তুমি রবে ৫১

1
1960
তুমি রবে ৫১ . . চোখদুটো মেলতেই মাহি ধরা খেলো আশফির সেই নেশা ভরা মায়া দৃষ্টি পানে। কুচকুচে কালো মণিদুটোর মাঝে একান্ত তার মুখটিই দেখতে পেলো সে। আশফির দৃষ্টি স্থির নেই যেন। কখনো তার নজর মাহির অধরে, কখনো বা মাহির চোখদুটিতে। তাকে বাঁধা দেওয়ার মতো শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে মাহি। ওই দু জোড়া চোখের পানে তাকালেই তার এই বেহাল অবস্থা হয়। এখন যেমন সে চাইলেও নড়তে পারছে না। যেন মনে হচ্ছে তার সারা শরীর অবস হয়ে আসছে। হাতটা গভীরে নেওয়ার প্রচেষ্টাতে আশফি। নাভির চারপাশটাতে তার আঙুলগুলো ঘুরানোর মুহূর্তে আশফি খেয়াল করল মাহির গালের পাশটা আর কপালটাতেও কাটা দাঁড়িয়ে গেছে। আলগোছে আশফি সেই হাত দ্বারা মাহির গালটা স্পর্শ করল। তার চোখের পাতাতে সে মুহূর্তে তার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করল, স্পর্শ করল মাহির কপালের মাঝটা। মাহির ঠোঁটজোড়াতে স্পর্শ করার মুহূর্তে মাহি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলো তার থেকে। তবে এবার আর আশফি থেমে থাকল না। মাহির কোমল গালটার মাঝেই চুমু খেলো সে। মাহি তার দিকে ফিরে তাকালে আশফি মৃদুস্বরে বলল, – “আমার মনে আছে বেগমসাহেবা! ঠিক সেই রাতটাতে আপনি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন, যে রাতটাতে আমি জ্বর নিয়ে পড়ে ছিলাম। আপনি কি জানেন সেদিন আপনার ভেতর এই প্রতিশোধ ছাড়াও আরও একটি বিষয় ছিল আপনার মাঝে?” মাহি কিছুটা লজ্জিত হলো আশফির মুখে সেই রাতটার বিবরণ শুনে। তবে এ কথা সত্য, তার মাঝে সেই রাতে প্রচন্ড রাগের সঙ্গে এই প্রতিশোধের দিকটা ফুটে উঠেছিল। যার কারণেই সে সকল দ্বিধাবোধ ভুলে গিয়েছিল। মাহিকে নীরবে চেয়ে থাকতে দেখে আশফি বলল, – “আমাকে নিয়ে আপনার ভাবনার শেষ ছিল না। ঘুমের মুহূর্তটুকু ছাড়া আপনি কখনোই যে আমাকে ভুলতে পারতেন না তা আমি জানি। সেদিন ওই প্রতিশোধের পাশাপাশি আপনার মাঝে আমার প্রতি প্রেমও ছিল বেগমসাহেবা।” আশফির ঠোঁটে স্মিত হাসি। মাহি তখনো নীরব। আশফি আবার বলল, – “আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন আমি উষ্ণ আর আপনি শীতল ছিলেন। শরীরের সবটুকু উষ্ণতা আমাকে দিয়ে আপনি পুরোটা রাত শীতে কেঁপেছেন। এক সেকেন্ড সময় নিইনি আপনাকে আমার বুকের মধ্যে আনতে। আর আপনি আমার এই দূর্বলতা অবশ্যই জানতেন। তাই চেয়ারের ওপর কী সুন্দরভাবে ফোনে ভিডিও রেকর্ড অন করে রেখেছিলেন।” মাহি এবার অতি বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বসলো, – “আপনি দেখে নিয়েছিলেন!” আশফি তার প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, – “অত্যন্ত রাগে তুমি মাইন্ডলেস হয়ে গিয়েছিলে। তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখলে তোমার ফোনটা অফ। তখনো তুমি কিছু বুঝতে পারোনি।” – “আমার ধারণা ছিল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল।” – “হ্যাঁ চার্জ তো শেষ করেছিলাম আমিই। তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি তো তোমার আমার ওই অনাকাঙ্ক্ষিত সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করছিলাম।” মাহি এবার উঠে বসলো। আশফির কথাগুলো তার মস্তিষ্কে স্থাপন হচ্ছে না ঠিক। এই গল্পের শুরুটা আশফি করলেও শেষটা তো সে করেছিল। কিন্তু আশফির কথাগুলোতে গল্পটার শেষ তো সে করতে পারেইনি বরংচ আরও দীর্ঘ করেছে সে। প্রচন্ড উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে মাহি জিজ্ঞেস করল, – “আপনি সম্পূর্ণ নিজেকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে প্রকাশ করতে চাইছেন এখানে। আপনি এই ঘটনার শুরু থেকে শেষ কিছুই বুঝতে পারেননি!” আশফি এবার ঠোঁটদুটো চেপে মাহির দিকে চেয়ে হাসতে থাকল। এরপর মাহির পাশেই উঠে বসলো। তারপর বলল, – “তুমি কেন মানতে পারছো না তা তো আমি বুঝতে পারছি। মাত্ করতে চেয়েছিলে তুমি। কিন্ত তা করতে পারোনি। এটাই কষ্টকর, না? মাহি, এটা কোনো গেম ছিল না। যে হার জিত দ্বারা তুমি এটাকে বিবেচনা করবে। কবে বিশ্বাস করবে তুমি? আমি যে খারাপটা তোমার সঙ্গে করেছি তা শুধু সোমের থেকে তোমাকে দূরে রাখার জন্য।” – “উফ্! আমি এই বিষয়ে কিচ্ছু শুনতে চাইছি না এখন। আপনি অর্ধেক কথাতে আছেন। শেষ করুন।” – “আমি দেখেছিলাম ভিডিওটা। আমি জানতাম ভিডিওটা তুমি শুধু ঐন্দ্রীকে পাঠাবে। কারণ তোমার রাগটা আমার ওপর ছাড়াও ঐন্দ্রীর ওপর ছিল, রাইট?” – “হুঁ।”
– “আমি চাইছিলাম তোমার মাধ্যমেই বিয়েটা ভাঙুক। কিন্তু আশ্চর্য হয়েছিলাম তুমি যখন দাদার সঙ্গে ডিরেক্টলি ব্যাপারগুলো শেয়ার করলে। রাগ হয়েছিল খুব। তবে সেটা কিছুক্ষণের জন্য। তোমার ওপর দাদা দাদীবু অনুগ্রহ করুক এটা আমি চাইনি। বিয়েটা ভাঙলে আমি নিজে দাদা আর দাদীবুকে সঙ্গে করে যেতে চেয়েছিলাম তোমার কাছে। তোমাকে করুণা দান করে এ বাড়িতে আনা হোক, তা আমার অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিল। কিন্তু সেই করুণার পাত্রীই হলে তুমি। আর এটাই ছিল আমার রাগের সব থেকে বিশেষ কারণ। আরও একবার প্রমাণ করলে, কত বড় নির্বোধ তুমি।” মাহি কপাল কুচকে, কেমন শূন্য দৃষ্টিতে আশফিকে দেখছে সে। সে এখন কীসের মধ্যে আছে তা সে ধারণা করতে পারছে না। রাগ আর দুঃখ-কষ্টের সংমিশ্রণে যদি কোনো অনুভূতি থেকে থাকে তবে সে এখন এই দুইয়ের মিশ্র অনুভূতিতে। মাহি ভারী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, – “আপনি ইচ্ছা করে ঐন্দ্রীকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনি পারতেন আমার এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে। তাহলে কেন করেননি? কতখানি কষ্ট পেতে হলো ঐন্দ্রীকে আপনার জন্য।” – “তার দায়ভার তো কিছুটা তোমারও।” এবার মাহির রাগটা বেশি অনুভূত হলো ভেতরে। চোখে-মুখে সেই রাগের ছায়া এনে তাকিয়ে আছে আশফির দিকে। কিন্তু আশফি সে মুহূর্তে এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। সে হঠাৎ সজোরে টান দিয়ে মাহিকে নিজের খুব কাছে নিয়ে এনে বলল, – “বিশ্বাস হচ্ছে না যে এর দায়ভার তোমারও? আমি আমার মন আর শরীরকে যতটা কন্ট্রোল করতে পারি ততটা কোনো পুরুষই পারে না। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু আমার এই আত্মবিশ্বাস তো ভাঙল তোমার জন্যই। তারপরও তো যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম নিজেকে। ওই রাতে তুমি কী করেছিলে আমার সঙ্গে? সেদিন তুমি ওইভাবে আমার কাছে না থাকলে আমি জীবনেও এত বড় অপরাধী হতাম না।” – “উহ্! ছাড়ুন তো। কিছুই করিনি আমি আপনার সঙ্গে।” – “করেছিলে। আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছো তুমি কাওয়ার্ডের মতো। আমাকে বাধ্য করেছো তোমার প্রতি অ্যাডিক্টেড হতে।” মাহি ধমক দিয়ে বলে উঠল, – “খবরদার আমাকে কাওয়ার্ড বলবেন না!” – “তাহলে আমার ঘুমানোর সুযোগটা নিয়েছিলে কেন? যা করার আমার জাগ্রত অবস্থাতেই করতে।” – “বললাম না কিছুই করিনি আমি! যতসব ফাজলামো কথা। আর আপনাকে কিছু করার ইচ্ছাও নেই আমার। দেখলাম তো বৃটিশ আফ্রিকানদেরও ছাড় দেননি। কী অশ্লীল! ছিঃ!” – “অদ্ভুত! অশ্লীলের কী দেখলে? ওটা একটা লাইব্রেরি ছিল। আর ওখানে সবাই বুক লাভারস ছিল। আমি খুব সুন্দর করে পয়েম, নভেল এগুলো পড়তে পারি। আর ওরা খুশি হয়েই…” – “দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কী সব! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এখন তো আবার বলবেন ওটা আপনাদের ওখানকার কালচার।” আশফি নির্বিকার ভঙ্গিতে তার উত্তরে বলল, – “হিংসা হওয়া ভালো। হিংসা হচ্ছে, তাই না? সুন্দর করে চুমু খেতে পারাও একটা যোগ্যতা।” মাহি তাকে বিদ্রুপের সুরে বলল, – “হ্যাঁ আপনার তো সেই যোগ্যতার সার্টিফিকেটে ফার্স্ট ক্লাস রেজাল্ট।” – “অবশ্যই। কোনো সন্দেহ আছে?” মাহি মুখ ভেংচি কাটল তার প্রশ্নে। আশফি তার সেই নেশাভরা চোখে দেখতে আছে মাহিকে। মাহি তা খেয়াল করে বলল, – “আপনিও যেমন অসভ্য আর আপনার নজরও অসভ্য।” কণ্ঠে হাসির আভাস তার অনেকটা। মাহির কথাতে সে জবাব দিলো, – “অস্বীকার করি না। নজর তো অসভ্য হয়েছে ট্রায়ালরুমের মধ্যে সেই অর্ধেক জামা পরা নারীর গলার নিচের সেই ক্ষুদ্র রাঙা চিহ্নটা(তিল) দেখার পর থেকে।” মাহি ভুলেই গিয়েছিল এই হিসাবটা তার বরাবর করা হয়নি। এই ঘটনাটা মনে পড়তেই এক সাংঘাতিক কাজ করে বসলো সে এই মুহূর্তে। জীবনে প্রথমবারের মতো সে কোনো পুরুষের কলার চেপে ধরল। আশফির কলার চেপে ধরতেই আশফি বিস্ময়ে চোখদুটো বড় বড় করে ফেলল। বিস্মিতভাবে সে বলল, – “কত বড় সাহস! আমার জামার কলার চেপে ধরছো তুমি? আমি কিন্তু এখন তোমার স্বামী।” – “এই মুহূর্তে আমি আমার স্বামীর কলার না, একজন ক্রিমিনালের কলার চেপে ধরেছি। আপনি অত্যাধিক মাত্রায় একজন অসভ্য পুরুষ। এখন আপনি বলতে পারেন না যে আমার জন্যই আপনি ট্রায়ালরুমে ঢুকেছিলেন। কারণ তখন আপনি আমাকে চিনতেন-ই না। তার মানে আপনার উদ্দেশ্য কত অশ্লীল ছিল, ছিঃ! আপনার সঙ্গে তো এখন সংসারও করা উচিত না আমার।” আশফি তার কলার মাহির হাতের মধ্যে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মাহির দুই হাতের কব্জি নিজের এক হাতের মধ্যে চেপে ধরে মাহিকে ধমকে বলল, – “আমাকে কিছু বলতে দেবে তুমি? আমি সেদিন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই ঢুকিনি।” – “তো কি পুলিশে ধাওয়া দিয়েছিল?” আশফি আবারও ধমকে উঠল। – “চুপ! গাধা একটা! আমি সেদিন একজনকে ফলো করছিলাম। তাকে খুঁজতে খুঁজতে তোমার রুমে ঢুকে যাই। সে আমার নজর এড়াতে একটা ট্রায়ালরুমে ঢুকেছিল। আর আমি ভুলবশত তখন তোমার রুমে…!” – “তার মানে সেই একজন নিশ্চয় মেয়ে ছিল?” – “হ্যাঁ।” আশফি এবার নির্বিকার সুরে উত্তর দিলো। মাহি এখানেও তাকে ভুল বুঝে তাকে জিজ্ঞেস করল, – “নিশ্চয় সে আপনার থেকে পালাতে চাইছিল। আপনি তার কাছে কতটা খারাপ হলে কেউ এভাবে আপনার থেকে পালায়!” আশফি এবার কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, – “মানে সবকিছুতেই নেগেটিভ একটা মিনিং বের করা, তাই না? এই স্বভাবটা আমার খুবই অপছন্দের। তবে এটা সত্য। আমি সেই মানুষটার কাছে হয়তোবা খুবই খারাপ।” এই মুহূর্তে আশফির ঔদাসিন্যতা একটা ছোটখাটো ধাক্কা দিলো মাহিকে। শেষ কথাটার মাঝে প্রচন্ড হতাশা ছিল, যা মাহি বুঝতে পারল। মুহূর্তেই সে ধারণা করে নিলো আশফি হয়তোবা তার পূর্বে অন্য কাউকে ভালোবাসতো। আর সে হয়তো তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মাহির এই চিন্তাগুলো বুঝতে আশফির বেশি সময় লাগল না তার চোখ-মুখের ভাব দেখে। আশফি বেশ দৃঢ় কণ্ঠে তাকে বলল, – “ভুলেও এ ধরনের সস্তা চিন্তাভাবনাগুলো করবে না।” – “তো সে কে ছিল? আশফি মাহবুব কাউকে এভাবে ফলো করতে পারে, তার মানে সে সাধারণ কেউ নয়।” ……………………………… (চলবে) – Israt Jahan Sobrin গঠনমূলক মন্তব্য বা সমালোচনামূলক মন্তব্যে আমি অবশ্যই রিপ্লাই করব। আমি নিজেও কারো কমেন্টের রিপ্লাই করি না। এই অভিযোগের পূর্বে আগে গঠনমূলক সমালোচনা করুন। অবশ্যই আমার রিপ্লাই পাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো কষ্ট করে বুঝে নেবেন প্লিজ।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে