক্যাচ ধরে ফেলে। রাদ তৎক্ষনাৎ দরজা বন্ধ করে ফেলে। মুরাদ ছুঁড়ে দেওয়ার সুযোগ পায় না। রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে অগ্রসর হয় ভেতরের দিকে।
__
সকাল দশটায় ইভান হোটেলের সামনে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয় ইসানাকে পীক করতে। ইসানা এক মিনিট পর বের হয় ভেতর থেকে। গাড়িতে বসার মুহূর্ত পর্যন্ত রাদ ওপর থেকে ওঁকে দেখে। ভেতরে এক রাশ ক্ষোভ চাপিয়ে রেখেছে। মুরাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিয়ে ইভানের গাড়ি দেখে আড়মোড়া ভেঙে ব্যাঙ্গ করে বলল,
‘আজকের দিনটা কত সুন্দর, কি বলিস রাদ?’ কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে বলল।
রাদ ক্রোধ নিয়ে টেরা ভাবে তাকায় মুরাদের পানে। সেটি দেখে সে পুনরায় বলে,
‘তুই তো কিছু করতে পারছিস না। অথচ দু’দিনের মানুষটি তাকে নিয়ে… ‘ লাস্টের অংশটুকু শিস বাজিয়ে শেষ করল।
‘তুই আমার বন্ধু না, একটা শত্রু!’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল রাদ।
মুরাদ হেসে রাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল,
‘কংগ্রাচুলেশনস, বুঝতে পেরেছিস।’
‘শা*লা..’বলে মারতে উদ্যত হতেই মুরাদ এক ছুটে পালায়। রাদ নিচের দিকে ঝুঁকে দেখে গাড়িটি আর নেই। হতাশাজনক সরু নিশ্বাস ফেলে সে৷
হনলুলু এরিয়ার গ্রিন হাউস নামের এক রেস্টুরেন্টে ইসানাকে নিয়ে আসে ইভান। সেটি সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। ইভান ইসানার সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে। আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করছে। অবশ্য ইভান ইসানার চেয়ে বড়ো ছিল। উনত্রিশে পা রেখেছে। এখনো পর্যন্ত সিঙ্গেল। তার গার্লফ্রেন্ড ছিল না। বর্তমানেও নেই। ইভান নিজেকে যতোই ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করুক না কেন, ইসানার মনের দাগ সে কিছুতেই মুছতে পারবে না।
‘আপনি কখনো রিলেশন করেছেন?’ ইসানা অকপটে জিজ্ঞেস করে বসে ইভানকে।
‘নাহ!’
‘গুড লুকিং হওয়া শর্তেও রিলেশন করেন নি। কারণ কি ছিল?’
‘আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল বড়ো কিছু হবার। চার বছর আগে পড়াশোনা কমপ্লিট করে আমি বিদেশে চলে আসি। গ্রিন কোম্পানিতে অপারেশন হিসাবে জব পাই। আমার কাজের দক্ষতা দেখে দু বছরের মাথায় কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে যাই।’
‘আপনি দেশে যাচ্ছেন না কেন?’
‘বাবা-মায়ের ওপর অভিমান জমে আছে।’
‘কিসের অভিমান?’
‘সে-সব না হয় আরেকদিন বলব। তোমার বিষয় কিছু বলো?’
‘আমি ডিভোর্সি!’ দ্বিধাবোধ ফেলে বলল ইসানা।
ইভান কিছুটা চমকালো। শিওর হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করল,
‘সত্যি?’
‘হুম।’
‘ছেলেমেয়ে আছে তোমার?’
‘নাহ! আপনি কি আগে বিয়ে করেছিলেন?’
‘একদম না। আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?’
‘নাহ! এমনি প্রশ্ন করলাম।’
‘ওহ!’
‘ভুলে যাওয়া রোগ কল্যাণময়, কিন্তু অতিদ্রুত ভুলে যাওয়া রোগ ভীষণ কষ্টকর!’
‘মানে?’
‘অনেকের ক্ষেত্রে এটা হয়, এজন্য বললাম।’
‘তোমার গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস আছে।’
‘মোটামুটি!’
‘আই লাইক ইট!’ হেসে বলল ইভান।
তারা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সময় অতিবাহিত করে। কেঁটে যায় ঘন্টাখানেক সময়। দূর থেকে ইমরান তাদের দুরবিন দিয়ে দেখছে। এখানে আসা অব্দি তাদের ফলো করেছে। এখনো করছে। কিছুক্ষণের জন্য নজর সরিয়ে একা একা বিড়বিড় করে বলে,
‘আমার সঙ্গে আসতে বললে কত বাহানা জোগাড় করে। আর তার সঙ্গে কি সহজে চলে এলো।’ এক রাশ দুঃখ প্রকাশ করে দুরবিনে নজর দিয়ে পুনরায় দেখতে লাগলো।
সন্ধ্যার পাখিরা নিজেদের নিড়ে ফিরছে। অবশ্য এখানে তেমন পাখপাখালির দেখা মিলে না। খুব কমই নজরে আসে। সূর্য ডিমের কুসুমের ন্যায় ধারন করেছে। একটু আগে ইসানা হোটেলে ফিরেছে। করিডোর থেকে রাদ, মুরাদ দু’জনে তাকে দেখেছে। রাদের মনে মনে রাগ হলেও সে মুরাদের সামনে প্রকাশ করে না। এমনিতেই মুরাদ তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে। প্রকাশ করলে আরো মজা নিবে ভেবে চুপ আছে।
‘আগে ছিল ইমরান এখন ইভান। তার জীবনে একজন না একজন আছেই। রাদ তুই তাকে ভালোবাসিস সেটা প্রকাশ কর নয়তো সে যে কারো হয়ে যেতে পারে।’
‘কীভাবে করব? আমার মস্তিষ্ক ফাঁকা।’
‘রাতে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারিস।’
‘যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘সে তোর পি.এ। বললেই যাবে দেখিস।’
রাদ নিরুত্তর থেকে ভাবে কীভাবে ইসানাকে বলা যায়। বললে কী যেতে রাজি হবে?
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।