ডুমুরের ফুল
১.
ফরিদপুর একটি জেলা। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই জেলাতে পল্লী কবির জন্ম। বৃহত্তর ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর জন্ম। বিখ্যাত ফরায়েজী আন্দোলনের মূল নেতার জন্ম এখানেই। ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের একজনের জন্ম এই ফরিদপুরে! এমনকি বাংলাদেশের একমাত্র নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ফরিদপুরে অবস্থিত। সুতরাং ফরিদপুরকে সামান্য জেলা বলা ঠিক না।
ফরিদপুর এর বায়তুল আমান হচ্ছে এমন একটা জায়গা যার নাম পুরা ফরিদপুর জানে। কারণ এখানে সরকারি পলিটেকনিক কলেজ আর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স শাখা অবস্থিত। রাজেন্দ্র কলেজ অনার্স শাখা রোডের সব থেকে বয়স্ক মানে পুরাতন মডেলের বাড়ি টা মিসেস জয়নব বিবি এর।
পুরো এলাকা তার ভয়ে কাঁপে। একমাত্র তার নাত্মী ব্যতিক্রম।
ফজরের ওয়াক্ত থেকে মিসেস জয়নব বিবির বাসায় হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
ফজরের নামাজের জন্য তার একমাত্র নাত্মীকে ডাকতে ডাকতে তার নামাজের ওয়াক্ত যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়।
বিশাল এই বাড়ির দোতলার দক্ষিণের রুমটা হেমলতা। হেমলতা মিসেস জয়নব এর নাত্মীর নাম। হেমলতার রুমের ঠিক দুটো রুমের পর মিসেস জয়নব এর রুম।
দক্ষিণের এই রুম পুরোপুরিভাবে বিলেতি স্টাইলে সাজানো – মিসেস জয়নব এর ভাষ্যে।
হেমলতার ভাষ্যে দুনিয়ার যতো খ্যাত ফার্নিচার আছে সব তার এই রুমে এসে জুটেছে।
দিনে ২-৩ বার ঝগড়া হয় নানী নাত্মীর। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালবাসা অটুট।
নানীর কিছু হলে নাত্মী পাগলের মতো হয়ে যায়। আর নাত্মীর কিছু হলে পুরো ফরিদপুর জেনে যায় মিসেস জয়নব বিবির নাত্মীর কিছু হয়েছে!
এখন ৫.৩০ ফজরের আজান দিবে। শীতের সময়। গরমেই ডাকতে ডাকতে পুরো বায়তুল আমান জেনে যায়। আর এখন তো শীত।
মিসেস জয়নব ওজু করে হেমলতার বিছানার পাশে বসে আছেন। ঘুমন্ত নাত্মীকে দেখতে তার ভালোলাগে। কিছুক্ষণ নাত্মীকে দেখেন তারপর ডাকতে শুরু করেন।
ঘুমন্ত মুখখানায় সে তার মৃতা কন্যাকে দেখতে পান। তার একমাত্র মেয়ে হেমলতাকে ৫ বছরের রেখে মারা যান। মেয়েকে মনে পড়ে যখন কান্না আসে তখনি ঘুম থেকে ওঠার জন্য হেমলতাকে ডাকেন।
– হেমলতা, হেমলতা
প্রতিদিন হেমেলতার ঘুম ভাঙে তার নানী যখন পা রাখেন তার রুমে।
পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তারপর সে তার নানীকে রাগানোর জন্যই ঘুমের ভান ধরে।
– হু
– কী হু?এতো ঘুমায় কেউ?
– হু ঘুমায়!
– তাড়াতাড়ি ওঠ। নামাজের ওয়াক্ত যায়।
– নানী আজকে মাফ করো।
– এই বুবু আমি মাফ করার কে?
বুবু ডাক হেমলতার একদমই পছন্দ না। এই ডাক শুনেই সে ঘুম থেকে বিছানায় লাফিয়ে উঠে বসে। চোখ ডলতে ডলতে বলে
– নানী আমাকে বুবু বলবা না।
– আমি তো বলবোই। দেখি কে ঠেকায়?
খুব হাসতে হাসতে এই কথাটা বলে মিসেস জয়নব।
তারপর দুজনে নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হয়।
বায়তুল আমান এলাকাটা খুব সুন্দর। বিশেষ করে গাছ গুলো। বিশাল বড় বড় গাছ। রাস্তার দুপাশ দিয়ে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বলতে চাচ্ছে সবাইকে – দেখো আমি কতো সুন্দর। আমি চিরসবুজ!
শীতের সাদা কোয়াশা গায়ে জড়িয়ে থাকে তখন হেমলতার মনে হয় গাছ গুলো অনেক ঠাণ্ডায় চাদর পড়েছে।
দুজন ৩০ মিনিট হেঁটে বাসায় আসেন।
তারপর খোলা বারন্দার চেয়ারে বসে সকালের নাস্তা সারেন।
প্রতিদিনের মতোও আজকেও তারা হেঁটে নাস্তা করতে বসেছেন। তখনি হেমলতার বাবা হাজির।
হেমলতার বাবার নাম মনোজ চৌধুরী। নাম শুনলে মনে হয় হিন্দু। কিন্তু আসলে তিনি মুসলমান।
মনোজ কে দেখেই জয়নব বিবি বললেন
– আরে বাবা তুমি?
– কেন আম্মা আমি কি আসতে পারি না?
– আরে কী বলো বাবা তুমি আসবা না তো কে আসবে? বললাম যে এতো ঠাণ্ডার মধ্যে আসলে তোমার তো আবার নিউমোনিয়ার সমস্যা আছে।
– আম্মা হেমকে দেখার জন্য মন টা ছুটে গেলো তাই আসলাম।
চারটা চেয়ার সহ এই টেবিলে তিনটা চেয়ার আজকে পূর্ণ। একটা চেয়ার খালি।
মনোজ খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন।
তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন
– হেম মা তোমার পরীক্ষা কবে?
– বাবা এখনো ২ মাস বাকি।
– ওওহ আচ্ছা।
– বাবা তুমি আমাকে এই প্রশ্ন কতোবার করলে আজকে দিয়ে?
মনোজ একটু লজ্জা পেয়ে আবার হেসে বলল
– হেম বয়স হয়েছে তো তাই ভুলে যাই।
মেয়ে বাবার কথা শুনে হাসতে শুরু করেছে।
একমাত্র নাত্মীর হাসি দেখে নানীও হেসে ফেললো।
মিসেস জয়নব বললেন
– বাবা নাস্তা করো।
তারপর লায়লী বানু কে ডাকলেন
– লায়লী লায়লী, মনোজের জন্য নাস্তা আনো।
খাওয়া দাওয়ার সময় লায়লী বানু আশেপাশে থাকেন। এই বাড়িতে ৩ জন কাজের লোক। একজন ঠিকা কাজ করে। আরেকজন রান্নাবাড়ার জন্য কুটাকাটি করে সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে যান। আরেকজন মানে লায়লী বানু রান্নাবাড়া সহ বাড়ির সবকিছু দেখেন।
মিসেস জয়নব এর ডাক শুনে সে বললেন
– জে আনতাছি।
নাস্তা খাওয়া শেষ হওয়ার পর মনোজ তার মেয়েকে বললেন
– আজ তোর প্রাইভেট নাই?
– আছে তো বাবা।
– কখন?
– এই তো ৮ টায়।
– তাহলে চল মা আমার সাথে চল
– আচ্ছা বাবা তুমি ৫ মিনিট বসো। আমি আসছি।
মিসেস জয়নব বিবি এই সময় ঘুমান। ৮ টা থেকে ১০ পর্যন্ত ঘুমিয়ে তিনি অনেক শান্তি পান।
বায়তুল আমানে রিক্সা পাওয়া কষ্টের। অটো পাওয়া যায়। কিন্তু মনোজের সেটা ভালো লাগেনা।
প্রায় মনোজ সকাল সকাল শ্বশুর বাড়ি মেয়ের কাছে চলে আসেন।তারপর একসাথে রিক্সায় করে মেয়েকে প্রাইভেটে দিয়ে নিজের বাসায় যান।
এই সময়টুকু সে তার মেয়ের সাথে গল্প করেন।
রিক্সা আগে থেকেই রিসার্ভ করে রাখেন।
রিক্সায় বসে মেয়ের সাথে তিনি রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলেন।
মাঝেমাঝে মেয়ে হেসে ওঠে আর তখনি মনোজ সাহেবের প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
মনোজ সাহেব বললেন
– হেম মা তোকে না মনে হয় আমার সাথেই রাখি। কিন্তু….
আর বলতে পারলেন না। হেমলতা তখন বলল
– জানি বাবা ছোট মা। ওনার জন্য আমাকে তুমি তোমার কাছে রাখতে পারো না। আর তোমার তো আরো দুটো মেয়ে আছে তাই না?
মনোজ সাহেব মেয়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। হুট করে চলে আসা চোখের পানি মুছে নিলেন। তারপর বললেন
– মা রে আছে তো। কিন্তু তোর প্রতি ভালবাসাটা বেশি। সন্তান তার পিতার চোখে সমান কিন্তু কেন যেন তোকে একটু বেশি ভালবাসি।
হেমলতা তখন খুব গম্ভীর ভাবে বলল
– হা জানি তো। আমি তো মা মরা মেয়ে।
দুজনের মধ্যে আর কথা হয়না। গভীর শোক তাদের মাঝে হানা দেয়। বাবা- মেয়ে চুপ করে তারপরের রাস্তাটা পার করেন।
দুজনেই কান্নাটা চাপা রাখেন একে অপরের জন্য।
এই সুন্দর শীতের সকালে দুজন বুকের মাঝে চাপা কষ্ট নিয়ে দিনের কাজ করতে শুরু করেন।
চলবে…..!