#তালা_চাবি
#পর্ব (৪)
সিঁথি সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করার পরও বাবা ফিরে আসেনি। আরশাদও কাগজপত্র নিয়ে আসেনি। এদিকে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করার সময় নেই একদম। ট্রেন ধরতে হলে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। অস্থিরচিত্তে আরও একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে দরজার দিকে তাকাল সে। কেউ নেই; পদধ্বনির শব্দ নেই; মানব ছায়াও নেই। তবে কি বাবার ইচ্ছেই আরশাদের ইচ্ছে? তার চাওয়াই অধিক সম্মানিত? প্রশ্ন দুটি মস্তিষ্কে উদয় হতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠল! স্বপ্নভাঙনের ব্যথা শুরু হলো হৃদয়ে। আশাহত দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা হয়ে আসতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ এতটা স্বার্থপর হতে পারিস না, আরশাদ। আমার কাছে বিশ্বাসের অর্থ তুই; নির্ভরতা অর্থ তুই; ভরসা অর্থ তুই। ‘
সিঁথি স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে দেহের সকল অঙ্গভঙ্গি। নিজ উদ্যোগে অপেক্ষা শেষ করতে চাইল। ব্যাগপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুতগতিতে। স্বপ্নকে ভাঙতে দিবে না কিছুতেই। প্রয়োজনে নতুন অভিভাবকের বিরুদ্ধে লড়বে, অবাধ্য হবে, যুক্তি দাঁড় করাবে, অধ্যবসায়ের নমুনা তুলে ধরবে। নিজেদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেইটে পৌঁছাল হম্বিতম্বিতে। ভারী ব্যাগটা সেখানে রেখে আরশাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে দুই কদম এগুতেই ছায়াসমেত তার দেখা মিলল। মৃদু পদধ্বনি তুলতে তুলতে এদিকে আসছে। গম্ভীরমুখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়ায় চোখ পড়তেই কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিনিটের দূরত্ব সেকেন্ডে সমাপ্ত করে তার সামনে আসল। সাদা রঙের ফাইলটা তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” এটা ফেলে এসেছিলি। ”
ফাইলটিতে নজর পড়তে অশ্রুতে ভরা নয়নজোড়া চিকচিক করে ওঠল। আনন্দে ঝলমল করতে লাগল মুখখানা। নিঃস্বার্থভাবে সবসময় পাশে থাকা মানুষটাকে কিছুক্ষণ পূর্বে ভুল বুঝার জন্য খুব লজ্জা পেল, অনুতপ্ত হলো। গোপনে নিজেকে বকাবকি করে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকাল আরশাদের মুখমণ্ডলে। উচ্ছসিতচিত্তে জড়িয়ে ধরার জন্য হাতদুটো মেলে ধরবে তখনই শুনতে পেল,
” আমাকে মাফ করে দিস, সিঁথি। ”
এমন প্রার্থনায় ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হলো তার। সন্দেহি মনে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” তোকে মাফ করতে পারলাম না বলে। ”
উত্তরটা জানিয়ে রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল আরশাদ। হাতের ইশারায় একটা খালি রিকশা থামাল। সিঁথির ব্যাগ টেনে সেখানে তুলে দিয়ে বলল,
” ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস। ”
কথা দুটো বলেই সিঁথির থেকে দূরে চলতে শুরু করল।
_________
এক বছর পর,
ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়া ট্রেনটিতে চেপে বসে আছে সিঁথি। খোলা জানালা দিয়ে উড়ে আসা হাওয়ায় কানের পাশের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। শাড়ির আঁচল একটু ঢিলে হয়ে আসতে দ্রুত সামনে নিল। সেইফটিপিন ভালো করে এঁটে নিতে নিতে মৃদু হেসে বিড়বিড় করল, ‘ শাশুড়ী মায়ের অনুমতি না নিয়ে শাড়ি পরিনি শুধু, আত্মসাৎও করেছি। ফিরে এসে নিশ্চয় খুব রাগারাগি করেছে তাই না রে আরশাদ? ‘ উত্তরে মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠল। ব্যাগ থেকে মোবাইলটি বের করে দেখল বাবা কল করেছে। তার অনিচ্ছায় ট্রেনিংয়ে যাওয়ায় খুব রেগে গেলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। প্রথম দিকে মাকে দিয়ে খোঁজ-খবর নিলেও পরবর্তীতে নিজেও কল করতে শুরু করেন। শুরুতে দুই-তিনটে প্রশ্ন করে রেখে দিলেও মাস পেরুতেই রাগ ভুলে গেলেন। অভিমান দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়েকে আগের চেয়েও দ্বিগুন ভালোবাসা ও আদর দিতে শুরু করলেন।
” হ্যাঁ, বাবা বলো। ”
” ট্রেন ছেড়েছে? ”
” ছেড়েছে। ”
” ব্যাগপত্র ভালোমতো দেখে রাখিস। ঘুমিয়ে পড়িস না আবার। চুরি হয়ে যাবে কিন্তু! ”
বাবার উদ্বিগ্নমাখা যত্ন বুলিতে আবারও হাসল সিঁথি। আশ্বস্ত করে বলল,
” আচ্ছা, ঘুমাব না। ”
” খাবার নিয়ে উঠেছিস তো? বাইরের কিছু খাস না কিন্তু। শেষে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবি। ”
” আচ্ছা, খাব না। ”
বাবা আরও দুটো উপদেশ বাণী দিয়ে কল কেটে দিতে চাইলেন তখনই সিঁথি সুধাল,
” আরশাদ কি জানে আমি ফিরছি? ”
” আমি তো বলিনি, তোর মা বলেছে নাকি জানি না। দাঁড়া জিজ্ঞেস করি। ”
সিঁথি দ্রুত বলল,
” মাও বলেনি, বাবা। আমি সকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ”
বাবা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন,
” তুই তো বলতে বলিসনি তাই বলিনি। জানলে কি ও ঢাকা থাকত এখনও? তোকে আনতে ছুটে যেত। ”
” রাখছি, বাবা। ”
কলটা কেটে দিতেই চোখের কোলটা ভরে ওঠল তার। এই এক বছরে একবারের জন্যও আরশাদের সাথে কথা হয়নি সিঁথির। না কল করেছে, না মেসেজ করেছে। উল্টো সিঁথি কল দেওয়ায় নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। বাবা-মা না বললেও সে ঠিক বুঝেছে, তাদের কাছ থেকেও তার খোঁজ-খবর নেয়নি। মানুষটা হুট করে এতটা কঠিন হয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি।
_________
নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যেতেই ট্রেন থেকে নামল সিঁথি। বাবা আগে থেকেই তার অপেক্ষাতে ছিল। দূর হতে দেখা পেতেই নিকটে আসলেন দ্রুত কদমে। মেয়ের কাছ থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে অল্প বাক্যে ভালোবাসা প্রকাশ করলেন। রিকশা ডেকে বাড়ির পথে ছুটতে ছুটতে অসংখ্য প্রশ্নও করলেন। যার উত্তর দিতে দিতে উদাস হয়ে পড়ল সিঁথি। ফেলে যাওয়া পথঘাট, দালানকোঠা, হাওয়া, ধূলিকণায় গভীর দৃষ্টি রাখতে রাখতে কখন যে বাসায় পৌঁছে গেল বুঝতেই পারল না। ধ্যান ভাঙল বাবার ডাকে। তিনি ব্যাগ-পত্র নামিয়ে গেইটের কাছেও চলে গেছেন। মেয়েকে নামার জন্য চোখের ইশারা করতেই নামল। বাবার দিকে এককদম এগিয়ে আচমকা বলল,
” তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি। ”
” একটু পরে কেন? এখন কোথায় যাবি আবার? ”
সিঁথি ডানে তাকাল। আরশাদের বিল্ডিংটার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল,
” একজনের সাথে দেখা করে আসছি। ”
বলতে বলতে ডানদিকের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। কয়েক কদম খুব দ্রুত ফেললেও পরবর্তীতে ধীর হয়ে আসল। গেইটের নিকটে পৌঁছাতেই পরিচিত ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ এসে বাড়ি খেল নাকে। প্রথমে ফুলের নামটা মনে করার জন্য ব্যস্ত হলেও পরক্ষণে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উৎসুক হলো। অন্য সময় গেইট বন্ধ থাকে। বন্ধ দরজার কাছে একজন দারোয়ান বসা থাকে। আজ দারোয়ান নেই, গেইটও বন্ধ নেই। সিঁথি বিনা বাঁধায় ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাক হলো। বাড়ির সামনে খোলা জায়গাটা বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে একটি ছেলে। সাজানো সম্পূর্ণ হয়নি আবার সন্ধ্যার আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছিল না কিছু তাই পেছন ঘুরে থাকা ছেলেটি ও ফুলের সাজকে চিনতে পারছিল না। ভালো করে চেনার জন্য আরেকটু সামনে যেতে চাইল তখনই পেছন থেকে একজন বলে ওঠল,
” ক্যাডা আপনি? ”
সিঁথি চট করে পেছন ঘুরল। দারোয়ানের পোশাক পরা থাকা সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারল না। আরশাদরা হয়তো নতুন রেখেছে এনাকে এই ভাবনায় বলল,
” আমি সিঁথি। আরশাদের সাথে দেখা করতে এসেছি। আছেন উনি? ”
” আছেন, কিন্তু দেহা হইব না। স্যার মেলা ব্যস্ত। আমারে কইছে কেউ দেহা করতে আইলে যেন কইয়া দেই, পরে আসতে। ”
সিঁথি কপাল কুঁচকে ফেলল। মাত্র এক বছরে এত পরিবর্তন! খানিকটা কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল,
” কী নিয়ে ব্যস্ত বলতে পারবেন? ”
” বিয়া নিয়া। সামনের হপ্তায় তো স্যারের বিয়া। ”
চলবে