#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৩
#সুমাইয়া মনি
দুপুরে ইসানাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয়। কেননা টাইসন আহতথাকার কারণে রাদের কথা অনুযায়ী তাকে বাড়িতে ফিরে দেখাশোনা ও খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে। বাড়িতে ফিরে ইসানা টাইসনকে তার ছোট বিছানায় দেখতে পায়। সেখানেই আয়েশ করে শুয়ে ছিল। ইসানা আগে টাইসনকে খাবার দিয়ে নেয়। টাইসন খাবার খেয়ে পুনরায় বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকে। একটু পর ইসানা টাইসনের খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে কি-না দেখতে এসে মেজাজ তুঙ্গে ওঠে যায় তার। টাইসব খাবার চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছে। এমনটা কখনোই করে না। আজ এরূপ কৃতকর্ম দেখে ইসানা রাগে শক্ত হয়ে রয়। টাইসনের পানে রাগী দৃষ্টি ফেলে ফ্লোর মুছে দেয়। রাতের রান্না শেষ হয় চারটার দিকে। গোসল সেরে টাইসনকে ডাকতে আরম্ভ করে রাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে।
টাইসন ইসানার ডাক শুনেও চুপচাপ বসে থাকে। কোমড়ে হাত রেখে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইসানা চলে এলো।
রাদ দশটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে। সঙ্গে ছিল মুরাদ। মুরাদ ইসানার রুম নক করে ভেতরে প্রবেশ করল। রাদ মুরাদকে ডাকতে এসে ইসানার রুমে ওঁকে দেখে মুখ কিছুটা ঘুচে এলো। ফ্রেস হতে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। মূলত তাদের কথপোকথন শোনার জন্য এখানে বসেছে। তার হৃরয়ে জলন অনুভব করছে ঠিক সেদিনের মতো। বার বার তির্যক নজরে তাকায় রুমের পানে। দশ মিনিট পর মুরাদ ইসানাকে নিয়ে বাহিরে এসে দেখে রাদ গুরুগম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বসে রয়েছে। রাদ দু’জনের পানে চেয়ে গলার টাই খুলতে খুলতে মুরাদের নিকটে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে তার রুমে নিয়ে এসে দরজা লক করে দেয়। ইসানা আহাম্মক হয়ে চেয়ে রয়। রাদের এরূপ আচরণ ইসানার বোধগম্য নয়।
মুরাদ রাদের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘হোয়াট সমস্যা?’
‘তার সঙ্গে কী কথা বললি?’
‘সোহানার বিষয়ে কথা বলেছি। প্রপোজের বিষয়।’
‘রুমে গিয়ে বলার কী প্রয়োজন ছিল?’
‘তো?’
‘তো-টো জানি না। আজকের পর থেকে তুই তার সঙ্গে আলাদাভাবে একা কথা বলতে পারবি না।’
‘হোয়াই?’ ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলল।
‘আমি নিষেধ করেছি তাই।’
মুরাদ চোখ পিটপিট করে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে বলল,
‘মেবি জ্বলছে কিছু?’
রাদ চোখ ছোট ছোট তাকায়। মুরাদ আঙুল তুলে বলল,
‘তোর হৃদয় জ্বলছে শিওর?’ বলে হেসে দেয়।
রাদ মুরাদকে মা’র’তে উদ্যত হতেই বিছানায় উঠে দাঁড়ায় মুরাদ। বলে,
‘জোক ইয়ার!’
‘আউট!’
‘আচ্ছা।’ বিছানায় থেকে নেমে হেঁটে দরজার নিকটে এসে বলল,’তাকে বিদায় বলে যাই।’
‘নাহ!’ বলে এগিয়ে আসতে নিলে মুরাদ এক ছুঁটে পালিয়ে যায়৷ রাদ টাইসনকে কোলে তুলে নেয়। কিছুক্ষণ আদর বিনিময় করে ফ্রেশ হতে যায়।
_
পরদিন শুক্রবার ছিল। তাই রাদ ফ্যাক্টরিতে যায় নি। ইসানাকেও যেতে নিষেধ করেছে। টাইসনের লেজ এখন কিছুটা আহত মুক্ত। সে বিভিন্নভাবে ইসানাকে বিরক্ত করে। রাদের জন্য ইসানা এখনো দমে আছে। নয়তো কি যে করতো নিজেরও জানা নেই। কিচেনের কাজকর্ম সেরে রুমে এলো। কাল সারাদিন সোহানার সঙ্গে কথা হয়নি। ফোনটি হাতে তুলে সোহানার নাম্বারে কল দেয়। সোহানা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আনমনে মাথা আঁচড়াচ্ছিল। তার আনমনার কারণ মুরাদ। সোহানা মুরাদের ভালোবাসা জড়িত আবেগপ্রবণ কথাগুলো ভাবছে। কাল মুরাদ কল দেয়নি আর। এখন সকাল দশটা বাজে। এখনো সে-ই মানুষটির ফোন না আসায় চিন্তিত হয় সোহানা। এসব ভাবতে ভাবতে একবার কল কেটে যায়। দ্বিতীয় বার ফোন বেজে উঠায় ভাবনা ফেলে ফোন রিসিভ করে।
‘কল ধরছিস না কেন? কাল সারাদিনও তো কল দিলি না। কিছু হয়েছে নাকি?’
সোহানা ইসানার প্রশ্নের উত্তর ঘুরিয়ে বলল,
‘মুরাদকে নাম্বার, বাসার এড্রেস তুই দিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ!’
সোহানা চুপ করে রয়। মনঃক্ষুণ্ন হয় তার কিছুটা। ইসানা বলে,
‘তার প্রপোজ করার বিষয়টি আমি জানি। মুরাদ তোকে ভালোবাসে। তুই তার ভালোবাসা এক্সেপ্ট কর।’
‘তোর দিক থেকে ভাব না! তুই করতে পারবি এক্সেপ্ট?’
‘অবশ্যই!’ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘মুরাদ নয়, রাদের কথা বলেছি। রাদ যদি তোকে প্রপোজ করে তুই তাকে মেনে নিতে পারবি?’
‘প্রশ্নই আসে না। রাদ এটা কখনোই করবে না।’
‘যদি এমনটা হয়।’
‘আমার জীবন, তোর জীবন এক না। আমি ডিভোর্সি মেয়ে।’
‘তুই ডিভোর্সি, কিন্তু এখনো কুমারীই আছিস। আমার ভাবনা থেকে ভেবে দেখ।’
‘এখানে আমাদের টপিক টেনে ব্যাপারটা কঠিন করছিস তুই।’
‘আমি মেনে নিলাম। কিন্তু আব্বু-আম্মু তো মানবে না। তখন কি কষ্ট হবে না আমার।’
‘ফিউচার পরে ভাব। আগে সামনে যে আছে, তার ভূমিকা পালন কর।’
‘নো নিড।’
‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড সোহানা…।’
খট করে ফোন কেটে দিলো সোহানা। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে। এমন একজনকে সে মনে রাখতে চাইছে যার অস্তিত্ব জীবনে পরবর্তীতে আসবে কি-না জানা নেই তার। কষ্টে হাতের মুঠোয় চিরুনি চেপে ধরে।
ওপর প্রান্তে ইসানা সোহানার বাক্যগুলো ভাবছে। রাদের নিকট থেকে প্রপোজাল পাওয়া অসম্ভব! কিন্তু সত্যি যদি এটি বাস্তবে রূপ নেয় তখন? এসব ভাবতে চায় না সে। বাহির থেকে তখনই রাদের আওয়াজ ভেসে আসে।
‘আপনি একটু বাহিরে আসুন।’
ইসানা বেরিয়ে দেখে রাদ একটি কাঁচের বাটিতে ডিম ফেটছে। টেবিলে আটা, লিকুইড দুধ, চকোলেট এসেন্স সহ আরো অনেক কিছু রাখা। ইসানা বুঝতে পারে রাদ কেক বানাচ্ছে।
রাদ ইসানার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’
‘আমার কাছে দিন আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু দেখবেন।’
ইসানা জবাবে ‘হুম’ বলে।
রাদ সব কিছু ঠিকমতো দিয়ে কেকের তরল মিশ্রণ তৈরি করে ফেলে। পরিশেষে ইসানার ওপর নজর ফেলে বলে,
‘সব ঠিকমতো ছিল?’
‘হ্যাঁ!’
‘আমি অল্পস্বল্প রান্না করতে পারি। মামনি বাড়িতে যখন থাকত না। আমিই রান্না করতাম।’
‘রাধুনি ছিল না?’
‘ছিল। তবুও শখের বশে রান্না করতাম। অবশ্য সার্ভেন্ট রা আমাকে রান্নাঘরে যেতে নিষেধ করতো মামনির নিষেধাজ্ঞা ছিল তাই।’
ইসানা নিরুত্তর থাকে। রাদ পুনরায় বলল,
‘পাপা মারা যাবার পর মামমি আমাকে সময় দিতে পারতো না। বেশিরভাগ সময় ফ্যাক্টরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কাজের লোকরা ছাড়াও আমাকে আমার কাজ গুলো একা একা করতে হতো। মামনির সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাও বন্ধুত্বসুলভ না। আমার সঙ্গে মামনি সব সময় গম্ভীর আচরণে কথা বলত। তাকে এমন দেখতে দেখতে আমি নিজেও গম্ভীর স্বভাবের হয়ে উঠে। আমি কারো সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না। মামনি আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে। কিন্তু সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। একটি বাচ্চার সঠিকভাবে ভেড়ে উঠার ক্ষেত্রে আদর-স্নেহ, ভালোবাসা খুবই প্রয়োজন।’
মনোযোগ দিয়ে রাদের কথাগুলো শুনছে ইসানা। রাদের মাঝেও ভালোবাসার কমতি উপলব্ধি করতে পারছে ইসানা।
উপর থেকে রাদকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তার মধ্যেও সুপ্ত ভালোবাসার কমতি রয়েছে।
রাদ এবার হালকা কেশে বলে,
‘সোহানা আপু কি মুরাদের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করেছে?’
‘নাহ!’ ছোট্ট করে জবাব দেয় ইসানা।
দু’জনার মাঝে নীরবতা এসে ভর করে। রাদ কেকের বাটিটি নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ওভেনের মধ্যে রেখে অন করে ড্রইংরুমে ফিরে এসে ইসানাকে সেই স্থানেই দেখতে পায়। বলে,
‘ওভেন অন করে দিয়েছি কেক হয়ে গেলে নামিয়ে নিবেন। আমার অনলাইনে মিটিং আছে বায়ারদের সঙ্গে।’
‘আচ্ছা আপনি যান।’
রাদ এগিয়ে গিয়েও থেমে বলল,
‘আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’
‘আপনিই ঠিক আছে।’
‘ওকে, তবে স্যার বলে ডাকবেন না। বাড়িতেও না, ফ্যাক্টরিতেও না।’
ইসানা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। রাদ মৃদুহাসি প্রধান করে চলে যায়৷ রাদের প্রধান করা মৃদু হাসি ইসানার ভালো লাগে। ওর ঠোঁটেও মুচকি হাসি চলে আসে। ইসানা রান্না বসিয়ে দেয়। কিন্তু বারে বারে সোহানার বলা কথা গুলো তাকে চিন্তিত করে তুলছে। রুম থেকে ফোনের রিংটোন শুনতে পায় ইসানা। চুলার আঁচ কমিয়ে তড়িঘড়িতে রুমে এসে স্ক্রিনে সোহানার নাম দেখে দ্রুত রিসিভ করে। ইসানা হ্যালো বাক্যটি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই সোহানা গমগম আওয়াজে বলে,
‘বিকেল চারটায় আমার সঙ্গে রমনাপার্কে দেখা করবি। সময় যেন এদারওদার হয় না। ঠিক চারটায়।’ বলে তৎক্ষনাৎ ফোন রেখে দেয় সোহানা। ইসানা এবারও বলার সুযোগ পায় না।
চিন্তায় কপাল কুঁচকে আসে তার। সরু নিশ্বাস টেনে কিচেকে ফিরে।
_
চারটার দিকে দু বান্ধবী এক সঙ্গে দেখা করে রমনায়। প্রথমে তো দু’জনেই চুপ করে তাকে। পরক্ষনেই সোহানা মুরাদের টপিক তুলে কথা বলে,
‘আমি তার সঙ্গে কোনো প্রকাশ সম্পর্কে জড়াতে চাই না। তুই তাকে ক্লিয়ার করে বলে দিবি।’
‘সমস্যা কী?’ কিছুটা জোর গলায় জানতে চাইলো ইসানা।
সোহানা তড়াক করে ঘুরে তেজি কণ্ঠে বলে,
‘সমস্যা কী তুই জানিস না? নাটক করিস আমার সঙ্গে।’
‘না আমি নাটকের হিরোইন, না তুই। তো এটা নাটক হয় কীভাবে?’
‘কথা ঘুরানোর চেষ্টা একদম করবি না।’
‘রাজি হতে সমস্যা কী তোর?’
‘আমার পরিবার যেখানে আমাকে বিয়ে দিবে আমি সেখানেই বিয়ে করব।’
‘তো রাজি হয়ে যা।’
‘আব্বু কখনোই রাজি হবে না। বুঝতেছিস না কেন ইসা।’ চিল্লিয়ে বলল সোহানা।
‘আঙ্কেল রাজি আছে ব’ল’দা মহিলা।’
সোহানা থ হয়ে যায়। কপালে তিন-চারটি ভাঁজ পড়ে। উঠে দাঁড়াতেই ইসানা হাত ধরে বসিয়ে হেসে হেসে বলে,
‘আঙ্কেল সেদিন আমার কাছ থেকে মুরাদের বিষয় সব জেনেছে। তারপর সেদিন যখন মুরাদ আমাকে তোর ব্যাপারে কথা বলতে ক্যান্টিনে ডেকেছিল, তখন আঙ্কেলকে লাইনে রেখে মুরাদের বলা কথা গুলো শুনিয়েছি। মুরাদকে আঙ্কেল পছন্দ করেছে। বয়স ফ্যাক্ট না। ওর মনমানসিকতায় আঙ্কেল মুগ্ধ হয়েছে। সঙ্গে তোর প্রতি এত ভালোবাসা দেখেও সে বিমোহিত।’
সোহানা মাথা নিচু করে মন খারাপ করে ফেলে। খুশিতে তার এই মুহূর্তে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চটজলদি ঝাপটে ধরে ইসানাকে। বলে,
‘আমি আমি…’ কথাগুলো মুখে আঁটকে যাচ্ছে সোহানার।
‘কিচ্ছু বলার প্রয়োজন নেই। একটু পর মুরাদ ভাইয়া আসবে তাকেই বলিস।’ সোহানা ইসানাকে ছেড়ে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
‘তুই আসতে বলেছিস?’
‘হুম।’
সোহানা মনে মনে খুশি হলেও ইসানার সামনে সেটি প্রকাশ করে না।
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৪
#সুমাইয়া_মনি
মুরাদ পার্কে পৌঁছাবার আগেই সোহানা বাড়ি চলে আসে। কেননা সে মুরাদের মুখোমুখি হতে চায় না। তার নিজের কাছে বিব্রতবোধ কাজ করছে। ইসানা ওঁকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। কিন্তু বান্ধবীর কথাও সে শুনেনি। তার থেকে বয়সে ছোট ছেলেকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে পাঁজরে। কিছুতেই দমাতে পারছে না সেই অনুভূতিকে। গেটের সামনে এসে সোহানা থমকে যায়। কারণ মুরাদ গাড়ির সঙ্গে ঠেস দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। সোহানাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে আসে। বলে,
‘চলে এলেন কেন?’
জবাবের আশায় তাকিয়ে রইলেও সোহানা নিরুত্তর হয়ে রয়। তাকে কীভাবে বুঝাবে চাপা অনুভূতি। যেটা সে দমিয়ে, চাপিয়ে রাখতে চায় মুরাদের কাছ থেকে।
‘কি হলো? বলছেন না যে মিস?’
‘এমনি।’ মিনমিন স্বরে বলল সোহানা।
‘আমি পার্কে এসে আপনাকে না পেয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। অনুমান করেছি আপনি বাড়ি ফিরবেন। অনুমান সফল হয়েছে। এবার সঠিকভাবে জবাব দিন কেন চলে এলেন আপনি?’
‘বললাম তো এমনি।’ একটু জোরে জবাব দিলো।
‘আঙ্কেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপত্তি কারো দিক থেকেই নেই। আপনি যদি আমাদের সম্পর্ক মেনে না নিতে পারেন। সরাসরি বলুন, আমি আর এগোবো না। সরে যাব আপনার জীবন থেকে।’
সোহানা কোমলভাবে বলল,
‘আমার সময় প্রয়োজন।’
‘ঠিক আছে। আপনি যেদিন আমাকে কল দিবেন। সেদিনই সম্মতি পেয়ে যাব। এ ক’দিন আপনি আপনার মতো থাকতে পারেন। তবে, বেশি দেরি করবেন না মিস। অন্যের দুঃখ একটু বুঝবেন। চললাম।’ শেষের অংশটুকু বলে মুরাদ গাড়িতে উঠে বসে। সোহানাকে বিদায় জানিয়ে মুরাদ গাড়ি নিয়ে চলে যায়৷ সোহানা গাড়ির পিছন দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘লোকটা কত বুঝে। আপনাকে পাওয়া যে আমার ভাগ্য!’
_
রাত বারোটার সময় বিকট শব্দে ইসানার ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে উঠে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে চারদিক নজর বুলায়।
শব্দটি বাহির থেকে আসছে ভেবে কম্বল সরিয়ে নেমে পড়ে। দরজা খুলে বাহিরে বের হতেই রাদ ও টাইসনকে দেখতে পায়ে। টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো কেক রাখা। ফ্লোরে পড়ে আছে স্টিলের ফ্রাইপেন। ইসানা কপাল কুঁচকে কিছু বলতে যাবে তখন রাদ মৃদুহেসে বলে,
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…।’
থমথম খেয়ে কপালে ভাঁজের পরিমাণ আরো বেড়ে যায় ইসানার। রাদ ছু’ড়ি হাতে ধরে বলে,
‘আসুন কেক কা’টু’ন।’
‘আমার জন্মদিন… ‘
‘সার্টিফিকেট থেকে দেখেছি। ক্লিয়ার? এবার আসুন।’
ইসানা এবার বুঝতে পারে সকালে কেক কেন বানিয়েছিল রাদ। কেকটি সুন্দর করে ডেকোরেশন করেছে। তার উপর মোমবাতি জ্বালিয়েছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। ইসানা ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে রাদের হাত থেকে ছুঁ’ড়ি নেয়। কেক কাঁ’টা’র সময় দ্বিধাবোধ কাজ করে। কেটে কাকে খাওয়াবে রাদকে? আনইজি লাগছে তার। তবুও সে মোমবাতি নিভিয়ে কা’টে, সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে এক টুকরো হাতে নিয়ে রাদের মুখের দিকে এগিয়ে নেয়। রাদ নরম ভঙ্গিতে ইসানার চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ এগিয়ে কামড় দিয়ে হাত ধরতে নিলে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয় ইসানা। কেকের বাকি অংশ পড়ে যায় ফ্লোরে। ইসানা দ্রুত ‘স্যরি’ বলে উঠে।
‘ইট’স ওকে। কেক খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে।’
ইসানা আরেক টুকরো মুখে দিয়ে জবাব দেয়,
‘ভালো হয়েছে অনেক। ধন্যবাদ!’
‘এটা তো আমার দেওয়া উচিত। প্রশংসা আপনি করেছেন।’
‘বার্থডে সেলিব্রেটি করার জন্য শুকরিয়া।’
রাদ বুকে আলতো হাত রেখে মাথা একটু ঝুকে দেয়। চেয়ার থেকে একটি রঙির পেপারে মোড়ানো বক্স বের করে ইসানার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
‘আপনার উপহার৷ আশা করি নিতে আপত্তি নেই।’
ইসানা নিতে না চাইলেও রাদের বলা কথায় আবদ্ধ হয়ে নিতে হয়। রাদ স্মিত হেসে বলে,
‘গুড নাইট। ঘুমিয়ে পড়ুন।’ বলে রাদ টাইসনকে নিয়ে রুমে চলে যায়৷ ইসানা দাঁড়িয়ে রয়। একবার কেকের দিকে, আরেকবার গিফটের দিকে তাকায়। কেকটি ফ্রিজে রেখে গিফট নিয়ে রুমে আসে। দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে সোহানাকে কল দেয়। সোহানা তখন জাগ্রত ছিল। ফোন রিসিভ করতেই ইসানা গড়গড় করে সব বলে দেয়। সোহানা মনোযোগ দিয়ে শুনে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দিতে বলে। ইসানা তাই করে।
‘গিফট খোল। দেখি রাদ কী দিয়েছে।’
‘আনইজি লাগতেছে।’ ঠোঁট কামড়ে বলল।
‘খোল মা’তারি।’ ঝাড়ি দিয়ে বলে।
ইসানা ফোন পাশে রেখে খুলে ফেলে। সেটির মধ্যে লাল রঙের গহনার বাক্স ছিল। ঢাকনা সরিয়ে দেখে ডায়মন্ডের সিম্পল গলার নেকলেস, সঙ্গে ছিল কানের দুল। সোহানা খুশির চোটে দু গালে হাত রেখে ‘ওয়াও’ বলে উঠে। ইসানার মুখ কালো হয়ে যায়।
‘তোর পছন্দ হয় নি?’
‘আমি কি এটা ডিজার্ভ করি?’
‘অবশ্যই!’
‘তোকে দিয়েছে ,রাদ টেক্সটাইল কোম্পানির মালিকের একমাত্র ছেলে।’
ইসানা চুপ করে আছে। সোহানা বলে,
‘কি হলো?’
‘কিছু না।’
‘ফিরিয়ে দিস না। রাদ কষ্ট পেতে পারে।’
‘সকালে রাদ নিজ হাতে কেক বানিয়েছে আমার জন্য ঘুণাক্ষরেও জানতাম না।’
‘বলিস কী?’
‘হ্যাঁ! তুই উইস করেছিস। আর রাদ…’
‘তারমানে হলো রাদের মনে কী চলছে?’
‘আজাইরা কথা বলিস না। আমি ঘুমাব।’
‘ঘুমা।’
ইসানা সোহানার আগে ফোন রেখে দেয়। নেকলেসের দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে ভাবনায় মসগুল হয়ে যায়।
_
রাদ টাইসনের সঙ্গে কথা বলছে। সে খুব এক্সাইটেড। ইসানার নেকলেসটি পছন্দ হবে কি হবে না ভেবে সে কনফিউজড!
‘টাইসন তোর কী মনে হয় তার নেকলেসটি পছন্দ হবে?’
টাইসন জিহ্বা বের করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। রাদের প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই। সে তো এমনিতেই ইসানাকে পছন্দ করে না। তার ওপর এসব প্রশ্ন শুনে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিমা দেখায়। রাদ টাইসনের এরূপ আচরণ বুঝতে পারে ইসানাকে না পছন্দ করার কারণ। গম্ভীর কণ্ঠে টাইসনকে বলে,
‘তাকে পছন্দ না বুঝতে পারছি। তো এমন রিয়াকশন দিচ্ছিস কেন? সে তো আর তোর জাত শত্রু নয়।’
টাইসনের মুখ তখনো ঘুরিয়ে রেখেছে। রাদ ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে লাইট অফ করে টাইসনের অপরদিক ফিরে ঘুমায়। এতে টাইসনের মনঃক্ষুণ্ন হয়।
.
সকলে…
রাদ ও লিসাকে কফি বানিয়ে কেবিনে দিয়ে ইসানা একটি পেপার হাতে প্রথম ফ্লোরে আসে। ইসানা মালতি নামের মধ্যবয়স্ক একজন মহিলার কাছ থেকে নতুন ফাইল নিয়ে পুরাতন ফাইন কালেক্টর করে ফিরার সময় পথরোধ করে ইমরান নামের একজন স্টাফ। তিনি ইসানাকে অনুরোধ স্বরে বলে,
‘প্লিজ যেও না। আমার একটা কথা বলার আছে তোমাকে।’
ইসানা চোখমুখ শক্ত করে বলল,
‘আমার জানা মতে, ভদ্রতার খাতিরে প্রথমত অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে আপনি করে সম্বোধন করতে হয়। আপনি ডিরেক্ট তুমি করে কেন বলছেন?’
‘ইসানা আমি তোমার এক বছরের বড়ো। তার ওপর যখন থেকে তুমি জয়েন হয়েছো তখন থেকে আমি তোমাকে চিনি। হয়তো কথাবার্তা হয়নি।’
‘কেন পথরোধ করেছেন?’
‘আসলে তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’ কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে বলল ইমরান।
‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন তাই তো?’ তড়িঘড়ি প্রশ্ন ছুড়লো ইসানা।
লজ্জামিশ্রিত হেসে ইমরান মাথা নাড়লো। যার উত্তর হ্যাঁ! ইসানা বলল,
‘আমি ডিভোর্সি।’
‘জানি।’
‘এতিম।’
‘সেটাও জানি।’
‘একজন কে ভালোবাসি।’
‘জা…কী?’ চোখ কপালে উঠে গেলো ইমরানের।
ইসানা ফিক করে হেসে দেয়। বলে,
‘মজা করছিলাম ভাইয়া।’
‘এমন মজা কোরো না। আর ভাইয়া তো বলবেই না, বুকে অ্যাটাক আসবে।’
ইসানা ঠোঁটে হাসি রেখে বলে,
‘এটা কর্মস্থান। রাদ স্যার কাজ ফাঁকি দিয়ে কথা বলতে দেখলে আপনার আমার দু’জনার চাকরী যাবে।’
‘তাহলে ছুটির পর দেখা করি?’ আগ্রহ নিয়ে বলল।
‘নাহ! আমাকে বাড়ি যেতে হবে।’
‘তোমার নিজের বাড়ি আর কোথায়, যাবে তো স্যারের বাড়িতেই।’
‘আপাতত সেটিই আমার বাড়ি।’
‘প্লিজ! বিকেলে বাহিরে দেখা করি আমরা।’
‘হবে না।’
‘ফোন নাম্বারটি দেও না আমাকে ইসানা।’
‘আপনার ভালোবাসায় যদি দম থাকে জোগাড় করে নিন।’
‘আচ্ছা। চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করলাম।’
‘বেস্ট অফ লাক।’ বলে ইসানা হাঁটা ধরলো।
ইমরান মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন কথা বলতে গিয়েও লজ্জায় পারেনি বলতে। আজ দ্বিধাবোধ ফেলেই ইসানাকে ভালো লাগার কথাটি জানাল। অবশ্য ইসানা তার ভাবসাব দেখে বুঝে নিয়েছে প্রথমেই।
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।