তুমি রবে ৪২
.
.
– “ভাবিজান! আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? আমার ভাইজান তো ওপরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
দিশানের এই হাসি মুখটা দেখে মাহির ভেতরটা আরও বেশি ভেঙেচুরে আসছে যেন৷ সে কীভাবে পারছে সবকিছু এত সহজ করে দেখতে? দিশান শাওনকে ডেকে বলল,
– “তোর কাজ কী বল তো এখন? খালি সাজগোজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? দু দুটো ভাবি পেতে যাচ্ছিস। সবসময় তাদের আঁচলে আঁচলে ঘুরবি। বড় ভাবিকে বিগ ব্রো’র রুমে নিয়ে যা।”
– “দিশান!”
মাহির কান্নার সুর শুনে দিশান মৃদু হেসে ইশারায় তাকে চুপ করতে বলল।
– “যাও। কথা বলো গিয়ে আমার ভাইটার সঙ্গে।”
শাওন মাহিকে নিয়ে যেতেই দিশান একবার ঘুরে তাকাল ঐন্দ্রীর দিকে। তার চোখদুটোতেও টলমল করছে পানি। আজ সত্যিই দিশানের মনে হচ্ছে, বাবা-মা থাকাটা কতটা জরুরি দুটো সন্তানের জীবনে। মা থাকলে হয়তো মা’কে জড়িয়ে বলতে পারতো তাদের কষ্টের কথাগুলো৷ যা তারা চাইলেও এই বৃদ্ধ দুজন মানুষকে বলতে পারছে না।
.
আশফির রুমে ঢুকতে প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ হচ্ছে মাহির। এই রুমের মানুষটার সামনে যেতেও তার আজ প্রচন্ড অসহ্য লাগছে।
– “ভাবি? দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
মাহির জবাবের পূর্বে জেবা পেছন থেকে এসে বলল,
– “ও তুই নিয়ে এসেছিস তোর ভাবিকে? আমি আরও আম্মার রুমে খুঁজে এলাম। মাহি, চলো রুমে। তোমার বর অনেকক্ষণ আগেই আমাকে বলেছিল তোমাকে রেডি করে দিতে। একদমই সময় পাইনি তোমার কাছে আসার। কিছু মনে করোনি তো মা?”
– “না না চাচি। কিছুই মনে করিনি৷ আর আমার রেডি হতে হবে মানে বুঝলাম না।”
– “দেখো মাহি, বিয়েটা যে পরিস্থিতিতেই হোক। বাহিরের কত আত্মীয় আছে নিচে। নতুন বউকে এভাবে দেখলে আরও কত কথা কানাকানি হবে বুঝতেই তো পারছো। আশফি আসার পরই শায়খকে পাঠিয়ে কত কিছু কিনে আনিয়েছে। সব রুমে রাখা আছে, চলো। তোমার বরও বোধহয় রুমেই।”
আচমকা বুকের মধ্যে হঠাৎ বারি দিয়ে উঠল মাহির। ‘তোমার বর’ এই দুটো শব্দতেই কেমন একটা শিহরণ তোলা অনুভূতি। যে অনুভূতি আগে কখনো হয়নি তার।
রুমে ঢুকেই দেখল আশফি গোসল করে বাথরুম থেকে বের হয়েছে সবে। মাহির দিকে তাকাল না সে। চাচিকে বলল,
– “আমি শায়খের রুমে যাচ্ছি।”
– “সমস্যা নেই। তোর তো রেডি হতে সময় লাগবে না। তুই রেডি হ। আমরা পরে আসছি। মাহি একটু বসো তুমি।”
মাহি কোনো উত্তর দিলো না। আর আশফিও বলল,
– “যেতে হবে না তোমাদের। আমি শুধু শার্টটাই পরব।”
আশফি শার্ট পরে ভেজা চুলগুলোতর আঙুল চালিয়ে ব্রাশ নিতে নিতে বেরিয়ে গেল সে। কতগুলো দিন আগেও এই মানুষটার এই রূপটাই মাহিকে এত বেশি টানতো যে সে চাইলেও নজর ধরে রাখতে পারতো না। আর আজ তার এক মুহূর্তের জন্যও মানুষটার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করল না।
জেবা তাকে শুধু শাড়ি পরাতেই সক্ষম হলো। এ ছাড়া এক বিন্দু সাজও তাকে করাতে পারেনি। অবশেষে শাওন বলল,
– “মা থাক না। বিগ ভাবিকে কিন্তু সাজ ছাড়াও চমৎকার লাগছে শুধু এই শাড়িটাতেই। ব্রাইডাল সাজের কাছে বিগ ভাবি এমনিতেই ফার্স্ট।”
– “তা অবশ্য ঠিকই। কিন্তু আশফি আবার কী বলবে কে জানে?”
– “চাচি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমার একদমই ভালো লাগছে না।”
মাহিকে রেডি করে চলে গেল জেবা আর শাওন। আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পরে আজ নিজেকে সত্যিই একজন বিবাহিতা মনে হচ্ছে তার। এর আগে কখনো নিজেকে শাড়িতে তার এমনটা মনে হয়নি। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কেন লাগছে?
.
দিশান তাকিয়ে দেখল ঐন্দ্রী সেই টলমল চোখদুটোতে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখছে। কাগজের ওপর দু ফোঁটা চোখের পানিও পড়ল। আশফি তখন ঠিক দিশানের পাশেই বসে আছে। খুব ইচ্ছা করল ঐন্দ্রীর একবার আশফির মুখটার দিকে তাকাতে। কিন্তু সেই জোরটুকু এখন তার নেই। তবে যার ওপর আজ থেকে জোর তার দিকে একবারও তার তাকাতে ইচ্ছা করল না। চোখদুটো মুছে দ্রুত সাইন করে দিলো সে। দিশান নিজেও আর এক সেকেন্ড দেরি না করে সাইন করে দিলো৷ কারণ সে জানে আর একবার দিয়ার কথা মনে করলে সে এই কাগজ ফেলেই চলে যাবে। তবে সব থেকে আশ্চর্যকর বিষয় দিশান কবুল পাঠের পূর্বেই উঠে চলে গেল। সবাই কয়েকবার পিছু থেকে তাকে ডাকল। কিন্তু সবার ডাককে উপেক্ষা করেই নিজের রুমে চলে গেল। ঐন্দ্রী সবাইকে বলল,
– “ওকে ডাকার প্রয়োজন নেই। যেদিন ইচ্ছা হবে সেদিনই না হয় বলবে।”
ঐন্দ্রীর বাবা-মা শুধু মেয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। ঐন্দ্রী তাদের চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল। বিয়ের কাজ শেষ হলে রাতের খাবার খেয়ে মিনহাজ তার পরিবার নিয়ে চলে গেলেন। বাইরে কালকের অনুষ্ঠানের জন্য অ্যারেঞ্জমেন্ট চলছে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে অতিথি আসবে। আবরার শুধু তাঁর নিকটাত্মীয় ছাড়া তেমন কাউকেই নিমন্ত্রণ করেননি। হীরা জেবাকে বলল,
– “মাহিকে নিয়ে আয়। রাতের খাবার খেতে ডাক। দিশানকেও ডাক।”
– “আম্মা এ কেমন বিয়ে হলো বাড়ির ছেলেগুলোর? যাদের নিয়ে সব থেকে বেশি আশা করেছিলাম সেই তাদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি খারাপ হলো। আমার একদম ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বিয়ে নয় কোন শোক পালন হচ্ছে এ বাড়িতে।”
– “কী সব বলিস! কথা বুঝে শুনে বলবি তো।”
– “মাফ করুন। কী করব? মনটা কী পরিমাণ খারাপ বলে বোঝাতে পারছি না।”
কথাগুলো বলে জেবা দিশানকে ডাকতে এলো। কতবার ডেকেও তার কোনো সাড়া পেলো না। মাহি বিছানায় পা ঝুলিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। তাকেও কতবার সাধাসাধি করতে হবে কে জানে? জেবার মেজাজ কিছুটা খারাপই হলো।
– “কী করছো মাহি? এসো নিচে যেতে হবে। রাত তো অনেক হলো। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়?”
– “খিদে পেয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না।”
– “এখন বাড়ির বড় বউ তুমি। এই ছেলেমানুষি এখন কি করলে হয়? চলো।”
মাহি কথা না বাড়িয়ে শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে নিচে এলো। দিশান ছাড়া সবাই-ই খাওয়ার টেবিলে উপস্থিত। আবরার যেন কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। মাহি আসতেই তিনি ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বললেন,
– “এই যে মাত্র নিচে এলো। কথা বল একটু।”
আবরার ফোনটা মাহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– “আসার পর নাকি দাদুর সাথে কথা হয়নি তোমার? কথা বলো একটু তাঁর সাথে।”
মাহি ওখানে দাঁড়িয়েই আলহাজের সঙ্গে দু একটা কথা বলে ফোনটা দ্রুত আবরারের কাছে দিয়ে দিলো। দাদুর কণ্ঠস্বর শুনতেই মাহির গলা ছেড়ে কান্নাটা বেরিয়ে আসতে চাইছে এবার৷ আবরার কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে মাহিকে নিজের পাশে বসালেন। তবে নাতবউ তো তাঁর এখন একজন নয়, দুজন। আর দুজনকেই তিনি সমান চোখে দেখবেন৷ যে যেমনভাবে, যেমন ঘর থেকেই আসুক। নিজ দায়িত্বে তিনি তাদের এ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। কারো মনে এক ফোঁটা অভিযোগ তিনি থাকতে দেবেন না। আর এই পরিবেশ স্বাভাবিক করে তুলতে তাঁকে এখন সেই রসিকতার চরিত্রে ফিরে আসতে হবে। তাই তিনি ঐন্দ্রীকে বললেন,
– “আরে একটু পর তো মালি যার যার ফুল সে সে নিয়ে যাবে। আমি তো আর সুযোগ পাবো না একটু প্রণয় করার। ঐন্দ্রী এসো তো আমার এ পাশে এসে বসো।”
শায়খ হেসে উঠে বলল,
– “ভাগ্যিস আমারটা এখনো আসেনি। নয়তো তাকে বোধহয় কাঁধে বসাতে হতো।”
শাওন বলল,
– “দাদা আমার কিন্তু ট্রিপল ভাবি চায়। ভাইয়াকে আর অনাথ রাখবে কেন?”
শায়খ ধমকে বলল,
– “ওই আমি অনাথ?”
হীরা হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,
– “বউ ছাড়া পুরুষলোক অনাথ।”
– “আর ভাইয়া তখন দুই ভাবিকে দেখে আফসোস করে বলছিলি এমন সুন্দরী রমণী কি আমিও পাবো? তাহলে বলে দে না।”
জেবা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে শায়খকে বলল,
– “তো আগেই বলতি। এই সুযোগে তোর ফুলও ফুটে যেতো।”
শায়খ এবার বলল,
– “যেভাবে বলছো যেন মেয়ে আঙুলের ডগাতেই ছিল?”
ভাইয়ের কথার পিঠে শাওন বলে উঠল,
– “কেন ভাইয়া ছিলই তো। তুই তো দেখলাম রীতিমতো তার ছবিও তুলে…”
শায়খ শাওনের চুল টেনে ধরে বলল,
– “এই তোর খাওয়া কিন্তু আমি বন্ধ করে দেবো। আর পরীক্ষার পর ফোনও পাবি না তুই।”
সবাই কিছুটা বুঝে গেল শায়খ এই বিয়ের অসিলাতেই কাউকে পছন্দ করে নিয়েছে। তাই হীরা বলল,
– “একটু রয়ে সয়ে খা ভাইয়েরা।”
শায়খ মুখে ভাতের লোকমা পুরে বলল,
– “আমার প্রচুর ধৈর্য আছে দাদীবু। কোনো সমস্যা নেই। সামনের মাসে হলেই হবে।”
এ কথা শুনে সবার সঙ্গে ঐন্দ্রীও হেসে উঠল। আশফি একবার মাহির দিকে তাকিয়ে দেখল যখন তখন তার চোখের ফোঁটা খাবারের প্লেটের মধ্যে পড়বে পড়বে অবস্থা। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে সে জেবাকে জিজ্ঞেস করল,
– “দিশান এলো না?”
– “ডেকে এলাম তো কতবার। কোনো সাড়া পেলাম না। আবার যাই।”
– “থাক, আর ডেকো না।”
খাওয়ার মাঝে প্রায় সবাই খেয়াল করল মাহি প্রায় অনেকক্ষণ পর পর দুই এক লোকমা মুখে পুরে তারপরই আবার পানি পান করছে। যার অর্থ সে বহুকষ্টে খাবারটা গিলতে চেষ্টা করছে। চোখদুটো তার তখনও সিক্ত। আশফি ইশারায় চাচিকে বলল মাহিকে উপরে নিয়ে যেতে। জেবা এসে বলল,
– “খুব খারাপ লাগছে মাহি?”
মাহি শুধু মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ প্রকাশ করল।
– “চলো আর খেতে হবে না। উপরে গিয়ে রেস্ট নাও।”
মাহিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরই আশফিও খাওয়া শেষ করে আর বসে থাকল না। বাইরে গিয়ে কালকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কতটুকু, কী হলো তা দেখতে গেল। ঐন্দ্রীর দৃষ্টিতে তখন স্পষ্টভাবে পড়েছিল চাচিকে আশফির ইশারা করার মুহূর্তটা। খেতে বসে কতবার মাহিকে সে লক্ষ্য করেছে সে তাও ঐন্দ্রী দেখেছে। মাহির প্রতি আশফির কেয়ারনেস কত বেশি তা ঐন্দ্রী বুঝে গিয়েছে। তার মানে মাঝখান থেকে সে সত্যিই ঠঁকেছে। মাহিকে আঘাত দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে সেদিন ব্যবহার করেছে আশফি তাকে। কিন্তু তবুও, সেদিন যদি মাহি আর আশফি একই সঙ্গে না থাকতো তাহলে আজ সে এখানে আশফি মাহবুব হতো। আশফি তাকে চরমভাবে অপমান করেছে। তার যে ক্ষতি আশফি করেছে, এই ক্ষতির কোনো পূরণ নেই।
.
.
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় আশফি রুমে এলো। রুমে ঢুকে আশফি মাহিকে পেলো না। বাথরুমের দরজা বন্ধ। বুঝতে পারল মাহি বাথরুমে। আশফি ক্লোজেট থেকে একটা কালো রঙের টি শার্ট আর ট্রাওজার বের করে নিয়ে শার্ট প্যান্ট পাল্টে ফেলল। গায়ে টি শার্টটা ঢোকানোর সময় মাহি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে আশফিকে দেখে বিছানার এক পাশে এসে বসে পড়ল। মাহি সেই কালো শাড়িটাই আবার পরেছে। সেন্টার টেবিলের ওপর টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু নিয়ে মাহি চোখদু্টো মুছে নিলো দু’বার। মাহি এখানে আসার পরই তার সমস্ত জিনিস শাওন আর জেবা দুজন মিলে আশফির ক্লোজেটে গুছিয়ে রেখে গেছে। কাজটা মাহির নিজেরই করার কথা। কিন্তু এ বাড়ির দুজন বউয়েরই একই হাল। তাই তাদের যত দ্রুত স্বাভাবিক করে নেওয়া যায় সেই প্রচেষ্টায় করছে তারা। আশফি নিজে ক্লোজেট থেকে খুঁজে মাহির শালটা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিলো। মাহি তখন নাক মুছতে ব্যস্ত ছিল। তার চোখ মুখ দেখে আশফি বুঝতে পারল কাঁদতে কাঁদতে সে ঠান্ডা লাগিয়ে নিয়েছে। মাহি তার ভেজা লাল চোখের সরু দৃষ্টিতে তাকাল আশফির দিকে। শালটা তার হাত থেকে নিয়ে সে প্রশ্ন করল,
– “আমার লাগেজ কোথায়?”
এই ক’দিনের মাঝে এটাই হলো আশফির সাথে বলা মাহির প্রথম কথা।
আশফি বিছানার এ পাশে এসে হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল,
– “লাগেজ কোথায় জানি না। চাচি আর শাওন এসে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে।”
মাহি উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু তার দৃষ্টি আশফির দিকেই তখনো। আশফি খেয়াল করল তার দৃষ্টি। তার কপালের সুক্ষ্ম ভাঁজটুকু দেখে আশফি বলল,
– “তাদের যেটা করার সেটা করেছে। মেহমান তো আর থাকছে না আমার রুমে।”
মাহি কিছু না বলে ক্লোজেটের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
– “এখানে রেখেছে?”
আশফি কিছু বলল না। কিন্তু শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে তার দিকে। মাহি তার জবাবের অপেক্ষা না করে ক্লোজেট খুলে একে একে নিজের সব শাড়ি, জামা-কাপড় খুঁজে তা বের করে নিতেই আশফি এসে বলল,
– “রুমে দ্বিতীয় কোনো ক্লোজেট নেই। আর এটা কেমন নাটক?”
মাহি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জবাব দিলো,
– “যেখানে থাকবই শুধু রাতটা। সেখানে এক রাতের জন্য কারো নিজস্ব জায়গা ব্যবহারের কোনো শখ নেই।”
আশফি ঠাস করে ক্লোজেট আটকে দিলো। তবে খুব স্বাভাবিক সুরে বলল,
– “বিয়ে বিয়ে খেলা খেলে আসিনি আমি আলহাজ শেখের বাসা থেকে।”
এরপর বিছানায় এসে বসতে বসতে এক অবজ্ঞা ভরা সুরে বলল,
– “যেন খেলা শেষ এবার যে যার বাড়ি চলে যাই।”
মাহি অদ্ভুতভাবে তাকাল আশফির দিকে। এরপর বলল,
– “একটা লোকের জন্য আমার চিরজীবনের ভালো থাকা নষ্ট হয়েছে, আমার বন্ধু আমার বোন দিয়া তাকেও সব থেকে মূল্যবান সম্পদ বিসর্জন দিতে হয়েছে। আমাকে প্রতিটা দিন তার থেকে জঘন্যভাবে অপমান হতে হয়েছে। সেই লোকের সঙ্গে আমি থাকব! আমি ছিলাম আপনার কাছে অপরাধী। আমার বন্ধু কী দোষ করেছিল? তাকে কী করে এভাবে কষ্ট দিতে পারলেন?”
আশফি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দেখে মাহি বলল,
– “এত বড় স্বার্থপর কী করে হলেন বলুন তো? ভাইয়ের কথাও মনে পড়ল না? আর ঐন্দ্রী? সে কি ভালো থাকবে দিশানের সঙ্গে? কেন তাকে গ্রহণ করলেন না? আমাকে সত্যি সত্যি ভোগ করার জন্য?”
– “কী?”
ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল আশফি। উঠে এসে জিজ্ঞেস করল,
– “শেষের কথাটুকু কী বললে তুমি?”
– “ভুল বলে ফেলেছি। আমাকে ছুঁলে তো আপনার হাত গন্ধ হবে। রুচির অবনতি ঘটবে। তবে কী জন্য করলেন বিয়েটা?”
আশফি কিছুটা উঁচু কণ্ঠে বলল,
– “হাত গন্ধ করার জন্য, রুচির অবনতি ঘটানোর জন্য। আর কোনো প্রশ্ন এ বিষয়ে?”
মাহি কোনো উত্তর দিলো না৷ ভেজা চোখ দু্টো মেলে শুধু তাকিয়ে রইল আশফির দিকে। আশফি জিজ্ঞেস করল এবার,
– “গলায় ছুরিটা কে ধরেছিল?”
– “হাসাবেন না প্লিজ। আপনি অর্থ্যাৎ আশফি মাহবুব যে কোনো মেয়ের হাতে ধরে রাখা ছুরিকে ভয় পান এটা বিশ্বাস করতে বলবেন না।”
– “তবে তোমার ক্লিয়ার হওয়া উচিত আশফি মাহবুব কেন এই অরুচিকর মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারে।”
– “না বুঝতে পারছি না। আমাকে বোঝান। কী প্রয়োজন আর আমার থেকে আপনার? আপনার মতো মানুষকে আমি প্রত্যাখ্যান করেছি আর তা আপনি সহ্য করতে না পেরে আমাকে এমনভাবে অপদস্থ করলেন আমার পরিবারের কাছে যে আমাকে বাড়িও ছাড়তে হয়েছিল। এরপরও আর কী করতে চান?”
– “এটাই বুঝলে? আমি প্রত্যাখ্যান হয়েছি বলে তোমাকে অপদস্থ করেছি?”
– “এই দাবি আপনি কোনোদিনও করতে পারবেন না আপনি মানুষটা মাহিকে কোনো এক সময় ভালোবেসেছিলেন।”
– “হ্যাঁ। ভালোবেসেছিলাম এটা ভুল। কারণ ভালোবাসি আমি।”
মাহি তার হাতে ধরে রাখা কাপড়গুলো নিচে ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
– “এ কেমন ভালোবাসা আশফি মাহবুব? কাউকে ভালোবাসলে তাকে কী করে এত নোংরাভাবে অপদস্থ করতে পারে কেউ? কী করে তাকে বলতে পারে এই মানুষটাকে ছুঁলে তার হাত গন্ধ হবে? এ কেমন নমুনা ভালোবাসার?”
– “জানি না। তবে আমি জানি যাকে ভালোবাসি তাকে অন্তত খারাপ দেখতে পারব না। আমি তোমাকে কোনোদিনও পাবো না বলে যে একটা জানোয়ারের হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া সহ্য করে নেবো এটা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না। সোম! যে মানুষটা তোমার পরিবারের চোখে কত মোটা একটা পর্দা এঁটে দিয়েছে যে তার জন্য তোমার পরিবার তার হিংস্র রূপটা দেখতেই পায় না। তাঁরা জানে না তাঁরা নিজের মেয়েকে বলি দিতে যাচ্ছিল তার হাতে। যে পরিবারের বাধ্য সন্তান হয়ে নিজের ভালোবাসা কবর দিয়ে ফেলেছিলে সেই পরিবার ওই দিন কেন তাদের মেয়েকে বিশ্বাস করেনি মাহি? বাইরের মানুষের দুটো তিক্ত কথা শুনে, কয়েকটা ছবি দেখে এত বিশ্বস্ত ছেলে আর ছেলের পরিবার কী করে নিমিষের মধ্যে বিয়ে ভেঙে দিতে পারে? কোনো জবাব আছে? দেখেছে তোমার পরিবার কত ভরসাপূর্ণ ছেলের হাতে তারা তুলে দিতে চেয়েছিল তাদের মেয়েকে? সেই মেয়ে কি দেখেছে যে পরিবারের সিদ্ধান্ত কাঁধে চাপিয়ে শেষে কোথায় এসে নামতে হয়েছে তাকে? আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল। সোমের অস্তিত্ব তোমার জীবন থেকে মুছে দেওয়া। কোনো প্রতিশোধ নেওয়া নয়। আর শেষ যে নমুনার কথা বললে, ভালোবেসে কী করে পারলাম এত জঘন্য অপমান করতে, তাই তো? নিভন্ত আগুনকে জ্বলন্ত করার জন্য অনেক সময় বাতাসের প্রভাব প্রয়োজন। আর আমার এই বিশ্রী কথাগুলো ছিল সেই বাতাসের প্রভাব।
আশফি এটুকু বলে বিছানায় এসে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলো। সচারাচর সে এ বাড়িতে কখনোই স্মোক করে না। কিন্তু ইদানীং তাকে যখন তখন করতে হয়।
– “কী চমৎকার আপনার ভালোবাসা! আমি সত্যিই অভিভূত।”
সিগারেটে এক টান দিয়ে আশফি জবাব দিলো,
– “অভিভূত হও আর বিমুগ্ধ হও। বিয়েটা যখন করেছো, তখন আশফির ঘরেও থাকতে হবে আর তার সংসারও করতে হবে।”
– “পাগল পেয়েছেন আমাকে, না? রাস্তার পাগল আমি? গায়ে ক্ষত সৃষ্টি করে এখন ওষুধ লাগাতে এসেছেন। আর তা দেখে আমি সুন্দরভাবে আপনার ওষুধ গ্রহণ করব তাই না? আপনি কেন দিয়া আর দিশানের কথা ভাবলেন না আশফি? আমাকে বলুন।”
আশফি হতাশ কণ্ঠে বলল,
– “আমি ভেবেছিলাম। ছোট ভাইটা আমার! তার সুখ আমি মুঠো ভরে দেবো কী সে আমার সুখের জন্য…”
– “কীসের সুখ? কাদের সুখের কথা ভেবেছে ওরা! আমাদের সুখের কথা ভেবেছে? আমি তো কবেই আপনাকে আমার ভাবনা, আমার মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিয়েছি। হায় মাবুদ! ওরা কী করেছে? দিয়াও আমাকে একটাবার বুঝতে দেয়নি।”
মাহি কাঁদতে কাঁদতে বিছানার অপর পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আশফি এবার মাহির শেষ কথাগুলো শুনে একদম থমকে গেল যেন। কী বলল তার মাহি? সেই কবেই আশফিকে সে তার ভাবনা আর মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিয়েছে! তাহলে কী করে থাকবে সে গোটা জীবনটা তাকে নিয়ে? কী নিয়ে থাকবে সে? ওকে ভালো রাখাটা কি তবে অন্যায় হলো তার? না কি ওকে ফিরে পাওয়ার সুযোগটা গ্রহণ করা অন্যায় হলো তার?
.
আবরার আর হীরার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ঐন্দ্রী দিশানের ঘরে এলো। নিজেকে শক্ত রাখার প্রচেষ্টাতে সে ক্রমশই ভেঙে পড়ছে। এভাবে সে নিজেকে কতদিন ঠিক রাখতে পারবে তা সে জানে না।
দিশান হঠাৎ ঐন্দ্রীকে দেখে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। ঐন্দ্রী খেয়াল করল দিশান এখনো আগের পোশাকেই। ঐন্দ্রী তাকে তড়িঘড়ি করে উঠতে দেখে বলল,
– “তুমি বসো। আমি বাথরুম থেকে চেঞ্জ করে আসছি।”
ঐন্দ্রী চারপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। দিশান বলল,
– “চাচি বোধহয় সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেছে। ক্লোজেট খুলে দেখো।”
– “এত কষ্ট করতে গেল কেন?”
দিশান বেরিয়ে যেতে গেল রুম থেকে। ঐন্দ্রী বলল,
– “প্রতিদিন তো আর বাইরে থাকতে পারবে না।”
– “না তোমার আনইজি লাগতে পারে তাই।”
– “সমস্যা নেই।”
বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ঐন্দ্রী দিশানকে বলল,
– “সময় নাও তুমি। এ সময়টা তোমার প্রয়োজন।”
দিশান বুঝতে পারল না ঐন্দ্রীর প্রতি তার রাগ হওয়া উচিত না কি সমব্যথী হওয়া উচিত। কারণ মেয়েটার কণ্ঠে এক রাশ কষ্ট।
শাড়িটা পাল্টে একটা স্যালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে এলো সে। দিশান তখনো চেঞ্জ করেনি। দাঁড়িয়ে যেন ফোনে কিছু করছে। ঐন্দ্রী জিজ্ঞেস করল,
– “তুমি কি রুমে না থাকার পরিকল্পনা করেছো?”
– “না। তবে তোমার প্রয়োজন হলে বলতে পারো।”
– “দিশান!”
এবার দিশান ফিরে তাকাল ঐন্দ্রীর দিকে। দিশানের চোখে তখনো চোখের পানি মুছে ফেলার আভাস। খুব ম্লান সুরে জিজ্ঞেস করল ঐন্দ্রী,
– “কীভাবে পারছো? না কি অনুগ্রহ দেওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়েছো?”
– “আমি কখনোই তুমি নই ঐন্দ্রী।”
– “এমনটা হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয় আমার জন্য? আমার সাথে যা হয়েছে তা কি ঠিক?”
– “না।”
– “তবে কেন জিজ্ঞেস করছো না আমি কীভাবে আছি এখনো এই পরিস্থিতিতে? বারবার আশফি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো একটা কঠিন যন্ত্রণা দিয়েছে। আর যখন শেষে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম তখন সে আমাকে ব্যবহার করেছে মাহিকে আঘাত দেওয়ার জন্য। যখন মাহি ফিরে এলো তখন সেই আবারও আমাকেই ওই কঠিন যন্ত্রণা পেতে হলো। আমিও তো ভালোই বেসেছিলাম। কতবার অপমান হওয়া যায়? কতবার ছোট হওয়া যায় নিজের মানুষগুলোর কাছে? যে বাবা কোনোদিনও মেয়েকে ধমকে কথা বলেনি, আমার সেই বাবা এই অসুস্থ মেয়ের গালেই চড় মেরেছিল যেদিন তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হই। আমি কি খুবই সস্তা দিশান? আমি কি আশফির পাশে খুবই বেমানান ছিলাম?”
– “এটা ঠিক, মাহি আমার ভাইয়ের জীবনে আসার আগে তুমি এসেছিলে। তবে তার জীবনে নয়। শুধু পরিচয়ে। কিন্তু শুধু একটা মাসের মাঝে আমার ভাই নিজের অজান্তেই মাহিকে তার জীবন আর তার ভাবনার মাঝে স্থান দিয়ে ফেলেছিল। মাহিও ঠিক একইভাবে ভাইকে অনুভব করেছে। কিন্তু কষ্টের বিষয় এই যে, এই অনুভূতি প্রকাশ করতে তারা খুব সময় নিয়ে নিয়েছে। এই সময়টা না নিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আমাদের। তুমি তখন মাহিকে কী বলছিলে? একটা মিডল ক্লাস সস্তা মেন্টালিটির মেয়ে হয়ে সে খুব দারুণভাবে ক্লাস পরিবর্তন করে ফেলেছে। তার যোগ্যতা নিয়েও তুমি প্রশ্ন তুলেছিলে। সবাইকে ফাঁদে ফেলে সে আশফি মাহবুবের ঘাড়ে এসে বসেছে। তুমি একটু ভেবে দেখো তো, তুমি হাই ক্লাসে বিলং করে ভাইয়ের সাথে আগে পরিচিত হয়েও কখনো ভাইয়ের জীবনে আসতে পারোনি। কিন্তু মাহির বেলাতে কী হয়েছে বলো তো? আশফি মাহবুব নিজে ফেঁসেছে। আর এই যে মাহির সঙ্গে আজ আমার ভাইটার বিয়ে হলো কী করে জানো? ভাইয়া নিজে শিকারির জালে ধরা দিয়ে শিকার হয়ে। শিকারি, জাল এগুলোই তো এখন তোমার মাথায় ঘুরছে তাই না? এগুলো তোমার না জানলেও চলবে। ঐন্দ্রী, বিয়ে আমার তোমার বা ভাইয়া আর মাহির হাতেও নয়। এই যে আমার আর দিয়ার সম্পর্ক এত স্বচ্ছ এত নির্ভেজাল ছিল। তাও দেখো আমার ভাগ্যে সেই মেয়েটা নেই৷ স্বপ্নেও ভাবিনি আজ তার জায়গাতে তোমাকে দেখব। এই বিয়েতে একমাত্র ওই উপরওয়ালা ছাড়া কারো ক্ষমতা নেই।”
– “খুব দারুণ কথা বলেছো দিশান। মেনে নিলাম আমার মাঝে আশফি যা পায়নি তা মাহির মাঝে পেয়েছে। কিন্তু সেই আমাকেই কেন তার ব্যবহারের হাতিয়ার করতে হলো? যেদিন আমি ওই ভিডিওতে মাহি আর আশফিকে দেখি সেদিন আমি দেখেছিলাম, আশফি কোনো কামনার দৃষ্টিতে নয় এক অনাবিল প্রশান্তি নিয়ে খুব আদরে মাহিকে জড়িয়ে রেখেছিল তার বুকের মধ্যে। মাহির প্রতি তার ফোর্সগুলো ছিল ভালোবাসা। কোনো খারাপ মতলব থেকে ছিল না ওই ফোর্স। আমাকে ঠঁকানো হয়েছে দিশান, আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তার কী বিচার করবে? কোনো বিচার করতে পারবে?”
– “বিচার তো তুমি নিজেই করে নিয়েছো।”
– “হ্যাঁ, আমি উপলব্ধি করাতে চাই তাকে। ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। সে চোখের সামনে দেখবে নিজের ভাইয়ের কষ্টটা। আমার জীবন নিয়ে আমি ভাবনা ছেড়েই দিয়েছি দিশান। আমি একটা সুন্দর জীবন পাবো তা আমি ভাবি না।”
– “প্রচন্ড পাগল তুমি। এভাবে আমার দ্বারা তুমি আমার ভাইকে আঘাত করতে পারবে? কী মনে হয় আমি তা হতে দেবো? আরে তুমি নিজেই তো এক সময় হাঁপিয়ে উঠবে। এমন বাচ্চামিতে তোমাকে যায় না ঐন্দ্রী।”
– “আমি ঐন্দ্রী এখানে দাঁড়িয়েই বলছি। আশফি মাহবুব যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমাকে ব্যবহার করেছে। সেই ভালোবাসা পেয়েও সে ভালো থাকতে পারবে না। চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ছোট ভাইয়ের নাটকীয় হাসি খুশিভাব দেখে সে ভেতরে ভেতরে এক অশান্তির আগুনে পুড়বে। তখন তার ওই ভালোবাসা এক সময় বিষাক্ত বিষ লাগবে।”
– “একটা কথা আমি তোমাকে ক্লিয়ার করে বলি। আমার ভাই তোমাকে ব্যবহার করেনি। আজ আমি তোমাকে এই বিয়েটা না করলে বিয়েটা ও নিজেই করতো তোমাকে। কিন্তু কেন করতে পারেনি জানো? এখানে আরও একজন স্বার্থত্যাগী আছে। আর সে আমার দিয়া। শুধুমাত্র আমার ভাইয়ের জীবনে মাহিকে রাখার জন্য সে আমাকে ত্যাগ করেছে। সে রাজি হয়নি বলেই আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি আমার ভাই৷ আর তাছাড়া আমি থাকতেও কখনো আমার ভাইকে কষ্টে জীবন পার করতে দেবো না। যে ভাই হাজার মেয়ের মাঝে শুধু মাহিকেই নিজের খুব আপন ভাবতে পেরেছে, সে ভাইয়ের জীবন থেকে আমি কখনোই ওই আপন মানুষকে যেতে দেবো না। আর তার জন্যই তোমাকে এই বিয়েটা করা। এখন সেই তুমি যদি এই পরিকল্পনাতে আমার জীবনে আসো যে আমার ভাইকে তুমি দূর থেকে আঘাত করবে তাহলে শোনো, তুমি ঐন্দ্রী সেই ক্ষমতা রাখো না। আমার বাবা এখনো জীবিত। আমরা না মানলেও আমরা জানি তিনি আমাদের পাগলের মতো ভালোবাসেন। পনেরো দিনের মধ্যে এই দেশ ছাড়ব তোমাকে নিয়ে আমি। সম্পূর্ণ আমার ভাইয়ের চোখের আড়ালে থাকবে। কোনো ক্ষমতা আছে আমার ভাইকে কষ্ট দেওয়ার?
শেষ বাক্যটা দিশান বেশ উঁচু আওয়াজে বলল ঐন্দ্রীকে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল ঐন্দ্রী। দিশান এবার স্বাভাবিক সুরে বলল,
– “আমি জানি ঐন্দ্রী। আমি অনুভব করছি। ভালোবাসা না পাওয়ার ব্যথা৷ কিন্তু আমি বলছি, এখানে আমার ভাইটা নির্দোষ। ও চায়নি তোমাকে কষ্ট দিতে। যে অপমান করে মাহিকে তুমি সকলের সামনে নোংরা মেয়ে বানিয়েছিলে, মাহি শুধু নিজের সম্মানটুকু ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সেও নির্দোষ ঐন্দ্রী। ওদের মাঝের সম্পর্কটা এবার স্বাভাবিক হতে দাও প্লিজ।”
ঐন্দ্রী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কান্নার মাঝেই বলল,
– “আমি কী করে মানব দিশান? ভালোবেসেছি তো ওকে। তিনটা বছর ধরে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। নিজে একবার ভাবো না! তুমি কি পারবে আমাকে দিয়ার মতো ভালোবাসতে? তাহলে আমি কী করে পারব?”
দিশান আর একটি কথাও বলতে পারল না। চেপে রাখা কান্নাটা এবার বুকটা ফেঁটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটা কথাও না বলে সে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। কাঁদতে কাঁদতে ঐন্দ্রী বিছানার এক পাশে বসে পড়ল।
.
আশফি রুম থেকে বেরিয়ে এসে বহু আগেই দাঁড়িয়ে আছে বাগানের পাশটাতে। মাহির কান্নাটা যেন ওর বুকের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করে করে রক্ত ঝরিয়ে ফেলছে। এভাবে সে মাহিকে দেখতে পারছে না। এক নিদারুণ কষ্টের সেই কান্না তার। যা সে সহ্য করতে পারছে না। সারাক্ষণ যে জেঁকে বসে থাকে মনের মধ্যে, তবুও তাকে সে কোনোদিনও পাবে না। নিজের জীবনের সঙ্গে যাকে বেঁধে ফেলল, তবুও তাকে ধরে রাখতে পারবে না। এই ভাবনাগুলো পাগল করে দিচ্ছে আশফিকে। তাকে দূরে সরে থাকতে হচ্ছে, তাকে পড়ে থাকতে হচ্ছে তার চোখের আড়ালে। কীভাবে থাকবে সে এই অবস্থাতে?
হঠাৎ দিশানকে ছুটে গাড়িতে উঠে বসতে দেখল আশফি। গাড়ি লক করে দিশান ভেতরে বসে চিৎকার করে কাঁদছে সে। এই জায়গার থেকে আর ভালো কোনো জায়গা নেই তার কান্না করার জন্য। কেউ শুনতে পাবে না, আর কেউ দেখতেও পাবে না। মুখটা দু’হাতের মধ্যে চেপে ধরে চিৎকার করে সে কাঁদতেই আছে। এক সময় সিটে হেলান দিয়ে বসতেই সে কাচের অপরপাশের মানুষটাকে দেখতে পেলো। এক মুহূর্ত পর দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো সে আশফির সামনে। গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ভাই। কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে নীরবে তাকিয়ে থেকে এবার ঝাপিয়ে পড়ল তার বুকে। আশফি তার ছোট ভাইটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখল শুধু। দিশান কোনো কথা বলতে পারছে না। শুধু কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। প্রচন্ড কান্না যা কারো থামানোর সাধ্যি নেই। আশফি শুধু তাকে চেপে ধরে নীরবে চোখের পানি ফেলে গেল। ভাইয়ের এই যন্ত্রণার কাতরানি সে আগে কখনো দেখেনি। এ যে সহ্য করা চেয়ে আর তার মৃত্যুও শ্রেয় ছিল।
কান্নার মাঝেই আশফির চোখজোড়া আটকে গেল তার ঘরের ব্যালকনিতে। সেখানে তার ভালোবাসার মানুষটার ভেজা গাল চিকচিক করতে দেখল সে। তাদের দুজনের দিকেই তার দৃষ্টি।
…………………………….
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.
Dishan ar diyar sathe keno korechen? Tader ki dosh?