#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৯ম পর্ব
~মিহি
-“কীরে প্রেমা কোথায়? তুই না বললি প্রেমা এখানে আছে।”
-“আরে ছিলই তো! কোথায় চলে গেল? ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আমি শুয়ে রেখে চলে গেছিলাম তোদের খুঁজতে। এখন ও এখানে নেই! অদ্ভুত তো!”
-“তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, সেখানে মাটি খোড়া হয়েছে। তার মানে এখানে কিছু একটা ছিল আর সেটা নিতেই প্রেমাকে পাঠানো হয়েছিল। প্রেমা কি দেখেছিল তোকে?”
-“নাহ! দেখার আগেই তো অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।”
-“কোনো একটা রহস্য অবশ্যই আছে। ঐদিকে একটা জায়গার নিচে সুড়ঙ্গের মতো কিছু একটা আছে। সেদিকে এগোতেই শুভ্রর জালে জড়িয়ে যাওয়া, এখানে প্রেমার আসা আবার হারিয়েও যাওয়া! কাছু একটা রহস্য আছেই। এসব কিছু ঐ লোকটা একা করতে পারবে? এখানে তো ঠিকঠাক সিগন্যালও পায় না। লোকটা কারো সাথে কন্ট্যাক্টও করতে পারছে না। একা একা এতকিছু কিভাবে করছে সে?”
-“কোথায় সুড়ঙ্গ দেখলি?”
-“চল দেখাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে সব রহস্য ওখানেই সামাধান হবে।”
রুদ্ধ, রেহান আর শুভ্র আবারো এগোয় সুড়ঙ্গের দিকে। এই জঙ্গলের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে সুড়ঙ্গে পৌঁছানো কঠিন। তার উপর সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চারদিকে সামান্য আলোর রেশ রয়েছে। সুড়ঙ্গ অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে যদি রাত হয়, তবে সেখানে গিয়ে আদৌ তারা কিছু করতে পারবে? একে তো কিছুই চেনে না সে জায়গার। তাছাড়া আগেরবার গিয়ে যে ফাঁদ দেখে এসেছে, দ্বিতীয়বার না জানি আরো বড় কোন ফাঁদ অপেক্ষা করছে! এতসব ভাবলে তো আর এগোনো যাবে না কিন্তু এগোতে তো হবেই।
____________________________________
প্রেমা মূর্তিটা দেওয়ার পরপরই রাজন প্রেমাকে আঘাত করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল কিন্তু তনয়ার জন্য তা সম্ভব হলো না। তনয়ার হাতের বাঁধন আলগা হওয়ায় সে তা খুলে ফেলেছিল আগেই। অপেক্ষায় ছিল শুধু প্রেমার আসার। প্রেমা আসামাত্র দুজন মিলে অতর্কিত ভাবে মারতে থাকে রাজনকে। রাজন নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকু পায় না। মারের চোটে বেহুশ হয়ে যায়। রাজন পড়ে যেতেই প্রেমা আর তনয়া দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। মূর্তিটা এখনো প্রেমার হাতে মুষ্টিবদ্ধ। রাজন প্রেমা আর তনয়াকে যে জায়গায় রেখেছিল তা ছিল মাটির নিচে। এ জায়গা যে অনেক আগে বানানো হয়েছে তাও স্পষ্ট বুঝলো প্রেমা। দৌড়ে বাইরে আসতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো সে। কিন্তু পড়লো না, কেউ একজন প্রেমার কাঁধে দুইহাত রেখে ধরলো তাকে। প্রেমা ভয়ে চিৎকার দিতে নিল। পরক্ষণেই মানুষটার হাত প্রেমার মুখ চেপে ধরলো। প্রেমা কামড় দিল হাতে।
-“উফ! রাক্ষসী একটা! এত জোরে কেউ কামড় দেয়?”
-“রুদ্ধর বাচ্চা! কই ছিলি তুই? ঠিক আছিস? তোর কিছু হয়নি তো?”
রুদ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রেমা। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি গড়াচ্ছে। রুদ্ধ মুচকি হাসছে। মেয়েটাও তবে তাকে ভালোবেসেই ফেললো? নাকি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে এত চিন্তা? শুধুমাত্র বন্ধুর জন্য এত আতঙ্কিত হয় কেউ? কই রেহান কিংবা শুভ্রকে তো জড়িয়ে ধরে কাঁদলো না প্রেমা। ওরাও তো বিপদে পড়েছিল। রুদ্ধর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রেমাও তাকে ভালোবাসে তবে সে ভালোবাসা অপ্রকাশিত রাখতে চায়।
-“রুদ্ধ! বলে ফেল কিন্তু। এখনো সুযোগ আছে।”
-“কী রে রুদ্ধ,বলবি না?”
রেহান আর শুভ্র সমানে রুদ্ধকে খোঁচাচ্ছে আর রুদ্ধ বেচারা তো কথাই বলতে পারছে না। পড়ে থাকা লোকটার ফোন নিয়ে বেশ অনেকটা সময় পার করে জঙ্গল থেকে বের হয় সকলে। রুদ্ধ প্রথমেই কল দেয় পুলিশকে। তারপর পাঁচজন রাস্তার এক ধারে বসে পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকে। রুদ্ধ সুযোগ খুঁজছে প্রেমাকে মনের কথাটা বলে দেওয়ার কিন্তু কিছুতেই সাহসে কুলাচ্ছে না। রুদ্ধর মাথায় আচমকা একটা মিউজিক ভিডিওর দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। অনেক পুরোনো একটা গান। কী যেন ছিল গানটা! ওহ হ্যাঁ, ‘সখীরে সখীরে।’ ছেলেটা তার বান্ধবীকে ভালোবাসত। বান্ধবী ছেলেটার মনের কথা জানার জন্য আরেকজনের সাথে প্রেমের নাটক করে। এটা দেখে ছেলেটা ঠিক করে মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যাবে। তারপর স্টেশনে এসে মেয়েটা ছেলেটাকে থাপ্পড় মেরে প্রপোজ করতে বলে। আচ্ছা, রুদ্ধ প্রেমাকে কিভাবে প্রপোজ করবে? যেন তেন ভাবে প্রপোজ করলে যদি প্রেমাও মেয়েটার মতো করে বলে, “বুদ্ধু! এভাবে কেউ প্রপোজ করে? ফিল্ম দেখিস না?” ধূর! কিছুই ভাবতে পারছে না রুদ্ধ। আপাদমস্তক তার ঢলছে, মাথার ভিতর সবকিছু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। প্রেমার পাশে বসতেও হাত-পা কাঁপছে। রুদ্ধর এসব কাণ্ড প্রেমা বাদে কারোরই চোখ এড়াচ্ছে না। শুভ্র তো কিছুক্ষণ পর পর বিরক্ত হয়ে রুদ্ধর গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।
রুদ্ধ নিজেও মনে মনে বিরক্ত। সে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, “রুদ্ধরে! তুই এত ভীতু কবে থেকে হলি! সামান্য তিনটা শব্দ!বলে দে প্রেমাকে। আচ্ছা, প্রেমার পায়ে কি হাইহিল? হাই হিল দিয়ে মারলে কেমন ব্যথা লাগে? প্রেমা কি জুতো খুলে মারবে নাকি হাত দিয়েই মারবে? ধুরো! কিসব ভাবতেছি! না মরেই ভূত হওয়ার মতো হাবিজাবি চিন্তা। মনে মনে কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিই…আচ্ছা, শুরুটা করবো কিভাবে? প্রেমা, আমি না তোকে খুব ভালোবাসি! এভাবে বলবো? কেমন যেন বেখাপ্পা লাগতেছে!” রুদ্ধর বিড়বিড় শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ চলে আসলো। রুদ্ধ মনে মনে কটমট করে উঠলো। বাংলাদেশের পুলিশ কবে থেকে এত ফাস্ট হলো? পরক্ষণেই খেয়াল হলো এরা লোক্যাল থানার পুলিশ।সম্ভবত ময়মনসিংহের আশেপাশের কোনো এলাকার। পুলিশ এসেই লোকটার খোঁজ করলেন। রুদ্ধ যেতে চাইলে শুভ্র তাকে আর প্রেমাকে সময় দিয়ে পুলিশকে নিয়ে চলে গেল। রেহান,তনয়াও গেল পিছু পিছু। রুদ্ধ দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। এটা তার পুরোনো অভ্যেস। যখনি ঘাবড়ে যায়, তখনি এই কাজটা করে। প্রেমা কেবলই তাকিয়ে তাকিয়ে রুদ্ধর কাণ্ডকীর্তি দেখছে। রুদ্ধ কি এখনো কিছু বলবে না? সে কি তবে ভালোবাসেনা প্রেমাকে? প্রেমা রুদ্ধকে ভালোবেসেছিল সেই দু’বছর আগেই কিন্তু হঠাৎ জানতে পারল রুদ্ধ অন্য কাউকে ভালোবাসে। সত্যতা যাচাইয়ের ব্যপারটা তখন তার মাথায় আসেনি। রুদ্ধর উপস্থিতিটাও তখন তার জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে কাউকে না জানিয়ে উড়াল দিল অচেনা রাজ্যে। এত বছর ফিরে দেশে ফিরে জানলো, দু’বছর রুদ্ধর থেকে দূরে থাকাটা কেবলই একটা বুল বোঝাবুঝির ফল। রুদ্ধটা এত বোকা কেন? এবারেও যদি সে ভালোবাসার কথা না জানায় তবে প্রেমা আর ফিরবে না, কখনোই না। প্রেমা নিজেকে কথা দিয়েছে। রুদ্ধ যদি সত্যি তাকে ভালোবেসে থাকে, অন্তত হারিয়ে ফেলার ভয়ে হলেও সব স্বীকার করত!
________________________________________________
প্রেমা বারবার রুদ্ধর দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখ ছলছল করছে। প্রেমার বাবা পুলিশের মাধ্যমে সব ঘটনা জেনে নিজের ইমার্জেন্সি প্লেনে করে দেশে এসেছেন। প্রেমাকে নিয়ে আজকের মধ্যেই তিনি ফিরবেন। ইতিমধ্যে টিকিটও কেটে ফেলেছেন। প্রেমা ভেবেছিল রুদ্ধ হয়তো এবার তাকে আটকাবে, নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকার করবে কিন্তু রুদ্ধ তো কিছু বললো না। হয়তো রুদ্ধ তাকে ভালোই বাসে না।
এদিকে রুদ্ধর ভেতরে যে কী চলছে তা শুধু সে-ই জানে। সকাল হতেই তার মনপাখি আবারো উড়াল দিবে তাকে ফেলে অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুদ্ধ। পুলিশ স্টেশন থেকে কল এসেছে। লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। সে কিছু বলতে চায়। রুদ্ধ বুঝে উঠতে পারে না পুলিশ বাদ দিয়ে তার সাথে লোকটার কি কথা? অবশ্য এত না ঘেঁটে সরাসরি গেলেই জানা যায়। যদিও রুদ্ধর মন-মেজাজ ঠিক নেই, তবুও দরকার ভেবে রুদ্ধ লোকটার সাথে দেখা করার জন্য মনঃস্থির করে তবে রুদ্ধ তখনো জানতো না লোকটার সাথে দেখা করাটাই তার জীবনকে একেবারে উলট-পালট করে দিতে চলেছে।
চলবে…