#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩৩
#সুমাইয়া_মনি
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই বললে হয়৷ বেলা সাতটা গড়িয়ে এগারোটার কাছাকাছি। এখনো আকাশ মেঘলাময়।
অনেকটা স্থান জুড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছে। মিতু গায়ের সুয়েটারটি ভালোভাবে টেনে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন থাকায় শীতের রেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবে একটা টিউশনি করিয়ে দ্বিতীয়টির গন্তব্যে হাঁটছে। আরেকটু পথ পেরোলেই পৌঁছে যাবে। রাস্তায় বেশ কয়েকটি পিকাপ যেতে দেখে আনমনে চোখ গাড়ির ওপর চলে যাচ্ছে। হয়তো কালকের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখার সুপ্ত আশা জাগছে হৃদয়ে। তবে বারংবার চোখ দু’টি হতাশ হয়েছে। এ গলি থেকে বেরিয়ে ওপর গলিতে এসে পৌঁছায় তার গন্তব্যে।
.
কালকের পর এখন অব্ধি ইসানার সঙ্গে রাদের কথপোকথন হয়নি। দুইটা বাজে। বাংলাদেশে বারোটা হবে। রাত বাসার ট্যাবে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেয়। টাইসন তখন বিছানার ওপর বসে কার্টুন দেখছিল। ইসানা টাইসনকে বিছানার ওপর কার্টুন দেখতে দিয়ে শাওয়ারে গিয়েছে। ভিডিও কলে রাদকে দেখে টাইসন তার বন্ধুকে চিনতে পারে। তাই রাদের কল সে পীক করে। আগে থেকে তাকে কল রিসিভ করার ট্রেনিং দিয়েছিল রাদ। তাই টাইসনের অসুবিধা হয়না কল রিসিভ করতে। কিছুক্ষণ টাইসনের সঙ্গে কথা বলে। কয়েকটি কথার উত্তরও দেয় টাইসন মাথা নাড়িয়ে। হঠাৎ ইসানা শাওয়ার শেষে বের হয়। রাদের নজর পড়ে ইসানার ওপর। বোকার মতো উৎসুক হয়ে ফোনের অপর প্রান্ত থেকেই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। পরক্ষণে টাইসনকে ইশারায় পাশে সরতে বলে। টাইসন রাদের ইশারা অনুসরণ করে পাশে সরে বসে। এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তাকে। ইসানা ভেজা চুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুছে টাওয়াল দিয়ে ঝাড়ছে। গায়ের ওড়না বিছানার ওপর রাখা। ইসানা উল্টোদিকে ফিরে ছিল তাই পিঠ দেখা যাচ্ছিল। রাদ আয়নার মাধ্যমে ইসানার মুখশ্রী সহ বদনখানি দেখছে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। ইসানাকে ভেজা চুলে এভাবে কাছ থেকে দেখা হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই মাথায় ওড়না দিয়ে রাখতো। তাই মাথার ঘন-কালো কেশ গুলো কখনো নজরে পড়েনি। ঝাড়া শেষে চুল আঁচড়িয়ে ওড়না নেওয়ার সময় ট্যাবে নজর পড়ে তার। সঙ্গে সঙ্গে ইসানার চোখাচোখি হয় রাদের সঙ্গে। তার চোখ চড়কগাছ! দ্রুত উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই নজর পড়ে আয়নায়। লজ্জায় তৎক্ষনাৎ বুকে দু হাত রেখে টাওয়াল জড়িয়ে নেয়। ছুটে গিয়ে ভিডিও কল কেঁটে টাইসনের পানে রাগান্বিত নজরে তাকায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে টাইসন। বোবা পশু আদৌও বুঝতে পারবে কি-না, সে কি কাণ্ডই না ঘটিয়েছে। ট্যাব বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আঙুল তাক করে ওঁকে বলল,
‘গ’র্দ’ভ কোথাকার। তুই তার ভিডিও কল রিসিভ করেছিস কীভাবে? কে শিখিয়েছে তোকে?’
টাইসন বোবা হয়ে দেয়ালে টাঙানো রাদের ছবির উপর নজর ফেলে। ইসানা টাইসনের নজর অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে রাদের ছবি দেখছে। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। চেঁচিয়ে বলে,
‘রাদ শিখিয়েছে? শীট! সম্মান আর রইলো না। আজকের পর থেকে তুই কার্টুন দেখতে পারবি না।’
টাইসন বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইসানা কপাল কুঁচকে ফেলে। টাইসন যে অভিমান করেছে এটা সে নিশ্চিত! লজ্জায় চোখমুখ ঘুচে আসে তার। তবে সে বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয়। তার ওপর পুরো অধিকার রয়েছে। আজ নয়তো কাল তাকে ঠিকিই তাকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। এটাই যে নিয়ম! নিজেকে ধাতস্থ করে ইসানা। ফোনের টোন পেয়ে হাতে ফোন তুলে নেয়।
রাদ টেক্সট দিয়েছে। লিখেছে,
‘টাইসনকে কিছু বলবেন না। আমিই ওঁকে সরে বসতে বলেছিলাম আপনাকে দেখার জন্য। যেহেতু আপনাকে দেখার পুরোপুরি অধিকার আমার আছে আশা করি আপনি বিষয়টি অস্বাভাবিক ভাবে নিবেন না। স্যরি!’
ইসানা টেক্সট পড়ে সরু নিশ্বাস নিলো। তার ও রাদের ভাবনায় মিল রয়েছে। শেষে স্যরি লিখার ফলে ইসানার কিছুটা ভালোলাগে।
কল কাটার পর রাদ কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ডুবেছিল। পরপরই ইসানাকে টেক্সট দেয়। কপালে দু আঙুল বুলিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। তার হাসি মুরাদের চোখে এড়ায় না। চটজলদি জিজ্ঞেস করে,
‘হাসার কারণ কি জানতে পারবো?’
‘না। অতন্ত্য গোপনীয়!’
‘প্রচুর?’
‘ভীষণ!’
‘শুনলাম না।’ ভ্রূক্ষেপহীন নজরে বলল।
রাদ মুরাদকে এক নজর দেখে মৃদু হাসে। মুরাদ টেরা চোখে তাকায়। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে না।
_
ইভানের মা ও বোন শালিনী মেয়ে দেখতে এসেছে। মেয়েদের অর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। পরিবারের বড়ো মেয়েকে দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়। ইভানের মা আগের বিয়ের বিষয়টি তাদের কাছে লুকায় না। সরাসরি জানায়। মেয়ের বাবা নেই৷ মা পুরো বিষয়টি শুনে বিয়ের জন্য সম্মতি দেয়। পরের সপ্তাহে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত করা হয়। বাড়ি ফিরে ইভানকে বিষয়টি বললে তেমন আগ্রহ দেখায় না। মায়ের জোরাজোরিতে বিয়ে করা হচ্ছে। নয়তো বিয়ের ধারেকাছেও যেতে চাইছিল না।
‘মেয়ের নাম মিতু। বড়ো মেয়ে।’
নাম শুনে ইভানের দেখার আগ্রহ হয়। কারণ ক’দিন আগেই এ নামের একটি মেয়ের সঙ্গে তার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়েছিল। শালিনী ছবি তুলে এনেছিল ইভানকে দেখানোর জন্য। বোনের ফোন থেকে ছবি দেখে ইভান শিওর হয় এটিই সেই মিতু নামের মেয়েটি। ছোট্ট ঘটনাটি মা ও বোনের সামনে তুলে ধরে।
‘তাহলে তোরা পূর্ব পরিচিত।’
‘হ্যাঁ! সে কি আমাকে দেখেছে? বা আমার নাম বলেছো?’
‘নাম বলেছি। ছবি শুধু মিতুর মা দেখেছে। মিতু দেখেনি।’
‘ওহ! আমার তাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। শোনো আপু, তুমি আমাদের বাড়িতে বিয়ের পর থাকবে না। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকবে। কারণ মায়ের জন্যই বিয়ে করছি। মিতুই মায়ের সেবাযত্ন করবে। তোমাকে আমাদের বাড়িতে আর থাকবে হবে না। মাঝেমধ্যে দুলাভাইকে নিয়ে বেড়াতে আসবে। ব্যস!’
‘বুঝেছি। তুই কি বলতে চাইছিস?’ অভিমানী স্বরে বলল শালিনী।
‘অভিমান কোরো না। আমার, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। মায়ের সেবাযত্ন অনেক করেছো। এভার শ্বশুর-শ্বাশড়ির সেবাযত্ন করো।’
শালিনী কিছু বলল না। ইভান দৃষ্টি নত রেখে বলল,
‘আমি বিয়েতে ইসানাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই মা।’
‘করিস। অনেকদিন হলো মেয়েটাকে দেখি না।’ খুশি মুখে বললেন তিনি।
ইভান মেকি হেসে গামছা নিয়ে গোসলে যায়। শালিনী মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার না করা উচিত ছিল। যদি ইসানা এসে আমাদের নামে দুর্নাম ছড়ায় মিতুর কাছে তখন ব্যাপারটা কোথায় যাবে একবার ভাবো তো।’
‘তুই এতদিনেও ইসানাকে চিনতে পারিসনি। আমাদের চেয়ে তো ইভান এ ক’দিনে ওঁকে চিনে ফেলেছে। তাই তো এখন আফসোস করছে। শোন, মন পরিষ্কার কর। দেখবি সব কিছু এমনিতেই পরিষ্কার মনে হবে।’ শালিনী মায়ের কথায় কর্ণপাত করল না। বিরক্ত হয়ে উঠে ভেতরে চলে এলো।
…
টাইসন টাইসন ডেকে গলা বসিয়ে ফেলার উপক্রম ইসানার। তবুও সাড়া নেই টাইসনের। ড্রইংরুম অতিক্রম করে বারান্দায় এসে মহাশয়কে পেয়ে যায়। ইসানা সরু চোখে ওঁকে দেখে নেয়। টাইসনের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ভারী অভিমান হয়েছে তার। চোখ-মুখ ভারী ভারী দেখাচ্ছে। এতক্ষণ ডাকাডাকি তার কর্ণকুহরে পৌঁছেছে কি-না সন্দেহ। ইসানা এগিয়ে এসে দু গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘অভিমান হয়েছে। স্যরি! ট্যাবে কার্টুন দেখতে দিবো। এবার খেতে আয়।’
টাইসন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ইসানার সঙ্গে হাঁটা ধরে। ইসানার কথাতে অভিমান ভেঙেছে মহাশয়ের। একত্তে দুপুরের আহার খেতে বসে।
রাদের চক্ষুদয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ভাসছে বারংবার। বহুবার কল দিতে গিয়েও ফোন রেখে দিয়েছে। সে জানে ইসানা কথা বলবে না। তবুও তার অবাধ্য মনকে সে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই দ্বিধাবোধ নিয়ে কল দেয় রাদ। ফোনের টোন শুনে ইসানা রুমে আসলো। রাদের কল দেখে কেটে মেসেজ দিলো। উত্তর আসার পূর্বেই ফের কল আসলো। এবারও কেটে দিলো। রাদ আগের ন্যায় কল দিলো। ইসানা তখনকার ঘটনার জন্য কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ নিয়ে ফোন পীক করল। স্পিকার অন করে পাশে রেখে বিনাবাক্যে খাচ্ছে। রাদ সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকে। ফের কোমল স্বরে বলে,
‘জানি আপনি আমার কল রিসিভ করলেও কথা বলবেন না। তবে আমার কথা বলায় তো কোনো বাঁধা নেই। আপনার সে-ই ওড়নার টুকরোটি এখন আমার হাতের মুঠোবন্দি!’
ইসানার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠলো। সে মনোযোগ দিলো।
‘সানা! তোমার ওড়নার টুকরোর মতো যদি তোমায় ছুঁতে পারতাম। তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে আমায় তীব্রভাবে য’ন্ত্র’ণা দেয়। এ য’ন্ত্র’ণা যে ভীষণ পীড়াদায়ক! সহ্যশক্তির বাহিরে। বহিঃপ্রকাশ করা অসম্ভব কষ্টদায়ক।’ এতটুকু বলার পর রাদ চুপ হয়ে যায়। ইসানা মূর্তির ন্যায় বাক্যগুলো শুনেছে। বক্ষে মোচড় দিয়ে উঠে। রাদের করা বহিঃপ্রকাশ একেকটি তীরের মতো বক্ষে এসে লাগে। কিছুক্ষণের জন্য ইসানা রাদের একেকটা কথা অমৃতর সমতুল্য মেনে নেয়। চোখ জোড়া আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে তার। শরীরের পশম শিউরে ওঠে। অপরপ্রান্তে রাদ নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে বসে। কিছুক্ষণের জন্য ইসানাকে পাওয়ার কল্পনার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে মৃদুস্বরে আওড়ায়,
‘স্যরি!’ খট করে লাইট কেটে দেয়। ইসানা নিজেকে ধাতস্থ করতে পারছে না। তার গলা শুঁকিয়ে গেছে। দ্রুত পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়। প্লেটের পানে এক পলক ফেলে উঠে পড়ে। খাওয়া আর হবে না। হাত ধুয়ে রুমের দিকে এগোয়। বক্ষে এখনো মৃদু ধুকধুক আওয়াজ হচ্ছে।
.
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩৪
#সুমাইয়া_মনি
‘আপনি কি ইভান বলছেন?’ সঠিক নাম্বারে কল দিয়েছে কি-না শিওর হতে প্রশ্নটি করল মিতু। অপরপ্রান্ত থেকে ইভানের জবাব এলো,
‘হ্যাঁ! কিন্তু আপনি কে?’
‘আমি মিতু। আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘যাকে অর্ধাঙ্গিনী বানাবো তাকে কেন চিনবো না। তবে প্রথমে কণ্ঠ শুনে ধরতে পারিনি।’
ইভানের শালীন কথন শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো মিতু। তাকে অর্ধাঙ্গিনী বানানোর সিদ্ধান্ত তার যেমন দৃঢ়, তেমনি তার স্ত্রী হতে কোনো আপত্তি নেইও তার৷ সে বলল,
‘আমি আসলে শিওর হবার জন্য কল দিয়েছি।’
‘বুঝেছি। আমি সেই ইভান। যার সঙ্গে অনাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়েছিল।’
‘কেমন আছেন আপনি?’
‘আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ! খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ! আপনি?’
‘খেয়েছি। আপনার এ বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে? থাকলে বলতে পারেন। আমার বিষয় নিশ্চয় আপনি সব জানেন।’
‘জানি। অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা বৃথা। আমি অতীতের চেয়ে বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে বেশি আগ্রহী। আপনাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম রঙিন করে তুলতে।’
‘শুকরিয়া।’
‘এটা তো আমার বলা উচিত।’
‘সমস্যা নেই। রাখছি। ভালো থাকবেন।’
‘জি, আপনিও। আল্লাহ হাফেজ।’ বাক্যটি শেষ করে কল কেটে দেয় ইভান। বালিশে মাথা রেখে স্থির সিলিং ফ্যানের পানে দৃষ্টি রাখে। সে নিজেকে অতীত থেকে বের করতে চাইছে। ভুলে যেতে চাইছে আগের কুকর্ম! ভালো পথে বাকিটা জীবন মিতুকে নিয়ে উৎসর্গ করতে চাইছে। খুব বেশি চাওয়া নয় তার। তবুও হৃদয়ের এক কোণায় ইসানার জন্য বড্ড ফাঁকা অনুভব হয়। এই ফাঁকা স্থান আদৌও ঘুচবে কি-না জানা নেই তার। ভাবতে ভাবতে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে।
__
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। রাদের কথা মনে উঠতেই হৃদয়ে ভূমিকম্পন সৃষ্টি হয় ইসানার। এ কম্পন তাকে ক্রমাগত দূর্বল করে তুলছে রাদের প্রতি। আঁখিযুগল কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে খুলে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। অপরপ্রান্তে ঘুরে শুতেই বিছানার ফাঁকা স্থানে নজর পড়ে। তার পাশাপাশি বালিশ পাতানো। শুধু শোবার জন্য মানুষটি নেই পাশে। ঐ ফাঁকা স্থানে হাত বুলায় ইসানা। সে ভাবে, যদি রাদ পাশে থাকতো নিশ্চিত তাকে ছুঁয়ে দেখার দুঃসাহসটি দেখাতো। আনমনে মৃদু হাসি ফুটে ঠোঁটে।
পরক্ষণেই রাদের চিন্তাভাবনা ফেলে টেবিল লাইটটি অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
নির্ঘুম যাচ্ছে রাতটি রাদের। ইসানাকে বলা কথাগুলো তাকে ভীষণ ভাবে দ্বিধায় ফেলছে। শত মাইল দূরে অবস্থান করছে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কাছে থাকলে নির্ঘাত কিছু একটা করে বসতো। ভেবে সে নিজেকে ধাতস্থ করে।
কাল বাদে পরশু রওয়ানা হবে নিজেদের দেশের উদ্দেশ্যে।
সে চাইছে সময়টা যেন দ্রুত অতিবাহিত হয়। ইসানাকে দেখার জন্য মন অস্থির তোলপাড় করছে বক্ষে। বার বার এপাশ-ওপাশ ফিরছে দেখে মুরাদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘সমস্যা কি? নিজে না ঘুমালে না ঘুমা। আমাকে তো অন্তত ঘুমাতে দে।’
‘দোস্ত। কেমন যেন লাগছে।’ অসহায় স্বরে বলল।
‘কেমন যেন বলতে?’ জানতে চাইলো।
‘কেমন যেন….।’ বলে ঠোঁট উল্টালো।
মুরাদ টেবিল লাইট জ্বালিয়ে উঠে বসল। রাদের পানে গোয়েন্দার নজরে পর্যবেক্ষণ করছে। রাদ কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল,
‘দেখছিস কী?’
‘তোকে?’
‘আগে তো কতবার দেখেছিস। নতুন করে কোথায় আবার রূপ জ্বালালো আমার?’
‘সেটাই দেখছি। কোথায় যেন নতুনে রূপ গজিয়েছে।’ হেসে বলল।
‘ফা’ল’তু!’ বিড়বিড় করল রাদ।
‘চল বিয়াল গি’লে আসি। তবে যদি জ্বা’লা মিটে।’
‘নাহ! যাব না। আমি এসব পছন্দ করি না।’
‘সাধুর বাপ আমার।’ আঁড়চোখে পলক ফেলে বলল মুরাদ।
‘আমাকে ইরিটেট করছিস।’
‘যাবি কি-না।’ সরাসরি জানতে চাইলো।
রাদ ভাবে সেকেন্ড কয়েক। তারপর বলে,
‘চল।’
দু বন্ধু মিলে বিয়ার কিনে হোটেলের ছাদে বসে খাচ্ছে। প্রথমে হোটেলের ম্যানেজার তাদের এখানে বসে বিয়ার খাওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরপরই ওরা তাকে টাকা দিয়ে পাশ কাঁটায়। তিন বোতল করে আলরেডি ছয় বোতল শেষ করতেই নেশারঝোঁক এসে দাঁড়ায় মাথায়। একে অপরকে তখন বলে,
‘এতদিন সিঙ্গেল ছিলাম। এখন বউ থেকেও সিঙ্গেল আছি। আমাদের কপালই খা’রা’প রাদ।’
‘তোর তো হবার আশাভরসা আছে। আর আমাকে দেখ। মনে হয় সারাজীবন সিঙ্গেল ভাবেই জীবনযাপন করতে হবে।’
‘কস্ট আই মিন কষ্ট নিস না। হবে হবে…’ কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘কবে ইয়ার!’ বলতে বলতে রাদ চেয়ারে হেলান দিলো।
‘হবে নে একদিন। খাওয়া হয়েছে। এখন রুমে চল।’
‘যাব না। বিছানায় গেলে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।’
‘শা’লা চুপ কর। এসব বলিস না। কেউ শুনে ফেলবে।’
‘শুনুক। দুঃখ প্রকাশ করতে দে। এত বছরেও একটা প্রেম তো দূর। কোনো নারীকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। এমন খেয়ালও মাথায় ছিল না। কিন্তু সানা আমার জীবনে আসার পর থেকেই নিজের ক্যারেক্টর উলোটপালোট হয়ে গেল৷ তাকে দেখলে ছোঁবার ইচ্ছে তৈরী হয়ে হৃদয়ে। কতটা পরিবর্তন হয়েছি। দেখ, আমি আগের রাদ নেই দোস্ত।’
‘দেখছি। এখন কি বাকি পরিবর্তন জামাকাপড় খু’লে দেখাবি?’
‘তাই করব। সানা তো আর দেখে না। আমাকে দেখলেই নজর সরিয়ে রাখে। সরাসরি তাকায় পর্যন্ত না।’ দুঃখের প্রলাপ বলতে বলতে কপালে চাপড় দিলো রাদ।
‘থাম রে আব্বা! চল এবার।’ বলে রাদকে টেনে তুলে হাঁটা ধরলো মুরাদ। নেশারঝোঁকে দু’জনার হাঁটা বড্ড দায় হয়ে গেছে যেন। কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমে এসে দু’জনে এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ে।
—
সকাল সকাল টাইসনকে গোসল করিয়ে ছাদে নিয়ে এসেছে ইসানা। টাওয়াল দিয়ে মুছিয়ে বেতের চেয়ারে রেখে নিজেও পাশে বসলো। সার্ভেন্ট এসে কফির মগ দিয়ে যায়। আর টাইসনকে ডগ ফুড। ইসানা খেতে খেতে ফেসবুক লগইন করে। ফেন্ড রিকুয়েষ্টে গিয়ে ইভানের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেখে এক্সেপ্ট করে। আপাতত ইভান অনলাইনে ছিল না। ইভানকে দেখে এখন আর তার খা’রা’প লাগে না। সে মন থেকেই তাকে মাফ করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে। তার সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলেই রাদ এবং নতুন মা’কে পেয়েছে। এটা যে আল্লাহর দেওয়া তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে শেষ হবার নয়। আকাশের পাবে চেয়ে মুচকি হাসে। সে খুশি, ভীষণ খুশি! হঠাৎ ফোনের টোন বাজে। রাদের মেসেজ,’গুড মর্নিং সানা।’ বার্তাটি দেখে ইসানা পুনরায় আকাশের পানে তাকায়। ঠোঁটে এবার তৃপ্তির হাসি ফুটে। এ হাসি যেন জানান দিচ্ছে রাদকে আস্তেধীরে আপন করে নেওয়ার বার্তা। দ্বিধা লজ্জাবোধ ফেলে সে নিজেও, ‘মর্নিং’ লিখে পাঠায়।
‘রেগে আছেন?’
‘নাহ!’
‘ভাবছিলাম রিপ্লাই আসবে না। তো কি করছেন?’
ইসানা মৃদু হেসে লিখে,
‘রৌদ্দে বসে আছি। আপনি?’
‘ডিল ফাইনালের জন্য মিটিংয়ে যাচ্ছি।’
ইসানার ইচ্ছে করে লিখতে,’সাবধানে যাবেন।’
কিন্তু লিখে না। ওপর পাশ থেকে রাদের ফের বার্তা আসে।
‘কাল বিয়ার খেয়েছিলাম। আপনাকে জানালাম। অনেক আগে একবার খেয়েছিলাম। আর কাল খেলাম।’
‘এগুলা খাওয়া হারাম।’
‘আপনি চাইলে খাব না কক্ষণো।’
‘তাহলে খাবেন না আর।’
‘আচ্ছা। আপনার কথা অবশ্যই রাখবো।’
‘ধন্যবাদ!’
‘টেক ইয়ার সানা। মিস ইউ!’
লাস্টের বার্তাটি দেখে ইসানার ওষ্ঠদ্বয়ে অটোমেটিক হাসি ফুঁটে উঠে। সে ফোন রেখে মুখ চেপে ধরে। অবাক হয় নিজের হাসি দেখে। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে রাদের প্রতি অনুভূতিটি অনুভব করে। এ দু’দিনে রাদের প্রতি অনেকটা দুর্বল অনুভব করে নিজের ভেতরে।
.
ফোন লক করে রা’গী দৃষ্টি ফেলে মুরাদের পানে। কাল অতিরিক্ত বিয়ার খাওয়ার ফলে মাথা ব্যথা অনুভব করছে রাদ। মেডিসিন নেবার পর কিছুটা কম অনুভব করছে। তবে এতটাও না। মুরাদ রাদের চাহনি বুঝতে পেরে ফোনের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,
‘আমারও মাথা ব্যথা করছে রে দোস্ত।’
‘মিথ্যা কথা বলবি না একদম।’ ঝাঁড়ি দিয়ে বলল।
‘আচ্ছা আর তোকে খাওয়ার জন্য ফোর্স করব না। এই মুহূর্তে নিজেকে শান্ত কর।’
রাদ জানালার পানে চেয়ে বাহিরের পানে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
‘ইভানের বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
রাদ ভ্রু কুঞ্চন করে মুরাদের দিকে তাকায়। বলে,
‘কবে?’
‘এই শুক্রবার বিয়ে।’
‘মেয়ে কী বিবাহিত?’
‘অবিবাহিত। নাম মিতু। এখন মনে হচ্ছে ও শুধরে গেছে। লোকদের নজরদারি করা বন্ধ করতে বলবো?’
‘না বলে দে।’
‘আচ্ছা। দাওয়াত দিবে তোদের? কি মনে হয়।’
‘এসব ফালতু ভাবনা ভাবী না আমি।’ মেকি রাগ দেখিয়ে বলল।
মুরাদ চুপ হয়ে যায়। রাদ আর কথা বাড়ায় না। ইসানার জীবন থেকে ইভান পুরোপুরি ভাবে চলে গেছে জেনে স্বস্থি পায় সে।
.
.
.
.
#চলবে?