Sunday, October 5, 2025







তুমি রবে ৩৬

তুমি রবে ৩৬ . . – “ইয়া আল্লাহ আর কত জোরে চিল্লাব রে!” দিয়ার খালি খলসির মতো ঝনঝন আওয়াজের কণ্ঠে মাহি ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠল। বুকের বাঁ পাশটাতে হাত দিয়ে দিয়ার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে কতক্ষণ চেয়ে রইল সে তা অগণন। দিয়া ধপাস করে মাহির সামনে বসে পড়ে অতিরিক্ত উত্তেজনাপূর্ণ ভাব নিয়ে বলল, – “কী হইছে আপা? এমন ক্ষুধার্থ বিড়ালের মতো চোখ করে তাকায় আছোস ক্যান?” মাহি মুখটা বিকৃতি করে খ্যাক মেরে উঠল। – “এভাবে ফাঁটা বাঁশের মতো করে চিল্লিয়ে ডেকেছিস কেন?” – “আরে বাল বাজে কতো দেখছোস? রাত আটটা বাজে। কতক্ষণ ঘুমাবি আর?” ‘রাত আটটা বাজে’ বাক্যটা শুনতেই মাহির বুকের মাঝে যেন ছ্যাত্ করে উঠল। অনেক লম্বা এবং একট ভয়াবহ স্বপ্ন দেখেছে সে এত সময় ধরে। অতিরিক্ত টেনশনে টেনশনে এত বিশ্রী স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয়? এলো মাইন্ড রিফ্রেশ করতে। তার বদলে কী সব তান্ডব চলছে তার ঘুমের মধ্যে। ফ্যাসফ্যাস আওয়াজে মাহি দিয়াকে জানাল, – “আশফি আমাকে প্রপোজ করেছিল। আর আমি ওকে রিফিউজড্ করে ফেলে চলে গিয়েছি।” দিয়া হাতের ফোনটা চাপা বন্ধ করে মাহির মুখের সামনে এগিয়ে এসে বলল, – “কী কস? বুঝি না তো!” দিয়ার মুখের দিকে মাহি তাকাতেই দরজা ঠেলে হিমু ভেতরে ঢুকে সেও ধপাস করে বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। মাহি পা’দুটো গুটিয়ে বসল। – “তুমি মনু বরকে ছেড়ে এখানে ক্যান?” – “আরে কিসের বর? ওকে রেখে আসছি ধ্রুবর কাছে। ও আর ধ্রুব এক সঙ্গে থাকবে। আর আমি এখানে।” – “ভালা করছোস। তিনজন এক সাথে না থাকলে জমে নাকি?” মাহি হেলে বসে দিয়ার কোলে পা তুলে দিলো। তারপর বলল, – “তুমি মামা কোন স্যারের ছাত্রী হলে? কথার ধাচ্ তো সেই ক্লাস সেভেন এইটে ফিরে আসছে আবার।” দিয়া পা ঝুলিয়ে বেশ আয়েশ করে হিমুর পেটে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বলল, – “কতকাল পর নিজের ছাঁচে ব্যাক করছি। কী যে ভালো লাগতেছে রে! সত্যিই এর জন্যই তো কই ধ্রুব আমার জিগারের দোস্ত লাগে। এক্কেরে জিগারের।” হিমু দিয়ার মাথার মধ্যে গাট্টা মেরে বলল, – “কম কম ঘেঁষাঘেঁষি করিস ওর সাথে। দিশান চুপচাপ আছে। কখন যেন পুরো নাক ফাটিয়ে দেবে ওর।” মাহিকে হঠাৎ উদাসীনভাবে টেবিল ল্যাম্পের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে হিমু ওকে ঠ্যালা মেরে বলল,
– “কুচা মুরগির মতো ঝিমাচ্ছিস কেন?” মাহি তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বাসার নাম্বার ডায়াল করল। সবার সাথে কথা বলে দাদুর সাথে কথা বলতে চাইল সে। কিন্তু দাদু নাকি ঘুমাচ্ছে৷ তাই শুধু তার শরীরের খোঁজটা নিয়ে ফোন রেখে দিলো। ফোনটা স্ক্রল করতে করতে মাহি দিয়া আর হিমুর কাছে জিজ্ঞেস করল, – “ও কী করছে রে এখন?” দিয়া বলল, – “কী সব রান্নাবান্না করবে নাকি ওরা। তার যোগাড়-গোছাল করতেছে।” – “কই আমি তো দেখলাম দুটো লোকের সাথে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন ডিরেকশন দিচ্ছে তাদের।” এবার মাহি দিয়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলল, – “ওই আমি কি দিশানের খোঁজ শুনছি?” – “উহ্! এত মারোস ক্যান? আমি কি জানি তুই তারে ‘ও’ বলা শুরু করছোস? আমি তো ভাবছি তুই আমার ওর কথা জিগাইছোস। আজব ছেমড়িগুলান!” – “তোরা কি আমার কিছু কথা শুনবি?” হিমু বলল, – “কান তো বন্ধ করে রাখিনি বোন। বলে ফেলো।” – “আমি স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে। প্রথম খুব ভালোই ছিল পরে সাংঘাতিক কিছু ঘটে যায়। ও আমাকে সত্যি কখনো প্রপোজ করলে আমি কোনোদিনও ওকে না বলে ফেলে যেতে পারব না।” হিমু আর দিয়া লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তারা দুজন এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করে উঠল, – “তুই জানলি কী করে!” মাহি হতচকিয়ে গেল ওদের বিস্মিত চেহারা দেখে। – “কী জানলাম আমি?” দিয়া বলল, – “আরে উনি তোকে প্রপোজ করবে তুই সেটা জানলি কী করে?” মাহি ঝারি দিয়ে উঠল। – “কী গাবাচ্ছিস ছাই? বললাম না স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে!” হিমু এবার বলল, – “তাই বল!” – “তাই তো বলি তুই কীভাবে জানবি?” মাহি দিয়ার কাছে এগিয়ে এসে বসে জিজ্ঞেস করল, – “কী জানার কথা বলছিস বল তো তোরা?” হিমু হাসতে হাসতে আবার ঠাস করে শুয়ে পড়ল। মোটামোটি যা জানানোর দিয়া তার সবই জানিয়ে দিলো মাহিকে। মাহি হতবিহ্বল হয়ে কতক্ষণ কিছুই বলতে পারলো না। এরপর খুশিতে চিৎকার করে দুই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল সে। তিনজনে কয়েক মিনিটের মাঝে এ ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করে ছোটোখাটো সেলিব্রেট করে ফেলল। তবে দুঃস্বপ্নের ব্যাপারটা মাহির মাথা থেকে বের হলো না। মাহির থেকে ওরা যখন ওর দুঃস্বপ্নের সবটাই জানলো তখন হিমু মুখ কাচুমাচু মুখ করে বলল, – “ইয়ে মানে দোস্ত আমি না একটা জায়গায় ঘেঁটে দিয়েছি।” মাহি চিন্তিত মুখ করে তাকাল হিমুর দিকে। দিয়া জিজ্ঞেস করল, – “তুই তো মনু ঘাটাঘাটির লোক না। কী করেছিস রে?” – “এখানে আসার আগে আমার কাছে ফোন আসে আঙ্কেল মানে মাহির বাবার থেকে। আমার কাছে জিজ্ঞেস করে সরাসরি, মাহির কারো সাথে বর্তমানে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। ওনার যা গম্ভীর কণ্ঠ! ভয়ে আমি বলেছি কোনো সম্পর্ক নেই কোথাও ওর। এখন তো মনে হচ্ছে আছে বললেই ভালো হতো। কিন্তু সেটা তো মিথ্যা হয়ে যেতো না?” দিয়া বাঁজ পড়ার মতো করে চিল্লিয়ে বলল, – “আমারে তো দিনটা ভর কুদ্দুস কস! এখন তুই হিসুবিবি কী করলি? তুই যে না কইলি এতে তো ওনারা সোমের ব্যাপারে আরও ফাইনালি আগাবে।” – “আরে ঘুড়া আমি তো ভেবেছি যদি ‘হ্যাঁ আছে’ বলি তাহলে উনি ওকে যদি ফোন করে বলে ‘এক্ষণি বাড়ি চলে আয়!’ তখন তো আমাদের এত মজাগুলোই নষ্ট হতো। কিন্তু ভাবিনি আরও সুবিধা করে দিলাম তাদের।” – “আমি তো দেখতেই পাচ্ছি আমার ভাগ্যে কী আছে। শুধু শুধু একটা মানুষের অনুভূতি ব্যায় হচ্ছে আমার জন্য। ওকে বারণ করে দিস। এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।” মাহির কম্পিত কণ্ঠস্বরের এই কথগুলো দিয়া আর হিমুর জন্য প্রচন্ড কষ্টের। হিমু বলল, – “আমি সত্যিই এতটা বুঝে কথা বলিনি রে।” – “আরে তুই কেন চাপ নিচ্ছিস? তুই যা বলেছিস তা তো সত্যিই।” – “দ্যাখ আমি যেটা ভাবছি সেটা হলো সোম ভাইয়ের মা ফাইনাল কথা বলতে আসার আগেই আশফি ভাইয়া যদি তোর বাসায় গিয়ে তোকে বিয়ে করার ব্যাপারটা বলে কিংবা ওনার দাদা আর দাদী নিজেরা গিয়েও প্রস্তাব দেয় তবে আমরা যতটা ঝামেলাপূর্ণ ভাবছি অতটাও ঝামেলাকর না এই ব্যাপারটা।” হিমু বলল, – “তোর ভাবনাগুলো যুক্তিসম্মত। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দ্যাখ তোরা। আমি যদি কাউকে কথা দিয়ে ফেলি যে আমার মেয়েকে আমি তার হাতে তুলে দেবো৷ সেখানে তার চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে যদি আসে পরে, তবে আমি আমার মেয়েকে কি তখন সেই ছেলের হাতে তুলে দিতে পারব তাকে প্রত্যাখ্যান করে? কথার খেলাফ হয়ে যায় না? আর নিজেকে তো তখন বিরাট লোভী বলে মনে হবে। এটা তো নিজেরই ভাবতে কেমন লাগছে৷ সেখানে দাদুর মতো অনেক বেশি আত্মসম্মানবোধ ওয়ালা মানুষ এই কাজ জীবনেও করবে না। আর ভয়টা এখানেই।” দিয়া বলল, – “তাহলে আশফি ভাইয়ার করণীয় হবে কাল রাতে মাহিকে আংটি পরিয়ে দেওয়ার পরই ওনাদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে দেওয়া। আর তারপরই ভাইয়ার দাদা মাহির দাদুর কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। তাহলে তো কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা না রাইট?” – “হ্যাঁ এটা হলে কোনো ঝামেলাই নেই। তুই আর টেনশন নিস না তো৷ কালকের মধ্যেই দেখবি সব সমস্যা শেষ।” দিয়া আর হিমু দুজনের কথোপকথনে মাহি এক পাশ থেকে টেনশনেও পড়ল আর অন্যপাশ থেকে আশার প্রদীপও জ্বলে উঠল তার মনে। . বাইরে আসতেই তিনজনের চক্ষু চড়কগাছে। গান বাজছে- “মনটা করে উরু উরু উরু উরু বুকটা করে দুরু দুরু দুরু দুরু হে মনটা করে উরু উরু বুকটা করে দুরু দুরু পরানের বন্ধু যখন পায় রে মনটা করে উরু উরু বুকটা করে দুরু দুরু পরানের বন্ধু যখন পায় রে আকাশে উড়াল দিয়া যামু রে ওরে লইয়া কলিজায় বাজে বল তাক ধুমা ধুম ধুম রে আজ আমার মনটা যেথায় পেখম তুইলা নাচে রে” গানের তালে অনিক, দিশান, ধ্রুব আর অফিসের আরও কিছু এমপ্লয়ি নাচতে নাচতে অস্থির অবস্থা তাদের। পাশে বসে ঐন্দ্রী, মিলি, রূপা আরও তিনজন মেয়ে এমপ্লয়ি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একজন আর একজনের গায়ে। মেজাজ পুরো বিগ্রে গেল দিয়ার। – “মানে এমন একটা পাগল ছাগলই কেন জুটল আমার কপালে?” মাহি হাসতে হাসতে কোনো কথা বলতে পারল না। হিমু বলল, – “কপাল লাগে রে এমন একটা পাওয়ার জন্য। তুই যে কেন রাগিস?” তিনজন এগিয়ে এসে বসলো ঐন্দ্রীদের পাশে। আশফি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। রাতের আড্ডার মাঝে রাত একটা বেজে গেল। আশফি এর মাঝে বিশেষভাবে কোনো কথা বলতে আসেনি মাহির সাথে। তবে চোখে চোখ পড়লে এক গভীর দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে তাদের মাঝে। দিয়া, হিমু, মাহি আর ঐন্দ্রী যখন এক জায়গাতে বসলো তখন গল্পে গল্পে ঐন্দ্রীর চেপে রাখা কষ্টটা ওদের সঙ্গে শেয়ার করে ফেলল। নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী লাগল তখন মাহির। আজকে তার জন্যই হয়তো ঐন্দ্রী আশফিকে হারালো। মাহি আর নিতে পারছে না তার চারপাশের এত সব সমস্যাগুলো। হতাশ হয়ে যখন সে রুমে চলে এলো দিয়া, হিমু, দিশান, অনিক চারজনই তাকে বুঝিয়ে শান্ত করল। আশফি কখনোই ঐন্দ্রীকে নয় বা অন্য কোনো মেয়েকেও নয়, মাহিকেই সে প্রথম ভালোবেসেছে তার এত বছরের জীবনে। এটা জানতেই মাহি আবার তার মনের বল ফিরে পেলো। পরেরদিন ভোর হতেই সবাই বেরিয়ে পড়ল নীলাচলের উদ্দেশে। খুব সুন্দরভাবে প্রত্যেকে আনন্দ করে সন্ধ্যার সময় রিসোর্টে ব্যাক করল। তবে আজ সারাদিনেও আশফি আর মাহি মিনিট দুইয়ের জন্য এক সঙ্গে কোথাও দাঁড়াওনি। কথাও তেমন হয়নি তাদের মধ্যে। রিসোর্টে যখন ব্যাক করল তখন মাহির চোখজোড়া খুঁজে বেড়াল আশফিকে। কারো কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারল না লজ্জাতে। আশফি রিসোর্টে আসেনি ওদের সঙ্গে তা পরে জানতে পারল মাহি৷ দিয়া আর দিশান একান্ত কিছু মুহূর্তে কাটাতে হাঁটতে হাঁটতে রিসোর্টের ভেতর অন্য কোথাও চলে গেল। আর অনিক, হিমুও আস মোমেন্টে ব্যস্ত। মাহি রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে আসলো একটু হাঁটার জন্য। কিছুটা সামনে আসতেই মিমির নাম্বার থেকে কল এলো। – “কেমন আছিস আপু?” – “এইতো ভালোই। কী করছিস?” – “শোন কিছু কথা জানানোর জন্য তোকে ফোন দিলাম। সামিরা আর ওর বয়ফ্রেন্ড অয়ন বিয়ে করে নিয়েছে। সোম ভাইয়ের মা আর ওনার চাচা আজ সকালে এসেছিল আমাদের বাসায়।” – “কেন?” – “উনি মেয়েকে মেনে নেবেন। একটা ছোটখাটো করে অনুষ্ঠানও করবেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে। কথা বলার শেষে তোর আর সোম ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারেও কথা হয়েছে।” এ কথা শোনা মাত্রই মাহির বুকের ভেতর কেমন বারি দিয়ে উঠল। – “কাকু খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে যেহেতু তোর কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তাই সোম ভাইয়ের ব্যাপারে আর না বলারও সুযোগ নেই। দাদু খুব জলদিই তোদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করে দেবেন। হতে পারে সেটা আগামী মাসও। কথাবার্তা সব পাকা। আন্টি তো মানে সোম ভাইয়ার মা বলছিলেন ‘মাহি থাকলে তো এখনি আংটি পরিয়ে রেখে যেতাম।’ দাদু বলেছে তুই ফিরলে পরিয়ে দিতে। আন্টি সোম ভাইকে কল করে এ ব্যাপারে জানিয়েছে আমাদের সামনে ফোন করেই। প্রচন্ড খুশি ওনারা। সোম ভাইও খুশি হয়ে বলেছে সে আজই তোর সঙ্গে দেখা করবে সে। ও চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবন রওনা হয়েছে। হয়তো এতক্ষণে পৌঁছেও গেছে। সম্ভবত ওখানেই সে তোকে রিং পরাতে আসছে। তোদের রিসোর্টের ঠিকানাও নিয়ে নিয়েছে।” মাহির এই মুহূর্তে প্রচন্ড কান্না পেয়েও কান্না যেন গলা অবধি এসে আটকে গেল। দুঃখ নয়, সীমাহীন ক্ষোভ আর রাগ হতে থাকল নিজের পরিবারের প্রতি। আজ মাহি উপলব্ধি করতে পারছে নিজের ভাইয়ের কষ্টটা। কেন সেদিন তার ভাই সবাইকে ছেড়ে তার ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে চলে গিয়েছিল তা সে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্ত আফসোস সে কোনোদিনও পারবে না। আবার বলতেও পারবে না ‘আমি অন্য কাউকে চাই।’ ওই যে হিমুর কথাগুলো! নিজেদের আত্মসম্মানের কাছে ঘরের ছেলে মেয়ের সুখ, তাদের ইচ্ছা বলি দিয়ে দেবে ওরা। তাও আত্মসম্মান খোয়ানো যাবে না। – “মাহি?” চমকে উঠে পেছনে তাকাল মাহি। সামনের মানুষটাকে দেখে এখন তার না হচ্ছে দুঃখ আর না হচ্ছে রাগ। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল তার হবুস্বামীকে। হ্যাঁ হবুস্বামীই তো। এই মানুষটাই তো কিছুদিন পর তার স্বামী হবে। সোম চলে এসেছে তার অধিকারের শিকল পরাতে। যেখানে মাহি কেবল এক বাধ্য নাতি আর বাধ্য মেয়ে। সোম চোখে মুখে তার খুশির আভাস ফুটিয়ে এগিয়ে এলো মাহির কাছে। মাহিকে এমন ভাবলেশহীন দেখে সোম জিজ্ঞেস করল, – “বিশ্বাস করতে পারছিস না তাই না যে আমি এসেছি?” – “হ্যাঁ, সত্যিই এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।” মাহির অনুভূতিহীনতা সোমের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। সে তার খুশির মুহূর্তে ব্যস্ত। – “হয়তো পরশুই তোকে ঢাকা পেতাম। কিন্তু ইচ্ছা করছিল এই সুন্দর জায়গাতেই তোকে এই সুন্দর মুহূর্তটার অনুভব দিই।” – “সোম ভাই আমি তো এমন দিন, এমন মুহূর্ত চাইনি। আমার চাওয়ার কি কোনো মূল্য নেই?” – “মন খারাপ করছিস কেন? তুই ফিরলে আমরা না হয় একটা প্রোগ্রাম করে নেবো আমাদের আংটি বদলের উদ্দেশে।” সোম বিনা অনুমতিতে মাহির হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নিলো। সোম আঁৎকে উঠে বলল, – “এত গরম কেন তোর শরীর? জ্বর লাগিয়েছিস না কি?” মাহি নিশ্চুপ থাকল। স্থির দৃষ্টি আটকে রইল সোমের দিকে। – “ভেবেছিলাম কোথাও ঘুরতে যাব তোকে নিয়ে। কিন্তু এই অবস্থায় তোর তো বাইরে থাকাও উচিত না। একদিনেই জ্বর বাঁধিয়ে নিয়েছিস।” সোম হাতটা তুলে তার অনামিকাতে নিজের অধিকারের শিকল পরিয়ে দিতেই টুপ করে বড় এক ফোটা জল গড়িয়ে পরল নিজের হাতের ওপর। সোম সেই পানিটুকু মুছে দিয়ে মাহির হাতটা নিজের বুকের ওপর নিয়ে বলল, – “অনেক প্রতীক্ষার পর।” হাতটার ওপর চুমু খাওয়ার আগ মুহূর্তে মাহি ছুটে চলে গেল ভেতরে। সোম ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। . . – “ম্যাম আসব?” দরজাটা খোলা ছিল। একজন মহিলা এসে মাহির দরজাতে নক করছে। চোখদুটো মুছে মাহি এগিয়ে এলো তার কাছে। র‍্যাপিং পেপাড়ে মোড়ানো বড় একটা গিফ্ট বক্স মাহির হাতে তুলে দিলো সে। সাথে একটা চিরকুটও দিলো তাকে। মহিলাটি চলে যেতেই ঘরে ঢুকল দিয়া আর হিমু। বক্সটা দেখে দুজনের আর বুঝতে বাকি নেই এ ব্যাপারে। একদম অনাগ্রহের সাথে মাহিকে প্রস্তুত হতে হলো দিয়া আর হিমুর জোরাজোরিতে। বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মাহি তাদের বলল, – “অফুরন্ত ঘৃণা নিয়ে ফিরতে হবে রে আমায়।” মাহির কান্নারত আওয়াজ শুনে ওরা দুজনেই চমকে গেল। তখন মাহি তাদের দুজনকে বলেছিল সে যেতে চায় না৷ কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় নষ্ট হবে দেখে তারা দুজন কোনো কথায় শুনতে চায়নি। চিরকুটে লেখা জায়গাটায় যেতে থাকল মাহি। . হারিকেন ল্যাম্পগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে আশফি গাছে ঝুলিয়ে রাখা ল্যাম্পগুলোও দেখে নিলো। আকাশটাতে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। আজ এই পূর্ণ চাঁদনিরাতেই তাদের জীবনের গল্পটা আরম্ভ হবে। শুকনো ঘাসের ওপর কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে চাঁদটার দিক থেকে নজর ফিরিয়ে আশফি ঘুরে তাকাল পিছে। শুভ্র বর্ণের ঝলমলে শাড়িতে তার চারপাশ ঝিলিক দিচ্ছে, কানের পিঠে গুঁজে রাখা চুলগুলো যেন অবাধ্য হয়ে তার চেহারাতে ছড়িয়ে পড়ছে বারবার। মুগ্ধতা আর মোহজাল গ্রাস করে নিতে চাইছে আশফিকে। আজ দুজনেই শুভ্র বর্ণের নির্মল আর নিষ্পাপ চাদরে মোড়ানো। সাদ স্যুট প্যান্ট আশফির পরনে। মাহি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে এই মোহাবিষ্ট মানুষটাকে আজ শেষবারের মতো পলকহীনভাবে দেখে নিচ্ছে। আশফি হাতটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। ঘোলা আর ঝাপসা দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। আশফি নিশ্চিত, মাহি আজ তাকে না জড়িয়ে ধরে থাকতেই পারবে না। মেয়েটা যে প্রচন্ড আবেগি। আশফি এগিয়ে এসে মাহির হাতটা ধরে তাকে চেয়ারে বসালো। চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো মাহি। আকাশের পূর্ণ চাঁদটার দিকে সে তাকাতেই আশফি তাকে বলল, – “প্রচন্ড বেহায়া সে, একদম আমার মতো। পণ করেছে আজ আমাদের একান্ত মুহূর্তগুলো সে দেখবেই। তাই তো আজ পূর্ণরূপ তার।” মাহি উঠে কিছুটা সামনে এগিয়ে দাঁড়াল। গাছের সজ্জাকরণও বেশ লাগছে। এই হলুদ আভা, রুপালী চাঁদ কিছুই যে আজ তার জন্য নয়। হঠাৎ এক জোড়া হাত মাহির দুই বাহু স্পর্শ করল। নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আশফি তাকে বলল, – “তুমি প্রস্তুত?” মৃদুমন্দ বাতাসে মুখরিত চারপাশ। এত চমৎকার মুহূর্তগুলো আজ তার নয় এটা ভাবতেই বুক চিরে কষ্টগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন৷ এই মুহূর্তে তার চিৎকার করে কাঁদতে হবে। নয়তো সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। আশফি সেই অবাধ্য চুলগুলো মাহির চেহারা থেকে সরিয়ে দিয়ে একটু হাসলো। – “আমি সত্যিই বেহায়া পুরুষ হয়েছি সেদিন থেকেই। যেদিন ওই তপ্ত সিগারেটটা ধরে আমার ঘরের দ্বারে এসেছিলে তুমি। নির্লজ্জও হয়েছি সেদিনই যেদিন এই বেহায়া আর নির্লজ্জতার ক্লাস নিতে গিয়ে এত কাছ থেকে এই চোখজোড়া আর এই অধরজোড়া দেখেছিলাম।” এত সামর্থ্য নেই এই মানুষটার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলতে। নীরব মাহি দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশফির বুকের খুব কাছে সে। হঠাৎ হৃদয়কম্পন হওয়া তিনটি শব্দ ভেসে এলো কানে ভেসে এলো তার। – “আই লাভ ইয়্যু মাহি।” উফ্! কী ঝংকারময় এই আওয়াজ! একটি বাক্য এত বেশি কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে মাহির বুকে এখন সে নড়চড় করার সামর্থ্যটুকুও হারাল। আশফির হাস্যজ্জ্বল ছোট ছোট চোখদুটোর পানে তাকাতেই মাহি ছিটকে দূরে সরে এলো। এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে আজ তাকেও যে অবাধ্য হতে হবে তার ভাইয়ের মতো। আশফি যেন আরও হেসে উঠল। সে এগিয়ে এসে মাহিকে তার বুকের একদম কাছে এনে মাহির কপোল স্পর্শ করে বলল, – “এত বেশি চমকে উঠলে তো বিপদ। পরবর্তী চমকে তো হার্ট আপনার ফেলও করতে পারে।” আশফি টেবিল থেকে একটি নীল রঙের ছোট বক্স হাতে নিলো। বক্সটার ভেতর থেকে ঝকঝকে নীল হীরা পাথরের আংটি বের করল সে। আংটিটার মধ্যমণি ওই নীল পাথরটা। আর তার চারপাশে ঘিরে আছে ছোট ছোট উজ্জ্বলপূর্ণ সাদা হীরার পাথর। – “এত অমূল্য উপহারের যোগ্য আমি নই।” আশফি তার মায়াপূর্ণ চোখদুটোর দৃষ্টি উঁচু করল। তার হাতটা ধরে খুব গাঢ় সুরে বলল, – “এর থেকেও বেশি অমূল্য এই মানুষটা। পূর্ণ জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই তোমাকে মাহি।” চোখ ছাপিয়ে নোনাপানি নিচে গড়িয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে আশফি তার হাতের ওপর পানিটুকু নিয়ে নিলো। বলল, – “যেখানে এই মানুষটা আমার জন্য অমূল্য। সেখানে তার চোখের নোনাপানিটুকু আমি কী করে নিচে পড়তে দিই? মাহির হাতটা তুলে তার হাতে তুলে নিতেই মাহি দ্রুত তা সরিয়ে নিলো। – “আশফি!” আশফির ওষ্ঠে এক তৃপ্তির হাসি ভেসে উঠল এ ডাক শুনে। মাহির বাহুদ্বয় ধরে হাসিমাখা মুখে সে বলল, – “এই প্রথম আমার নাম শুনছি তোমার মুখে। এটা সত্যিই কতটা আনন্দের তা তোমাকে বোঝাতে পারব না মাহি!” সত্যিই সমুদ্রের চেয়েও অধিক প্রশস্ত মানুষটার মন। কত সামান্যতেও সে কতটা খুশি হতে পারে। মহামূল্যবান সম্পদ মাহি আজ পেতে গিয়েও হারিয়ে ফেলছে। এর চেয়ে নিঃস্ব আর কে হতে পারে? আংটিটা এবার আশফি পরিয়ে দেওয়ার জন্য মাহির হাতটা ধরল। মাহি কোনো বাঁধা দিলো না। সে নিজেই দেখুক। যা সে মুখে বলার শক্তি পাচ্ছে না তা আশফি নিজেই দেখে নিক। কয়েক মুহূর্তের জন্য আশফি তার অনামিকা আঙুলটা ধরে নিস্তব্ধ চাহনি মেলে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মাহির মুখটার দিকে যখন সে তাকাল মাহি তখন শূন্য দৃষ্টি মেলে নিচে তাকিয়ে। আশফি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না যেন। তাকে নীরবে মাহির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহি নির্বিকার হয়ে তাকে বলল, – “আজ থেকে আমি সোম রায়হানের হবুস্ত্রী।” মুহূর্তেই আশফি হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিস্মিতক চাহনিতে তাকাল। কত সময় দুজনে নিস্তব্ধ হয়েছিল তা অজানা। আশফি কয়েক পা পিছিয়ে এসে চেয়ারটা ধরে দাঁড়াল। মাহি বলতে শুরু করল, – “আজ সন্ধ্যায় আমরা এঙ্গেজড হয়েছি। আগামী মাসের মধ্যেই আমি তার বউ হয়ে যাব।” আশফি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। প্রচন্ড গরম লাগছে তার। গা থেকে স্যুটটা খুলে চেয়ারের ওপর রেখে এবার সে মাহির দিকে তাকাল। গম্ভীরতার মাঝে দৃঢ় কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, – “কেন পরলে তুমি?” মাহি নিশ্চুপ। এর উত্তর কী দেবে সে তা খুঁজে পেলো না। আশফি আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, – “তাকে তোমার পছন্দ ছিল?” মাহি এবার চকিতে উত্তর দিলো, – “না।” – “তাহলে কেন পরলে?” – “এর উত্তর আমি গুছিয়ে দিতে পারব না। তবে এই আংটি খোলার সাহস আর উপায় আমার নেই।” এ কথা শুনে আশফি আরও একবার ধাক্কা পেলো যেন। – “তার মানে তুমি এখনো সেই দেড় বছর পূর্বের খাঁচায় বন্দি থাকা পাখির মতো? যার সিদ্ধান্ত জানানোর মতো কোনো অধিকার নেই? না কি ক্ষমতা নেই?” – “আমার দাদু তাঁর কথার খেলাফ করতে পারবেন না কখনো।” আশফি চেঁচিয়ে বলে উঠল, – “আরে তোমার দাদু তাঁর কথার খেলাফ করবেন কেন? তুমি কি তাকে কখনো বলেছো তোমার কোনো সিদ্ধান্ত আছে? কিছু বলার আছে তোমার?” – “আমি বলেছিলাম আশফি। ভাবিনি এভাবে আর এত দ্রুত আমাকে ছাড়া…” – “অসভ্য, নির্বোধ আর মূর্খ সব!” প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় আশফি মাহির পরিবারকে কথাগুলো বলল। মাহি নারাজভাবে বলল, – “এসব কী বলছেন?” চেঁচিয়ে বলল আশফি, – “কেন বলব না? কী অধিকার আছে তাদের তোমার লাইফের এমন একটা ডিসিশন নেওয়ার?” – “তারা আমাকে জন্ম দিয়েছে, আমাকে বড় করে তুলেছে।” – “একজন বাবা-মা হিসেবে এগুলো তাদের দায়িত্ব আর কর্তব্য। তাই বলে তোমার সারাজীবনের সিদ্ধান্ত তারা বোকামি করে নিতে পারে না।” মাহি তার কথার কোনো জবাব দিতে পারলো না। তাকে চুপ থাকতে দেখে আশফির রাগটা যেন ক্রমশ বাড়তেই থাকল। – “টমফুল ব্যক্তির মতো এখন তুমিও তাদের ঢোলের তালে নাচবে না?” – “আমার কী করার আছে বলুন?” – “তুমি পারবে না ওই আংটির সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, তাই তো?” মাহি এ প্রশ্নের উত্তরে কেবল নীরবতা প্রদান করল। মুখে বলে কিছু বোঝাতে হলো না তাকে। আশফিও আর একটা কথা বাড়ালো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সে দৃষ্টি নিচে ঝুঁকিয়ে। ধীর পায়ে হেঁটে মাহি আশফিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল। কোনো বাঁধা প্রদান করল না আশফি। মাহি হঠাৎ থেমে পিছু ফিরে তাকিয়ে আশফিকে বলল, – “যে যোগ্য আপনার তাকে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছেন? বছরের পর বছর তাকে অপেক্ষা করিয়ে কেন তাকে প্রত্যাখ্যানের নির্মম যন্ত্রণা দিচ্ছেন? এই অধিকারও আপনার নেই। ফিরিয়ে নিন ঐন্দ্রীকে।” কথাগুলো যেন আগুনে ঘী ঢেলে দেওয়ার মতো ছিল। হয়তো মাহির বদলে অন্য কেউ হলে নিশ্চিত তার গালে আশফি নিজের হাতের পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট ছাপ ফুটিয়ে দিতো। গম্ভীর কণ্ঠের উচ্চ আওয়াজে সে বলল, – “চলে যাও।” মাহি দ্রুত পায়ে হেঁটে ফিরে এলো রিসোর্টে। আজ তার চোখের কোণে এক ফোঁটাও জল আসছে না। এই যে এত বড় একটা আঘাত সামলিয়ে চলছে সে, তার চোখজোড়া তো বিরতিহীনভাবে ভেজা হয়ে থাকার কথা। কিন্তু কেন সে কাঁদতে পারছে না? চিৎকার করে কান্না করাটা যে তার অতি প্রয়োজন। রুমে ঢুকে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে হিমু তার হাত টেনে ধরল। মুহূর্তের জন্যও তার হঠাৎ মনে হলো আশফি যেন ছেড়ে দিতে চাইছে না তাকে। তাই তো ছুটে এসে তার হাতটা টেনে ধরেছে। ক্ষীণ কণ্ঠে সে ‘আশফি’ বলে পেছনে ঘুরতেই হিমুকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। – “আহা! সব জায়গাতেই এখন শুধু আশফি।” হিমু তার হাতটার দিকে নজর দিলো। আংটিটা দেখে প্রসন্নচিত্তে বলল, – “দ্বিতীয় সারপ্রাইজটা পেতে এখনো বাকি। চল।” – “আমি আর কোথাও যেতে পারব না রে। আমি একটু বিশ্রাম করব।” – “কেন রে? প্রথম চুমুতেই কাহিল! পরে কী করবি রে?” মাহিকে টেনে নিয়ে এলো হিমু অন্য একটা ঘরে। সেখানে দিশান হাতে গিটার নিয়ে বসে আছে। রুমটাতে সবাই এক সঙ্গে বসে গান, আড্ডা, নাচ সব করছে। মাহিকে দেখে দিশান, দিয়া আর অনিক প্রশস্ত একটা হাসি দিলো। আধঘন্টা পার হওয়ার পর আশফি এসে ঢুকল রুমে। দিশান তাকে চেপে ধরে বলল, – “ভাই আমার আর সহ্য হচ্ছে না। জলদি অ্যানাউন্সমেন্ট করো না!” আশফি ম্লান হেসে বলল, – “হ্যাঁ করব।” দিশান তখনি চেঁচিয়ে সবাইকে বলল, – “এতক্ষণে সেই সারপ্রাইজ পেতে চলেছি আমরা। আমাদের এই আসরের ক্রাউন উপস্থিত।” মাহির স্থির দৃষ্টি আশফির ওপরেই। আশফি তা বুঝতে পেরেও একবার তাকাল না তার দিকে। মাহির পাশে ঐন্দ্রী দাঁড়িয়ে। সে লক্ষ্য করল মাহির দৃষ্টি। আশফি পকেট থেকে কিছু একটা বের করে হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়াল মাহি আর ঐন্দ্রীর সামনে। আশফি মাহির চাহনি উপেক্ষা করে ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে সে হাতটা বাড়াল ঐন্দ্রীর দিকে। ঐন্দ্রী তখনো কিছুই বুঝতে পারল না। আশফির হাতে হাতটা তুলে দিয়ে তার সঙ্গে এসে দাঁড়াল সবার মাঝে। ঐন্দ্রীর দিকে তাকিয়ে আশফি সেই আংটিটা বের করে উচ্চস্বরে বলল, – “আমি চাই আমাদের সেই মুহূর্তটা যে মুহূর্তের জন্য তুমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে গেছো আমার জন্য। বিয়ে করবে আমায়?” ঐন্দ্রী মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলল একদম। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিলে আশফি তার অনামিকাতে আংটিটা পরিয়ে দিলো। চারপাশে করতালিতে মুখোরিত। শুধু স্তব্ধ কয়েকটা মুখ। দিশান বিস্মিত চাহনিতে তাকাল মাহির দিকে। মাহি নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হিমু তখন তাকাল মাহির অনামিকার পানে। দিয়ার মুখেও কথা নেই। এর মাঝে সবাই বলে উঠল ‘প্লিজ স্যার কিস হার।’ কারণ সবাই জানে তাদের স্যার একজন বাঙালি হলেও তার মাঝে বৃটিশদের কিছু কালচার আছে। আশফি তার আঙুলের ওপর আলতো করে চুমু খেলো। ঐন্দ্রী আশফির বুকের মাঝে ঝাপিয়ে পড়ল এরপর। কান্না যেন তার থামতেই চাইছে না। অথচ এমনভাবেই তার বুকের মাঝে থাকার কথা ছিল অন্য মানুষটার। আশফি ঐন্দ্রীকে জড়িয়ে রেখে একবার বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল মাহির দিকে৷ যেন সে স্বাভাবিক। কোনো আক্ষেপ, কোনো কষ্ট তার চেহারাতে নেই। আশফি বলল, – “এরপর তো গান হওয়ার কথা ছিল দিশান।” দিশান কিছু মুহূর্ত মাহির দিকে তাকিয়ে থেকে আর কিছু মুহূর্ত তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে গিটারটা নিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে সবাইকে ইশারা করল তার সুরে গান ধরতে। . “কথা হবে দেখা হবে প্রেমে প্রেমে মেলা হবে কাছে আসা আসি আর হবে না… চোখে চোখে কথা হবে ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দেবে ভালোবাসা বাসি আর হবে না… শত রাত জাগা হবে থালে ভাত জমা রবে খাওয়া দাওয়া কিছু মজা হবে না… হুট করে ফিরে এসে লুট করে নিয়ে যাবে এই মন ভেঙে যাবে জানো না… আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না…২ ভুলভাল ভালোবাসি কান্নায় কাছে আসি ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না… কথা বলি একা একা সেধে এসে খেয়ে ছেঁকা কেন গাল দাও আবার বুঝি না… খুব কালো কোন কোনে গান শোনাবো গোপনে দেখো যেন আর কেও শোনে না… গান গেয়ে চলে যাব বদনাম হয়ে যাব সুনাম তোমার হবে হোক না… আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না…২ যদি তুমি ভালোবাসো ভালো করে ভেবে এসো খেলে ধরা কোনো খানে রবে না… আমি ছুঁয়ে দিলে পরে অকালেই যাবে ঝরে গলে যাবে যে বরফ গলে না… আমি গলা বেঁচে খাবো কানের আসে পাশে রব ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথা হবে না… কারো একদিন হবো কারো একরাত হবো এর বেশি কারো রুচি হবে না… আমার এই বাজে স্বভাব কোনদিন যাবে না…২ . গানের মাঝেই আশফি মাহির পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার মুহূর্তে মাহির কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায় সে কিছু একটা। গানটা শেওয়ার হওয়ার আগেই মাহি নিজেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বেরিয়ে এসে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল শুধু। রাতের প্রহরটা কাটতেই আবার একটা একটা শক পেলো মাহি। …………………………. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin ওইযে দেখতে পাচ্ছেন যে জায়গাটা, ঠিক এমন একটা জায়গাতেই এমনভাবে সাজিয়ে আশফি মাহিকে প্রপোজ করেছিল।
পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ