তুমি এলে তাই পর্ব-২৪

0
2715

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৪
.
স্পন্দন গুঞ্জনের দুই বাহু এতোই শক্ত করে ধরেছে যে গুঞ্জন এবার ব্যাথা পাচ্ছে। গুঞ্জন একটু নিচু গলায় বলল,

— ” মিস্টার চৌধুরী আমার লাগছে।”

গুঞ্জনের কথা শুনে স্পন্দনের হুস ফিরলো। ও সাথে সাথেই গুঞ্জনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

— ” আ’ম.. আ’ম সরি। আমি হার্ট করতে চাইনি তোমাকে। আসলে..”

গুঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

— ” ইটস ওকে। একচুয়ালি আই এম সরি। আমার ওভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।”

স্পন্দন কিছু বললনা গিয়ে বসে পরলো খরের ওপর। গুঞ্জনও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে গিয়ে স্পন্দনের কাছে গিয়ে বসলো। স্পন্দন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। গুঞ্জন কিছুক্ষণ স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

— ” রাগ করেছো?”

স্পন্দন গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে একটা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,

— ” নাহ ঠিক আছে।”

গুঞ্জন কিছু বললনা। গুঞ্জনের কেনো জানিনা খুব খারাপ লাগছে। স্পন্দনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। স্পন্দনের প্রতিটা অনুভূতি বুঝতে পারে ও। স্পন্দনের ভালোবাসা নিয়ে ওর মনে কোনো সংশয় নেই কিন্তু যতো সংশয় দোটানা সব নিজেকে নিয়ে ওর। ও নিজেই অনুভূতিগুলো নিয়ে কনফিউসড। স্পন্দনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। আজ শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করছে। কেনো সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারছেনা। নিজের মনের মধ্যে উথালপাতাল হচ্ছে। নিজেকে মনকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেনা ও। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে। কিছু না ভেবেই স্পন্দনের হাতের বাহু জরিয়ে ধরল। স্পন্দন বেশ অবাক হয়ে তাকালো গুঞ্জনের দিকে। গুঞ্জনকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে গুঞ্জন স্পন্দনের কাধে মাথা রেখে বলল,

— ” আরেকটু সময় দাও আমাকে। আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছিনা। আই নো ইউ লাভ মি। আমিও ফিল করি। কিছুতো ফিল করি কিন্তু আমার আর কয়েকটা দিন সময় চাই সিউর হওয়ার জন্যে। প্লিজ।”

স্পন্দন গুঞ্জনের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

— ” আমি বুঝতে পারছি। একটু কেনো তোমার যতোটা ইচ্ছে সময় নাও। কিন্তু আমার থেকে নিজেকে দূরে সরানোর চিন্তা ভুলেও কোরোনা। খুব বেশি খারাপ হয়ে যাবে। এটা ভেবোনা যে তুমি আমাকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চাইবে আর আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। আমাকে যে যা দেয় তার সবকিছুই দশগুন করে ফেরত দেই আমি সেটা ভালোবাসা হোক বা কষ্ট।”

গুঞ্জন কিছু বললোনা ও এখোনো স্পন্দনের কাধে মাথা দিয়ে রেখে দিয়েছে। দুজনেই চুপ করে আছে। দুজনের দৃষ্টিও আগুনের দিকে। বেশ অনেকক্ষণ ওরা ওভাবেই বসে আছে। গুঞ্জন স্পন্দনের কাধ থেকে মাথা নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” বৃষ্টি থেমে গেছে।”

স্পন্দনও বাইরে তাকিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তো?”

গুঞ্জন কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছাওনির কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো কিছুক্ষণ বৃষ্টির পর আকাশটা বেশ পরিস্কার হয়ে গেছে। কনকনে শীতের ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারপাশ। গুঞ্জন একটা খামের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দেখছে। স্পন্দন এসে গুঞ্জনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” বাতাসটা খুব ভালো লাগছে তাইনা?”

গুঞ্জন নিজের হাত দুইবাহুতে ক্রস করে বলল,

— ” শীত করছে আমার খুব।”

স্পন্দন আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

— ” ফিল করতে ইচ্ছে করছে না এই প্রকৃতি, বাতাস, খোলা মাঠ, আকাশ।”

গুঞ্জন চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলল,

— ” হুমম দেখছি তো। সুন্দর।”

স্পন্দন এবার একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো গুঞ্জনের দিকে। তারপর কিছু গুঞ্জনের হাত ধরে বলল,

— ” চলো।”

গুঞ্জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই স্পন্দন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো গুঞ্জনকে। ওকে নিয়ে এক্কেবারে মাঠের মাঝখানে চলে গেলো স্পন্দন। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” এখানে আনলে কেনো?”

স্পন্দন গুঞ্জনের পেছনে দাঁড়িয়ে ওর বাহু ধরে নিজের বুকের সাথে ওর পিট লাগিয়ে ধরলো। গুঞ্জন একটু চমকে গেলেও কিছুই বলল না। স্পন্দন গুঞ্জনের দুই হাত ধরে ছড়িয়ে ধরে বলল,

— ” চোখ বন্ধ করে ফিল করো?”

গুঞ্জন স্পন্দনের কথা অনুযায়ী চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষণ পরেই গুঞ্জন ব্যাপারটা ইনজয় করতে শুরু করল। ঠান্ডা বাতাস আর শো শো শব্দ খুব বেশিই ভালোলাগছে ওর। এর আগে কক্ষনো এভাবে প্রক‍ৃতিকে ফিল করেনি ও। ও স্পন্দনের বুকের সাথে নিজের মাথা হেলাম দিলো। স্পন্দনও চোখ বন্ধ করে আছে। বেশ অনেকটা সময় পর স্পন্দন গুঞ্জনের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ” ভালো লাগলো তো?”

গুঞ্জন চোখ খুলে নিচু কন্ঠে কন্ঠে বলল,

— ” হুম।”

স্পন্দন গুঞ্জনকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

— ” থাকবে এখানে নাকি ছাউনির ভেতরে যাবো।”

গুঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ থেকে চারপাশটা দেখে বলল,

— ” থাকি আরেকটু ভালোই লাগছে।”

স্পন্দন ঠোঁট চেপে একটু হাসলো তারপর বলল,

— ” আচ্ছা।”

দুজনেই বেশ কিছু ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে আশেপাশটা দেখছে তবে কেউ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ হাটাহাটির পর ওরা ছাউনির নিচে চলে গেলো। গুঞ্জন স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঘুম পাচ্ছে খুব।”

স্পন্দন হেসে বলল,

— ” বাহবা তোমার আবার ঘুমও পায়? আর তাছাড়া একটু পর তো ভোর হয়েই যাবে।”

গুঞ্জন ভ্রু কুচকে তাকালো স্পন্দনের দিকে। স্পন্দন হেসে দিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা! আচ্ছা! ওয়েট।”

বলে স্পন্দন এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা খামের সাথে হেলান দিয়ে বলল,

— ” এখানে এসে বসো।”

গুঞ্জন ভ্রু কুচকে গিয়ে বসলো ওর পাশে। স্পন্দন নিজের কোলের দিকে ইশারা করে স্পন্দনে বলল,

— “এখানে শুয়ে পরো।”

গুঞ্জন কিছুক্ষণ স্পন্দনের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে থেকে অদ্ভুতভাবে কোনো প্রশ্ন না করেই স্পন্দনের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো। স্পন্দন গুঞ্জনের চুল আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে নেড়ে দিতে লাগলো। গুঞ্জনও কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে স্পন্দনের ডাকেই ঘুম ভাঙলো গুঞ্জনের। গুঞ্জন চোখ না খুলেই উঠে বসর।তারপর একটা হাই তুলে আস্তে আস্তে চোখ খুলে স্পন্দনের দিকে তাকাতেই স্পন্দন মুচকি হেসে বলল,

— ” গুড মর্নিং।”

গুঞ্জনও ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

— ” মর্নিং। আপনি ঘুমান নি রাতে?”

স্পন্দন গুঞ্জনের প্রশ্নের কোপো উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে গুঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ” চোখ মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

গুঞ্জনও কথা না বাড়িয়ে তাই করলো। গুঞ্জন চোখে মুখে পানি দিয়ে আসতেই স্পন্দন ওর নিজের রুমাল গুঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিলো। গুঞ্জন এবারেও কোনো প্রশ্ন না করে ওটা দিয়েই মুখ মুছে নিলো। স্পন্দন বলল,

— ” এবার তাহলে যাওয়া যাক?”

গুঞ্জন বলল,

— “কিন্তু গাড়ি?”

স্পন্দন ওর জ্যাকেট পরতে পরতে বলল,

— ” সকালে ড্রাইভারকে ফোন করে দিয়েছি এসে গেছে এতোক্ষণে।”

গুঞ্জন মাথা নেড়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো। তারপর দুজনেই বেড়িয়ে পরলো গাড়ির উদ্দেশ্যে। রোডে গিয়ে ড্রাইভারকে ওই গাড়িটা ঠিক করে নিয়ে চলে আসতে বলল। আর ওরা দুজন ড্রাইভার এর আনা গাড়িতে করে বেড়িয়ে গেলো। অনেকটা পথ যাওয়ার পর স্পন্দন গাড়ি থামিয়ে দিলো। গুঞ্জন আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

— “এখানে কেনো?”

স্পন্দন সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলল,

— ” চলো দেখতেই পাবে।”

গুঞ্জনও এবার কোনো কথা না বাড়িয়ে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। স্পন্দন একটু হেসে বলল,

— ” কী ব্যাপার? আজ আমার ঝাঁসির রাণী আমার সব কথা এমনি এমনি মেনে নিচ্ছে? ওয়াও?”

গুঞ্জন মুচকি হেসে বলল,

— ” জানিনা। আজ শুনতে ইচ্ছে করছে তাই।”

স্পন্দন আর কিছু না বলে স্পন্দনের হাত ধরে একটা রিস্টুরেন্টের ভেতরে নিয়ে গেলো। ওখানে গিয়ে স্পন্দন দুজনের জন্যেই খাবার ওর্ডার করলো। ব্রেকফাস্ট কম্প্লিট করার পর গুঞ্জন বলল,

— ” খাওয়া তো শেষ এবার যাওয়া যাক?”

স্পন্দন ট্যিসু পেপার দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলল,

— ” তোমার ব্যাগটা খোলো?”

গুঞ্জন একটু অবাক হলেও নিজের ব্যাগটা খুললো। ও প্যাকেটটা বের করে স্পন্দনের দিকে তাকাতেই স্পন্দন চোখের ইশারায় ওকে বলল ব্যাগের ভেতর দেখতেহ। গুঞ্জন ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা নীল জরজেটের একটা শাড়ি পেলো, আর তারসাথে নীল কাঁচের চুড়ি। শাড়িটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— “এসব কার জন্যে?”

স্পন্দন মুখে হাসি রেখে বলল,

— ” তোমার ব্যাগে যখন আছে নিশ্চয়ই তোমার জন্যে।”

গুঞ্জন একটু ইতস্তত করে বলল,

— ” কিন্তু আমিতো এসব..”

স্পন্দন গুঞ্জনকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল,

— “আমি জানি তুমি এসব পরোনা। আর যা পরো তা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি সেটাই পরবে যেটাতে তুমি কমফরটেবল ফিল করো। কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে আমার শাড়ি স্যালোয়াল সুট, চুড়ি এসব খুব ভালোলাগে। তাই আমার ইচ্ছে য‍েদিন তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানাতে আসবে সেদিন প্লিজ এটা পরে এসো। আমার ভালো লাগবে।”

গুঞ্জন কিছু না বলে মুচকি হেসে প্যাকেটটা আবার নিজের ব্যাগে ভরে নিলো। স্পন্দন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” চলো এবার।”

গুঞ্জন সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্পন্দন গুঞ্জনকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। গুঞ্জন ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে রাতে ফিরবেনা তাই কেউ আর কোনো প্রশ্ন করেনি। আর প্রশ্ন করলেও যে গুঞ্জন উত্তর দেবেনা সেটা খুব ভালো করেই জানে সবাই। আবির আর মেঘলার ও কোথায় ছিলো সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। ও ঠিক আছে সেটাই ওদের কাছে যথেষ্ট।

______________________

আরো কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। এরমধ্যে আবির আর তিতলির বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। মেঘলা মধ্যের সেই পরিবর্তনগুলো আরো গভীর রুপ নিচ্ছে। তবে এখন পরিবর্তন হয়েছে গুঞ্জনের মধ্যেও। ঐ দিনের পর থেকে অনেকবার ভেবেছে স্পন্দনকে নিয়ে। বারবার ভেবেছে। নিজের অনুভূতি নিয়ে সংশয় মেটাতে যতোভাবে ভাবা যায় ভেবেছে। স্পন্দন একয়েকদিনে ওকে অনেককিছু শিখিয়েছে। অনেক কিছু অনুভব করতে শিখিয়েছে, অনেক স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছে ওর মধ্যে। কিন্তু এখন আর গুঞ্জনের মধ্যে কোনোরকমের সন্দেহ নেই। স্পন্দনের কাছে থাকতে এতো ভালোলাগা, স্পন্দনের সব কথাই শুনতে ইচ্ছে করা, স্পন্দনের প্রতি ওর সব রকম অনুভূতির মানে বুঝে গেছে আজকে ও। হ্যাঁ ভালোবেসে ফেলেছে ও স্পন্দনকে। আর এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই ওর মনে। বেডে শুয়ে শুয়ে এসব ভেবেই মুচকি মুচকি হাসছে গুঞ্জন। কালকে বিকেলে স্পন্দনের সাথে দেখা করার আছে। ও ঠিক করে নিয়েছে কালকেই নিজের মনের কথা বলে দেবে। এসব ভেবে উঠে কাবার্ড থেকে সেই শাড়ির প্যাকেটটা বের করে নিলো। হঠাৎ মনে পরলো যে ও শাড়ি পরতে পারেনা। কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” আরে এতো ভাবছি কেনো? মেঘু দি আছে তো। মেঘুদি কেই বলবো পরিয়ে দিতে। আর মিস্টার চৌধুরীর কথাও বলবো আপিকে।”

এসব ভেবে প্যাকেটটা কাবার্ডে প্যাকেটটা রেখে গুঞ্জন মেঘলার রুমের দিকে গেলো। মনে মনে খুব খুশি ও। আজ অনেকবছর পর মন থেকে খুব খুশি ও। গুঞ্জন রুমের সামনে গিয়ে দরজার কাছে গিয়ে মেঘলাকে ডাকতে যাবে তখনি এমন কিছু শুনলো যে ও পুরো থমকে গেলো। পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলো।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে