তুমি রবে ৫৬
.
.
জীবনের সব থেকে বাজে পরিস্থিতিতে আশফি পড়েছিল যেদিন তার মা এই বাড়ি ছাড়ে। সেদিনের কথা মনে পড়লে আশফির তীব্র রাগ আসে তার বাবার প্রতি। কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে, এরপরও সে ওই বাবা মানুষটাকেই বেশি ভালোবাসে। আর আজ যেটা ঘটল তাতে তার মাথায় খুন চাপলেও তাকে স্থিরতা ধারণ করতে হচ্ছে। মাহির চরম বোকামির ফল কীভাবে তাকে ভোগ করতে হচ্ছে তা হয়তো তার স্ত্রী বুঝতেও পারছে না।
দাদীবু এক গ্লাস পানি এগিয়ে ধরল আশফির সামনে। আশফি স্তব্ধ হয়ে গা এলিয়ে বসে আছে সোফায়। গ্লাসটা সে ধরল না। পাশে বসে আছে দিশান, চাচা শিহাব। আর সামনে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে দাদা আবরার। সবার চোখের ঘুম হারাম আজ। চাচি জেবা গেছে মাহির কাছে। প্রচন্ড ভয়ে আছে সে। ভয়ের চোটে সে অনবরত কেঁদেই চলেছে। শায়খ বাসার বাইরে ডিউটিতে। কাল দুপুরের আগে সে ফিরতে পারবে না। দিশান খোঁজ নিয়ে জেনেছে সোম এখন ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসারত আছে। মূল ঘটনাটি কী ছিল তা শুধু স্পষ্টভাবে মাহিই বলতে পারবে। কিন্তু আশফির এই মুহূর্তে যে মেজাজ তাতে তাকে কেউ মাহির ধারের কাছে যেতেও দিচ্ছে না। চাচা শিহাব নীরবতা ভেঙে বলল,
– “ব্যাপারটা যেহেতু এত দূর চলে গেছে আমার তো মনে হচ্ছে পুলিশ কেস এসব না হয়ে যায়।”
উত্তরে দাদা আবরার বললেন,
– “হওয়া তো স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলেটার পরিবারের সঙ্গে তো মাহির পরিবারের ভালো কমিউনিকেশন। তারা কি এত কিছু করবে?”
– “দাদা তাদের সঙ্গে মাহির পরিবারের সম্পর্ক এই মুহূর্তে মোটেও ভালো নয়। কারণ ভাইয়ার সঙ্গে মাহির বিয়েটা তাদের জন্য ছিল অভাবনীয়।”
– “কিন্তু তারা তো নাকি বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল?”
– “শুনেছি পরবর্তীতে সোম নিজে এসে জানিয়েছিল বিয়েটা সে করবে।”
দাদীবু প্রশ্ন করল,
– “খবরটা নিউজ হয়েছে কী শিরোনাম করে?”
দিশান এবার ফোন থেকে দাদীবুকে দেখাল সবটা। পত্রিকাগুলো এই নিউজের শিরোনাম ছেপেছে – প্যারোট টেক্সটাইল কোম্পানির চেয়ারম্যান আশফি মাহবুবের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী জনসম্মুখে তার প্রাক্তনকে গাড়ির নিচে ধাক্কা মেরে হত্যার চেষ্টা করেছেন। শিরোনামটা দেখা মাত্রই দাদীবুর মাথাও গরম হয়ে গেল। সেখানে তার নাতির ক্রোধের মাত্রায় বিবেচনা করছেন তিনি। আশফির নীরব ভঙ্গি অত্যাধিক রাগের একটি দিক। তাকে নীরব থাকতে দেখে আবরার বললেন,
– “কাল সকালে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা যাবে। রাত হয়েছে অনেক। যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। আর মাথা গরম করিস না বেশি ওর সাথে।”
আশফি নড়ল না একটুও। চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে বসে আছে সে। প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার। সবাই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলেও তার ভাবনা এই মুহূর্তে সামনে কী হতে চলেছে। সোমের ব্যাপারে সে যা জানে তা হয়তো মাহিও জানে না। সোম যদি সুস্থ হয় তবে তার আগেই আশফি তাকে দমিয়ে রাখার চিন্তাতে মগ্ন এখন। খুব দ্রুতই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তাকে।
এসব ভাবতেই সে উঠে দ্রুত পায়ে চলে গেল ওপরে। রুমে ঢুকতেই সে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো মাহির মুখে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা। মাহি কাঁদতে কাঁদতে চাচিকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে। আশফি রুমে ঢুকে ক্লোজেটের কাছটাতে এসে দাঁড়াল। মাহি তাকে দেখে ভয় পেয়ে আবার চুপ করে গেল। আশফি জিজ্ঞেস করল,
– “ওর আবদার ছিল কী? কী চেয়েছিল ও তোমার কাছে?”
মাহি মিনমিন আওয়াজে জবাব দিলো,
– “আমাকে ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল।”
– “আর?”
– “আমি যেতে রাজি হইনি বলে অনেক ধমকাতে শুরু করে।”
এটুকু বলে মাহি থেমে গেল।
– “বলতে থাকো।”
– “আমাকে নিয়ে ওর ভাবনা, ইচ্ছা, স্বপ্ন এসব বলছিল। আমি চলে আসতে গেলে আমার হাত টেনে ধরে জোর করে দাঁড় করিয়ে বলতে থাকে আমাকে ছাড়া…”
এরপরের কথা মাহি বলতে পারল না। তারপর থেকে বলতে শুরু করল,
– “এসব বলতে বলতে ও কেঁদে ফেলে। তখন আমরা লেকের মাঝে। আশেপাশের সবার দৃষ্টি তখন আমাদের ওপর। আমি আবারও চলে আসতে চাইলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে আর বলে আমি ওকে ঠকিয়েছি। আমি তখন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ওকে ধাক্কা দিলে ও নিচে পড়ে যায়। আমি ধাক্কাটা খুব জোরে দিইনি। কিন্তু আমার ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও বোধহয় অনেকটা অস্বাভাবিক অবস্থাতে ছিল।”
– “নেশারত অবস্থাতে ছিল?”
– “হ্যাঁ তেমনই লাগছিল। চোখদুটো ভয়ানক লাল ছিল। আর ওর কথাও কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। আমি দৌঁড়ে রাস্তায় চলে এলে তখন পিছু থেকে আমাকে আবার আটকে ধরে। আমি তখন খেয়াল করিনি যে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ওকে আবার ধাক্কা দিতেই ও একটা প্রাইভেট কারের সামনে গিয়ে পড়ে। আর তারপর চোখের সামনেই একদম…! সবাই দৌঁড়ে আমার দিকেই আসছিল তখন। প্রচন্ড ভয়ে আমি দ্রুত একটা সিএনজিতে উঠে পড়ি।”
জেবা উঠে এসে আশফিকে বলল,
– “তাহলে ছবিগুলো লেকের মানুষেরাই মজা উপভোগ করে তুলেছে। আজ কাল তো দেশের জনগণের একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব। ভালো কোনো কাজে পদক্ষেপ নেই যতসব আলতু ফালতু জিনিস ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে বেড়ানো।”
– “হুঁ। ছবিগুলো ওইদিন থেকেই ছড়িয়েছে। কিন্তু আজ বেশি হাইলাইট হয়েছে পত্রিকাগুলোতে যাওয়ার জন্য।”
– “টেনশান করিস না। শায়খ দেখছে ব্যাপারগুলো। ছবিগুলোও নাকি ডিলিটের ব্যবস্থা করছে সব জায়গা থেকে।”
আশফি মাথা যন্ত্রণায় চোখদুটো বারবার কচলাতে থাকল। কপালের মাঝের রগটাও তার জেগে উঠেছে। জেবা বেরিয়ে যেতেই মাহি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আশফি গেল ওয়াশরুম। মাহি দরজাটা বন্ধ করে বিছানা গুছিয়ে নিলো। আশফি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মুখ মুছে বিছানার কাছে আসতেই মাহির ফোন বেজে উঠল। মাহি ফোন রিসিভ করতে এগিয়ে এলেও আশফিকে ফোন তুলতে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। নাম্বারটা অচেনা। আর এই নাম্বার যেহেতু তার নতুন সিমের নাম্বার, তাই বিশেষ পরিচিত ছাড়া এই নাম্বার কারো জানার কথা নয়৷ আশফি শীতল দৃষ্টিতে তাকালেও খুব কড়াকণ্ঠে মাহিকে আদেশ করল,
– “কোনো অচেনা নাম্বার থেকে কল এলে রিসিভ করবে না।”
মাহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল শুধু। কলটা কেটে গিয়ে আরও দু’বার বাজল। শেষমেশ ফোনটা অফ করে দিলো আশফি। বিছানার ওপর সেটা ফেলে মাহিকে বলল,
– “লাইটগুলো অফ করে দাও।”
তারপর শুয়ে পড়ল সে। মাহি লাইট অফ করে দিয়ে বিছানাতে এসে আশফির পাশে শুতে কেমন জড়তা কাজ করল তার মাঝে৷ অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে আজ সে আশফিকে। এদিকে আশফি সোজা হয়ে কপালে হাত ফেলে শুয়ে আছে। নজর তখন তার সিলিং ফ্যানের দিকে। মাহি তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শুয়ে পড়ল তার পাশে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল, মাহি কিছুতেই ঘুমাতে পারল না। পাশ ফিরে দেখল আশফি সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা শীত শীত অনুভব হলো মাহির। আশফির গায়েও কোনো চাদর নেই। চাদরটা উঠিয়ে আশফির গায়ে তুলে দিতেই আশফি চোখ মেলল। চোখজোড়া প্রচন্ড লাল হয়ে উঠেছে তার। ঘরের মৃদু আলোতেই মাহি দেখতে পেলো আশফির কপালের মাঝে জেগে ওঠা রগ। চোখদুটো বন্ধ করতেই মাহি তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “মাথা ধরেছে তোমার?”
আশফি অনেকক্ষণ পর শুধু ‘হুঁ’ বলে উত্তর দিলো। মাহি জিজ্ঞেস করতে গেল মাথা টিপে দেবে কিনা সে। কিন্তু তা জিজ্ঞেস করাটা খুবই বেমানান। কিছু না বলেই মাহি উঠে বসে তার কপালের দু’পাশ চেপে দিতে শুরু করল। আশফি তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। মাহি বুঝতে পারল আশফি আরামবোধ করছে তাহলে। প্রায় দশ মিনিট বাদে আশফি ঘুম কাতুর কণ্ঠে মাহিকে বলল,
– “শুয়ে পড়ো। আর লাগবে না।”
– “ব্যথা কি কমেছে?”
– “হুঁ।”
মাহি বিছানা থেকে উঠতেই আশফি জিজ্ঞেস করল,
– “কোথায় যাও?”
– “ওয়াশরুমে।”
মাহি ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখল আশফি কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানাতে উঠে এসে মাহি তার মুখোমুখি হয়ে শুলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে মাহির। তবে আশফির ব্যবহারের জন্য নয়, আশফিকে এত বাজে পরিস্থিতিতে দেখে নিজেকে অনেক বড় অপরাধী লাগছে তার। কতটা চিন্তার মাঝে আছে মানুষটা! নিজের সম্মানকে সে খুব ভালোবাসে। সেই সম্মান ক্ষুণ্ন হলে সে হয়তোবা পৃথিবীর সব থেকে ভয়ানক মানুষটিকে পরিণত হয়! এমনটাই ধারণা করল মাহি। চোখের কোণ ভিজে উঠতেই দ্রুত চোখদুটো মুছে নিলো সে। তার নাক টেনে ওঠার শব্দ গেল আশফির কানে। তার ঘুমটা যে তখনো মজবুত হয়নি। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল মাহি অপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
.
.
রাতের অর্ধেক সময় অবধি আবরার জেগে ছিলেন। তাই বেলা নয়টাতেও তাকে দেখা গেল না নাস্তার টেবিলে। আশফি আর দিশান দ্রুত নাস্তা সেড়ে নিলো। নাস্তা সেড়ে উঠে আশফি তার দাদীবুকে বলল,
– “দাদাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আপনি একটু ওনাকে সময় দিন রুমে গিয়ে। বেশি টেনশান নেওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি দেখছি সব।”
আশফির এত স্বাভাবিকতা দেখে দাদীবু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর নাতির ক্রোধের মাত্রা সম্পর্কে তাঁর জানা। ভেবেছিলেন হয়তোবা মাহির সঙ্গেও খু্ব খারাপ আচরণ করবে সে। কিন্তু সকালে মাহিকে ডেকে নাস্তার টেবিলে বসিয়ে যখন আশফি নিজে তার প্লেটে খাবার তুলে দিলো তখন হীরা উপলব্ধি করতে পারলেন, যত যা-ই হোক, আশফি কখনোই তার বাবার মতো হবে না। আর মাহিকে সে কোনো কিছুর বিনিময়েও ছাড়বে না। এ দৃশ্য দেখে তিনি খু্বই তৃপ্তি পেয়েছেন।
মাহি চাচি জেবার সঙ্গে খাবারের টেবিল গোছাতে ব্যস্ত। আশফি দিশানের সঙ্গে কথা বলছে সোমের ব্যাপারটা নিয়ে। ঠিক সে মুহূর্তেই এস আই মুরাদ দুজন কনস্টেবল নিয়ে এসে বাড়ির মূল ফটকে এসে দাঁড়িয়েছেন। গেটম্যান ফোন দিয়ে জানাল আশফিকে। আশফি তাদের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে চাচিকে বলল,
– “দাদার রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসুন চাচি। ওনার কানে যেন এ মুহূর্তে পুলিশ আসার খবর না পৌঁছায়।”
মাহি রীতিমতো ভয়ে চুপসে গেছে। গত দু’দিন বাদে ঠিক গতকাল রাত থেকেই সোম আর মাহির ছবিগুলো বেশি রটেছে। আর মাহি নিশ্চিত, সোমের পরিবারও ঠিক কালই অবগত হয়েছে এ ব্যাপারে। এ কারণেই তারা কেস করে এসেছে নিশ্চয়।
আশফির সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে মুরাদ বললেন,
– “আমরা জাস্ট কিছু কথা বলব আপনার মিসেসের সঙ্গে।”
মাহি ভয়ে জড়সড় হয়ে আশফির পিছে দাঁড়িয়ে আছে। দিশান বলল,
– “হ্যাঁ অবশ্যই, বসুন আপনারা।”
– “স্যরি, এখানে নয়। আমাদের সঙ্গে ওনাকে যেতে হবে কিছুক্ষণের জন্য।”
আশফি বেশ চড়া হয়ে বলল,
– “কথা বলার জন্য আমার লিভিংরুমটাও পারফেক্ট। আপনি এখানে বসে কথা বলুন। সমস্যা তো নেই।”
– “স্যার, ব্যাপারটা সমস্যার নয়। ব্যাপারটা আইনের। আপনার মিসেস এখন মার্ডার কেসের আসামি। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ দ্বারাই কেস হয়েছে ওনার বিপরীতে।”
মাহি খুব শক্ত করে আশফির হাতটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আশফি সেই আগের সুরেই বলল,
– “কেস তো আমিও করেছি। কিন্তু ভিক্টিম এখন চিকিৎসাধীন তাই তাকে ইন্টাররোগেট করতে সময় নেওয়া হচ্ছে।”
এর বিপরীতে মুরাদও উত্তর দিলেন। এক কথা দুই কথাতে আশফির সঙ্গে তর্ক লেগে গেল তাঁর। আশফি মাহিকে জেরা করতে দিতে রাজি। কিন্তু কোনোভাবেই মাহিকে সে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে দিতে রাজি না। রাগে আশফির কণ্ঠ উচ্চ হয়ে উঠেছে বহু আগেই। আবরারও বেশ কিছু সময় ধরে বসার ঘরে আওয়াজ পাচ্ছেন তাঁর দুই নাতির। সেই সঙ্গে অচেনা কোনো পুরুষের কণ্ঠ শুনতেই তিনি দরজা ধাক্কাতে থাকলেন ভেতর থেকে। আশফির রাগ চরম মাত্রাতে। সে দৃষ্টিপাত করল না সেদিকে। জেবা বাধ্য হয়ে দরজা খুলে আবরারকে নিয়ে এলেন বসার ঘরে। তাঁকে দেখে মুরাদ সম্মান প্রদর্শন করতেই আবরার জিজ্ঞেস করলেন তাকে,
– “কোনো সমস্যা?”
– “কোনো সমস্যা নয় স্যার। আমরা মিসেস মাহিকে আমাদের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যেতে এসেছি। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমাদের।”
– “হ্যাঁ সেটা তো এখানে বসেও জিজ্ঞেস করা যায়।”
– “স্যার আপনি অন্তত এভাবে বলবেন না। আইনের হিসেব তো আপনার জানা।”
এসবের মাঝে জেবা বহু আগেই শায়খকে ফোন করে জানিয়েছিল পুলিশ আসার বিষয়ে। শায়খ তার ওপরের কর্মকর্তার মাধ্যমে মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে এ মুহূর্তে জানাল তার যা জিজ্ঞাসাবাদের আছে, তা যেন তিনি ঘরে বসেই করেন। আর শায়খও মিনিট দশের মাঝেই চলে আসছে। এ আদেশ মানতে বাধ্য হলেন মুরাদ। মাহির মুখোমুখি বসলেন তিনি। মাহিকে আতংকিত দেখে মুরাদ অভয় দিয়ে বললেন,
– “ম্যাম আপনি নির্বঘ্নে শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো দেবেন।”
আশফি খেয়াল করল মাহির শরীর কাঁপছে খুব। চোখজোড়াও জলে ভিজে একাকার। সে এসে মাহির পাশে বসে মুরাদকে বলল,
– “আপনি আপনার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করুন।”
প্রায় বিশ মিনিট যাবৎ মুরাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলল মাহির সঙ্গে। পাশাপাশি আশফিও সোম আর মাহির পূর্বের সম্পর্ক, তারপর দিশানের প্রতি সোমের আচরণ আর তার কারণও বিশ্লেষণ করল তাকে। সঙ্গে আশফি প্রমাণসহ এ তথ্যও জানাল, সোম প্রায় চার বছর যাবৎ বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত। নেশাদ্রব্যের পাশাপাশি নারী নিয়ে ব্যবসাও তার কর্মের অন্তর্ভুক্ত। এ সবই সর জানাল মুরাদকে। দিশান সোমের বিপরীতে প্রতিটা ডকুমেন্টস আর তার ব্যবসায়ের স্থানগুলোও মুরাদকে দেখাল। মাহির প্রতি সোমের মানসিকতা কী তা প্রমাণ করতে মেয়ে নিয়ে ব্যবসায়ের তথ্যগুলো ভালোভাবে উপস্থাপন করল তাঁর কাছে। এর মাঝে শায়খ এসে উপস্থিত। সোমের কেসটা সে খু্ব দ্রুতই হাতে নেবে বলে জানাল মুরাদকে। মাহির কেসটার ব্যাপারে মুরাদ জানালেন শায়খকে,
– “দেখুন সোম এখানে ভিক্টিম হলেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। আর কেসটা এতটা জটিল হতো না যদি না এটা এভাবে ছড়াছড়ি হতো সারা ফেসবুক জুড়ে। এখানে একটা ভিডিও পর্যন্ত ভাইরাল হয়েছে আজ সকালে। সেটা নিশ্চয়ই দেখেছেন? সেখানে অত্যন্ত রুড ছিলেন তিনি সোমের প্রতি। আর শেষ ধাক্কাটাও উনি যেভাবে দিয়েছেন সেখানে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, গাড়ি আসার মুহূর্তেই উনি ধাক্কাটা দিয়েছিলেন। তাই এত সহজে কেসটা সামলে ওঠা কষ্টকর। আমি আজ যাচ্ছি। তবে ওপর থেকে কী নির্দেশ আসতে পারে সে বিষয়ে আপনাদের তো ধারণা দিয়েছিই।”
.
.
মাহির পরিবারও এসে কথা-বার্তা বলে গেছে মাহির সঙ্গে। মাহি রুমের মধ্যে বসে সোমের ব্যাপারে আশফির আর দিশানের বলা কথাগুলো ভাবছে। সোম ব্যবসা করতো ঢাকার বাহিরে। তার ব্যবসায়ের খাতিরে অধিকাংশ সময়ই সে ঢাকার বাইরে দিনের বেলাটুকু থেকে তাকে রাতে ফিরতে হতো। কিন্তু এই ব্যবসাগুলে যে এত বাজে পর্যায়ের ছিল তা মাহি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তাহলে এ কারণেই আশফি তাকে এত বেশি ঘৃণা করে!
রাত প্রায় নয়টা বাজে। আশফি সকাল এগারোটার সময় বেরিয়েছে। এর মাঝে আর আসেনি সে বাড়িতে। বিকালে দিয়া আর হিমু এসে কথা বলে গেছে মাহির সঙ্গে। কিন্তু সকাল থেকেই মাহি আশফিকে নিয়ে ভাবছে। মাত্র ক’টা দিন এসেছে সে আশফির জীবনে। আর সে আসার পরই আশফিকে সব থেকে বড় বিপদে পড়তে হলো। তবে পড়তে হলো নয়; তার বোকামি দ্বারা আশফিকে সে বিপদে ফেলেছে।
এত কিছু ভাবনার মাঝে আশফি রুমে ঢুকল। মাহি তাকে দেখে ব্যালকনি থেকে দ্রুত রুমে এলো। প্রচন্ড এলোমেলো চেহারা মানুষটার। আশফি চেঞ্জ করতে বাথরুমে চলে গেল। বাথরুম থেকে ফিরে মাহিকে বলল,
– “তোমার ফোনে কোনো কল এসেছিল আর?”
– “ওটা তো আপনি অফ করে রেখেছেন কাল রাত থেকে।”
আশফি প্রথম অবাক হলো মাহির পুরো কথাটা শুনে। কাল রাতে আশফি রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। আর তাই সে ফোনটা ধরেও দেখেনি। আর দ্বিতীয়বার অবাক হলো তাকে আপনি সম্বোধন করতে শুনে। একটা বাক্যতেই আশফির বোঝা হয়ে গেছে, মাহি তাকে নিয়ে ঠিক কী চিন্তাভাবনা করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কিছু বলল না মাহিকে। ফোনটা ওপেন করতেই মিসড কল অ্যালার্টে কয়েকটা অচেনা নাম্বার পেলো আশফি। এরপর মাহিকে বলল,
– “এটা কোনো অ্যাডাল্ট পার্সোনের কাজ?”
মাহি কোনো কথার জবাব দিলো না। আশফি নাম্বারগুলো নিজের ফোনে তুলে কল করতে থাকল সেগুলোতে। কিন্তু রিসিভ হলো না। মাহিকে বলল,
– “কল এলে অবশ্যই কল রেকর্ড চালু করে কথা বলবে।”
– “ঠিক আছে।”
মাহি এরপর জিজ্ঞেস করল আশফিকে,
– “আপনার খাবারটা কি রুমে নিয়ে আসব?”
আশফি ফোনটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো মাহির কাছে।
– “কী সমস্যা? এসব কী ধরনের আচরণ?”
– “আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো নিচে থেকেই খাবার…”
– “এক মিনিট! আপনিটা কী? আমরা একটা সম্পর্কের মাঝে আছি মাহি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে। কোনো ড্রামা মুভিতে অভিনয় করছি না আমরা। এই সম্বোধনের অর্থ কী? তুমি কি রেগে আছো কালকের জন্য?”
মাহি মুখটা মলিন করে জবাব দিলো,
– “আমি কেন রাগতে যাব? রাগ তো আপনার হওয়া স্বাভাবিক।”
– “মাহি!”
আশফি ধমকে উঠল তাকে। মাহি বলল,
– “আমি কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে কারো ক্ষতি করিনি। আপনার ক্ষেত্রেও আমি এই ক্ষতিটা ইচ্ছাপূর্বক করিনি।”
– “এসব কী কথা বলছো তুমি? এই কথার অর্থ কী? কীসের ক্ষতি?”
মাহি কোনো জবাব না দিয়ে চলে যেতে গেলে আশফি তাকে টেনে এনে নিজের কাছে দাঁড় করাল। এরপর বলল,
– “সব ক্লিয়ার করো। ভেতরে আর কী কী পুষে রেখেছো সেটা আমাকে বলো।”
মাহি অনেকক্ষণ চুপ থেকে থমথমে মুখ করে বলল,
– “আপনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার, আপনার সম্মান ক্ষুণ্ন করার কোনো উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। বিশ্বাস করুন।”
– “তুমি কি আগের সম্বোধনে ফিরে আসবে? আমার এটা শুনতে ভালো লাগছে না কিন্তু।”
– “আমি পারব না৷ আপনার দিকে তাকাতেই আমার প্রচন্ড জড়তা কাজ করছে। তুমিটাও বলতে আমার বাঁধছে। আমি চাইলেও পারছি না।”
আশফি এবার গম্ভীর আওয়াজে বলল,
– “কাল আমার আচরণগুলোই তোমার আর আমার মাঝে দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে রাইট? আচ্ছা তুমি যে এভাবে আমার সঙ্গে হঠাৎ করে ফর্মাল বিহ্যাভগুলো করছো, তার অর্থ এটা দাঁড় করাওনি তো যে আমি শুধু আমার সম্মান হানি হওয়ার জন্য এত রেগেছি তোমার ওপর?”
এ প্রশ্নের উত্তরে মাহি নিশ্চুপ রইল। আশফি তাকে নীরব থাকতে দেখে অত্যন্ত বিরক্তে কিছুক্ষণ চোখদুটো এঁটে বন্ধ করে চুপ থাকল। এরপর বলে উঠল,
– “তুমি মানুষটা ঠিক কী দিয়ে গড়া বলো তো? আমি আমার সম্মান নিয়ে শুধু ভাবছি, এটাই ভাবছো তাই না? মানে তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে এর থেকে কী করে সেফ করব এসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই আমার? এই যো আজ সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে এলাম খালি আমার সম্মান যাতে বজায় থাকে এর জন্য?”
এ প্রশ্নগুলোর বিপরীতে মাহি যে উত্তরটি প্রদান করল তাতে আশফি কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তাকে ঘিরে মাহির চিন্তাভাবনা কী তা জানতে পেরে আশফি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মারল সে আয়নাতে।
………………………………
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin
ক্লান্ত আর ঘুম চোখে নিয়ে লেখাতে ভুল শব্দ, ভুল বানান কষ্ট করে বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল।
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.