#তালা_চাবি
#রোকসানা_রাহমান
(পর্ব ১)
” বাপ-মা জিন্দা থাকতে লুকিয়ে বিয়ে করছি কেন বুঝতে পারছি না, সিঁথি। আমাকে যদি তোর এতই পছন্দ তাহলে আংকেল-আন্টিকে বললেই হয়। উনারা তো কয়েক বছর ধরেই চাচ্ছেন আমরা বিয়ে করি। ”
আরশাদ নিজের বক্তব্য শেষ করে সিঁথির দিকে তাকিয়ে নিভে এলো। মেয়েটার চোখ থেকে যেন গরম লাভা পড়ছে! এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লেই আরশাদ কয়লা হয়ে যাবে।
সিঁথি কটমটে বলল,
” সাইন কর। ”
আরশাদ কলম তুলে নিল। কাবিননামায় চোখ রেখে বিদ্রুপ করে বলল,
” দুই পরিবারের সম্মতি থাকা সত্ত্বেও এই ট্রিটখোররা সাক্ষী হচ্ছে। এরা তো আমার হতে যাওয়া সংসারটা হওয়ার আগেই বেচে দিবে! একেকটার মুখ দেখেছিস? দেখ একবার। খাওয়ার জন্য হাঁ করে আছে। ”
সিঁথি বন্ধুদের দিকে তাকাল না। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আরশাদের উপর। সিঁথির দিক থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো আরশাদ। অসহায় দৃষ্টি রেখে বলল,
” একটা কল করি? কাউকে আসতে বলব না। শুধু জানিয়ে দেই আমরা বিয়ে করছি। নাহলে খুব কষ্ট পাবে। তুই তো জানিস, আংকেল-আন্টি আমাকে কতটা বিশ্বাস করেন। ”
সিঁথির ভাবভঙ্গি সামান্যতমও বদলাল না। মায়া, দরদ, মমতা নামক অনুভূতিগুলি তার রক্ত থেকে হারিয়ে গেছে যেন। সে পুনরায় একই কথা বলল,
” সাইন কর। ”
একরকম বাধ্য হয়েই সাইন করল আরশাদ।
বিয়ে সম্পন্ন হলে আরশাদের বাড়িতে গিয়ে উঠল সিঁথি। পেছন থেকে স্বামীর ঘ্যানঘ্যানে একটুও পাত্তা দিল না। আরশাদের রুমে ঢুকে দরজা আটকাল। তালা ঝুলিয়ে চাবি রাখল নিজের জিম্মায়। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিচে ফেলে বলল,
” আমি এখন ঘুমাব। ”
আরশাদ দূর থেকে অবাক হয়ে দেখল সিঁথি বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সেই দৃষ্টি ঘুরে গেল দরজার দিকে। তালাতে চোখ স্থির হতে সর্বশরীরে শিরশির অনুভূত হলো। নিজেকে সামলে উঠার চেষ্টা করতে গিয়েও ফসকে গেল। করুণ কণ্ঠে সুধাল,
” আমরা কি এক রুমে শোব? সারারাত? ”
সিঁথি রয়ে-সয়ে জবাব দিল,
” হ্যাঁ, কিন্তু এক বিছানায় না। ”
আরশাদ কিছু একটা বলার জন্য ছুটে এলে সিঁথি সাবধান করল,
” কাছে আসবি না। যা বলার দূর থেকে বল। ”
আরশাদ একহাত দূরে থমকে বলল,
” বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? ”
” একদমই না। তুই যে ভুল করেছিস তার উপযুক্ত শাস্তি এটাই। ”
সিঁথি টানটান হয়ে চোখ বন্ধ করল। সেসময় আরশাদের সামনে তার ভুলটা স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল মনের আয়নায়। কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা। বিকেলবেলা। প্রকৃতিতে বৈশাখের ঝড়ের গন্ধ। গাছপালা হেলেদুলে যাচ্ছে। নীল আকাশ ঘনকালো মেঘের দখলে। বাতাসে শোঁশোঁ শব্দ। যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবী ভিজিয়ে দিতে পারে। এমন অবস্থায় সিঁথি কল করে জানাল, সে ঝালমুড়ি খাবে। আরশাদ যেন রিক্সা নিয়ে মোড়ে অপেক্ষা করে। সে বের হচ্ছে। আরশাদ মানা করার পরও সিঁথি মানল না। নিজেই রিক্সা ডেকে আরশাদের বাড়ির গেইটে হানা দিল। দুজনের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় এমন ঘটনা রোজই ঘটে। দারোয়ান মানিয়ে নিয়েছে। আশেপাশের প্রতিবেশিরা সহ্য করে ফেলেছে। এ দুটো যুবক-যুবতীকে তারা চাইলেও খারাপ নজরে দেখতে পারে না। কটু কথা বলতে পারে না। যেন এদের মেলামেশা বেশ স্বাভাবিক!
ঝালমুড়িওয়ালা মুড়ি মাখতে মাখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়। আরশাদ ছুটে রিকশায় উঠলেও সিঁথি উঠে না। সে বৃষ্টিতে ভিজে ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে তবেই রিকশায় উঠল। তার কিছুক্ষণ পরই অঘটনটা ঘটে গেল। প্রকৃতির ইশারায় হোক অথবা সয়তানের প্ররোচনায়, কোনো একটার প্রবল প্রভাবে পড়ে জোর করে চুমু খেয়ে বসল সিঁথির ঠোঁটে। সেই চুমুর ঘোর কাটার পর যারপরনাই বিস্মিত হলো আরশাদ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টের পেল কত বড় ভুল করে ফেলেছে। বেস্টফ্রেন্ডের দেয়াল ভেঙে নিষিদ্ধ স্পর্শ করেছে। এ অন্যায় কি মাফ পাওয়ার যোগ্য? কখনই না। ‘
আরশাদ আর সিঁথির সম্পর্ক প্রায় পনেরো বছরের। সময়ের সাথে সাথে তাদের শারীরিক ও মানসিক যত পরিবর্তন হয়েছে বন্ধুত্বের সম্পর্কও তত গভীর হয়েছে। কিশোর বয়স পেরিয়ে উঠার পরও এদের ঘনিষ্ঠতা দেখে সকলে ধরেই নিয়েছে এরা একে-অপরকে ভালোবাসে। পাড়াপ্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধবসহ দুজনের বাবা-মায়ের ধারণাও একই। বন্ধুরা তো সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে! সে খোঁচার তীব্র প্রতিবাদ করে দুজন একই স্বরে বলে, ‘ আমরা শুধু বন্ধু। ‘ এই তীব্র প্রতিবাদ কিনা এক মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল!
সেই মুহূর্তের পর সিঁথি পাহাড়ের মতো স্থির, নিশ্চল হয়ে পড়ে। পুরো রাস্তায় একটা কথাও বলেনি। একবারের জন্য আরশাদের দিকে তাকায়নি। আরশাদও বাক্যহারা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। বাক্য ফিরে পেল সিঁথি রিকশা থেকে নেমে নিজের বাসার দিকে হাঁটা ধরলে। পেছন থেকে চিৎকার করে ডেকেও থামাতে পারল না। বাসার ভেতর ঢুকতে গিয়ে দেখে গেইট বন্ধ। বারংবার ধাক্কালে দারোয়ান উঁকি মেরে জানায়, ম্যাডাম গেইট খুলতে নিষেধ করেছে। এই নিষেধ মানতে পারল না সে । হাত ফেলে পা দিয়ে লাথি মারতে থাকে। চিৎকার করে সিঁথিকে ডাকতে থাকে। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মোবাইল বের করে কল দেয়। সিঁথি ধরে না। আরশাদ গেইটের ছাউনি ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিঁথির বেলকনির উদ্দেশ্যে ক্ষমার প্রার্থনা করে চেঁচিয়ে। প্রবল বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ভিজতে মাঝ রাস্তায় কান ধরে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সিঁথি নিচে আসে। গেইটের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আংকেল-আন্টি কবে আসবেন? ”
আরশাদ কান ধরা অবস্থায় সিঁথির সামনে এসে দাঁড়ায়। দ্রুত জবাব দিল,
” কাল। ”
সিঁথি হাত পেতে বলল,
” চাবি দে। ”
আরশাদ চাবি দেওয়ার বদলে নিজের দোষ থেকে মুক্তি পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাফ চাওয়ার জন্য আরেকটু এগিয়ে আসলে সিঁথি বলল,
” আমি চাবি চেয়েছি। ”
আরশাদ পকেট থেকে চাবি বের করে দিল। সিঁথি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বন্ধুর বাড়ির ভেতরে ঢুকল। আরশাদের মায়ের রুমের বালিশের নিচ থেকে আলমারির চাবি নিয়ে ড্রয়ার খুলল। তাঁর বিয়ের শাড়ি আর গয়না বের করে বলল,
” সবাইকে কল করে আসতে বল। ”
আরশাদ বুঝতে না পেরে বলল,
” সবাই বলতে কাকে? ”
” তোর বন্ধুদেরকে। এখনই। ”
আরশাদ তখনও বুঝতে পারেনি সিঁথি সবাইকে নিয়ে কাজী অফিসে যাবে। বন্ধুরা সাইনবোর্ড দেখেই হৈহৈ করে যখন টিটকারি মারতে শুরু করেছিল তখন সন্দেহ হয়েছিল। সেই সন্দেহ কাটল কাবিননামায় সাইন করার পর।
—————-
ঘণ্টাখানিক নিচে শুয়ে থাকার পর উঠে বসল আরশাদ। নরমসুরে ডাকল,
” সিঁথি? ঘুমিয়েছিস? ”
” হ্যাঁ। ”
ঘুমিয়ে থেকে কেউ কথা বলে না। সিঁথি বলেছে। তার মানে সে সজাগ। আরশাদ বসা অবস্থায় একটুখানি এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। শান্ত স্বরে বলল,
” এটা কিন্তু শাস্তি নয় সুযোগ। আমি কিছু করতে চাইলে তুই কিন্তু…”
আরশাদের কথার মাঝেই ঘাড় ফেরাল সিঁথি। সরাসরি চোখে চেয়ে বলল,
” একবার সুযোগ নিয়ে মন ভরেনি? আবার নিবি? নে, বার বার নে। ”
সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর এমন ক্রুদ্ধ বদন ও কণ্ঠে খানিকটা মিইয়ে গেল। ফিরে গেল পূর্বের স্থানে। বালিশে মাথা রেখে চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করে চোখ মেলে তাকাল তার দিকে। শান্তভাবে পড়ে থাকা দেহটা একটু অশান্ত হচ্ছে। শাড়িতে অনভ্যস্ত হওয়ায় ঘুমাতে পারছে না। অস্বস্থিতে এপাশ-ওপাশ করছে। সে হালকা স্বরে বলল,
” বিয়ে হয়ে গেছে। এখন শাড়ি-গয়না খুলে ফেললেই পারিস। ”
সিঁথি কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেও উঠে বসল। আরশাদের কক্ষে কোনো মেয়েলি কাপড় নেই। কাপড়ের খোঁজ করতে হলে এই কক্ষ থেকে বের হতে হবে। সে লুকিয়ে রাখা চাবি নিয়ে তালা খুলল। আরশাদকে ভেতরে রেখে বাইরে দিয়ে সিটকানি তুলে দিতেই শুনল,
” আমাকে একা রেখে কোথায় যাচ্ছিস? ভয় করবে তো। সিঁথি? এই সিঁথি। ”
তার মিছে ভয়ের আচরণকে একটুও পাত্তা দিল না সিঁথি। গয়না ও বেনারশি ছেড়ে একটা সুতির শাড়ি পরে ফিরে এলো স্বামীর কক্ষে। আগের মতোই ভেতর থেকে তালা দিয়ে চাবি নিজের জিম্মায় রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আরশাদ তার আদ্যোপ্রান্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,
” তোর চাওয়াটা কী বলবি আমাকে? ”
” আমার কোনো চাওয়া নেই। ”
” তাহলে এমন তালা-চাবি নিয়ে খেলছিস কেন? ”
” খেলছি কোথায়? তোকে শাস্তি দিচ্ছি। ”
” আমার অপরাধ কী? ”
” বেস্টফ্রেন্ডকে চুমু খাওয়া। ”
আরশাদ শোয়া থেকে উঠে বসল ঝটিতে। সিঁথির শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি এমনি খেয়েছি? তুই তো খাওয়ার জন্য আমাকে প্রলোভন করলি। ”
” আমি প্রলোভন করেছি? ”
” তা নয় তো কী? ঝালমুড়ি খাচ্ছিস, ভালো কথা। বার বার ঠোঁট দেখিয়ে ‘ ঝাল লেগেছে ‘ বলবি কেন? ”
সিঁথি অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,
” ঝাল লাগলে বলব না? ”
” অবশ্যই বলবি। বার বার বলবি কেন? ঠোঁট দেখিয়ে বলবি কেন? ”
” ঠোঁটে ঝাল লাগলে দেখাব না? ”
” না, দেখাবি না। অমন বৃষ্টি ভেজা মাতাল হাওয়ায় এক রিকশায় বসে কোনো ছেলেকে ঝালে লাল হওয়া ঠোঁট দেখাবি না। ”
” কোনো ছেলেকে দেখাইনি। তোকে দেখিয়েছি। ”
আরশাদ ভ্রূ তুলে চোয়াল শক্ত করে বলল,
” আমি ছেলে না? ”
সিঁথি উত্তরে কী বলবে খুঁজে পেল না। তর্ক-বিতর্ক বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। চোখ বুঁজে নিতে আরশাদ অধৈর্য হয়ে বলল,
” কথা শেষ না করে একদম কেটে পড়বি না। আমার কথার উত্তর চাই। ”
সে কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ শুয়ে থাকল। আরশাদ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সিঁথির হাত ধরল। টেনে তুলে রাগ দেখানোর বদলে আতঙ্কিত হয়ে বলল,
” তোর শরীর এত গরম কেন? জ্বর হয়েছে নাকি? এই চাবি দে, ডাক্তার দেখাতে হবে তো! ”
সিঁথি চাবি দিল না। জ্বর নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই। আরশাদের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিশ্চুপে পড়ে থাকল। আরশাদ নিজ থেকেই চাবি খুঁজতে থাকল। সিঁথিকে এদিক-সেদিক নাড়িয়ে, বালিশ সরিয়ে, চাদর উল্টে বলল,
” চাবি কোথায় রেখেছিস? পাচ্ছি না তো। উফ! কী যন্ত্রণা। ”
চলবে