তুমি রবে ৩০

0
1935
তুমি রবে ৩০ . . কিছু মুহূর্ত আসে যা খুব ক্ষণিকের জন্য। আর সেই মুহূর্তগুলোই আজীবনের জন্য মনে দাগ কেটে যায়। মনে হয় যদি বারবার ফিরে পাওয়া যেত সেই ক্ষণিকের বিশেষ মুহূর্তটুকু! গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিশান হাসতে হাসতে ঘরে আসলো। ব্যালকনিতে তার ভাইটা। দু’হাতের ওপর মাথা রেখে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়েছে। ওষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার সুখ অনুভূতি হওয়া এক প্রফুল্ল হাসি। পাশে এসে বসে ঠাট্টার ভঙ্গিতে ভাইকে বলল, – “আমার তো মনে হচ্ছে মরণকামড়। খুবই দ্রুতই অসুখে পড়বে।” আশফি ভাইয়ের মজা ধরতে পেরে সোজা হয়ে বসে কপট রেগে বলল, – “কী বলছো তুমি দিশান?” – “কোথায়? কিছু না তো।” মুখটা নিরীহ ভাব করে বলল সে। আশফি চুপ করে চেয়ে রইল শুধু ভাইয়ের দিকে। দিশান ফিক করে আবার হেসে উঠল। এবার আশফি কপালে সুক্ষ্ম বিরক্তির রেখা ফেলে বলল, – “উফ্! যাও তো তুমি। একা বেশ ছিলাম।” – “সে তো আমিও বুঝছি। এর জন্যই তো বললাম বুকের কামড়টা প্রেম কামড় নয় মরণকামড়। কামড় খেয়ে যেভাবে ঠান্ডার মাঝে ব্যালকনিতে বসে কামড়ের স্মৃতিচারণ করছো!” – “দিশান!” আশফি লাফিয়ে উঠতেই দিশানও দ্রুত উঠে রুমের ভেতর চলে এলো। আশফি তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, – “প্রচন্ড বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তুই দিশান। আমি তোর বড় হই।” দিশান হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বলল, – “আমি সত্যি এখানে নির্দোষ ভাই। তোমার টি শার্ট খোলার সময় আমার নজর ওখানে যায়। ইচ্ছা করে কিন্তু দেখিনি।” – “দারুণ ব্যাপার।” দিশানকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে আশফি ঘর থেকে বের করে দিলো। বুকের দিকটাতে একবার তাকিয়ে আয়নার সামনে এসে গায়ের টি শার্টটা খুলে ফেলল। কামড়ের দাগগুলো সত্যিই খুব গভীর। এক্কেবারে দাঁতের চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে। . .
– “কী করছেন ব্যথা পাচ্ছি তো।” বুকের ওপর থেকে মুখটা তুলে আশফির টি শার্টের গলার কাছে চেপে ধরে মাহি বলল, – “খুন করে ফেলা উচিত আপনাকে। মানুষ এত জঘন্য হতে পারে!” হাতটা বাড়িয়ে আশফি রুমের লাইট জ্বেলে দিলো। গালদুটো ভিজে একাকার হয়ে আছে মেয়েটার। ভেজা গালে চুলগুলো লেপ্টে আছে। ঘামে শরীরটাও প্যাচপ্যাচ করছে তার। তবে এর মাঝে চোখে লাগার মতো হলো মাহির শাঁড়ির আঁচলটা তার বুকের ওপর নেই। গলার চারপাশে ঘাম তখনো গড়িয়ে পড়ছে। মাহির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আঁচলের ওপর থেকে সরে দাঁড়িয়ে খানিকটা দূরে সরে এলো আশফি। আঁচলটার দিকে চোখ পড়তেই নিচ থেকে আঁচল উঠিয়ে দ্রুম গায়ে জড়িয়ে নিলো মাহি। হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে মাহির সামনে ধরল। কয়েক সেকেন্ড মাহি ক্রুর চোখে আশফির দিকে চেয়ে থেকে গ্লাসটা নিয়ে আশফির গায়ে পানি ছুঁড়ে মারল। – “আমি কী করলাম? অদ্ভুত!” – “আবার প্রশ্ন করছেন?” – “অবশ্যই। এটা কেন করলেন আপনি?” – “তার আগে আপনি কৈফিয়ত দিন, কী কারণে এরকম হয়রানি করলেন আমাকে।” মাহির হাতটা ধরে টেনে নিয়ে বিছানার ওপর বসিয়ে তাকে বলল, – “আগে এক গ্লাস পানি খাবেন। তারপর কথা বলব আমরা।” আশফি আবার এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে মাহিকে দিলো। পানি খাওয়া শেষে মাহি দেখল আশফি গায়ের গেঞ্জিটা খুলছে। ধমকের সুরে সে আশফিকে আদেশ করল, – “একদম খুলবেন না।” বিস্ময় চোখে চেয়ে ছিল আশফি। তারপর তার মনে পড়ল দেড় বছর আগের সময়গুলো। খুব হাসি পেলো আশফির। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসিটা চেপে রাখা তার জন্য ফরজ। আশফি হাত দুটো তুলে বলল, – “খুলছি না।” সোফার হাতলের ওপর বসে মাহিকে বলতে শুরু করল, – “আপনাকে ভয় দেখানো আমার পূর্ব পরিকল্পিত কোনো পরিকল্পনার ছিল না।” – “মিথ্যা বলার চেষ্টাও করবেন না। আপনি জানেন আর একটু হলে আমি সেন্স হারাতাম!” – “না হারাতেন না। সেন্স গেলে তো বেঁচেই যেতেন। আমি সত্যি বলছি, আমি আপনাকে ভয় দেখানোর কোনো পরিকল্পনা করতে চাইনি। আমার পরিকল্পনা তো ছিল অন্য কিছু। আমি যখন আমার এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজাটা খুলি তখন দেখলাম আপনি চোখ কান বন্ধ করে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। আমি ভাবিনি যে আপনি টেরও পাবেন না আমার ভেতরে আসাটা। আমি হেঁটে এসে আপনার পেছনে দাঁড়ালাম, তখনো আপনি টের পেলেন না। কত বেশি ত্রাসপূর্ণ ছিলেন আপনি সেটা দেখেই অবাক হলাম আমি। আর পরিকল্পনাটা তখনই পরিবর্তন করলাম। ফোনটা আপনার পাশ থেকে তুলে অফ করে নিজের পকেটে পুরে রাখলাম। রিমোটটা নিয়ে টিভি অফ করে দিলাম। তারপরই তো শুরু হলো হরর সিন।” মাহি একটু চিন্তিত মুখ করে রইল। তারপর ফোঁস করে উঠে শাঁড়ির আঁচলটা হাতে নিয়ে বলল, – “এটা টেনে ধরেছিল কে? আঁচলটা টেনে ধরার জন্যই তো আমি বেশি ভয় পেয়েছি। এত সুন্দর করে আপনি মিথ্যা বলতে পারেন? কী ভেবেছেন আমি আপনাকে মাফ করব?” – “মোটেও আমি আপনার শাড়ির আঁচল টেনে ধরিনি। এই অভিযোগ আমি কখনোই মানব না। একবার ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে আসুন আমার অতো সুন্দর ফ্লাওয়ারপটটা কীভাবে ভেঙেছেন?” মাহি অবাকের সুরে বলল, – “আমি কখন ভাঙলাম?” – “শাঁড়ির আঁচলটা ফুলের স্টিকেই আঁটকেছিল। আর আপনি আঁচল টান দিতেই ওটা নিচে পড়ে ভেঙে যায়।” মাহি নিমিষে প্রশ্ন ছুড়ল, – “আর সেকেন্ড টাইম? তখনো কি আপনার ফ্লাওয়ারপটে আঁটকেছিল?” – “ডাইনিং এর চেয়ারের নকশার সঙ্গে আঁটকেছিলেন বোধহয়। চেয়ার নড়ার শব্দ শুনে তাই তো মনে হলো।” মাহি একটু মনে করতে চেষ্টা করল তখন কিছু নড়ে ওঠার শব্দ পেয়েছিল সে। কিন্তু অতিরিক্ত ভয়ে সে চেয়ারের শব্দকেও অন্য কিছু ভেবেছিল। . ঘটনাগুলো মনে পড়তেই রীতিমতো এখনো আশফির হাসি পাচ্ছে। তখন সে মাহির আতঙ্কিত মুখটা দেখে বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিল। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হেসে টি শার্টটা গায়ে ঢুকিয়ে এসে শুয়ে পড়ল। বারবার হাতটা নিজের বুকের ওপর নিয়ে জায়গাটাতে তাকিয়ে দেখছে কামড়ের দাগগুলো। এমন সময় দরজায় নক পড়লে আশফি হাসিটা থামিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, – “এবার বিরক্ত করলে খারাপই হবে তোমার সঙ্গে।” দিশান ওপাশ থেকে উত্তর দিলো, – “একটা বিশেষ অ্যাডভাইজ ছিল।” – “আমাকে অ্যাডভাইজ!” কথাটা আশফি আস্তে করে বলে বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, – “দাঁড়া তোর হচ্ছে।” দরজাটা খুলে দিশানকে ধরতে গেলে দিশান এক হাত পিছিয়ে এসে বলল, – “আমার কথাটা আগে তোমার শোনা উচিত ভাই।” আশফি দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলল, – “বল।” – “এবার প্রপোজটা করা উচিত।” মুহূর্তেই আশফির চেহারার রংটা বদলে গেল। বুকের ওপর দু’হাত মুড়ে দাঁড়াল এবার সে। একটু চিন্তা করার ভঙ্গীতে বলল, – “ভাবছি।” – “এবার সত্যিই ভাবনা থেকে বেরিয়ে কাজটা করা উচিত।” – “করব।” – “মানে তুমি কি আরও সময় চাইছো?” – “উঁহু।” – “তো কীসের জন্য দেরি করছো?” – “সময়ের জন্য।” – “কলেজের প্রেমীকদের মতো আচরণটা একদম করো না প্লিজ। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, অথচ মুখ ফুটে বলতেই পারে না। আমার প্রচন্ড অসহ্য লাগে এসব প্রেম।” – “শাট আপ। আমি একদমই ওই টাইপ চিন্তা নিয়ে বসে নেই। আমি ওকে যেনতেনভাবে প্রপোজ করব না। আর তাছাড়া বর্তমান আমার প্রতি ওর এক্সপ্রেশনগুলো কেমন তা দেখো না?” – “আজকের পর সেগুলো থাকবে না।” হেসে বলল দিশান। – “থাকলেও তোয়াক্কা করব না।” . . সময় মানুষকে কত কিছু শেখায়, কত কিছু বোঝায়, নতুন করে বাঁচতে শেখায়। আর মানুষকেও পাল্টে দেয়। আজ এতগুলো বছরেও একটাবার মায়ের কাছে ফোন করেনি ছেলেটা। ফোন করে একটাবার জিজ্ঞেস করেনি ‘মা কেমন আছ?’ এত পর হয়ে গেল কী করে ছেলেটা? হোস্টেল গিয়ে যে ছেলে দিনের অর্ধেক সময় মায়ের সাথে, বোনের সাথে, দাদুর সাথে কথা বলে পার করেছে, আজ সেই ছেলে বছরের পর বছর কত দূরের দেশে থাকছে। কোনো যোগাযোগও করেনি। একা একা কোথাও ঘুরতে পর্যন্ত যেতে চাইতো না ছেলেটা। বলতো, – “তোমাদের ছাড়া আমার কোথাও থাকতে ভালো লাগে না।” এখন সে শিখে গেছে তাদেরকে ছেড়ে একা থাকতে। অবশ্য একা কোথায়? বউ আছে, পরীর মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে। ওরাই তো এখন তার পরিবার। ছেলেটা সত্যিই কত পাল্টে গেছে। প্রায় দিনই মুমু এসব কথা ভেবে নীরবে চোখ ভাসায়। মমিন ঘরে এসে দেখল সে কপালে হাত দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে শুয়ে আছে। আজকের দিনটা তারও খুব ভালোভাবেই মনে আছে। তাদের প্রথম সন্তানের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল এ দিনে। কত ভালোবাসা, কত স্নেহের ছিল বাচ্চাটা। যত বড় হলো তত বেশি আদর সোহাগ বাড়তে থাকল তার প্রতি। পরিবারের সকলের কলিজা ছিল সে। আর তার কলিজা ছিল তার ছোট বোনটা। হায়! আজ সেই কলিজাটা কোথায়? একটাবার কি তার কলিজাটার কথাও তার মনে পড়ে না? মুমুর পাশে বসে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে মমিন বলল, – “তোমায় মেয়ে এসেছে। শরীরে জ্বর নাকি। একটু দেখে আসবে?” মুমু উঠে বসে বলল, – “কাল তো সুস্থই ছিল। জ্বর এলো কী করে?” কথাটা বলেই দ্রুত বিছানা থেকে নেমে মাহির ঘরে গেল মুমু। হাত মুখ ধুয়ে মাত্র বসেছে সে বিছানায়। মাকে দেখতে পেয়ে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের ওপর মাথা রাখল মাহি। – “কীভাবে জ্বর বাঁধালি বল তো? গা তো দেখছি ভালোই গরম।” মাহি নিশ্চুপ থেকে মাকে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে রইল। মুমুর নজর গেল বিছানার ওপর রাখা একটা প্যাকেটের ওপর। প্যাকেটটার র্যাপিং দেখে মুমুর বুঝতে বেশি সময় লাগল না। মেয়ের চুলগুলোর মাঝে একটু বিলি কেটে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, – “কেমন আছে সে?” মাহি জবাব দিলো না। মুমু আবার প্রশ্ন করল, – “হঠাৎ এত বছর পর বোনকে মনে পড়ল কেন? কোনো পাত্র দেখেছে না কি?” মাহি মুমুর কোমর ছেড়ে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে প্যাকেটের ভেতরের জিনিসটা বের করে মায়ের হাতে দিলো। ভেতরের শব্দহীন চাপা কান্নাটা এবার শব্দপূর্ণ হয়ে বেরিয়ে এলো মুমুর। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে তার ছেলেটা। আর তার নাতনির চেহারা যে অবিকল তার ফুপির শৈশবের প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলায় মাহি এত বেশি ফর্সা ছিল যে সবাই বলতো তার মেয়েটা দেখতে একদম বিদেশিদের মতো। বড় হওয়ার পর তার আদল, গায়ের রং পরিবর্তন হয়েছে। কিন্ত ছোটতে একদম সে এমন দেখতে ছিল। অনেকক্ষণ ছবির ফ্রেমটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল মুমু। মাহি বলল, – “চট্টগ্রাম যাওয়ার পর প্রতিদিনই ভাইয়ার সঙ্গে কথা হতো। এখানে আসার পর আর ফোন দিতে পারেনি। আমিই বারণ করেছিলাম। কাল হঠাৎ রাতে ফোন আসে। ফয়সাল ভাইয়ার হাত দিয়ে এটা পাঠিয়েছে।” মুমু কিছুই বলল না তার বিষয়ে। ছবিটা বিছানাতে রেখে শুধু বলল, – “ছবিটা আড়ালে রেখো। কোনোভাবে দাদুর চোখে পড়লে….বুঝতেই তো পারছো।” মুমু চলে যেতে গেলে মাহি পেছন থেকে তাকে ডেকে বলল, – “মা! জানো তোমার ছেলেটা দারুণ অভিনয় শিখেছে।” মুমু কিছুই বলল না। বেরিয়ে গেল রুম থেকে। দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় এসে ছবিটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল মাহি। ভাইটা যে তার ভালো নেই। সেটা যেমন সে বুঝেছে, তেমন মুমুও বুঝে গেছে। . জ্বর এসে প্রায় তিন দিন মাহি বিছানা ছাড়তে পারেনি। সেদিন রাতের ভয় আর রাতভর ভাইয়ের চিন্তায় কান্না, দুই মিলিয়ে শরীরে জ্বর বয়ে নিয়ে এসেছে সে। এর মাঝে সোমের বাড়ি থেকে সোমের মা আর চাচা এসেছিল। এসে মাহিকে দেখে যায় আর কিছু জরুরি কথাও সেড়ে যায় মাহির বাবা আর দাদুর সাথে। সোম ব্যবসায়ের কাজে এখন ঢাকার বাইরে। মাহির বিপদ আর তারপর তার অসুস্থতার খবর শুনে দিনের মাঝে অগণিতবার সে কল করে মাহির খোঁজ নেয়। জ্বর ছাড়তে মাহি আর একদিনও দেরি না করে অফিসে ছুটে। অ্যামেরিকা থেকে জরুরি খবর আসার পর আশফি হঠাৎ সেখানে চলে যায়। কবে ফিরবে এ নিয়ে সে কিছুই বলে যায়নি। খুব বিষণ্ন মন নিয়ে মাহি সপ্তাহ একটা পার করে। এরপর একদিন হঠাৎ মাহির কেবিনে দিয়া এসে উপস্থিত হলো। মাহি চমকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, – “তুই এখানে হঠাৎ? ঠিক আছিস তো?” দিয়ার মুখের ভাব দেখে মাহির প্রচন্ড চিন্তা হলো। কেমন মলিন মুখটা তার। যেন কতদিন ঘুমায় না সে, ঠিকমতো খেতেও পারে না হয়তো। – “এই তুই কি অসুস্থ? তোকে এমন লাগছে কেন?” দিয়া থম মেরে বসে আছে। মাহি উঠে এসে দিয়ার পাশের চেয়ারে বসলো। – “কী হয়েছে দোস্ত বল না? আর আমাকে ফোন দিলেই তো আমি তোর বাসায় চলে আসি। এত কষ্ট করে অফিসে আসার কী দরকার ছিল?” দিয়া মুখটা নিচু করে উত্তর দিলো, – “দরকার ছিল।” – “কী দরকার?” দিয়া উৎকণ্ঠা হয়ে বলল, – “মা আমাকে স্যরি বলেছে মাহি! আমাকে নিয়ে সে খুব গর্ববোধ করে।” মাহি অবাকের শীর্ষে। বিস্ময় ভরা চাহনিতে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল, – “আন্টি বলেছে এই কথা?” দিয়া উত্তরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল। – “কিন্তু কীভাবে? আর হঠাৎ কেন?” – “তার উত্তর জানতেই তো এসেছি।” – “আমি কী করে জানব?” – “তুই জানবি কেন? ও জানে?” – “ও টা কে?” – “আমি তোকে অনেক কিছু বলব মাহি। তুই অবশ্যই শুনবি বুঝেছিস?” – “হ্যাঁ সে তো শুনবই। তুই তাড়াতাড়ি বল তো।” . পাঁচ মিনিট হলো মাহি হেসে চলেছে। কিন্তু তাতে দিয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্য সময় হলে সে এতক্ষণে মাহির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। মাহি হাসতে হাসতে বলল, – “দোস্ত প্লিজ একটু ইজি হ।” দিয়া রোবটের মতো মুখ করে বসে আছে। সে বলল, – “আমি ইজিই আছি।” – “না তুই ইজি নেই। তুই প্রচন্ড সিরিয়াস।” মাহির হাসি থামছে না। দিয়ার দৃষ্টি মাহির পেছনের দেয়াল ঘড়িটার দিকে। এগারোটা বাজার শব্দ হতেই দিয়া লাফিয়ে উঠে বলল, – “আমি আসছি।” মাহি হাতের বৃদ্ধা আঙুল উঁচু করে বেস্ট অফ লাক জানাল। এরপর আবার তার হাসি। . দরজায় নক পড়তে দিশান বলে উঠল, – “এক ঘন্টা পরে আসুন।” ওপাশের ব্যক্তিটি দিশানের কণ্ঠস্বর শুনে কেমন আঁৎকে উঠল। তারপরও সে দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলো। দিশান তাকে দেখে বলল, – “আজ তো কোনো ভাইবা ছিল না। তাহলে?” এমন আচরণের মুখোমুখি হবে এটা সে ভাবেইনি। তবুও আজ সে সমস্ত অপমান সহ্য করবে। আর তারপর তার জবাব সে নিয়েই যাবে। – “বসব?” – “হ্যাঁ বসুন। আমার কিন্তু মনে পড়ছে না কোনো ভাইবা নেওয়ার কথা ছিল কিনা আজ।” – “না ছিল না। আমি আপনার কোম্পানিতে চাকরির জন্য আসিনি।” – “এক মিনিট।” দিশান পিওনকে ডেকে দুটো কফি আনতে বলল। – “আমি কফি খেতে আসিনি।” – “আমি আপনাকে অফার করিনি তো। আমি নিজেই দুটো খাব।” কত সময় দিশানের এই রূপ আচরণ সে সহ্য করতে পারবে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সে বলল, – “আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার পরশি।” – “নামটা? না মানে পরশি তো অনেকই আছে।” – “দিয়া। এবার বলুন তো সেদিন রাতে আপনি আমার মায়ের সাথে কী কথা বলেছিলেন?” – “কোনদিন রাতে?” দিয়া চোখ মুখ শক্ত করে বলল, – “প্লিজ দিশান মাহবুব। আমি খুব সমস্যাতে আছি।” – “কী সমস্যা? সেখানে আমার কী করণীয়?” দিয়া চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে হাঁটা চলা করে হঠাৎ দিশানের কাছে এসে দাঁড়াল। বিস্ময় চোখে সে শুধু দিয়ার কার্যকলাপ দেখছে। – “দিশান মাহবুব আপনি কি একটু উঠে দাঁড়াবেন?” – “কেন?” দিয়া চোখ গরম করে তাকাতে দিশান দ্রুত উঠে দাঁড়াল। এরপর দিয়া বলল, – “বলেন না কী বলেছিলেন মা’কে?” – “আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।” – “উফ্!” – “কী হলো?” দিয়া কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, – “দিশান মাহবুব আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।” দিশান দ্রুত টিস্যুবক্স থেকে টিস্যুপেপাড় নিয়ে দিয়ার দিকে ধরল। টিস্যুটা নিয়ে সেটা হাতের ভেতর মুড়ে ঝুড়িতে ফেলল দিয়া। – “আপনি কিছু জিজ্ঞেস করছেন না কেন?” – “আচ্ছা কী জিজ্ঞেস করব বলুন।” প্রচন্ড চিন্তিত চেহারা দিশানের। – “আমার খিদে পায় না, ঘুম পায় না, রাগ হয় না। শুধু কান্না পায়। এই যে দেখুন এখনো কান্না পাচ্ছে।” – “আচ্ছা তাই?” – “কতবার লিফ্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি জানেন?” – “না।” – “বাসাটা ছেড়ে দিয়েছেন না কি আপনারা?” – “কই না তো।” – “তাহলে আসেন না কেন?” – “প্রয়োজন নেই তাই।” – “ও। কোনো প্রয়োজন পড়েনি এই দশদিনে?” – “আগামী দশদিনেও বোধহয় পড়বে না। কেন বলুন তো?” – “কিছু না।” এরপর আবার দিয়া চেঁচিয়ে একই কথা বলল, – “কিছু নাআআআ।” – “শুনতে পাচ্ছি তো। চিল্লাচ্ছেন কেন?” – “আমার মা আমাকে স্যরি বলেছে। সে যা করেছে আর সে যা ভাবে তা একদম ঠিক ছিল না। তা সে ফিল করতে পেরেছে।” – “ওহ তাই। দারুণ ব্যাপার।” দিয়া দিশানের মুখের দিকে চেয়ে আছে। এই যে সে হঠাৎ করে এভাবে তার অফিসে এসেছে তা নিয়ে এই লোকটার বিন্দু মাত্র আনন্দ নেই। একটু আগ্রহও নেই তার সঙ্গে কথা বলার। ব্যাপারটা বুঝতেই দিয়ার আবার কান্না পেলো। এদিকে কফিও চলে এসেছে। দিয়া এক কাপ কফি হাতে নিয়ে দিশানকে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, – “নিন কফি খান। আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল। তবে আপনি ইচ্ছা করলে বলতে পারতেন, আমার মা’কে আপনি কী বলেছিলেন। কিন্তু বললেন না। ঠিক আছে, কফি খান।” দিশান কফিতে এক চুমুক দিয়ে বলল, – “আপনি চাইলে এক কাপ খেয়ে যেতে পারেন।” দিয়া আহত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকাল। কিছু না বলে চেয়ার থেকে ব্যাগটা উঠিয়ে দরজার কাছে চলে গেল। কিন্তু মনে হলো কিছুতে বেঁধে গেছে সে। দরজার হাতলে তার ব্যাগটা আঁটকে গেছে। সেটা ছাড়িয়ে বের হতেই আচমকা এক হ্যাঁচকা টানে তাকে ভেতরে নিয়ে আসা হলো। এক হাত দিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিশান অন্য হাত দিয়ে দিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁটে চওড়া হাসি। দিশান মৃদু কণ্ঠে বলল, – “কাঁদুনিবুড়িকে এক কাপ কফি না খাইয়ে যেতে দিই কী করে?” দিয়া নাকিকান্না কেঁদে বলল, – “আমি কফি খাব না দিশান মাহবুব। চলে…” কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে দিশান তার ঠোঁটদুটোর ওপর আঙুল চেপে ধরল। ওই ঠোঁটদুটোর দিকে চেয়ে সে বলল, – “কফি না খাইয়ে ছাড়ব না তো।” – “খাব না। দশটা দিনে একটাবারের জন্যও কেন আসেননি?” – “আজকের দিনটার জন্য।” দিশানের চোখদুটোর দিকে তাকাতেই তার চোখের ভাষা বুঝে নিলো দিয়া। প্রচন্ড লজ্জা পেলো সে। দিশান স্মিত হাসলো। এবারের ঝক্কিটা দিয়া সামলাতে না পেরে বেসালাম হয়ে দরজার সঙ্গে একদম মিশে গেল। . . – “হ্যাঁ খবরটা পেয়েই তো ছুটে এলাম। না না, আমি এখনো গাড়িতে। বাসায় ফিরছি।” ফোনের অপর পাশের ব্যক্তির প্রশ্নে আশফি জবাব দিলো, – “আসলে পুরো ক্রেডিটটা আমার অফিসের এমপ্লয়িদের। তাই ভাবছি এবার তাদের জন্যই কিছু করব। আচ্ছা তো দেখা করে অনেক কথা বলব। রাখছি।” ফোনটা কেটে আশফি দিশানকে লম্বা একটা টেক্সট করল। উত্তরে দিশানও অনেক বড় একটা রিপ্লাই করল। ফোনটা পকেটে রেখে আশফি মৃদু হাস্যে বলল, – “অনেক কিছুই বদলে যাবে সেই দিনটাতে।” …………………………… (চলবে) – Israt Jahan Sobrin সামনের ঝক্কিটা শুধু আশফি মাহির জন্য নয়। আপনাদের জন্যও।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে