#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৯
#সুমাইয়া মনি
‘কালকের জন্য স্যরি লিসা।’ মুরাদ কিছুটা অপরাধী স্বরে বলল।
‘হেই! স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। আমি কিছু মনে করিনি। দেখো, আমার যদি কোনো বিষয় তোমাদের কাছে খারাপ লাগে সংকোচ বোধ ফেলে বলবে। আমি এতে রাগ করব না।’
‘রিয়েলি?’
‘পাক্কা রিয়েলি।’
‘ওয়েল, তুমি একটু কথা কম বলো। তাতেই হবে।’ বলে হেসে দেয় মুরাদ।
লিসা সরু চোখে তাকিয়ে রয়। মুরাদ উঠে চলে যায় রাদের কেবিনে। লিসাও বেরিয়ে আসে নিজের কেবিন থেকে।
আজ ইসানা ফ্যাক্টরিতে এসেছে। রাদকে কফি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ধরলে মুরাদ তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ইসানা আপু আপনার বান্ধবী কি আপনার বয়সি?’
‘হ্যাঁ!’
‘সেইম বয়স?’
‘সেইম বয়স বলতে এক বছরেই জন্ম, হয়তো মাসের পার্থক্য হতে পারে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘কেন বলুন তো ভাইয়া?’
‘না, এমনিতেই জেনে নিলাম আর কি।’
‘ওহ!’ বলে ইসানা চলে গেল।
রাদ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ভালোবাসার গ’ন্ধ পাচ্ছি নাকে।’
‘তেমন নয়। সোহানাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বাট…’
‘বয়স! তাই তো?’
‘তিনি আমার বড়ো।’
‘ব্যাপার না।’
‘ক্যারি অন, মুভ অন কোনোটিই করতে পারছি না।’ সরু নিশ্বাস ফেলে বলল।
‘ট্রাই কর যেকোনো একটি।’
‘কী ট্রাই করবে রাদ?’ বলতে বলতে এগিয়ে এলো লিসা।
মুরাদ গমগম গলায় বলল,
‘অতিরিক্ত কথা বলা।’
‘কেন? আমার জন্য নাকি?’
‘হতে পারে তোমার জন্য।’ দু কাঁধ নাচিয়ে বলল রাদ।
‘ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।’
‘খাবারের সঙ্গে বেশি করে লবন পরিবেশন করবে। দেখবে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ মুরাদ বলল।
রাদ মৃদু হাসলো। লিসা রাদের দিকে তাকিয়ে মুরাদের উদ্দেশ্যে তেজি কণ্ঠে বলল,
‘তোমরা আমাকে নিয়ে মজা করছো?’
‘নাহ!’
‘একদমই না।’ রাদ জবাবে বলে।
‘মজাই করছো। থাকব না আমি আর।’ রেগেমেগে বেরিয়ে গেল লিসা। পিছন থেকে রাদ, মুরাদ ডেকে সাড়া পায়নি।
দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। পরপরই মুরাদ বিদায় বিয়ে ফ্যাক্টরি ত্যাগ করে। পথিমধ্যে সোহানাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি পাশে পার্ক করে নেমে আসে। সোহানা ফুটপাত থেকে সবজি কিনছিল। ঠিক পাশে এসে দাঁড়ায় মুরাদ। হাত দু’টো পিছে নিয়ে সরস কণ্ঠে শুধালো,
‘আমি কী সাহায্য করব?’
সোহানা চকিতে তাকায়। মুরাদকে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘আমি কী বলেছি?’
‘মানবতার খাতিরে..।’
‘এক কাজ করুন। আপনি বরং মানব সংঘটনে নাম লিখান।এতে মানুষদের উপকার হবে কিছুটা।’
‘গুড আইডিয়া। আপাতত আপনাকে দিয়েই প্রথম শুরু করি, কী বলেন?’
‘লিভ মি!’ কাঠিন্য কণ্ঠে বলে অপর পাশে হাঁটতে লাগলো সোহানা।
‘আরে শুনুন।’ পিছু পিছু হাঁটছে তার।
‘সমস্যা কী? পিছু নিচ্ছেন কেন?’
‘সাহায্য করতে দিলেন না, এখন পিছু নিচ্ছি তাতেও সমস্যা।’
‘হ্যাঁ!’
‘বেচারা যাবে কোথায়?’
‘বাড়ি যেতে পারে। কেউ আঁটকায় নি তাকে।’
‘আপনি এত নিষ্ঠুর কেন?’
‘আপনার কী?’
‘অনেক কিছু!’
‘কী?’ বলে থেমে যায় সোহানা। চোখ রাঙিয়ে তাকায় মুরাদের দিকে।
‘হার্ট অ্যাটাক হবে! ঐভাবে তাকালে।’ বক্ষে হাত রেখে বলল মুরাদ।
‘রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মজা করছেন? আপনি জানেন আমি আপনার বড়ো।’ লাস্টেরটুকু আঙুল তুলে বলল সোহানা।
‘আই নো! তাই তো যথেষ্ট রেসপেক্ট দিচ্ছি।’
‘বিরক্ত করছেন।’
‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি। আবার পরে বিরক্ত করতে আসব।’
‘একদমই নাহ!’ গমগমে গলায় বলল।
মুরাদ মুচকি হাসি প্রধান করে চলে যায়। সোহানা কপাল কুঁচকে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। গাড়ি নিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সোহানার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয়। সোহানার মুখ কিছুটা হা হয়ে যায়। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি নত রেখে বলে,
‘অভদ্র!’
__
সুরভী খাতুন চেয়ারম্যানের কাছে টাকা ঋণ নিতে এসেছেন। সামনের মাসের এক তারিখে তার বড়ো মেয়ে সিমার বিয়ে। যৌতুক হিসাবে ঘর সাজিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন ছেলের পরিবার। বিয়ে দিতে এতটুকু যদি না দিতে পারে তবে সুখী হবে না মেয়ে। এদিকে তার স্বামী লিয়াকত আলী ইটের ভাটায় কাজ করে যা টাকা উপার্জন করে তাতে সংসারে খরচ সহ তিন ছেলে মেয়ের পড়াশোনায় খরচ হয়ে যায়। তিনি নিরুপায়। এজন্য চেয়ারম্যানের কাছে টাকা চাইতে এসেছে।
চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান হক টাকা দিতে পারবে না বলে বিদায় করে দেন তাকে। খালি হাতে মুখ কালো করে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। বিয়ে বুঝি হবে না ভেবে সিমার মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। আচমকা মুঠোফোনে ফোন আসায় নিজেকে স্বাভাবিক করেন তিনি। বাক্যবিনিময় শুরু করে।
.
.
রাতে…
রাদ ল্যাপটপ ঘাটছিল। তখন দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে এগিয়ে আসে। সঙ্গে টাইসন এলো। রাদ দরজা খুলে ইসানাকে দেখে। ইসানা কোমলভাবে বলল,
‘কিচেনে গরুর মাংস রেখেছিলাম রান্নার জন্য। টাইসন সব খেয়ে ফেলেছে।’
রাদ ক্রোধ নিয়ে টাইসনের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই টাইসন কাচুমাচু ভঙ্গিতে নজর সরিয়ে নিলো। যেন সে রাদের ক্রোধের কারণ বুঝতে পেরেছে। রাদ নজর সরিয়ে নিয়ে ইসানার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কিচেনে কাপ নুডলস আছে সেটা তৈরী করে দিন আমাকে। আর আজ রাতে টাইসনকে কোনো খাবার দিবেন না।’
‘আচ্ছা।’ বলে চলে যেতে উদ্যত হতেই রাদ বলে,
‘দাঁড়ান!’ ইসানা দাঁড়িয়ে গিয়ে ঘুরে তাকাল। রাদ বলল,
‘আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন যেহেতু আমি আপনার ছোট। আপনিও খেয়ে নিবেন নুডলস।’ বলে রাদ রুমে ফিরে টাইসনকে বাহিরে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
ইসানা মুচকি হাসে। মুখ কালো হয়ে আছে টাইসনের। ইসানা ঝুঁকে খেঁক খেঁক করে হেসে বলল,
‘উচিত হইছে। এখনো সময় আছে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেও টুসু।’
টাইসন ইসানার পুরো কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বন্ধুত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ইসানার। রাগ হয় তার। আঙুল তুলে সোজা হয়ে বলল,
‘লাগবে না তোর বন্ধুত্ব সর!’ চলে গেল।
রুমের ভেতরে বসে রাদ মনিটরে ইসানা ও টাইসনকে দেখছে। মূলত সে টাইসনের ভাবভঙ্গি দেখার জন্য মনিটরে চোখ রাখে। কিন্তু ইসানার কথা আর টাইসনের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি দেখে স্মিত হাসে। দু’জনকে দেখে তার কাছে কু’কু’র ও বি’ড়া’ল বলে মনে হচ্ছে। কেননা তারা তো কখনোই বন্ধু হতে পারে না। ইসানা সেখান থেকে চলে গেলেও টাইসন সেখানেই বসে থাকে মুখ ভার করে। দরজায় কয়েকবার নখ ঘষে। ইসানা রান্না ঘর থেকে ড্রইংরুমে এসে ব্যাঙ্গ করে অনেক কথা ছুঁড়ে দেয় টাইসনের নিকট। তাতে কী? টাইসন পাত্তা দেয় না। এতে করে ইসানার প্রচুর রাগ হয়। রেগেমেগে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। বেশ মজা পাচ্ছে রাদ। দু’জনের খুনসুটি বিনোদন দিচ্ছে তাকে।
.
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১০
#সুমাইয়া মনি
‘একটা কিছু কর ইসানা, এই মুরাদ আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।’ সোহানা ফোনে অসহায় ভঙ্গিতে ইসানাকে বলছে।
‘আজও দেখা হয়েছিল নাকি?’
‘হ্যাঁ! সেধে বিরক্ত করেছে।’
‘যাক, যাও সে মানুষ। আর আমি তো বিরক্ত হচ্ছি টাইসনকে নিয়ে।’
‘টাইসন কি করেছে আবার?’
‘এই বা’লে’র কু’ত্তা’য় এত ভাব দেখায়। মন চায় চি’পা মা’ই’র দিতে।’
‘দে! তাহলেই ঠিক হবে।’
‘হ! কু’বু’দ্ধি দিচ্ছিস। পরে কামড় কে খাবে হুহ?’
‘তাহলে সহ্য কর। এখন বল এই মুরাদের কি করব?’
‘এক কাজ কর। তোর না কলেজের বন্ধুু আছে রাতুল?’
‘আছে!’
‘তার সঙ্গে রিলেশন কর।’
‘হপ!’
‘আরে এটা মুরাদকে দেখানোর জন্য করবি।’
‘বা’লে’র আইডিয়া।’
‘তাহলে আমার কাছে কোনো সাজেশন চাইবি না।’
‘রেগে যাচ্ছিস কেন? একে তো আমি মুরাদের জন্য বিরক্ত, আর তুই টাইসনের জন্য।’
‘দেখা হলে হাত মিলাবো নে।’
‘বোইন চুপ থেকে আইডিয়া দে।’
‘তার আগে আমার সঙ্গে দেখা কর কাল।’
‘গার্ডেনে আসিস।’
‘আচ্ছা।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে রান্না ঘরে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ পেয়ে বের হয় ইসানা। উঁকিঝুঁকি দিয়ে রান্নাঘরে দেখে পুনরায় ফিরে রুমে। রান্নাঘরে ফ্রিজের পেছন থেকে রাদ বের হয়। পানি খেতে এসেছিল রান্না ঘরে। পাশের রুম থেকে ইসানা ও সোহানার কথপোকথন শুনছিল। তখনই পাশ থেকে স্টিলের গ্লাস নিচে পড়ে যাওয়ায় শব্দ হয়। ইসানা বের হবার আগেই রাদ লুকিয়ে ফেলে নিজেকে। পা টিপে টিপে রাদ রান্নাঘর থেকে রুমে পৌঁছায়।
__
পরদিন..
রাদ ও মুরাদ গুরুতর ভাবে ভাবনায় মশগুল। ইতিমধ্যে রাদ কালকের বলা তাদের কথপোকথন ঢালা শেষ। তাই মুরার, রাদ দু’জনে চুপ থেকে ভাবছে কীভাবে কি করা যায়। তৎক্ষনাৎ রাদ বলল,
‘তুই লাঞ্চ টাইমে ফুট গার্ডেনে যাবি। আমি শিওর, সেখানে সোহানার বন্ধুকে পেয়ে যাবি।’
‘সত্যিই পাব?’ চিন্তিত হয়ে বলল।
‘দেখে আসলে ক্ষতি কী?’
‘ওকে যাব। কিন্তু দু’জনকে এক সঙ্গে দেখলে…. ‘ লাস্টের অংশটুকু না বলে থেমে যায়। রাগ লাগছে তাঁর।
‘কুল ব্রো। এখন তুই যাহ।’
মুরাদ উঠে চলে গেলো। রাদ ইসানাকে কেবিনে আসতে বলল। দরজা ঠেলে ভেতরে এলো ইসানা। সরস কণ্ঠে বলল,
‘জি বলুন স্যার?’
রাদ একটি সাদা রঙের খাম এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এর মধ্যে একচল্লিশ হাজার টাকা আছে। ভয় নেই! এগুলো অগ্রীম টাকা। যেটা আপনাকে দেওয়া হয়নি জয়েন হবার পর। বেতনের টাকা মাস শেষে পাবেন। আর নয় হাজার টাকা জরিমানা হিসাবে রাখা হয়েছে।’
ইসানা হাতে নিয়ে মনে মনে ‘খ’বি’শ’ বাক্যটি বলল। তবে সে খুশি হয়েছে।
‘ধন্যবাদ! স্যার।’ বলে চলে গেল।
রাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে মনিটরে ইসানার পানে চেয়ে বলল,
‘মনে মনে আপনি আমাকে গালমন্দ করেন সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি মিস. ইসানা।’
.
সোহানা একজন ব্যক্তির সঙ্গে ফুট গার্ডেনে বসে লাঞ্চ করছিল। খাওয়ার সঙ্গে হাসিমুখে বাক্যবিনিময় করছে। মুরাদ মাত্রই পৌঁছেছে। ওপরের তলায় এসে সোহানাকে অপরিচিত একজন ব্যক্তির সঙ্গে হাস্যমুখে কথা বলতে দেখে হৃদয় যেন পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাদের কথা সত্য প্রমাণিত হলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধপাস করে তাদের ওপর পাশের আসনে বসল। আচমকা মুরাদের আগমনে দু’জনেই থমথম হয়ে তাকায়। মুরাদ লোকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নিলো। গায়ে শার্ট, খয়েরী রঙের ফুল প্যান্ট। আদলে বয়স্ক ছাপ। বাঁ হাতে সোনালী রঙের ঘড়ি। পর্যবেক্ষণ করার পর নজর সরিয়ে নিলো মুরাদ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোহানার উদ্দেশ্যে বলল,
‘মিস, আপনার চয়েজ এত বাজে আগে জানতাম না। শেষ অব্ধি একজন আধবুড়ো লোকের সঙ্গে ডেট করছেন।’ বলতে বলতে আফসোস হয়ে টেবিলে হাত রাখল মুরাদ। সোহানা অগ্নিশর্মার ন্যায় রূপ ধারণ করেছে। ছোট চামচটি হাতে তুলে পিছন দিকটা উঁচু করে সজোরে নিক্ষেপ করে মুরাদের হাতের উল্টো পিঠে। মুরাদ চেঁচিয়ে উঠে ব্যথায় কুঁকড়ে হাত ঝাড়তে আরম্ভ করে। আশেপাশে সকলের দৃষ্টি এবার তাদের ওপর। তারা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে চেঁচামেচির কারণ অজানা। সোহানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ওনি আমার আব্বু!’
মুরাদ থ হয়ে স্থির হয়ে যায়। যতটুকু ব্যথার দরুন হাত ঝাড়ছিল সেটি কর্ণপাত হতেই যেন উবে গেছে। চমৎকার মিস্টেক করেছেন তিনি। রীতিমতো সোহানার বাবা আনোয়ার হোসেন চমকপ্রদ পুরো ঘটনা দেখে। মুখে কিছু না বললেও সে আন্দাজ করে নেয় কিছুটা। মুরাদ জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘স্যরি মিস! স্যরি আঙ্কেল! মিস্টেক হয়েছে। হাতে প্রচুর ব্যথা পেয়েছি। ডক্টরের কাছে যেতে হবে।’ বলতে বলতে দ্রুত গতিতে প্রস্থান করল মুরাদ। সোহানা তার আব্বুকে কীভাবে ম্যানেজ করবে সে-ই টেনশনে আছে আপাতত। পিছন থেকে ইসানা পুরো ঘটনাটি দেখেছে। মুখ চেপে প্রচুর হেসেছে। মুরাদ চলে যাওয়ার মিনিট কয়েক সেখানে দাঁড়িয়ে রয়। সে চাইছে বিষয়টি যেন সোহানা একাই সামলে নেয়। তারপরই সে তাদের কাছে যাবে।
_
‘আউচ! আস্তে ব্যান্ডেজ কর রাদ, ব্যথা লাগছে।’ আহত কণ্ঠে বলল মুরাদ৷
রাদ মুচকি হেসে মুরাদের হাতে ব্যান্ডেজ করতে করতে বলল,
‘ভাগ্য ভালো ছিল চামিচের উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করেছে। কাঁটা চামিচ হলে হাত ছিদ্র হয়ে যেতো।’ লাস্টের অংশটুকু শেষ করে রাদ হেসে ফেলে৷ মুরাদ মেকি রাগ নিয়ে বলল,
‘হাসিস নাহ! তোর কথা শুনেই তো আমি গিয়েছিলাম। কে জানতো ওনি সোহানার আব্বু হবে।’
‘একজন বয়স্ক লোক ও ইয়াং ছেলের মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না। তুই কী আসলেই পুরুষ?’ পিঞ্চ দিয়ে বলল।
‘তুই আমার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করছিস। শোন ছোট বেলায় দু বার পালিয়েছি মুসলমানি করব না দেখে।’
রাদ এবার উঁচু গলায় হাসতে আরম্ভ করল। মুরাদ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে। তার এটা বলা একদমই উচিত হয়নি। রাদকে পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে ভুলে বলে ফেলেছে। হাসি থামিয়ে রাদ মুরাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘সমস্যা নেই, আমরা আমরাই তো। এখন তুই সোহানাকে স্যরি বল।’
‘দু তিনদিনে ওর সামনে যাবই না।’
‘যেমন তোর মর্জি!’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল রাদ।
.
‘এ দুর্দিনে ইসারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এটাই তো অনেক বেশি সোহানা। কতোই না কষ্ট পোহাতে হয়েছে মেয়েটার।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সুরভী খাতুন। সোহানা পাশে বসে তার কথা শুনছে। আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘মায়ের অভাব আপনি পূরণ করেছেন মামি। ও নিজেই চেয়েছিল আসতে। অনেকদিন হলো আপনাদের দেখে না। কিন্তু মামার জন্য আসার সাহস করেনি।’
‘পারলাম না আমি ওর মামাকে মানাতে। ইসানার কথা একদমই শুনতে পারে না লোকটা।’
‘মামি টাকার বিষয়টি মামার কাছ থেকে গোপন রাখবেন ইসানা বলেছে।’
‘গোপন রাখতে হবে না।’ বাক্যটি বলে ক্ষোভ নিয়ে এগিয়ে এলো লিয়াকত আলী। স্বামীকে দেখে চমকে উঠেন সুরভী খাতুন। সোহানাও ঘাবড়ে যায়। তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
‘অভি’শপ্ত, পোড়ামুখীর টাকা দিয়ে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না। ফিরিয়ে দেও ওর টাকা সুরভী।’
সুরভী খাতুন স্থির থাকতে পারলেন না আর। ছোট থেকেই ইসানার প্রতি এরূপ আচরণ মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। শেষ অব্ধি বিয়ে দিয়েও মেয়েটির জীবন নষ্ট করে ক্ষান্ত হয়নি। এখন তাদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে এটাও সহ্য হচ্ছে না। চটজলদি দাঁড়িয়ে গেলেন। খেঁকিয়ে বললেন,
‘অভি’শপ্ত ইসানা নয়, তুমি? মনে নেই কয়েক বছর আগে কীভাবে সংসার চালাতে? ইটের ভাটায় অর্ধেক বেলায় কাজ করে, আর অর্ধেক বেলা জুয়া খেলে সব টাকা উঠিয়ে দিতে। কত কষ্টের মধ্যেই আমাকে কাজ করে সংসার চালাতে হয়েছে। ছোট্ট মেয়েটি ঘরে তোমার দুই ছেলেমেয়ে দের দেখাশোনা, যত্নআত্তি করেছে। আজ তোমার জন্যই ইসানার এই অবস্থা। টানাপোড়ায় ঠিকমতো সংসার চালাতে পারো নি। যদি মেয়েটাকে ভালো কোনো ঘরে বিয়ে দিতে সুখে থাকত। আজ অন্যের অধীনে কাজ করে পেট চালাতে হতো না। একবার ভাবো, মনে করে দেখো। কতোটা অকথা, বিশ্রীভাবে গালিগালাজ করেছো। একবারও তো মুখ ফুটে কিছু বলেনি মেয়েটা। নিজের মেয়েকেই বড়ো বলে গন্য করেছো, অথচ ওদের চেয়ে বড়ো ইসানা। নিজের বাবার চোখে দেখেছে তোমাকে।’ পুরোটা বলে তিনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিলেন। লিয়াকত আলীর দৃষ্টি নত। বিন্দু বিন্দু অনুতপ্ত বোধ তীরের মতো হৃদয়ে আঘাত আনছে তার।
সুরভী খাতুন নজর সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘অল্পতেই থেমে যেতে চাই। ইসানার জন্মদাত্রী মা আমি নই, তবে নিজের সন্তানের চেয়ে কম নয় ইসানা। আজ আমি বলছি, আমার বড়ো মেয়ের টাকা দিয়েই মেজো মেয়ের বিয়ে হবে। এতে কারো যদি আপত্তি থাকে, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। এ বিয়েতে ইসানাও থাকবে। সোহানা তুমি এখন যাও।’
হ্যাঁ সম্মতি জানিয়ে সোহানা বেরিয়ে এলো। সুরভী খাতুন তার কামরাতে চলে গেলেন। সিমা ও মানিক পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথা শুনছিল। তারাও তাদের কক্ষে চলে এলো। রয়ে গেলো শুধু লিয়াকত আলী। এ প্রথম আজ নিজেকে ঘৃ’ণা লাগছে । আদরের ছোট বোনকে কতোই না ভালোবাসতো। ইসানা পৃথিবীর আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন আদরের বোন৷ তখন থেকেই ইসানাকে অভিশপ্ত ভেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা যে তার ভুল ধারণা আজ সে বুঝতে পেরেছে। সে আজ অনুতপ্ত!
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।