#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#২য় পর্ব
~মিহি
-“তুমি? আমি ভাবলাম তোমার জল্লাদ বাবা বোধহয় কল করেছে। তা বাসর ঘরে বসে হঠাৎ আমায় কল?”
-“একটা ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য রুদ্ধ। তাই কল দিলাম। আমার ফোন ফেলে ভুল করে বাবারটা নিয়ে এসেছি। তাই এটা থেকেই কল দিলাম।”
-“বেশ। ধন্যবাদ দেওয়া শেষ। এখন আদিলের কাছে যাও। নাহলে বেচারা আমাকে অভিশাপ দিবে এখন।”
অদৃতা হেসে কলটা কাটে। প্রেমা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুদ্ধ কথা শেষ করামাত্র সে আবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন চার নম্বর প্লেট চলে তার। রুদ্ধ হা হয়ে দেখছে।
-“আর কত খাবি, হাতি!”
-“চুপ কর শালা সজারু। আমাকে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিবিনা। তোর চেয়ে বিশ কেজি কম আমার ওজন।”
-“তুই যে এত খাস, মোটা হস না ক্যান? খাবারগুলা যায় কই? তোর বাবার লকারে?”
-“এহ তুই যা তো, যাহ! আমাকে শান্তিতে খেতে দে।”
-“আরে বের হবো তোকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”
-“কই যাবি? তাও এই মাঝরাতে?”
-“তনয়া, শুভ্র, রেহান সবাই অপেক্ষা করছে।”
-“কীহ! আমি এসেছি ওরা জেনেও গেছে? তোর পেটে একটা কথা থাকেনা? বললামই তো মাত্র সাতদিনের জন্য এসেছি। ওদের সাথে দেখা হলে তো একমাসেও দেশে ফিরতে পারবো না।”
-“লন্ডন তোর দেশ হলে, এইটা কি বিদেশ? ভাব কম খা! তুই আসছিস আর ওরা জানবে না? ভাবলি কেমনে? চল তাড়াতাড়ি নাহলে ওরা লাঠি নিয়ে আমার বাড়ি ভাঙতে আসবে।”
প্রেমা খাওয়া থামিয়ে উঠে হাত ধুয়ে নেয়, আনমনে হাসে। এখনো কত গভীর তাদের বন্ধুত্ব। যেন চোখ বন্ধ করলেই ভার্সিটি লাইফের স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখে।
_____________________________________________________________________________________
শুভ্র একমনে সুর তুলছে গিটারে। তনয়ার গান আর রেহানের অপ্রয়োজনীয় বাদশাহর বিট দেওয়া! এসব দেখে হাসতে হাসতে একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রেমা। আর রুদ্ধ এলো আটচল্লিশতম জুটির ব্রেকআপ করিয়ে দেওয়ার আনন্দে ট্রিট দিতে। প্রেমা রুদ্ধর কাজ দেখে মুখ কুঁচকায়।
-“দেখিস এত জুটির অভিশাপ লাগবে তোরে যে তোর জীবনেও বিয়ে হবে না।”
-“না হলো। তুই আছিস, তোরে দিয়ে কাপড় ধোয়ায়ে নিব, রান্না করে নিব। হাত-পা কি তুই টিপে দিবি নাকি তার জন্য লোক রাখা লাগবে?”
-“বান্দরের বংশধর! দূর হ এখান থেকে।”
-“তুই জলহস্তীর বংশধর।”
“এহ তোরা থামবি?” বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে রেহান। প্রেমা আর রুদ্ধ একে অপরকে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা দেখে বাকিরা হেসে ওঠে। শুভ্র গিটার বাজানো থামিয়ে বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ! খুব তো রাগ দেখানো হচ্ছে। দেখবোনি কয় ন্যানোসেকেন্ড টেকে এই রাগ! চোখের সামনে এক বাটি আইসক্রিম রাখলেই যার রাগ ফুঁস হবে, সে আবার ভেংচিও কাটে!”
“কী রে? ইহজগতে আছিস না পরজগতে? ভালোমতো বস বাইকে, পড়ে যাবি তো। তখন আবার তোর বিলেতি বাপ আমার নামে কেস করবে।” রুদ্ধর ডাকে ঘোর কাটলো প্রেমার। আগের দিনগুলোর স্মৃতি তার মানসপটে জ্বলজ্বল করছে। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। যখন তখন দেখা হতো, কথা হতো, মাঝরাত অবধি আড্ডা হতো।
রুদ্ধ বাইক চালাচ্ছে। পেছনে বসে আগের স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টায় মত্ত প্রেমা। রুদ্ধ একাধারে বকবক করে চলেছে। বহুদিন বাদে এমন করে রুদ্ধর পিছনে বসে অন্ধকার রাস্তা পার করছে প্রেমা। মনে মনে সে একবার প্রার্থনা করে, “এ পথ যেন কখনো শেষ না হয়!”
_________________________________________________________________________________________
শুভ্রর গিটারে সুর উঠছে। তনয়া গাইছে,”কফি হাউজের সেই আড্ডাটা…” রেহান চায়ের কাপে আড্ডা জমাতে ব্যস্ত। প্রেমার চোখ আনন্দে ছলছল করছে। রুদ্ধ আড়াল থেকে দেখছে প্রেমার হাসিমাখা মুখ। এই মেয়েটা চিরতরে তার বাঁধনে আবদ্ধ হতে পারতো কিন্তু হলো না। “আমরা শুধু বন্ধু” কথাটা খুব সুন্দর কিন্তু এই সম্পর্কে একপক্ষীয় ভালোবাসা থাকলে, অনুভূতিটা হয়ে ওঠে মারাত্মক যন্ত্রণার। রুদ্ধ প্রেমাকে চিনতো স্কুল লাইফ থেকেই। ভার্সিটি অবধি তারা শুধু বন্ধুই ছিল। অনুভূতির সূচনা হলো খুব আকস্মিকভাবে কিন্তু খুব ধীরগতিতে। এক ব্যস্ত সন্ধ্যায় নিয়নবাতির আলোয় প্রেমার হাসিটা আগুনের ন্যায় ঝলসে দিয়েছিল রুদ্ধর অন্তরটাকে। অতঃপর প্রেমার চোখের প্রতিটি পলক ফেলাও যেন গুণে গুণে রাখতো রুদ্ধ। তনয়া, শুভ্র, রেহান বিষয়টা বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছিল কিন্তু প্রেমা বোঝেনি। মেয়েরা নাকি চারহাত দূর থেকেও বুঝতে পারে কে তার সম্পর্কে কী ভাবছে। তাহলে দুহাতের নাগালে থেকেও কেন প্রেমা বুঝলো না রুদ্ধর অনুভূতিটুকু? এতটা অপ্রকাশিত ছিল তা? নাকি প্রেমা বুঝতেই চায়নি রুদ্ধকে?
-“রুদ্ধ? তুই কি এবারও সুযোগটা হারিয়ে ফেলবি?”
-“রেহান, আস্তে কথা বল। প্রেমা শুনে ফেলবে।”
-“ওহ আচ্ছা! তার মানে এবারও তুই ওকে কিছুই জানাবি না, ইভেন জানতে দিবিও না।”
-“আমি চাই না আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হোক। প্রেমার আমার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই রে।”
-“ফিলিংস নাই দেইখাই তো ছুটে আইছে তোমার বিয়ের কথা শুইনা। তোমার মিয়া আজাইরা ভয়! যাও, বলা লাগবে না তোমার। কয়দিন পর একটা এনআরআইরে বিয়া করবো, তখন তার বিয়েতে খাবার সার্ভ কইরো তুমি।”
রুদ্ধ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় রেহানের দিকে। অবশ্য রেহান ভুল কিছু বলেনি। বয়স তো থেমে নেই, প্রেমাও বিয়ে করবে একদিন। হয়তো ছেলেটা রুদ্ধ হবে না। আর সাতটাদিন, তারপরেই ওড়ে যাবে রুদ্ধর পাখিটা। ভাবতেই বুকের মধ্যে ক্ষরণ অনুভব করে রুদ্ধ।
-“এই এই রুদ্ধ, শোন তো। নেক্সট সাতদিনের জন্য দারুণ কিছু প্ল্যান কর তো। চল কোথাও থেকে ট্যুর দিয়ে আসি।”
-“তুই দেশেই আসছিস সাতদিনের জন্য। সাতদিনের মধ্যে একদিন গেছেই। এখন হঠাৎ কী প্ল্যানিং করবো আমি?”
-“সুন্দরবন যাই?”
-“তারপর একটা বাঘ এসে তোকে খেয়ে নিক।”
-“ধূর ছাতার মাথা! সবসময় আউল-ফাউল কথা না বললে তোর হয় না? দেখ, সাতটা দিনই তো আছি আমি, তারপর তো চলেই যাবো।”
প্রেমার কথাটা তীরের মতো এসে লাগে রুদ্ধর বুকে। সে কিছু বলে না, কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। শুভ্রর ভ্রমণ বিষয়গুলো নিয়ে অগাধ জ্ঞান। তার বেশ কয়েক দিন ধরেই এক জায়গায় যাওয়ার বেশ ইচ্ছে কিন্তু এখনো কাউকে বলেনি।
-“কীরে শুভ্র? কী এতো ভাবিস?”
-“কিছুনা রে। একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবছি। আজ সবাই বাসায় চল। এসব নিয়ে কাল সকালে দেখি।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
শুভ্রর কথার জবাব দিয়ে রুদ্ধর দিকে তাকালো প্রেমা। চোখের ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝে গেল রুদ্ধ। বিদায় অনুষ্ঠান শেষ করে প্রেমাকে নিয়ে আবারো ছুটে চললো। প্রেমা মেয়েটা পাগলাটে! এত কিছু খেলো, তাও এখন তার রাস্তার পাশের আইসক্রিম খেতে হবে। রাত তিনটায় কোন পাগল তার জন্য আইসক্রিমের স্টল নিয়ে বসে আছে আল্লাহ মালুম।
মিনিট বিশেক পর এক চৌরাস্তার মোড়ে একটা আইসক্রিমের স্টল দেখতে পেল প্রেমা। সাথে সাথে তার লাফালাফি শুরু। রুদ্ধ বাধ্য হয়ে বাইক থামিয়ে আইসক্রিম আনতে গেল। রুদ্ধর অবাক লাগে প্রেমা তাকে যেভাবে ট্রিট করে, সেভাবে কোনো বন্ধুদের মধ্যকার সম্পর্ক হয় না। অনেকটা প্রেমিকার মতোই বিহেভ করে প্রেমা রুদ্ধর কাছে আসলে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রুদ্ধ দুটো আইসক্রিম নিয়ে সামনে এগোলো। প্রেমা দৌড়ে এসে দুটো আইসক্রিমই রুদ্ধর হাত থেকে নিয়ে এক দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে। রুদ্ধ হালকা হেসে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছে।
রাতের নিস্তব্ধ রাস্তা। আচমকা হেডলাইটের আলো এসে চোখে বাঁধে রুদ্ধর। রাস্তার ঐ পাশ থেকে প্রেমার চিৎকার বুঝে ওঠার আগেই চোখ পড়ে বেসামালভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসা ট্রাকের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে রুদ্ধ। পা যেন জমে গিয়েছে তার। শেষবার প্রেমার দিকে তাকালে আবিষ্কার করে ছুটতে থাকা এক সুন্দরী রমনীর চিন্তিত, আশঙ্কায়িত মুখখানা।
চলবে…