#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৮ম পর্ব
~মিহি
প্রেমার মাথা ঘুরছে। তার শরীরে ঠিক কতটুকু ড্রাগ ইনজেক্ট করা হয়েছে সে জানেনা কিন্তু ড্রাগের মাত্রাটা যে খুব কম নয় তাও স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারছে। প্রেমাকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছে। সময়ের মধ্যে কাজটা সমাধান করতে না পারলে তনয়াকে নিজের জীবন হারাতে হবে। প্রেমা কিছুতেই চায় না সেটা। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তার তনয়াকে বাঁচাতে হবে। প্রেমার কাজটাও যে খুব সহজ তা নয়। এই জঙ্গলের কোনো এক কোণে একটা সোনালি বর্ণের ছোটখাটো নারীমূর্তি লুকিয়ে রেখেছে রাজন। তাকে সেই মূর্তিটা খুঁজে বের করতে হবে। কিছু ক্লু তাকে দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু ড্রাগের ডোজে সে আপাতত মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো আচরণ করতে শুরু করেছে।
রাজনের খেলাটা বেশ মজা লাগছে। অবশ্য খেলাটা হুট করেই মাথায় আসলেও এর পেছনে তার একটা বিস্তর স্বার্থ আছে। পুলিশের কাছে ধরা দেওয়ার আগে রাজন একটা স্মাগলিংয়ের সাথে জড়িত ছিল। প্রায় ডজনখানেক প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি সে বিদেশে চড়া দামে পাচারও করেছে
শেষমুহূর্তে এসে এই মূর্তিটা সে এই জঙ্গলে লুকিয়েছিল যেন ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে। প্রেমাকে কাজে লাগিয়েই সে মূর্তিটা হাতাতে চায়। তারপর প্রেমা, তনয়া দুজনকেই মেরে ফেলবে। গুরুর লোকগুলোর মুখ থেকে এখনো পুরো সত্যিটা শোনেনি রাজন। শোনার কি দরকার আছে? গুরু কেন রাজনকেই বোকা বানাতে চেয়েছিল? সে নিজেও তো এই কিডন্যাপিংটা করতে পারত। গোলমালের গন্ধটা রাজন পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সে মত্ত তার বিকৃত খেলায় যা তাকে এইমুহূর্তে চরম তৃপ্তি দিচ্ছে।
রাজনের হাসিটা তনয়ার একদম পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তার বাড়িতে বলে এসেছে আগামী সাতদিনের জন্য তারা ঘুরতে যাবে। শুভ্রর কথা বিশ্বাস করেই হয়তো কেউ তাদের খুঁজতে আসছে না, এমনকি যোগাযোগের চেষ্টাও করছে না। এই ঘুরতে আসাটাই যে তনয়ার কাল হবে জানলে সে কখনোই আসতো না। এমনকি কাউকেই আসতে দিত না। রাজন এখনো হাসছে। লোকটার হাসির মাঝে এক ধরনের পাগলামি লক্ষ করেছে তনয়া। স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে হাসে, লোকটা সেভাবে হাসে না। লোকটার হাসি অনেকটা থ্রিলার মুভির ভিলেনগুলোর মতন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া। মনে একটাই প্রশ্ন, প্রেমা কি পারবে লোকটার দেওয়া কাজ শেষ করে ফিরতে?
______________________________
রুদ্ধ পড়ে আছে ঘাসের উপর। অনেকক্ষণ থেকে তার মুখে পানি ছিটাচ্ছে শুভ্র কিন্তু রুদ্ধ চোখ খুলছে না। শুভ্র তাও খুশি এই ভেবে যে অন্তত রুদ্ধকে সে খুঁজে পেয়েছে। রুদ্ধর পাশেই বসে আছে সে। আচমকা তার চোখ পড়ল রুদ্ধর ঘাড়ের দিকে, রুদ্ধর গাড়ে ইনজেকশনের দাগ। রুদ্ধকে কি ড্রাগ টাইপ কিছু দেওয়া হয়েছে? মুহূর্তেই আঁতকে ওঠে সে। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর তাদের সাথে কি কি হয়েছে সব মনে করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ চেষ্টা! একবিন্দুও কিছু মনে করতে পারে না। শুভ্রর নিজের উপর রাগ হচ্ছে। সব দোষ তার! এই এডভেঞ্চারে আসার কোনো মানেই ছিল না। ইচ্ছে করে বিপদ ডেকে এনেছে সে। বেটটা এক্সেপ্ট না করলেও পারত সে! সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ট্যুর গ্রুপে পরিচিত এবং বেশ এডভেঞ্চারাস হওয়ার সুবাদে অপরিচিত একটা মেয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল চিকন কালার বনে আসার জন্য। তখনো সে এটা নিয়ে এত সিরিয়াসলি ভাবেনি। কিন্তু যখন সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা হলো, তখনি তার মাথায় আসলো জায়গাটার কথা। এখন কেন যেন সবকিছু প্রি-প্ল্যানড মনে হচ্ছে শুভ্রর। হুট করেই প্রেমার দেশে ফেরার পরপরই এতকিছু ঘটে যাওয়া কোনোভাবেই কো-ইনসিডেন্সের মধ্যে পড়ে না। কেউ জেনে-বুঝে এসব কিছু প্ল্যান করেছে কিন্তু কেন? আর প্রেমার দেশে ফেরার সাথেই এই প্ল্যানের কী যোগসূত্র রয়েছে? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে শুভ্রর।
ধীরে ধীরে চোখ খুলছে রুদ্ধ। চোখ খুলতেই সামনে শুভ্রকে দেখে খুশাতে চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। ইচ্ছে করল এখনি শুভ্রকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু শক্তিটুকু পেল না শরীরে।
-“শুভ্র!”
-“তুই রিল্যাক্স হ। তোর শরীরে অনেক আঘাত লেগেছে। কোনোভাবে এখান থেকে বের হয়ে আগে ডাক্তার দেখাতে হবে।”
-“প্রেমা আর তনয়াকে ছাড়া আমরা কোনভাবেই ফিরতে পারবো না।”
-“তোর কি মনে হচ্ছে লোকটা ওদেরকেও এই জঙ্গলে রেখেছে?”
-“মনে হচ্ছে কারণ লোকটা একটা খেলা খেলতে চাইছে। নাসলে আমাদের এভাবে এখানে ফেলে রাখত না। অবশ্যই কিছু একটা চলছে লোকটার মাথায়।”
-“আমার মনে হচ্ছে সবকিছু প্রি-প্ল্যানড।”
শুভ্র বেটের কথাটা রুদ্ধকে বলল। রুদ্ধরও সন্দেহ হচ্ছে। নিশ্চিত কোনো একটা ঝামেলা আছে এসব কিছুর মাঝে। সবকিছু বোঝার আগে প্রেমা আর তনয়াকে খুঁজতে হবে।
-“রেহান কই?”
-“ঐ নড়তে পারছে না। একটা গাছের নিচে বসায়ে আসছি। ও ঠিকই আছে। চিন্তা করিস না।”
-“কোনদিকে যাওয়া যায় বল তো।”
-“আপাতত সোজাই চল।”
-“আচ্ছা চল।”
রুদ্ধ আর শুভ্র সামনের দিকে এগোতে থাকে।
প্রেমার হাসি পাচ্ছে। কোন ধরনের ড্রাগ তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে জানা নেই তার। একটু আগেই কান্না পাচ্ছিল, এখন হাসি পাচ্ছে। কখনো বা প্যানিক হচ্ছে! এসব সামলে মূর্তি খোঁজাটা কিভাবে সম্ভব তার পক্ষে? তবুও হাল ছাড়েনা প্রেমা। মনে করার চেষ্টা করে লোকটা কী কী বলেছিল কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক মনে করতে পারেনা শুধু মনে পড়ে মূর্তিটা একটা বড় গাছের নিচে পুঁতে রাখা আছে আর গাছটার উপর একটা ত্রিশূলের চিহ্ন এঁকে রেখেছিল সে। এতগুলো গাছের মধ্যে সে গাছ খুঁজতে যাওয়া অনর্থক। তার চেয়ে বড় কথা লোকটা কত বছর আগে চিহ্ন এঁকেছিল আল্লাহ মালুম! এতদিনে কি সেই চিহ্নের চিহ্নটুকু অবশিষ্ট আছে? একটু হাঁটতেই হাঁপিয়ে উঠছে প্রেমা কিন্তু চিহ্নটা তো তাকে খুঁজতে হবেই। প্রেমা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় থাকতে পারে গাছটা। নাহ! এভাবে হাঁটলে পাওয়া যাবে না। কিছু তো বিশেষত্ব আছে গাছটার, যার জন্য লোকটা ঐ গাছের নিচেই মূর্তিটা লুকিয়েছিল। আশেপাশের সব গাছই তো একরকম। একটু একটু করে জঙ্গলের গভীর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে প্রেমা। আচমকা খেয়াল করে একটা অবয়ব। অবয়বটার দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সে। লোকটা যে গাছে হেলান দিয়ে আছে, সে গাছটা একেবারে সবুজ-সজীব। অথচ বনের অন্য গাছগুলোর চামড়া অবধি শুকিয়ে এসেছে। নির্ঘাত কোনো একটা রহস্য আছে। প্রেমা ধীর পায়ে এগোচ্ছে। সামনে থাকা লোকটা তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আচমকা চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে আসে প্রেমার। সশব্দে পড়ে যায় শুকনো পাতার উপর।
পাতার মর্মর শব্দে আহত শরীর নিয়ে পিছনে তাকাতেই প্রেমাকে দেখতে পায় রেহান। প্রেমা তখন বেহুশ অবস্থায়। চিৎকার করে শুভ্রকে ডাকে ফে কিন্তু শুভ্র অবধি রেহানের গলার আওয়াজ পৌঁছায় না। রেহান ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছে না। শেষমেশ শরীরের উপর সর্বোচ্চ জোর দিয়ে উঠে প্রেমাকে গাছের নিচে শুয়ে দেয় সে। আলতো করে প্রেমার গালে থাপ্পড় দিয়ে তাকে ডাকতে শুরু করে কিন্তু প্রেমা চোখ খুলছে না। রেহান যে একা কিছু করতে পারবে না তা সে নিজেও জানে। তাই প্রেমাকে সাবধানে রেখে সে শুভ্রকে খোঁজা শুরু করে।
-“অনেকক্ষণ ধরেই তো হাঁটছি রে রুদ্ধ। সব কেমন যেন গোলকধাঁধায় মতো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এখন কী হবে?”
-“একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”
-“কী?”
-“এই জায়গায় পা রাখলে অদ্ভুত একটা শব্দ আছে যেন নিচে কোনো দরজা আছে।”
-“দেখি তো…হ্যাঁ তাই তো। এখন কী করবি?”
-“আগেই নিচে নামা যাবে। এটা কোনো ফাঁদ হতে পারে। আশপাশটা দেখে আসি চল।”
রুদ্ধর কথামতো শুভ্র যে-ই না সামনে এগোবে, অমনি একটা জাল এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রক্তাক্ত হাতে আরো ব্যথা পায় সে। রুদ্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমনটা আশা করেনি সে।
চলবে…