তুমি রবে ৪৯

0
1951
তুমি রবে ৪৯ . . হঠাৎ যেন চারপাশটা নিভৃতে পরিণত হলো। কারো কোলাহলের আওয়াজও কানে আসছে না। আশফির থুঁতনিতে কপালটা ঠেকিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে মাহি। আশফির হাতজোড়া তখনো মাহির কোমর জড়িয়ে। আশফির বুকের সঙ্গে মিশে তার জামার অংশ দু’হাতে চেপে ধরে নিমজ্জিত মাহি চোখ দুটো ঠেসে বন্ধ করে রেখেছে। এই ক্ষণিকের মাঝে তার কী হয়ে গিয়েছিল? এখনো যেন শরীর কাঁপছে তার। এখন তো কোনোভাবেই সে মানুষটার চোখে চোখ রাখতে পারবে না। আশফি নিজেও নীরব। সে অপেক্ষাতে আছে মাহির নজরে নজর রাখার জন্য। একটু সময় বাদে মাহি তার শরীরের ঝোঁক সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মুখ ফুলিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল আশফি। – “বাপরে! এভাবে দানবের মতো মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে? নিয়ন্ত্রণই তো হারিয়ে ফেলছিলাম!” হতবুদ্ধি হলো মাহি তার এমন কথাতে। লজ্জাকে গ্রাস করে এবার সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ল আশফির দিকে। কোনো কথাও খুঁজে পেলো না সে তাকে বলার মতো। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ করে দিলো লোকটা! মুখ খিঁচিয়ে তাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। রাগে সে দিশেহারা হয়ে এবার শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে আশফির পায়ের পাতাতে নিজের পা দ্বারা আঘাত করে বাইরে চলে এলো। পা’টা চেপে ধরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে বিস্মিত চোখে সে তাকিয়ে রইল মাহির যাওয়ার পথে। . – “আর সব কই?” অনিক ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর তুলে মাহিকে বলল, – “তোর দেবর ফোনে কথা বলতে বলতে পুলের মধ্যে পড়ে গেছে। এখন সবাই ওখানেই।” মাহি হাসতে হাসতে ট্যারেস থেকে একবার উঁকি দিলো পুলের দিকে। শায়খকে তুলে নিয়ে আসছে দিশান। ওপরে এসে শায়খ চলে গেল অন্য একটি ঘরে কাপড় চেঞ্জ করতে। তার মাঝে আশফি এসে বসলো মাহির পাশে। একবার কটমট চোখে তাকাল মাহি তার দিকে। আশফি নির্বিকারভাবে তার দিকে তাকিয়ে তারপর সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে একটি কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাস তুলে নিলো হাতে। দিশান, দিয়া আর হিমুর হাসি তখনো থামছে না শায়খের অবস্থা দেখে। – “খুব মজা পেলে সব, না? অথচ সরষে ক্ষেতের ভূতকে কেউ আর দেখলে না।” কথা বলতে বলতে শায়খ বেরিয়ে এলো রুম থেকে। চুলগুলো মুছতে মুছতে এসে বসলো আশফির পাশে। আশফি বলল, – “তো তোদের আর কী প্ল্যান?” দিশান হাসি থামিয়ে তাদের মুখোমুখি বসে বলল, – “প্ল্যান তো আজ সারা রাত সবাই অনেক গল্প করব। সবার লাইফের সব রকম কথা আজ আমরা জানব, জানাব, শুনব, শুনাব। শুধু আড্ডা চলবে।” দিয়া আর হিমু অনিকের দু’পাশে বসেছে। দিয়া মুখটা একটু ভার করে বলল, – “রাত তো অনেক হলো। আমাকে যে ফিরতে হবে। আমার তো আজকের আড্ডামহল ছেড়ে একদমই উঠতে ইচ্ছা করছে না।” – “তো তোমাকে কে উঠতে বলছে? হিমু? তুমি কি বলে আসোনি যে ও আজ তোমার সঙ্গে থাকবে?” – “হ্যাঁ আমি তো তাঁদের অনুমতি নিয়েই এলাম দিয়া।” – “আজ রাতে একটা ডিজাইন কমপ্লিট করতে হবে।” – “আমি এ নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।” দিশানের কড়া কণ্ঠের আদেশ শুনে দিয়া কেমন হাসি চেপে রাখা মুখ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মাহিকে চুপচাপ দেখে অনিক মাহিকে বলল, – “কীরে? আমরা এসেছি বলে তোর মন খারাপ না কি?” – “আরে ধুর! এত ফালতু চিন্তা আসে কোথা থেকে তোদের?” আশফি তার দিকে সরাসরি নজরে তাকালেও মাহি বাঁকা চোখে তাকাল তার দিকে। – “আচ্ছা কাহিনীটা কী ঘটেছিল? আমি কিন্তু এখনো বুঝতে পারিনি।” হিমু প্রশ্নটা করল শায়খকে। শায়খ অসহায়ের মতো মুখ করে বলল, – “ছোট হলে বড় ভাইদের কত অত্যাচার, কত র‍্যাগ, কত কিছু সহ্য করতে হয়! আমিও এর সুদে আসলে শোধ তুলব একদিন।” দিশান হাসতে হাসতে ড্রিংকসের গ্লাসটাতে চুমুক দিয়ে আশফিকে বলল, – “ভাইয়া কিছু বলছো না কেন? তোমার পাশে বসে কী সব ব্লেম দিচ্ছে আমাদের।” – “তুমি জানো সে এই শীতের মধ্যে আমাকে পুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে! আর সবাইকে কী বলছে? আমি প্রেমালাপ করতে করতে পুলে পড়ে গিয়েছি। আজ ছোট বলে এই অনাচার। তবে এর মাসুল দিতে হবে আমার ভাবিদের। খালি দ্বিতীয়জনের আসার অপেক্ষাতে রইলাম।” একদম হুমকির সুরে বলল শায়খ। আশফি বলল, – “আমার আপত্তি নেই। যদি পারিস তো ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করিস। সব মওকুফ।” আশফির কথাটা শুনে দিশান ফোঁস করে উঠল। – “একদম ফ্লার্ট করার চেষ্টা করবি না আমার বউয়ের সাথে, বলে দিলাম।” শায়খ জোর পেলো আশফির কথাতে। এদিকে মাহির রাগটা ক্রমশ আরও বেড়ে গেল।
– “তোমার কি তোমার বউয়ের ওপর বিশ্বাস নেই? আমি তো ফ্লার্ট করবই। বড়সাহেবের আদেশ পেয়ে গিয়েছি। তোমার বউয়ের মধ্যে ভেজাল না থাকলে সে কেন আমার প্রেমে ফাঁসবে?” দিয়া মিটিমিটি হাসছে। দিশান দিয়ার দিকে একবার তাকাল। এরপর শায়খের দিকে তাকাতেই শায়খ চোখ মেরে বসলো দিয়াকে। দিয়ার হাসি আরও বাড়ল তখন। দিশান তার হাতে থাকা সানগ্লাসটি ছুঁড়ে মারল শায়খের গায়ে। অনিক তখন বলল, – “ভাইয়া তুমি কিন্তু মোটেও শায়খকে মারতে পারো না। তোমার মিঠাইয়ের মিঠাই-ই তো দেখো কেমন গলে পড়ছে তাকে দেখে।” – “যাও যাও! আমার ভাবি যেন একটা। পাশে আরও একজন আছে। আর এখানে আমার লাইন পরিষ্কার। ঠিক তো ভাইয়া?” – “একদম। আমার কোনোই আপত্তি নেই।” কথাটা বলে আশফি এক মুহূর্তের জন্য আঁড়চোখে দেখল মাহিকে। তার নাকের ডগায় রাগটা তখনো ঝুলছে। আশফির কথা শেষ হতেই শায়খ মাহিকে বলল, – “তাহলে তো কোনো বাঁধাই রইল না ভাবি। চলে আসি?” মাহি মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলল, – “সেটাই। নারিকেলের থেকে ডাবের চাহিদা বেশি। চলে এসো চলে এসো!” শায়খ টুপ করে মাহির পাশে এসে বসে পড়ল। অনিক অনেকটা খোঁচা দেওয়া সুরে আশফিকে বলল, – “ভাই আপনাকে নারিকেল বলে দিলো সে!” – “কী যেন একটা কথা আছে না? বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়! ফল দিলে এমনিতেই বুঝে যাবে। নারিকেল না কি ডাব!” আশফির এবারের কথায় দিয়া, হিমু, মাহি তিনজনেই খুব লজ্জা পেলো। ওদিকে অনিক, শায়খ, দিশান শব্দহীন হাসিতে ফেটে পড়ছে। রাগের চোটে মাহি তাকে মৃদুস্বরে বলেই ফেলল, – “বেহায়া।” আশফি তার কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, – “তা দেখানোর সুযোগ আর পেলাম কই?” দিশান হাসি থামিয়ে সবাইকে বলল, – “আচ্ছা চলো আজকের রাতটাতে ট্রুথ অর ডেয়ার হয়ে যাক।” সবার আগে দিয়া চিল্লিয়ে বলে উঠল, – “কোনোদিনও না। এসব খাইশ্টা গেম ছাড়া আর কোনো গেম নেই যেন!” – “এটা খাইশ্টা গেম!” – “হ্যাঁ খাইশ্টা-ই। এই এত রাতে আমি কোনো ডেয়ার ফেয়ার খেলতে পারব না।” – “ওকে। তো ট্রুথ তো খেলায় যায়।” হিমুও সায় দিয়ে বলল, – “হ্যাঁ এটাই ভালো। আমরা বরং এই গেমটাই খেলি। শুধু ট্রুথ চলবে। কোনো ডেয়ার চলবে না।” আশফি বলল, – “এই সব ছেলেমানুষি গেম খেলার ধৈর্য আমার একদমই নেই। আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।” আশফি উঠতেই মাহি তার হাত দু’হাত দিয়ে টেনে ধরে ধমকে বলল, – “একদম চুপচাপ বসুন। এক পাও নড়বেন না। আমাকে এতগুলো মিথ্যা বলে নিয়ে এসে এখন ঘুমাতে যাওয়া হচ্ছে?” – “আমি কখন মিথ্যা বললাম? অদ্ভুত!” মাহি তার হাত টেনে ধরে ঠাস করে বসিয়ে দিলো। সরু চোখদুটোতে তাকিয়ে সে আশফিকে বলল, – “পুরো গেম শেষ হবে। তারপর উঠবেন।” – “আমাকে মানে আশফি মাহবুবকে কেউ একজন থ্রেট করছে! আমাকে অর্ডার করছে!” দিশানের কাছে অভিযোগ দেওয়ার মতো করে বলল আশফি। মাহি অনেকটা দাম্ভিকতার সুরে বলল, – “সেই কেউ একজন যেন তেন কেউ একজন নয়। মিসেস আশফি মাহবুব সে।” আশফি শীতল চাহনিতে তাকিয়ে থাকল মাহির দিকে। তারপর দিশানকে বলল, – “গেম শুরু কর দিশান। ডেয়ারও থাকবে। এবং যাকে যা বলব তাকে তাই-ই নিতে হবে। আশফির কথার ইঙ্গিত আর কারোরই বুঝতে বাকি রইল না। এরপর খুব বিশেষ কিছুই হতে চলেছে, এ ব্যাপারে। মাহি তার কথাকে পাত্তা না দেওয়ার মতো করে একটা ভেঙচি কাটল। শায়খ বলল, – “গেমটা এমন হোক। সবাই সবার লাইফের অতি স্মরণীয় কিছু মুহূর্তগুলো শেয়ার করবে। যা সে কোনোদিনও ভুলতে পারেনি। বা যা সে কোনোদিনও কারো সঙ্গে শেয়ারও করেনি। মানে এক কথায় ট্রুথ। আর এই ট্রুথটা সবাইকেই নিতে হবে। আর ডেয়ার কাউকে দিতে চাইলে সে দেবে।” দিশান বলল, – “হ্যাঁ ভালো বলেছিস। তাহলে তোর থেকেই শুরু হোক।” অনিক, দিয়া, হিমু তাল মেলাল দিশানের কথায়। শায়খ বলল, – “ঠিক আছে। তাহলে সিরিয়ালি যাবে। আমার পর ভাবিজান, ভাবিজানের পর ভাইয়া। এভাবেই যাবে।” – “ওকে।” – “আসলে ব্যাপারটা খু্ব আপত্তিকর। আমি ব্যাপারটা ইজিলি বললেও আমার ভাবিজানেরা কীভাবে নেবে সেটাই ভাববার বিষয়।” হিমু বলে উঠল, – “শোনো ভাই। এখানে সবাই কাপল। সিঙ্গেল কেউ-ই নয়। তাই বিয়ের পরের অ, আ এসব ব্যাপার সবারই জানা। তাই লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু নেই বোধহয়।” দিশান জিজ্ঞেস করল, – “কী ব্যাপার বল তো? আমিও কি জানি না সেটা?” শায়খ মাথা নাড়িয়ে না জানাল। আর বলল, – “দেখো এরপর কিন্তু আমাকে কেউ কোনোরকম ব্যাড কমেন্টস দেবে না। আমি আগেই বলেছি, এটা খু্বই আপত্তিকর।” অনিক বলল, – “আরে বলো না ভাই। না বলা কথাগুলো বেশিরভাগ লজ্জাজনকই হয়।” শায়খ এবার উঠে আশফির পাশে বসলো। তাকে উঠে যেতে দেখে মাহি বলল, – “আমার পাশে বসে বলতে লজ্জা বেশি লাগত না কি?” – “আমার লাগত না ভাবিজান। আপনার লাগত।” আশফি বলল, – “এত তামাশা না করে বলতে আরম্ভ কর।” – “আমি যখন ক্লাস নাইন থেকে ফোন হাতে পাই ঠিক তখনকার ঘটনা এটা।” দিয়া বলল, – “আচ্ছা ক্লাস নাইন থেকে ফোন ইউজ করতে তুমি?” – “হ্যাঁ। অনেক কান্নাকাটির পর পেয়েছিলাম। তো ফোনটা হাতে পেয়েই প্রথমে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে নিলাম। কিছুদিন পর ফ্রেন্ডদের ভীড় থেকে এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই আলাপ হলো এক মেয়ের সাথে। বলে রাখছি সে আমার থেকে সিনিয়র ছিল দুই বছরের। আমাদের বেশিরভাগ কথা হতো ফেসবুকেই। একদিন মেসেঞ্জারে সে ভিডিও কল করে। আমিও টুপ করে তা রিসিভও করে নিই। কিন্তু মেয়েটা খুব চালাক ছিল। সে ফ্রন্ট ক্যামেরাতে আঙুল দিয়ে চেপে রেখে নিজেকে আড়ালে রেখেছিল। আমাকে ভিডিওতে দেখার পর যখন তার আমাকে ভালো লাগল তখন সে দেখা দিলো। আমাদের কথা হতো বেশিরভাগ সময় অনেক রাতেই। কোনো সম্পর্ক ছাড়াই আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। তো মেন ঘটনা যেটা, একদিন বৃষ্টির রাতে সে আমার থেকে কিস চায় হঠাৎ।” এটুকু বলেই শায়খকে থামতে হলো। আশফি বিরক্তির সুরে বলে উঠল, – “এসব টিনেজারদের প্রেম কাহিনী শোনাতে বসিয়েছিস?” – “হ্যাঁ। আর তোমাকে শুনতেও হবে। চুপ করে বসে থাকো।” দিশান বলল, – “হ্যাঁ তুই বল তো। এই কাহিনীটা আমি তোর থেকে আগেও শুনেছি। কিন্তু এর মাঝে কী হাইড রেখেছিলি সেটা ডিরেক্টলি বল।” শায়খ চোখ-মুখ এঁটে এক নিঃশ্বাসে বলল, – “ওই দিন রাতে আমরা মোবাইল কলে সেক্স করেছিলাম।” আশফি এবার তার দিকে তাকাল পুরো বিস্ময়পূর্ণ চোখে। প্রত্যেকেই কয়েক মুহূর্তের জন্য একই চাহনিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। শায়খ তখনই তাদের উদ্দেশে বলল, – “নো কমেন্টস। কেউ কোনো কমেন্টস করতে পারবে না কিন্তু।” আশফি আবার নির্বিকার ভঙ্গিতে বসলো। মাহি, হিমু, দিয়া আর তাকাল না শায়খের দিকে। তবে কিছুক্ষণ বাদেই হিমু খিকখিক করে হেসে উঠল। শায়খ তাকে বলল, – “হ্যাঁ হাসতে পারো। কোনো আপত্তি নেই।” দিশান কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার আগেই শায়খ তাকে হাতের ইশারায় থামতে বলে বলল, – “নেক্সট। আমার টার্ন শেষ।” আশফি শায়খের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, – “তুই বসেছিলি তোর ভাবিজানের পাশে। এ পাশে বসে আমার টার্ন কেন দিলি?” – “দেখো গেম তো গেম। আমি এখন তোমার পাশে। তো তোমাকেই শুরু করতে হবে। অবশ্য তোমার লাইফের অত্যন্ত স্মরনীয়, লজ্জাজনক সবরকম ঘটনায় তো আমাদের জানা।” দিশানও বলল, – “সেটাই তো। এর বাইরে আর কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। আছে না কি ভাই?” আশফি এবার একটু বিব্রত মুখ করে একবার আঁড়চোখে তাকাল মাহির দিকে। তার এমন চেহারা দেখে দিশান আর শায়খ অনেক অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, – “তার মানে আছে!” আশফি একটু মিইয়ে পড়া কণ্ঠে বলল, – “আসলে ওই সময়টাতে তোরা আমার সঙ্গে ছিলি না। আর আমারও পরে আর বলা হয়ে ওঠেনি।” – “এর অর্থ কী ভাই? আমরা তোমার সঙ্গে না থাকলে জানতে পারব না?” – “আমি তা কখন বললাম?” অনিক বলল, – “আচ্ছা আগে বলেনি আজ তো বলবে। এই রিয়্যাক্টটা তোমরা পরে দিও তো। এখন ভাইয়া আপনি বলতে শুরু করুন।” দিশান বলল, – “ঠিক আছে, তোলা রইল।” আশফি মাথাটা নিচু করে ডান ভ্রুয়ের মাঝে আঙুল দিয়ে একটুখানি চুলকিয়ে বলল, – “আমার তো বলতে আপত্তি নেই। আপত্তি অন্য কোথায় না হলেই হয়।” মাহি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকিয়ে তাকাল তার দিকে। দিয়া বলল, – “আজ সব আপত্তি হজম করব ভাইয়া। বলে ফেলুন।” হিমুও বলল, – “হ্যাঁ ভাইয়া বলে ফেলুন তো। আজ সব আপত্তি অনিকের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি।” আশফি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে তার আর মাহির প্রথম দেখা হওয়া ট্রায়ালরুমের ঘটনাটা খুলে বলল শুধু মাহির নামটা অপ্রকাশ্য রেখে। এবং সে সেদিন সেই তার চেহারাতে নয়, তার গলার নিচের লাল তিলটা দেখে এক মুহূর্তের জন্যও তার হার্টবিট মিস করে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। এটাও সে অকপটে স্বীকার গেল। একদম মার্বেলের মতো চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে শুনছে মাহি আশফির কথাগুলো। কথাগুলো বলার সময় একদম নির্বিকার ভঙ্গি ছিল আশফির। মাহির বুঝতে বাকি নেই সেদিনের মানুষটা কে ছিল। এই ঘনটার রিয়্যাক্ট সেও তুলে রাখল। হিমু জিজ্ঞেসই করে ফেলল আশফিকে, – “নেক্সট টাইম আর দেখা হয়নি ভাইয়া তার সঙ্গে? আশফি এবার তার ঠোঁটে হালকা হাসি ধরে বলল, – “দুর্দান্ত নাটকীয়ভাবে হয়েছে দ্বিতীয়বার। আর এরপর অগণিতবার।” দিয়া এবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, – “ভাইয়া আপনি বিবাহিত এখন। আপনি আমার বান্ধবীর সামনে এই কথাগুলো বলছেন তাও আবার এত অনুভূতি নিয়ে বলছেন যেন এখনো আপনি ভুলতে পারেননি আর কোনোদিনও পারবেনও না। মানে চরমভাবে আসক্ত আপনি এখনো তার প্রতি। এটা কিন্তু ঠিক না।” – “হ্যাঁ তা ঠিকই ধরেছো। অতিমাত্রায় আসক্ত আমি এখনো।” এই ফাঁকে একটাবার মাহির দিকে তাকাতে ভুলল না আশফি। তবে মাহির মুখের রংটা আর কারো চোখে পড়ল না। কারণ সবাই তখন আশফির এই তিলে আসক্ত হওয়া গল্পের মুহূর্ত নিয়ে মশগুল। আশফি সবাইকে বলল, – “আমাকে কি কেউ ডেয়ার দিতে চাও?” সবাই না জানাল। মাহিও তখন থেকে নীরব। আশফি এবার মাহিকে বলল, – “তাহলে নেক্সট!” মাহি তার চোখে মুখের ভঙ্গিতে প্রকাশ করল সে প্রস্তুত। আশফি তাকে বলল, – “আপনার স্বামীর সব থেকে আকর্ষণীয় দিকগুলো বলুন।” মাহি বিদ্রুপের হাসি হেসে সোজাসাপটা উত্তর দিলো, – “আমি কোনোভাবেই আকর্ষিত হইনি এখন অবধি তার প্রতি। তার মানে আকর্ষণীয় কিছুই নেই তার মাঝে।” আশফি শুধু হাসলো তার কথাতে। মাহির এ কথার ঘোর বিরোধিতা করে দিশান বলল, – “ভাবিজান তুমি তো অন্ধ নও! তোমার তো দুটো সুন্দর চোখ আছে। এ কথা তুমি কীভাবে বলতে পারলে? আমার ভাইয়ের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছুই দেখতে পাও না তুমি!” – “সে হয়তো ভাবে বা তোমাদের কাছে মনে হয় সে খুব আকর্ষণীয় কিছু।” শায়খ বলল, – “এতে কোনো সন্দেহ আছে ভাবিজান?” – “সন্দেহ নয়। আমি তো সরাসরিই বললাম।” – “এত বড় কথা!” দিশানকে সে বলল, – “এরপর তো না দেখালেই নয় ভাই।” – “ওয়েট।” পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্যারেসের লাইট অফ করে ঘরের দেয়ালে প্রজেক্টরের রশ্মি ফেলে দিশান তাদের ল্যাপটপ থেকে এমন কিছু মুহূর্ত দেখাল সবাইকে, যা দেখে বাকি সবাই এনজয় করলেও মাহির অত্যন্ত কান্না পাচ্ছিল। দিশান আশফিকে বলল, – “তোমার তো এখানে চুপ থাকা মানাচ্ছে না ভাইয়া!” – “আমাকে সুযোগ দিয়েছিস কিছু বলার?” আশফি এবার মাহির দিকে ঘুরে বলল, – “ওয়েল, আমি অ্যাট্রাক্টিভ পার্সোন এটা আমি কখনোই ভাবি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু বিশেষ বা আকর্ষণীয় কিছু জিনিস থাকে, যা দ্বারা তার কাছের সেই বিপরীত মানুষটা ধীরে ধীরে তার প্রতি আসক্ত হয়।” – “আমি কি আসক্ত আপনার প্রতি?” – “নও?” হিমু বলল, – “মাহি একদম মিথ্যা বলবি না। সত্যি বলবি।” মাহি একটু সময় নিয়ে বলল, – “একটু।” হেসে উঠল সবাই তার উত্তরে। আশফি এবার বলল, – “এখন আপনাকে ডেয়ার নিতে হবে।” – “কেন? সবার বেলাতে শুধু ট্রুথ। আমার বেলাতে কেন দুটোই?” – “সবাই দেয়নি বাকিদের। কিন্তু আমি দেবো। আর সেটা আপনাকে নিতেই হবে।” মাহি গম্ভীর মুখ করে বলল, – “আচ্ছা বলুন।” – “আমার স্ত্রী আমার প্রতি একটু আসক্ত। প্রমাণ চায় তার।” – “মানে এটার আবার কীভাবে প্রমাণ দেয়?” – “তর্কে যেতে চাইছি না। প্রমাণ চায় শুধু।” শায়খ বলল, – “জি ভাবিজান প্রমাণ দিন। প্রমাণ চায় আমাদের।” সবাই একই কথা বলল। কিন্তু মাহি একদম কাঠ হয়ে মুখ গম্ভীর করে বসে রইল তার পাশে। চোখে মুখে তার রাগ, বিরক্তি সবই ফুটে উঠেছে। আশফি তা বুঝতে পারল। যার জন্য সে সিদ্ধান্ত নিলো রুমে চলে যাওয়ার। ফোনটা হাতে তুলে সে নীরবে উঠে দাঁড়াতেই তার জ্যাকেটের কলার পেছন থেকে টেনে ধরে মাহি সোজা চুমু খেয়ে বসলো তার খোচাখোচা দাড়িভর্তি গালে। তাকানোর সময়টুকুও পেলো না আশফি। ..…………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে